মাহাথির আহমেদ তুষার

By firm immutable immortal laws
Impress’d on Nature by the Great First Cause,
Say, Muse! how rose from elemental strife
Organic forms, and kindled into life…
—Eramus Darwin, The Temple of Nature.

কোনো এক দেশে, কোনো এক কালে ছিলো একটা ঝর্ণা। কেউ কেউ বলতো, অনেকগুলি সাগর, মহাসাগর পেরিয়ে, বন জঙ্গল পেরিয়ে সে ঝর্ণা। নাম তার “ন্যানোগ”।

সে ঝর্ণার পানি এনে দিতো অমরত্ব।

মানুষ সত্যিই খুঁজেছে সেরকম কোনো ঝর্ণা। যদিও তা পাওয়া সম্ভব ছিলো না। ক্যাল্টিক মিথোলজির এই ন্যানোগ না পাওয়া গেলেও একটা বিচিত্র জগতে কাছাকাছি সে-রকম কিছু মজুদ আছে। যার ক্ষমতা আছে স্টেম সেল এর যৌবন ধরে রাখার।

কোথায় সে জগত?

আপনার কোষে। খুব ছোট্ট একটা জগত! সেটায় ঢুকে চলে যান নিউক্লিয়াসে। তারপর সেখান থেকে খুঁজে নিন ক্রোমাটিড ফাইবারদের, যারা কোষবিভাজনের সময় খাটো-মোটা হয়ে যাবে পানি বিয়োজন করে। এবার সেখান থেকে ১২ নং ক্রোমোজম খুঁজে নিন। এখানে চিরুনি অভিযান চালান। পেয়ে যাবেন “ন্যানোগ” জিন!
সেই ন্যানোগ প্রোটিনের gene একটা ঐতিহাসিক দলিলও।

কিসের দলিল?

A record from where we can find our cousins…

চলুন, নিজের শরীর থেকেই খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা যাক লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসকে। আমরা আমাদের ডিএনএ-র বিশাল তথ্যভান্ডার ঘেঁটে দেখবো কি লিখা আছে অতীত নিয়ে। দেখবো পূর্বপুরুষদের ভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাস, বের করবো সে ভাইরাসদের ফসিল। ফসিলের সত্যতা যাচাই করতে প্রাণ দিবো তাতে। সেখান থেকে মিলবে পূর্বপুরুষদের হদীস, মিলবে আত্মীয়দের পরিচয়।

বলা যাক, শিম্পাঞ্জি আর আমাদের আত্মীয়তার গল্প। বের করা যাক ইনএভিটেবল এক বাস্তবতাকে।

আমাদের আজকের আলোচনায় ডিএনএ থেকে আমরা যে প্রমাণগুলির সাহায্যে শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের আত্মীয়তার দলিল খুঁজবো, মোটাদাগে সেগুলি হচ্ছেঃ
ন্যানোগ প্রোটিন

ক্রোমোজম-২
বিট গ্লোবিন জিন
হিউম্যান এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস(HERV)

ন্যানোগ প্রোটিনের জিন থাকে আমাদের ১২ নং ক্রোমোজমে। এটি স্টেম সেলের যৌবন ধরে রাখে। আমাদের কোটি কোটি কোডের এই জিনোমে চিরুনি অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, ১২ নং ক্রোমোজমে থাকা এই ন্যানোগ জিনটি ছাড়াও আরও ১১ টি ভাঙা সিউডো ন্যানোগ প্রসেসড সিউডোজিন জিন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। এই সিউডোজিনগুলি ক্রোমোজম-12 সহ আরও ৮ টি ক্রোমোজমে ছড়িয়ে আছে। কোন ৮ টি?

