মাননীয় রাষ্ট্রদূত

পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি কালে আমাদের সবুজ পাসপোর্ট থেকে ইসরাইল ভ্রমনে নিষেধাজ্ঞামুলক দুটি শব্দ তুলে নেয়ায় আপনি খুবই মর্মাহত হয়েছেন এবং এ নিয়ে প্রকাশ্যে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। কষ্ট পাওয়াটা অবশ্য স্বাভাবিক কিন্তু এভাবে উষ্মা প্রকাশটি কূটনৈতিক শিষ্টাচার মুলক নয়। তবু বহু বিচিত্র জাতি হিসেবে ক্ষুদ্র ইস্যুতে  উত্থাল হওয়া আর বৃহৎ ইস্যুতে চোখে গাঢ় চশমা আর কানে কোলা বেঁধে তা চেপে যাওয়া আমাদের মজ্জাগত বলে আপনার এই শিষ্টাচারবর্জিত মন্তব্য আমাদেরকে তেমন বিচলিত করবেনা। আপনারা যারা এদেশে কূটনৈতিক হিসেবে আসেন তারা অনেকটা সাত জন্মের পূণ্যের ফল হিসেবে এদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। আপনাদের নিজ নিজ দেশে আপনারা হয়তো সাধারণ একজন কেরানী দপ্তরীরও সমান মর্যাদা পাননা কিন্ত বাংলাদেশে আসা মাত্রই আপনাদের কপাল খুলে যায়। আপনাদের সাথে দরবার করে আমাদের জাঁদরেল মন্ত্রীরা ধন্য হন। মন্ত্রী আমলারা আভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধানে আপনাদের মূল্যবান পরামর্শ প্রার্থনা করেন।বিরুধীদলের অভিযোগ জানাবার মোক্ষম জায়গাটিই হলো আপনাদের দূতাবাসগুলি। আপনারা রাস্তায় বেরিয়ে গলাটি একটু উঁচু করলেই শয়ে শয়ে সাংবাদিক ফটোসাংবাদিক আপনাদিগকে ঘিরে ধরেন। আপনাদের মুখ নিসৃত বাণীগুলি পত্রিকার লিড নিউজ হিসেবে ছাপা হয়। টিভি সংবাদের প্রধান শিরোনাম হয়। টকশো পন্ডিতদের সারগর্ভ বক্তব্যের মূল্যবান রেফারেন্স হয়ে যায়। সুতরাং এ রকম দুচার পাঁচটা লাগামছাড়া বক্তব্য আপনারা দিলেও আমাদের কিছু আসে যাবেনা। এক অদ্ভুত এবং বিচিত্র  জাতি আমরা।

