পরীমণির কারামুক্তিতে প্রায় একমাসের একটি হট ইস্যু ফ্লপ মেরে গেলেও এই কান্ডের নেপথ্য কুশীলব বিষয়ে আমার সংশয় এখনও কাটেনি। আমরা যারা তার পক্ষে সামাজিক মাধ্যমে দুচার লাইন লিখেছি তারা ঢালাওভাবে পুরুষতন্ত্রের উপর দায়িত্ব চাপিয়েই দায় সেরেছি। পুরুষতন্ত্রের স্বপক্ষে আমি কোনো সাফাই গাইছিনা শুধু প্রশ্ন করছি দায়টা কি শুধুই পুরুষতন্ত্রের ? পুরুষতন্ত্র ব্যাপারটি একটি বৃহৎ ফ্রেমের অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্র তথা সমাজ নিয়ন্ত্রক প্রায় সকল সংস্থাই এই তন্ত্রের সৃষ্টি সুতরাং দায়টি এই বৃহৎ ধারণার উপর চাপিয়ে দিলে আসল কুশীলবগণ এতে ভাল একটি ছত্রছায়া পেয়ে যায়। এর ফলে দায় থেকে এরাতো বেঁচেই যায় অধিকন্ত এই ছাতাকে ধারণ করে তারা নতুন নতুন নিপীড়নের ছক কষতে বা বাস্তবায়ন করতে সুবিধা পেয়ে যাবে। তাই আমাদিগকে স্পেসিফিক পয়েন্ট খুঁজতে হবে।পরীমণিকান্ডের প্রেক্ষাপট বিবেচনাকল্পে তার প্রতিপক্ষে দাঁড়ানো যে সমাজটিকে আমরা দেখি সেই সমাজের ব্যাপ্তি পরিসর এবং ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি তবু এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। বছর কয়েক আগের ঘটনা। একজন সরকার দলীয় তরুন সাংসদ টকশো ইত্যাদিতে তার সুন্দর বাচনভঙ্গি এবং প্রেজেন্টেসনের মাধ্যমে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। রাতারাতি তার ভক্ত ফ্যান ফলোয়ারের সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু তরুন এই সাংসদ জনপ্রিয়তার ভারটি খুব বেশিদিন বহন করতে পারেননি। গ্রামীণ প্রবাদ যেমন বলে-‘ডেকাগরু (ষাঁড়) বাঘ চিনেনা’ তেমনি এই তরুন তুর্কি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে সেই বাঘ চেনার বোধটি হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং এর ফল আমরা দেখেছি। সাংসদ থাকা অবস্থাতেই শারিরীক লাঞ্চনা থেকে শুরু করে পুলিশ রিমান্ড হাজতবাস করে একই ধারাবাহিকতায় সাংসদ পদ দলীয় সদস্যপদ হারিয়ে সেই উদীয়মান নেতা এখন রাজনৈতিক উপেনের পর্যায়ে। ভাগ্যিস তিনি নারী ছিলেননা হলে আমরা আরেকটি পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের প্লট তৈরি করে আসল কুশীলবকে সেই ছাতার নিচে ঢুকিয়ে ফেলতাম।

পরীমণির জামিন শুনানিতে হাইকোর্ট চমৎকার একটি মন্তব্য করেছেন-“পুলিশ চাইল (রিমান্ড) আর দিয়ে দিলেন এমনতো সভ্য সমাজে চলতে পারেনা।এ বিষয়ে হাইকোর্টের গাইডলাইন আছে কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেটগণ তা মানছেননা।“ হাইকোর্টের গাইডলাইন অমান্য করে দিনের পর দিন এই অসভ্যতা এবং বর্বরতা চলেই আসছে। সরকার আসছে সরকার যাচ্ছে কিন্তু আইনী ছায়ার এই পাশবিকতা বন্ধ হচ্ছেনা।পাকিস্তান আমলে ইলামিত্রের উপর রিমান্ডের নামে ভয়াবহ পুলিশী নির্যাতনের কথা আমরা জানি দেশ স্বাধীন হয়ে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই পুলিশ সেই রিমান্ড সেই বর্বরতা আজও ভয়াবহ মাত্রায় অব্যাহত আছে। ইলামিত্রের অমানুষিক অভিজ্ঞতা ইতোপূর্বে লাভ করেছেন বিদিশা (যার অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে শিউরে উঠতে হয়) বিদ্বজ্জন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুন প্রমূখ। কারো কারো ক্ষেত্রে সেই অভিজ্ঞতা মৃত্যুর ভয়াল থাবা নিয়েও আসে। যেমন হতভাগ্য লেখক ও উদ্যোক্তা মুস্তাক আহমদ। একজন কার্টুনিষ্ট কিশোর বধির হয়ে গেছেন চিরতরে। কিন্তু কিছুতেই থামছেনা এই আইনী বর্বরতা। কোনো সরকারই চায়না এই অস্ত্রটিকে ভোঁতা করে দিতে কেননা এটিই বিরুদ্ধ মত আর পথকে দমিয়ে রাখার ভীতিকর একটি আইন স্বীকৃত হাতিয়ার।