Chromosome-6, 7, 9, 10, 12, 14, 15 এবং Chromosome-X ।

আপনি যদি ক্রোমোজমে এই ১১ টি জিনের অবস্থান দেখেন, তাহলে দেখবেন খুব বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে তারা। কোনো ক্রোমোজমে ১ টা সিউডো ন্যানোগ জিন, কোথাও দু’টো। এদের অবস্থানের না আছে কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন, না আছে ক্রম।

এবার প্রশ্ন আসতে পারে, কিভাবে এই ন্যানোগ ব্রোকেন ন্যানোগ জিনগুলি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রইলো?
উত্তরটা সহজ করে বলি।

ক্রোমোজম-12 এ থাকা ন্যানোগ জিনটি ডিএনএ রেপ্লিকেশনের সময় মিউটেটেড হয়ে আরেকটা ব্রোকেন জিন তৈরি করে ফেলে। যেটা এই একই (১২ নং) ক্রোমোজমে এক্টিভ ন্যানোগ জিনটির পাশেই থাকে। এরপরে সেখান থেকে বাকি ক্রোমোজমগুলিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। তাও সহজ করে বললে,
ন্যানোগ জিন থেকে RNA তৈরির পর এটি প্রোটিন তৈরি না করে কখনও রিভার্স ট্রান্সক্রাইবড হয়ে DNA-র অন্য জায়গায় ঢুকে যায়। ফলে, নতুন একটা প্রসেসড সিউডোজিন তৈরি হয়ে যায়। এতে করে আসলটাও থাকলো, আবার নতুন করে আরেকটাও জন্ম নিলো। এভাবে, লম্বা সময় ব্যবধানে, আমাদের জিনোমের বিভিন্ন জায়াগায় RNA রিভার্স ট্রান্সক্রাইবড হয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। তাই রেন্ডমলি, বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ক্রোমোজমে বিক্ষিপ্ত ভাবে ন্যানোগ জিনের এই প্রসেসড সিউডোজিনগুলি অবস্থান করছে। লক্ষ করুন, ৮ টা ভিন্ন ভিন্ন ক্রোমোজোমে মোট ১০ টা ন্যানগ প্রসেসড সিউডোজিন উৎপত্তি লাভ করেছে এবং সেখানেই অবস্থান করছে।

(processed pseudogene এর উৎপত্তি নিয়ে আরও বিস্তারিত পড়তে পারেন এখানে, আর, এছাড়াও এই লিংকে সারমর্ম(Abstract) বিনামূল্যে পড়তে পারেন। বাকিটা পড়তে পে করতে হবে)

এখন, একটা নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণির জিনোমে বিভিন্ন জায়গায় এমন mistakenly, এলোপাথাড়িভাবে ডিরাইভ হওয়া এই সিউডোজিনগুলির অবস্থান আর অন্য কোনো প্রজাতির প্রাণির জিনোমে ন্যানোগ এর সিউডোজিনের অবস্থান নিশ্চয়ই একই ক্রোমোজমের একই লোকেশানে হবে না। তাই না??

কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে শিম্পাঞ্জির জিনোমে খোঁজ চালিয়ে দেখা গেছে, এর ক্রোমোজোমে ঠিক একই স্থানে, একই লোকাসে ন্যানোগের প্রসেসড সিউডোজিনগুলি অবস্থান করছে!

ঠিক যেমনটা মানুষের ছিলো। শিম্পাঞ্জিরও ঠিক Chromosome-6, 7, 9, 10, 12, 14, 15 এবং Chromosome-X—এ ছড়িয়ে আছে সিউডোজিনগুলি। এবং…এবং সেই ক্রোমোজোমগুলির অবস্থানও হুবহু একই লোকাসে, ঠিক যেমনটা মানুষের! দুই ক্ষেত্রেই ১০০% মিল!

এই হুবহু, শতভাগ নিখুঁত সাদৃশ্য তখনই সম্ভব, কেবল যখন মানুষ আর শিম্পাঞ্জি একই পূর্বপুরুষ থেকে আসবে। এর পেছনের কারণটা ইনেভিটেবল। আপনার আমার মুখের কথায় সেটাকে অস্বীকার করা যাবেনা।
কারণ, শুধুমাত্র একটা প্রাণিদেহেই এলোপাতাড়িভাবে এই সিউডোজিনগুলির উৎপত্তি ঘটলে এর উত্তরসূরীদের ক্রোমোজমের লোকাসে ১১ টা সিউডোজিনের অবস্থান হুবহু একই হওয়া সম্ভব। আর কোনোভাবে এটা সম্ভব নয়।

▪️এ সংক্রান্ত পুরোটা স্টাডি আপনার পড়ার দরকার আছে বলে মনে করি:

—Booth, H.A.F. & Holland P.W.(2004), Eleven Daughters of NANOG. Genomics,84(2), 229-238
তাছাড়া, এখানেও পাচ্ছেন:
https://linkinghub.elsevier.com/retrieve/pii/S0888754304000667
—Evolution of the NANOG pseudogene family in the human and chimpanzee genomes, BMC Ecology and Evolution(2004). Link: https://bmcecolevol.biomedcentral.com/articles/10.1186/1471-2148-6-12

▪️এ ধরণের আরও একটা গবেষণা: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3484675/

▪️ন্যানোগ প্রোটিনের ব্যাপারে ডিটেইলস জানতে: https://www.cell.com/fulltext/S0092-8674(03)00394-5

মানুষ এর মোট ক্রোমোজম কয় জোড়া জানাই তো আছে, তাই না?

২৩ জোড়া।

কিন্তু, মানুষ ব্যাতীত অন্যান্য Great ape সদস্যদের ২৪ জোড়া।

তাহলে কি আমরা স্বতন্ত্র?

না, অতোটাও স্বতন্ত্র নই আমরা। আমাদেরও ২৪ জোড়াই থাকার কথা ছিলো।

কিন্তু, আমাদের ২ নং ক্রোমোজমটি হচ্ছে আসলে দুটো ক্রোমোজমের head to head ফিউশান বা সমন্বয়। দুটো ক্রোমোজমের এই হেড টু হেড ফিউশান ঘটলে কি হবার কথা?

১. এর দুইটি কেন্দ্র বা সেন্ট্রোমিয়ার থাকার কথা— হ্যাঁ, মানুষের এই chromosome-2 তেও দুটো সেন্ট্রোজোম আছে। যার মধ্যে একটা কার্যকর।
২. এর দুটি টেলোমিয়ার একসাথে লেগে থাকার কথা— জ্বী হ্যাঁ, ২নং ক্রোমোজমেও দুটি টেলোমিয়ার একসাথে লেগে আছে। এটাই দুটি ক্রোমোজমের সংযোগস্থল। এই সংযোগস্থল ঠিক কোথায়, তাও বের করা গেছে। এই ক্রোমোজমের শেষ দিক থেকে ১১ কোটি ৩৬ লক্ষ ২ হাজার ৯২৮ টা বেসপেয়ার পর।

আমাদেরও থাকার কথা ছিলো ২৪ টা ক্রোমোজম। কিন্তু, শিম্পাঞ্জি আর আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে পৃথক হওয়ার পর বিবর্তনের এই লম্বা পথে রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশানের ফলে দুটো ক্রোমোজমের ফিউশান ঘটে আজকের Chromosome-2 এ পরিণত হয়েছে। মানবদেহের এই Chromosome-2 এর জেনেটিক সিকোয়েন্স সহ অন্যান্য জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল হুবহু এক, এমন ক্রোমোজম আছে শিম্পাঞ্জিতে দু’টো।

(The Origin of Man: The Chromosomal Pictorial Legacy | Yunis and Prakash | Science: https://science.sciencemag.org/content/215/4539/1525.long ; এখান থেকে আর্টিকেলটা পড়তে পে করা লাগবে। আপনি এই আর্টিকেলের পিডিএফটা এই ড্রাইভ লিংক থেকেই পড়ে নিতে পারেন ফ্রিতে: https://drive.google.com/file/d/1gz1_EQ2OVjQ3HzcGBcmY2jGMxxQqNk6r/view?usp=drivesdk )

এখানে সন্দেহ থাকে না যে, শিম্পাঞ্জি সহ আমাদের পূর্বপুরুষের থাকা এই দুইটি ক্রোমোজম মানবদেহে কালক্রমে একসাথে মিশে গিয়ে Chromosome-2 হয়েছে। এটা নিয়ে বিস্তর ও স্বীকৃত গবেষণা আছে। ব্যাপারটা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞানে কোনোকিছুর প্রতিষ্ঠা পাওয়াকে হালকা মেজাজে দেখার কোনো উপায় নেই আপনার।

পিয়ার রিভিউড জার্নাল, Proceedings of the National Academy of Sciences বা PNAS—এ এই ব্যাপারে Jaco W. Ijdo তার গবেষণাপত্র, “Origin of Human Chromosome-2: An Ancestoral Telomere-Telomere Fusion” এর সারমর্ম টানেন এই বলে যে,

“আমরা উপসংহারে আসতে পারি, c8.1 ও c29B কসমিডের মধ্যে লোকাসের ক্লোন হয়েছে, যেটা আদি টেলোমিয়ার–টেলোমিয়ার এর ফিউশানের অবশিষ্টাংশ। এই ব্যাপারটা কেবল একটা বিষয়কেই নির্দেশ করে__ সেটা হচ্ছে, দু’টো আদি এইপ ক্রোমোজমের এই ফিউশান-ই মানুষের ক্রোমোজম-2 কে সৃষ্টি করেছে।”

আরও বিস্তারিত:

▪️” The Bonobo Genome Compared with The Chimpanzee and Human Genomes”— Peer reviewed, Nature. Link: https://www.nature.com/articles/nature11128
▪️”Origin of Human Chromosome 2: An Ancestral Telomere-Telomere Fusion” — Peer Reviewed, PNAS.
পিডিএফটা এখান থেকে ডাউনলোড করে পড়ে নিন: https://drive.google.com/file/d/1gZ2uBmryPHgDOszOHp_DDs9sWXwRKfHi/view?usp=drivesdk
▪️”Differences Between Human and Chimpanzee Genomes and Their Implications in Gene Expression, Protein Functions and Biomedical Properties of The Two Species”— Peer reviewed, BMC Genomics. link: https://bmcgenomics.biomedcentral.com/articles/10.1186/s12864-020-06962-8

◾এবার চলুন, এই মলিকিউলার পর্যায়ের আরও গভীরে ঢোকা যাক। খুঁজে খুঁজে দেখা যাক আর কতো কতো ইতিহাস লিখা আছে।
মানব জিনোমের বিটা গ্লোবিন গুচ্ছে পাঁচটি জিন পাশাপাশি থাকে। এই জিনগুলি হিমোগ্লোবিনের সেকেন্ড চেইন হিসেবে কাজ করে ভ্রূণ শুরু করে থেকে বিকাশের বিভিন্ন ধাপে । জিনোমের এই অংশটির মাঝামাঝি অঞ্চলে বিটা চেইন জিনের মতো একটি অংশ আছে, যাকে বলে সিউডো-জিন। একে সিউডো বলার কারণ হলো, মিউটেশনজনিত কারণে জিনটি কোনো কার্যকরী প্রোটিন তৈরি করতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো, শিম্পাঞ্জি জিনোমের একই অংশে হুবুহু একই সিউডো-জিন পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এই মানব সিউডো-জিনে দুটি নিউক্লিওটাইড substitute-মিউটেশন, এবং একটি নিউক্লিওটাইড deletion-মিউটেশন রয়েছে। এই মিউটেশনগুলোর প্রতিটিই শিম্পাঞ্জি সিউডো-জিনেও একই জায়গায় রয়েছে।

শুধু বিটা গ্লোবিন জিনই নয়, ভিটামিন-সি তৈরির জন্য দায়ী GLO (বা GULO) জিনের মিউটেশন মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রে এই রকম, তাই মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি কেউই ভিটামিন-সি তৈরি করতে পারে না।

মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির এনসেস্টর একই হওয়ায় এদের জিনোমে মিউটেশনের চিহ্নগুলো এতো নিখুঁত!

◾এবার আমরা দেখবো Endogenous Retrovirus DNA সংক্রান্ত একটা প্রমাণ। যা অনিবার্যভাবেই স্পষ্ট করে, কেন মানুষ আর শিম্পাঞ্জি একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে!

এতোক্ষণ যারা এই লেখা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলেন, তাদের বলছি, চোখ মুখ ধুয়ে পরবর্তী অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করুন।

রেট্রোভাইরাস কি?

রেট্রোভাইরাস এক ধরণের বিশেষ ভাইরাস, যেটা অন্য কোষের DNA তে নিজের জিন ইনজেক্ট করানোর মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এটাকে বলে, হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। ভাইরাস জিনটি পোষক কোষে প্রবেশের করার পর সেই কোষের DNA তে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করে। পোষক কোষ সেই জিনটাকে নিজের কোষের অংশ ধরে নেয়। এই কোষ যখন বিভাজিত হয়, তখন ভাইরাস কোষটিও বিভাজিত হয়। রেট্রোভাইরাস সাধারণত স্তন্যপায়ীদের শ্বেতরক্তকণিকাকে আক্রান্ত করে। এই ভাইরাস আবার শুক্রাণু কিংবা ডিম্বাণুকেও এফেক্ট করতে পারে। আক্রান্ত এই শুক্রাণু বা ডিম্বাণু ফার্টিলাইজড হলে সেই স্তন্যপায়ীর সন্তানের দেহেও ভাইরাসটি স্থানান্তরিত হয়। এমনকি, তার প্রতিটি কোষেই। পরবর্তীতে এই সন্তানও তার নেক্সট জেনারেশনে এই ভাইরাসটি পাস করে। পোষক কোষে এই ভাইরাসের অবস্থানের ফলে ক্ষতিকর মিউটেশন কিংবা রেয়ার কিছু ক্ষেত্রে উপকারী মিউটেশনও ঘটে যেতে পারে।

এই ভাইরাস জিনটি একটা সময় বাড়তি জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে, যা জেনারেশন থেকে জেনারেশন বিবর্তিত হতে থাকে। একটা পর্যায়ে ভাইরাসটির উপর সেই প্রাণিটার পুরো প্রজাতিটিই নির্ভরশীল হয়ে যায়। এটা ছাড়া তার রিপ্রডিউস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই প্রজাতিটির ডিএনএ-র স্থায়ী অংশ হয়ে যায়৷ মানুষ সহ প্রায় সব প্রাইমেটদেরই দেহে এই ভাইরাস জিন ডিএনএ-র স্থায়ী অংশ। বিজ্ঞানীরা সেটাকে নাম দিলেন, Endogenous Retrovirus। এটাকে Endogenous বলা হয় কারণ এটা আমাদের কোষের অংশ হিসেবে থাকে জন্ম থেকেই।

(এব্যাপারে কিছু স্টাডি:
▪️ https://journals.plos.org/plosbiology/article?id=10.1371/journal.pbio.3000028
▪️ https://www.pnas.org/content/112/5/E487 )

মানুষের জিনোম হাজার হাজার রেট্রোভাইরাস সেগমেন্ট ধারণ করে। আমাদের ডিএনএ-র ৮% জিনই হচ্ছে রেট্রোভাইরাস ডিএনএ। এটা আজ আমাদের দেহকোষে ঘাটি গেড়ে বসে আছে তার কারণ, আমাদেরই কোনো পূর্বপুরুষ এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো। এটাকে এক প্রকার হিস্টোরিকাল রেকর্ডও বলা যায়।
প্রশ্ন আসতেই পারে, আমাদের এই ভাইরাস জিনের ন্যায় সিকোয়েন্স ধারণ করা জিনগুলি কি সত্যি সত্যিই কোনো ভাইরাস থেকেই এসেছিলো? ব্যাপারটা কি প্রমাণিত?
জ্বী, প্রমাণিত।

মানুষের কোষ পেট্রিডিশে রেখে ইনকিউবেট করা হয় এবং খুব অল্প পরিমাণে সেই কোষের Endogenous Retrovirus এর ডিএনএ মিউটেটেড করানো হয়। এই ডিএনএ গুলি প্রাচীন সেই ভাইরাসটাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে কিনা সেটাই ছিলো দেখার বিষয়। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বিলুপ্ত এই প্রাচীন ভাইরাসগুলি সত্যি সত্যিই রিভাইভ করে!

( সূত্রঃ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1665638/ )

এবার দেখা যাক, এই এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস আমাদের আর শিম্পাঞ্জিদের কিভাবে কানেক্ট করেছে।

যদি সত্যি সত্যিই মানুষ আর শিম্পাঞ্জির কমন এনসেস্টর থাকে, আর সেই এনসেস্টর যদি রেট্রোভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়—তাহলে আজকের দিনে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনোমে একই লোকেশানে ভাইরাস জিনগুলি থাকার কথা। আবার, তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে না আসলে তাদের জিনোমে হুবহু একই জায়গায় ভাইরাস জিনগুলি থাকা পুরোপুরি অসম্ভব।

কেন অসম্ভব?

এর প্রথম কারণ হচ্ছে, রেট্রোভাইরাস কোনো হোস্টকে আক্রমণ করলে সেটা সেই হোস্টের জিনোমের অনেক জায়গায় থাকতে পারে। দেখা গেছে, হিউম্যান জিনোমে রেট্রোভাইরাসের ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি insertion স্পট আছে।

তথ্যসূত্র:
▪️ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1933515
▪️ https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/7926746
▪️ https://www.semanticscholar.org/paper/Retroviral-DNA-Integration%3A-ASLV%2C-HIV%2C-and-MLV-Show-Mitchell-Beitzel/f2c061e75d8ee0ddcf34edf93e9c986cbe854aba

যার ফলে, আলাদা আলাদা ভাবে যদি একটা মানুষ আর শিম্পাঞ্জি এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে তাদের দুজনের জিনোমে একই স্থানে ভাইরাস জিনটির অবস্থান করার সম্ভাবনা ১/১০০০০০০০। এখন ধরা যাক, আলাদাভাবে এই দুই প্রজাতির দুই প্রাণির মধ্যে ১২ টা ভাইরাস জিন প্রবেশ করলো। তাহলে, তাদের দুজনের জিনোমে একই স্থানে এই ভাইরাস জিনগুলির অবস্থানের সম্ভাবনা হচ্ছে, ১/পর্যবেক্ষণশীল মহাবিশ্বের সব পরমাণু!

মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনোম স্ক্যান করে মানুষের ২১১ টি ও শিম্পাঞ্জির ২০৮ টি Retrovirus insertion পাওয়া গেছে।
( https://personal.broadinstitute.org/sfs/personal/Science-1982-Yunis-1525-30.pdf ▪️ https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/16136131/ )

দেখা গেলো, ১ না, ২ টা না কিংবা ১২ টাও না— ২০৫ টা রেট্রোভাইরাস জিনের অবস্থান মানুষ আর শিম্পাঞ্জির জিনোমের একই অবস্থানে আছে!

(বিস্তারিত এখানে)

এই নিখুঁত মিলটা তখনই সম্ভব, কেবল যদি তাদের কোনো সাধারণ পূর্বপুরুষ একজনই আক্রান্ত হয়ে থাকে। আলাদা আলাদা ভাবে দুজনের জিনোমে একই স্থানে এই এতো বিশাল সংখ্যক ভাইরাস জিনগুলির অবস্থানের সম্ভাবনা ১/(প্রায় অসীম) অর্থাৎ, শূন্য।

বলা যায়, আমাদের আর শিম্পাঞ্জির সেই কমন এনসেস্টর এর দেহে ২০৫ টা রেট্রোভাইরাস জিনের প্রবেশ ঘটেছিলো। পরবর্তীতে, পূর্ব পুরুষ থেকে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর মানুষের ৬ টা বৃদ্ধি পেয়েছে আর শিম্পাঞ্জির ৩ টা।

আমাদের ডিএনএ জুড়েই লিখা আছে শতকোটি বছরের ইতিহাস। বিবর্তনের সবচেয়ে নিখুঁত হিসেব–নিকেশ তাই এই স্থানটাতেই পাওয়া যায়। মলিকিউলার লেভেলে বিবর্তনের এ ট্রেইটগুলি কারোরই অস্বীকার করার কোনো রাস্তা নেই, যদি না সত্যিকার অর্থেই আপনার কান্ডজ্ঞান থাকে।

এমন আরও কিছু স্টাডি দেখতে পারেনঃ
▪️ https://genome.cshlp.org/content/17/8/1186.long
▪️ https://bmcecolevol.biomedcentral.com/articles/10.1186/s12862-018-1125-1
▪️ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC509299/?tool=pubmed
▪️ https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/7926746/

