বাংলাদেশকে ব্যর্থ প্রমাণের কালোচেষ্টা

মাসকাওয়াথ আহসানঃ ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ, বাংলাদেশের একটি আধাসামরিক বাহিনীকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া এক মানবতাবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিষয়টি বিডিআর বিদ্রোহ বলে মনে হলেও বিদ্রোহের কারণ এবং ফলাফলের মধ্যে অবিশ্বাস্য ফারাক তৃতীয় একটি পক্ষের সক্রিয়তাকে একেবারেই সামনে নিয়ে এসেছে।

একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সুশৃঙ্খল বাহিনীর মধ্যে নরহত্যার উৎসবে মেতে উঠবার যে হিংস্র মানসিকতা দেখা গেল তাতে অনুমান করা যায় তৃতীয় পক্ষটি কী সুকৌশলে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে ব্যবহার করেছে।

বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানদের পক্ষ থেকে তাদের ওপরে সেনাশাসনের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, পারিশ্রমিক ও মুনাফা বৈষম্য, অপারেশন ডাল-ভাত বা নির্বাচনী দায়িত্বের জন্য পাওয়া সরকারি অর্থ দুর্নীতি, পদোন্নতি, ছুটি, বিশ্রাম এসব দাপ্তরিক প্রক্রিয়ায় নিষ্পেষণ কিংবা বিডিআর জওয়ানদের প্রতি সেনা কর্মকর্তাদের ঔপনিবেশিক আচরণ- এসবই তদন্তের দাবি রাখতে পারতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যেভাবে একটি দুঃস্বপ্ন ঘেরা পরিস্থিতিকে মাতৃস্নেহে সামলালেন, তাতে ভাবতে অবাক লাগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে না জানিয়ে, আগামীমনস্ক একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে না জানিয়ে কেন এ রকম মধ্যযুগীয় বর্বরতার পথ বেছে নিতে হলো?

জানানো হয়নি কারণ এই সেনা হত্যা, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিডিআরের আক্রোশ বশত যতোটা তারচেয়েও বেশি একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সম্ভাবনাকে অংকুরেই বিনষ্ট করা। দেশকে বিশ্বমানচিত্রে অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা, আবারো।

আশার বিষয়, জাতি এখন ঐক্যবদ্ধ, উন্নয়নমুখী। বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া হাসিনা সরকারের এই এসিড টেস্টে বন্ধুর মতো সহযোগিতার এবং ঐক্যের হাত বাড়িয়েছেন। ফলে অতীতের মতো বিভাজন নীতি বা উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর অপসংস্কৃতি কোনো জায়গা করে নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাজেট সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বরাবর প্রতিবাদী প্রগতিশীল গোষ্ঠীও পিলখানা ট্র্যাজেডির বর্বরতায় স্তব্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোন দখলদার বাহিনী নয়, বহিঃশক্র নয় ফলে বিডিআর দরবার হলে নিরস্ত্র সেনা কর্মকর্তাদের উপরে গুলিবর্ষণ, হত্যার রিবংসায় মেতে ওঠা, মৃতদেহ নিয়ে পৈশাচিক কর্মকাণ্ড; সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রী সন্তান পরিজনদের নিরাপত্তাহীনতা, অপমান এবং শোকের অন্ধকার নিমজ্জিত করার যৌক্তিকতা সিজনড পর্যবেক্ষক কিংবা বিভিন্ন পন্থীদের পক্ষে খুজেঁ বের করা কঠিন।

দেশ যখন গণতন্ত্রের পথে দৃপ্ত যাত্রা অব্যাহত রেখেছে যখন বিভাজিত জাতির ঐক্যের পথ প্রশস্ত হচ্ছে, সংসদে সরকারি ও বিরোধীদলের বিভেদ ঘুচে গিয়ে উন্নয়নের একটি লেবেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড তৈরি হচ্ছে, কেন বাংলাদেশ তখন এতটা পিছিয়ে দেয়ার কালো চেষ্টা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানার এ মৃত্যু উপত্যকায় গিয়েছিলেন ঘটনার একদিন আগে। তিনি অক্ষত অবস্থায় ফিরে এলেও, পচিঁশ তারিখের হত্যাযজ্ঞ সুকৌশলে তার পরিণতিও এমন হতে পারতো এমনি এক দম্ভ মেলে ধরে ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষ থেকে। কারণ পিলখানা উচ্ছৃঙ্খলতায় সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও সন্নিহিত আবাসিক এলাকায় যে সিভিলিয়ান মৃত্যু ঘটেছে তাতে ঐ সহিংসতার নিষ্ঠুরতা ও দেশপ্রেমহীনতার প্রমাণ স্পষ্ট।

সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন তাদের অনেকেই জঙ্গী বিরোধী তৎপরতায় পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতার পরিচয় রেখেছেন। ওয়ান ইলেভেন পরিবর্তন, মধ্যবর্তী দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, নির্বাচন কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা সহযোগিতা দিয়েছেন এদের বেশির ভাগই সেনা শাসন, জলপাই শাসন সামরিক শাসন এসব পশ্চাদপদ অপশাসনের অনিশ্চয়তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ওয়ান ইলেভেন দেশকে নৈরাজ্যের হাত থেকে রক্ষা করে নির্বাচনের ট্রেনে চড়িয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ এখন আবারো গণতন্ত্রে। ফখরুদ্দীন সরকারের পারফরমেন্স নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকবেই, মইন উ আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাগডেটেড পথে না গিয়ে, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে গেছে। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ওয়ান ইলেভেনের মৌল অঙ্গীকার পূরণের পরেও মধ্যবর্তী সেনা দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ ও তদন্ত হতে পারতো। কিন্তু পিলখানার ডেথ সার্টিফিকেট সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গের প্রাপ্য হতে পারে না। নতুন সরকারকে ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পরেই সুকৌশলে চাপে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা এই সেনা কর্মকর্তা নিধনযজ্ঞ।

দেশকে আরো অনিশ্চয়তার পথে যেতে না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং এই সাধারণ ক্ষমা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার সঙ্গে প্রতিতুলনার দাবি রাখে। বড়মাপের রাজনৈতিক নেতারা ঔদার্যের শব্দমালায় জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির চেষ্টা করেন। শেখ হাসিনার সে চেষ্টা সফল হয়েছে। কিন্তু পিলখানা ষড়যন্ত্রে জড়িতদের অনুপুঙ্খ তদন্ত ও বিচার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রয়োজন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সেটা ব্যাখ্যা করেছেন। একইভাবে যে বাস্তবতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা করেছিলেন। জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী রাজনৈতিক ধারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো দেশদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রমূলক আচরণের প্রমাণ জনসমক্ষে রেখে ফেলার পর, একাত্তরের ও দু হাজার নয়-এর বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র ও হত্যাযজ্ঞের বিচার এখন কেবল বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থেই।
পিলখানা ট্র্যাজেডি এবং একাত্তরের ট্রাজেডির ষড়যন্ত্রকারীদের খুজেঁ বের করা, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ।

একমাত্র সত্যের উদঘাটন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই পারে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে নিরাপদ রাখতে। কতিপয় স্বার্থপন্থীদের স্পেকুলেশনের ল্যাবিরিন্থে ঘুরপাক না খেয়ে বাংলাদেশপন্থী জনমানুষ সব সময় ঐক্য, শান্তি এবং মানবাধিকারের পক্ষে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য-এডিটর ডট নেট।