পরীমণিকে নিয়ে পুলিশ ম্যজিষ্ট্র্যাটদের মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা সরকারের শীর্ষমহল অবগত নন এটি বিশ্বাস করা কঠিন বিশেষত শীর্ষ মহলের শীর্ষতম চেয়ারটিতে আসীন যখন ফোবর্স ম্যাগাজিনের চিহ্নিত বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর শত নারীর একজন, যাঁর ক্ষমতার নিরংকুশতা প্রশ্নাতীত,যাঁর নির্দেশ ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘড়ির কাঁটা অচল অন্যদিকে যিনি নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী অথচ তাঁরই অজ্ঞাতে অসম্মতিতে দিনের পর দিন আরেকজন নারী আইন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার যৌথ অংশ গ্রহণে লাঞ্চিত হচ্ছে এটা কী করে বিশ্বাস করা যায় ? প্রশ্ন উঠতে পারে তিনি কেন একজন অভিনেত্রীর প্রতি এমন বিরূপ মনোভাব পোষণ করবেন? সেই অভিনেত্রীতো রাজনীতি করেননা, নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছাও তিনি কোনোকালে ব্যক্ত করেননি, যিনি কোনোদিনও তাঁর প্রতিপক্ষ হবেননা বিষহীন ঢোঁড়া সাপের মতো সেই নারী অভিনেত্রীর উপর তিনি কেন রুষ্ট হবেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদিগকে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জীবনাচারে নজর দিতে হবে। তিনি একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিলেও সময় ও পরিস্থিতির কারণেই হোক তিনি তাঁর পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের সেই উদার আবহাওয়া থেকে এখন অনেক দূরে সরে পড়েছেন। এখন তিনি ঘোর রক্ষণশীল মানসিকতা সম্পন্ন। তাঁর মানসিকতার সেই কক্ষ পরিবর্তন তাঁর চার পাশের পারিষদবর্গ ধরতে পেরেই তারা শেখ হাসিনার ধর্মীয় জীবনাচার নিয়ে নানা রকমের মিথ তৈরিতে মনযোগী হয়ে পড়েছেন। তিনি কতক্ষণ কোরান তিলাওয়াত করেন কতক্ষণ জায়নামাযে কাটান কখন এশার নামায পড়ে ঘুমাতে যান আবার কখন ভোররাতে উঠে তাহাজ্জুদের  নামায পড়েন ইত্যাদির একটি ফর্দই তারা তৈরি করে ফেলেছেন। শুধু তাই নয় তার দোয়া ও নামাযের বরকতে বাংলাদেশ অনেক দুর্যোগ থেকে বেঁচে গেছে বা অনেক প্রাপ্তিও হয়েছে এমনও তারা মিডিয়ায় প্রচার করে থাকেন। এমনকি সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁকে তাঁর উপস্থিতিতে হযরত, রাদিয়াল্লাহু আনহা ইত্যাদি বলেও সম্বোধন করা হয়েছে এবং তিনি তা নিয়েছেনও। এগুলি হয়তো অনেকটা ফান করে বা অনেকটা অতিভক্তির কারণেও হয়ে থাকতে পারে কিন্তু যে কারণেই হোক এইসব মিথ শেখ হাসিনার জীবনকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করে।একজন আদর্শ মুসলিম সাধ্বী হিসেবে যাঁর একটি ভাবমূর্তি একবার দাঁড়িয়ে যায় তিনি ইচ্ছা করলেও সেই ভাবমূর্তির অদৃশ্য বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননা। এবার ভাবুন পরীমণির কথা। মুসলমান সমাজের প্রবাহমান আদর্শের বিপরীত এক চরিত্র পরীমণি। মিডিয়ার তৈরি বিভিন্ন স্টোরি অনুসারে সে মদ খায়, ডিজে পার্টি করে,রাত বিরেতে বারে বারে ঘুরে বেড়ায়, বড়লোকদের সাথে দেশে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমনে যায় এমনকি পয়সাওয়ালাদের জন্য মেয়ে মানুষও সাপ্লাই দেয়। কী সাঙ্গাতিক কথা ! এমন একটি নষ্ট ভ্রষ্ট বকে যাওয়া নারীকে  একজন আদর্শ মুসলিম সাধ্বী নারী কী দৃষ্টিতে দেখতে পারেন? চোখ বুজে বলে দেয়া যায় তিনি চাইবেন সেই ভ্রষ্টা নারীকে পীড়ন করা হোক। পীড়ন করে করে তাকে ইসলামী আদর্শে ফিরিয়ে আনা হোক। ফেসবুকে আমার বন্ধুতালিকায় ছেঁড়া জিন্স পরা (আমি তাঁদের পোষাককে অশ্রদ্ধা করছিনা) অনেক অত্যাধুনিকাকেও দেখেছি পরীমণি বিষয়ে তারা নিঃসংকোচে  তাদের ঘোর রক্ষণশীল মানসিকতা প্রদর্শন করেছেন। খুবই প্রত্যাশিত ছিল জেল থেকে পরীমণি মাথায় হিজাব পড়ে অক্ষত তরমুজ (সম্প্রতি এক তালেবান নেতা বলেছেন হিজাবহীন নারী হলো ফাটা বা কাটা তরমুজ) হয়ে সমাজে প্রত্যাবর্তন করবেন। কিন্তু হায়, সকলই গরল ভেল, পরীমণি ফিরেছেন পরীমণিরই মতো। ভেস্তে গেল সকল অমানবিক রাষ্ট্রীয় বর্বরতা।এভাবেই প্রতিকুল ঢেউয়ের বিপরীতে কেউ দাঁড়িয়ে যায়।দাঁড়িয়ে থাকে।