কমন এনসেস্টর সম্পর্কিত আলোচনা করতে গেলে পুরো একটা বই লিখা যাবে। শতশত স্টাডি দেখানো যাবে। বিবর্তন তত্ত্ব এমনি এমনি এতোটা শক্ত ভিত গেড়ে বসে নি। বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। অনেকদূর চলে গেছে এই তত্ত্ব।

বিবর্তন তত্ত্ব বিরোধীরা আপনাকে মায়া কান্না শোনাবে, কেন শিম্পাঞ্জি আর আমাদের মধ্যে ৪% জিনের অমিল। অথচ, তারা আপনাকে কখনও জানাবেনা FoxP2 জিনের কথা। এই জিন প্রায় সকল স্তন্যপায়ীদের মধ্যে থাকে। জিনটি ২ হাজার টিরও বেশি অক্ষর বা কোডের লম্বা একটি তন্তু। এই FoxP2 জিনের সম্পূর্ণ ২ হাজার ৭৬ পরিমাণ কোডের মধ্যে মানুষ আর শিম্পাঞ্জির পার্থক্য কয়টি কোডে জানেন?

মাত্র ৯ টি কোডে!

এবার একটু দূরবর্তী কোনো প্রাণির জিন, যেমন ইঁদুরের জিনের সাথে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া গেছে ১৩৯ টি কোডে।(The Magic of Reality, Richard Dawkins)
তাও কিভাবে আমাদের ইতিহাস, প্রাচীন আত্মীয়দের অস্বীকার করবেন?

কালকেই সাগরতলে কোনো নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হলে এর নামকরণ, শ্রেণিবিন্যাস করতে সেই বিবর্তন তত্ত্বের কাছেই যাওয়া লাগবে। কোনো প্রজাতির ইতিহাস ইভোলিউশনারি ভিউ ছাড়া ব্যখ্যা করা অসম্ভব। আপনি আরও গভীরে, মলিকিউলার পর্যায়ে যান। সেখানেও হাজার হাজার ট্রেইট ইভোলিউশনের। কোষজুড়েই বিবর্তনের শতশত চিহ্ন। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। জানেন কি? আমাদের ডিএনতে নন-কোডিং জিনগুলিকে বলে এক্সন। এই প্রতিটা জিনই কোনো না কোনো ভাইরাস থেকে এসেছে। এখানেও আছে বিবর্তনের লম্বা কাহিনী।

হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের প্রধান, ডা: ফ্রান্সিস কলিনসের ভাষ্যমতে,

“If there was any lingering doubt about the evidence from the fossil record, the study of DNA provides the strongest possible proof of our relatedness to all other living things.”

আজকের এ আলোচনায় কেবল তো আমরা একটা আইসবার্গের চূড়া দেখলাম।

Shared Protein Coding genes, Long terminal repeat Divergence, Shared Chromosomal Inversions, Broken Gene comparisons… আরও কতো ভাবে যে কমন এনসেস্টর নিশ্চিত করা গেছে! তাও ২১ শতকে এসে এদেশে ইভোলিউশনের এগেইনস্টে রিডিকিউলাস সব প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। পর্যাপ্ত তথ্যাভাবে জেনারেশন থেকে জেনারেশন এই প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির ব্যাপারে জ্ঞাত থাকতে পারে না। এই সুযোগ নিয়ে বাজারে বের হচ্ছে অপবিজ্ঞান ছড়ানো নানান রঙচঙে বই।

তেমনি এক বইয়ে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের কমন এনসেস্ট্রির ব্যাপারটাকে পাঠকদের কাছে স্কেপ্টিকাল করার প্রয়াসে লেখক আফসোস করেছেন, “মানুষ যখন মহাকাশ থেকে ঘুরে আসছে, তখন শিম্পাঞ্জি গাছের ডালে ঝুলে উ–উ–আ–আ করে বুক চাপড়াচ্ছে।” (হোমো স্যাপিয়েন্স, রাফান আহমেদ, ১ম প্রকাশ, পৃষ্ঠা:১২০)

লেখাটা শেষ করছি হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের একজন অগ্রদূত, বব ওয়াটারস্টোনের একটা কথা দিয়ে,

“When we look at chimpanzees __ we get this extremely fine-grained view of evolution, and as a result we understand a lot more about the processes that are changing our own genome over time.”