মাননীয় রাষ্ট্রদূত

প্যালেস্টাইনী নির্যাতিত মানুষের পক্ষে আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট কেননা আপনাদের মতো আমরাও এককালে নির্যাতিত ছিলাম। আপনাদের মতো আমাদেরও মুক্তির পেছনে একটি তিক্ত গল্প আছে। তাহলে চলুন সংক্ষিপ্তাকারে একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করি। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্টিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আপনাদের কতজন লোক এই অভিশপ্ত ইহুদি জাতী কর্তৃক নিহত হয়েছে বলতে পারেন ? এক পরিসংখানে দেখেছি ১৯৪৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ৪৭৯১ জন প্যালেস্টাইনী নাগরিক ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা নিহত হয়েছেন বাকি ছয় বছরে এর সাথে যদি আরও দু তিন হাজার যোগ করা হয়  তবে এ সংখ্যা হয়তো দশ হাজারের কাছাকাছি হবে।এই বিপুল সংখ্যক নিহত মানুষের জন্য আমরা অনুতাপ প্রকাশ করছি। ইহুদি সেনাবাহিনীর বর্বর সেনা কর্তৃক আপনাদের কতজন নারী ধর্ষিতা হয়েছেন সে হিসাব অজ্ঞাত অর্থাৎ তেমন অভিযোগ খুব একটা শুনা যায়না এ দিক দিয়ে আপনাদেরকে কিছুটা ভাগ্যবান বলাই যায়। কেন ভাগ্যবান বলছি তা আমাদের সেই তিক্ত ইতিহাসের একটি পরিসংখ্যান শুনলেই বুঝতে পারবেন। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের আইকনিক রাষ্ট্র পাকিস্তানী ইসলামী সেনা কর্তৃক এদেশের ত্রিশলাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। পথে ঘাটে মানুষের লাশ পঁচেছে। শিয়াল শকুনের খাবার হয়েছে। কোনো রকম শেষকৃত্য ছাড়া আবর্জনার মতো নিহত মানুষের শত শত লাশকে এক গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। নিজের কবর নিজেকে দিয়ে খনন করিয়ে সেই কবরের উপরই গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। আর ধর্ষণ ? সংখ্যা শুনে ইহুদিরা নিজেদেরকে নপুংশক ভেবে লজ্জা পাবে। দুই থেকে আড়াই লাখের মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছিল পাকিস্তানী খাঁটি ইসলামী সেনারা। বাংলাদেশের সেই ভয়াল দুঃসময়ে আপনারাও পি এল ও এর নেতৃত্বে যুদ্ধরত ছিলেন। বাংলাদেশ তখন আশা করেছিল মুক্তিকামী জাতী হিসেবে ফিলিস্তিন আরেক মুক্তিকামী জাতীর পাশে দাঁড়াবে। না, কোনো সামরিক সাহায্য নয় নৈতিক সমর্থনটুকুই আমাদের কাম্য ছিল। দিয়েছিলেন সেই সমর্থন? না স্যার, উল্টোটি করেছিলেন। ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ প্যালেষ্টাইন মুফতি ই আজমের সংগঠক আমিনুল হোসাইনী এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের আভ্যন্তরিন বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছিলেন। আর পি এল ও প্রধান ইয়াসির আরাফাত এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন, ইতিহাসের এক ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা তাকে একটুও স্পর্শ করেনি। বিচলিত করেনি। এবার আসুন  আমাদের আসমানী কিতাবের ফরমান অনুযায়ী অভিশপ্ত বলে খ্যাত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের ভূমিকা প্রসঙ্গে। আমরা প্রায়শ ইসরাইলকে আমেরিকার পোষ্যপুত্র, জারজসন্তান, তাবেদার ইত্যাদি বলে গালমন্দ করে থাকি। শব্দগুলি অপ্রমিত এবং অশালীন হলেও বাস্তবে এগুলির কিছুটা সত্যতা আছে কেননা কারো দ্বারা ইসরাইল আক্রান্ত হলে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। আমেরিকার সমর শক্তিতে ইসরাইল বলীয়ান তাই আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আমেরিকার বিপক্ষে স্ট্যান্ড নেয়া ইসরাইলের পক্ষে কার্যত অসম্ভব কিন্তু বিষ্ময়কর সত্য হলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ইস্যুতে এই পুঁচকে ইসরাইল কিন্তু আমেরিকার বিপক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। তৎকালীন নিক্সন প্রশাসন এই যুদ্ধকে অনেকটা প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করেই পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এমনকি পূর্বপাকিস্তানে গণহত্যার ভয়াবহতা অনুধাবন করে যখন মার্কিন কংগ্রেস পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে ভোট দেয় তখন নিক্সন প্রশাসন কৌশল করে গোপনে সৌদি আরব জর্ডান ইরান লিবিয়া তুরস্কের মাধ্যমেও পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো অব্যাহত রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের এই চ্যালেঞ্জিং যুদ্ধে ইসরাইল দাঁড়িয়েছিল এর বিরুদ্ধ পক্ষে অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তারা জুলাই মাসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব পাঠায় কিন্তু এতে মুসলিম বিশ্ব বিগড়ে যাবার ভয়ে মুজিবনগর সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে যদিও পুরো মুসলিম বিশ্ব প্রথম থেকেই একপায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আমাদের এককোটির মতো শরনার্থী নিয়ে তৎকালীন দারীদ্রপীড়িত ভারত যখন হিমসিম খাচ্ছিল ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কলেরা মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ মরছিল তখন খাদ্য এবং চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু দেশ ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আর সেই দেশগুলির অন্যতম একটি ছিল ইস্রাইল। কোনো মুসলমান দেশ একটাকা দিয়েও আমাদিগকে সাহায্য করেনি। বরং প্রকাশ্যে বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। অর্থ দিয়ে অস্ত্র দিয়ে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে সমানে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে।

মাননীয় রাষ্ট্রদূত,

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীন হলাম। আর স্বাধীন হয়েই আমরা আপনাদের ভূমিকার নতুন মূল্যায়ন করলাম। মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের নেতিবাচক ভূমিকাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই নিলাম। আপনাদের মুক্তিসংগ্রাম চলে এলো আমাদের একনম্বর প্রায়োরিটিতে। আর বেচারা ইস্রাইল, মুক্তিযুদ্ধে আমাদিগকে সাহায্য সহায়তা করেও চলে গেল ব্রাত্যের কাতারে। ব্রাত্য হলেও বোধহয় ইহুদীদের প্রতি কিছুটা নমনীয়তা বুঝাতো কিন্তু ব্রাত্য থেকে চলে গেল একেবারে জন্মশত্রুর পর্যায়ে। আমরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েই একটি দেশকে নিষিদ্ধ শত্রুর দেশ বলে গন্য করলাম। না আমাদের গণহত্যাকারী দেশকে নয় তৃতীয় আরেকটি দেশকে আর সে দেশটি হলো ইসরাইল। আমাদের সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই বড় একটি হোঁচট খেল। আমাদের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম অঙ্গীকার কারো সাথে শত্রুতা নয় নীতি কার্যত স্ববিরুধী হয়ে গেল।  তারচেয়েও বড় কথা “ A friend in need is a friend indeed প্রবাদটির অভূতপূর্ব বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখালাম আমরা। কৃতজ্ঞতা চক্ষুলজ্জা বিবেক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে গেল আমাদের মজ্জার ভেতরে জমা ইহুদীবিদ্বেষ। আর এই বিদ্বেষটি এতই প্রখর প্রবল এবং অবিনাশী যে ত্রিশলাখ বাঙালিকে হত্যা আর আড়াইলাখ বাঙালি রমনীকে ধর্ষণ করেও পাকিস্তান আমাদের বন্ধু হতে পারে কিন্তু ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল এখনও আছে শত্রুর একনম্বর সিরিয়েলে। পঞ্চাশ বছর পর আমাদের পাসপোর্ট থেকে আপত্তিকর দুটি শব্দ ডিলিট করে ফেলার অনুশোচনা থেকেই কি না কে জানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন-আমরা ইস্রাইল রাষ্ট্রকে স্বীকার করিনা তখন বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় প্রবাদটিই আমাদের আশ্রয়ের অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।

 

 

মাননীয় রাষ্ট্রদূত,

যে দেশের মুক্তিযুদ্ধের বি্রোধিতা করার পরও দেশটি আপনাদিগকে এত দিল, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইসরাইলের স্বতপ্রনোদিত স্বীকৃতি এবং সামরিক সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলো,  আধা শতাব্দী ধরে তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন না করে রাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতি করলো, অথচ মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক সামরিক এবং ধর্মীয় মোড়লপনায় শীর্ষ দেশ সৌদি আরব তুরস্ক ইত্যাদি ইসরাইলের সাথে যথারিতি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে সেই বেনিফিট নিচ্ছে। বাঁশের চেয়ে বড় হয়ে যাওয়া এই কঞ্চিটি আপনাদিগকে রাজা বাদশাহর মতো বসবাসের জন্য দূতাবাসের জায়গা দিয়েছে শুধু তাই নয় শুনা যায় এই দেশের বেকুব পাবলিক আবেগের ঠ্যালায় প্যালেস্টাইন যুদ্ধের জন্য ডকুমেন্টস বিহীন বিপুল চাঁদা আপনাদের দূতাবাসে পাঠাচ্ছে যা নিয়ে কি না আপনার দেশের মানুষই ক্ষুব্ধ হয়ে টুইট করছে কারণ তারা মনে করে এই পাবলিক সাহায্য আপনারা দূতাবাসে বসে বসে আরামসে ভোগ করছেন। করুন। করতে থাকুন ভোগ। কারণ এমন আজব দেশ আর জাতি বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাবেননা।  পরিশেষে কৌতুকছলে গ্রাম বাংলার একটি প্রবাদ শুনিয়ে দিই- যার মরা সে খায় মাছে ভাতে, কাইন্দা মরে যোগীর সাতপুতে।  অবশ্য এই আন্তর্জাতিক যোগীর সাত পুত নয় এক পুতই আছে  আর সেটি এই  বাংলাদেশ। পৃথিবীতে এমন নির্বোধ যোগীপুত্র আর দ্বিতীয়টি নেই যে। ইতি

বিনীত

আহমেদ শাহাব

কিশোরের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী