২০১৯ সনের মে মাসে মারে গেলমান (Murray Gell-Mann) মৃত্যুবরণ করলেন, তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০। পল ডিরাক, শিনিচিরো তোমোনাগা, জুলিয়ান সুইংগার, রিচার্ড ফাইনম্যানের মত বিজ্ঞানীরা যেমন করে কোয়ান্টাম তড়িৎবলবিদ্যাকে (quantum electrodynamics বা QED) গড়ে তুলেছিলেন, সেই ঐতিহ্যের পথ ধরেই মারে গেল-মান, ইয়োচিরো নামবু প্রমুখ তাত্ত্বিকদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল কোয়ান্টাম বর্ণবলবিদ্যা (quantum chromodynamics বা QCD)। ফাইনম্যান ও মারে গেলমান একই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালটেক ইনস্টিটিউটে পাশাপাশি অফিসে কাজ করতেন, দুজনে প্রথমে একসাথে কিছু গবেষণা করলেও তাদের ব্যক্তিগত অহম এক অর্থে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। এই দ্বন্দ্বে মারে গেল-মানের প্রতিভা ও অর্জন কোনো অংশেই ফাইনম্যানের চেয়ে কম ছিল না, কিন্তু ফাইনম্যান যেভাবে বিজ্ঞানকে ফাইনম্যান লেকচার সিরিজ দিয়ে ছাত্রদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিংবা ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম দিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের কণাদের মিথস্ক্রিয়াকে বর্ণনা করা সহজ করে দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তার সঙ্গে গেলমানের প্রতিযোগিতা করার সুযোগ ছিল না। অথচ গেলমানের কাছে আমরা পেয়েছি প্রকৃতির অন্যতম ভিত্তিভূমি সবল মিথষ্ক্রিয়া যা কিনা পরমাণুর মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রনদের একসাথে ধরে রাখে, পেয়েছি কোয়ার্কের মত মৌলিক ধারণা যা দিয়ে অতিপারমাণবিক কণার পর্যায় সারণী তৈরি করা যায়। সেই অর্থে মারে গেলমান ছিলেন আধুনিক যুগের দিমিত্র মেন্দেলিয়েভ।

চিত্র ১: মারে গেলমান ১৯৫০ ও ‘৬০এর দশকে কণা পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ছিলেন। ছবিটি ১৯৫৩ বা ১৯৫৪ সনে তোলা।

১৯৪০ ও ‘৫০ এর দশকে পদার্থবিদরা কোয়ান্টাম ও বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করে তড়িৎ আধানযুক্ত কণারা কীভাবে ফোটন বিনিময় করে একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে সেটার একটা পূর্ণ চিত্র পেলেন; এটাই হল কোয়ান্টাম তড়িৎবলবিদ্যা (QED)। নিউক্লীয় সবল এবং দুর্বল মিথষ্ক্রিয়া তখনও ছিল অজানা। উচ্চ শক্তির কণাত্বরক যন্ত্রে তখন বিজ্ঞানীরা প্রচুর ক্ষণস্থায়ী কণার সন্ধান পাচ্ছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারছিলেন না প্রোটন, নিউট্রন বা ইলেকট্রনের সঙ্গে সেগুলোর সম্পর্ক কী। তবে তারা ধারণা করছিলেন তড়িৎচুম্বকীয় বলের বাইরে অন্য বল দিয়ে এই কণাদের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জাপানী বিজ্ঞানী হিদেকি ইউকাওয়া ১৯৩৫ সনে একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন যেখানে পায়ন নামে একটি অনুকল্পিত কণা বিনিময়ের মাধ্যমে প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৪৭ সনে মহাকাশ থেকে আগত কণাদের (কসমিক রে) মধ্যে পায়ন বা পাই মেসন কণা আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীকালে দেখা যাবে প্রোটন, নিউট্রন এবং পায়ন কণারা সবাই কোয়ার্ক (ও গ্লুয়োন) দিয়ে গঠিত; প্রোটন ও নিউট্রন তিনটি কোয়ার্ক, আর পায়ন দুটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। তিনটি কোয়ার্ক (বা বিজোড় সংখ্যার) সম্বলিত কণাদের ব্যারিয়ন আর দুটি কোয়ার্কের (বা জোড়) কণাদের মেসন বলা হয়। ব্যারিয়ন ও মেসন মিলে তৈরি করে হ্যাড্রন পরিবার। 

এর পরের বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে বুঝতে হল আমাদের দুটি ধারণার প্রবর্তনা করতে হবে। এর একটি হল আইসোস্পিন, অপরটি হল স্ট্রেঞ্জনেস। আইসোস্পিনের ধারণাটা অনেকটা ইলেকট্রন স্পিনের মতই, ইলেকট্রনের যেমন +১/২ ও -১/২ স্পিন থাকতে পারে, বিজ্ঞানীরা (হাইজেনবার্গ বোধহয় প্রথম এটি ভাবেন) ধারণা করলেন প্রোটন ও নিউট্রন একটি কণারই দুটি রূপ। কণার আইসোস্পিন +১/২ হলে প্রোটন ও -১/২ হলে সেটি হবে নিউট্রন। এখানে স্পিন বা ঘূর্ণন ধ্রুপদী বলবিদ্যার ঘুর্ণন নয়, অর্থাৎ আমরা প্রতিনিয়ত যে ঘুর্ণনের সাথে পরিচিত সেরকম নয়, বরং এটা কণার অন্তর্নিহিত কোনো একটা বৈশিষ্ট্য যাকে দৃশ্যত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। 

কণাত্বরক যন্ত্রে আবিষ্কৃত কণাদের তালিকা তৈরি করে মারে গেলমান আইসোস্পিনের মত আর একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলেন। তিনি এর নাম দিলেন স্ট্রেঞ্জনেস (strangeness)। যদি কোনো কণা প্রোটনে রূপান্তরিত হয় তবে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে -১, অ্যান্টি বা পরাপ্রোটনে রূপান্তরিত হলে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে +১। কোনো স্ট্রেঞ্জ কণা অন্য একটি স্ট্রেঞ্জ কণায় রূপান্তরিত হতে বেশী সময় নিলে (১০-১০ সেকেন্ড) তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে বেশী -২, কম সময় (১০-২৪ সেকেন্ড) নিলে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে -১। এখন আমরা জানি সবল মিথষ্ক্রিয়ায় কণাদের স্ট্রেঞ্জনেস নম্বর সংরক্ষিত হয়, দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় হয় না। 

গেলমান স্ট্রেঞ্জনেস ও আইসোস্পিনের ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি চিত্র সাজালেন, প্রতিটি চিত্রে আটটি করে কণা স্থান পেল (চিত্র ২)। তিনি ভাষা, দর্শন, সঙ্গীত, প্রত্নতত্ত্বে খুবই উৎসাহী ছিলেন, তাই এই অষ্টকণার সম্মেলনকে বৌদ্ধ প্রথা অনুযায়ী নাম দিলেন eight-fold way যার বাংলা হল অষ্টাঙ্গিক পন্থা। ২ নম্বর চিত্রটিকে আমাদের একটু সময় নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। যেহেতু কোয়ার্কের ধারণা তখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি আমরা চিত্রটিতে প্রথমে কোয়ার্কের চিহ্নগুলো অগ্রাহ্য করব। চিত্রে সর্বমোট তিনটি অক্ষ দেখানো হয়েছে – I3 দিয়ে আইসোস্পিন, S দিয়ে স্ট্রেঞ্জনেস ও Q দিয়ে তড়িৎ আধান। উদাহরণস্বরূপ প্রোটনের স্ট্রেঞ্জনেস ০, আইসোস্পিন হল ১/২ এবং তড়িৎ আধান +১, অন্যদিকে Ξ– কণার স্ট্রেঞ্জনেস হল ২, আইসোস্পিন -১/২ ও তড়িৎ আধান -১। চিত্রে দুটি কণার – Σ০ ও Λ এর স্ট্রেঞ্জনেস ১, আইসোস্পিন ০ ও তড়িৎ আধান ০; তারা স্থান পেয়েছে ষড়ভূজের কেন্দ্রে। চিত্রটি নিশ্চয় প্রকৃতির মধ্যে কোনো গভীর প্রতিসাম্য নির্দেশ করে, কিন্তু এর অর্থ উদ্ধার করতে গেলমানের একটু সময় লাগল। ক্যালটেকে একজন গণিতের অধ্যাপকের কাছে তিনি লি গ্রুপের প্রতিসাম্যর কথা শুনলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে নরওয়ের গণিতবিদ সোফাস লি (Sophus Lie) এমন একটি গ্রুপ তত্ত্ব সৃষ্টি করেছিলেন যেখানে Special Unitary SU(3) নামে একটি গ্রুপ পাওয়া যায়; SU(3) দিয়ে গেলমান তাঁর অষ্টাঙ্গিক পথের রহস্য উদ্ঘাটন করলেন।

 

নরওয়ের গণিতবিদ সোফাস লি (১৮৪২–১৮৯৯)

 

 

চিত্র ২: মারে গেলমানের Eight-Fold Way (অষ্টাঙ্গিক পথ)। I3 অক্ষ হল আইসোস্পিন, S স্ট্রেঞ্জনেস ও Q হল তড়িৎ আধান।

 

গেলমান দেখলেন যদিও SU(3) দিয়ে কণাদের ৮টি (চিত্র ২) বা ১০টি (চিত্র ৪) প্রতিরূপে সাজানো যাচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে সহজ যে প্রতিরূপ – একটি ত্রিভূজ – সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। অথ্চ SU(3) তে ত্রিভূজ একটি মৌলিক গ্রুপ। গেলমান ভাবলেন এই ধরণের ত্রিভূজ পাওয়া যাবে যদি আমরা কোয়ার্ক নামে এক ধরণের কণা চিন্তা করি যাদের তড়িৎ আধান পূর্ণ সংখ্যা নয়। তিনি তিন ধরণের কোয়ার্কের কথা চিন্তা করলেন – আপ (u), ডাউন (d) ও স্ট্রেঞ্জ (s)। (কীভাব গেলমান কোয়ার্ক নামটা পেলেন সেটাও একটা ইন্টেরেস্টিং কাহিনী, সময়ের স্বল্পতা হেতু সেটা পরবর্তীকালের জন্য তুলে রাখা হল)। এদের তড়িৎ আধান হবে যথাক্রমে +২/৩, -১/৩ ও -১/৩, ও অন্যদিকে আইসোস্পিন সংখ্যা হবে +১/২, -১/২ ও ০। ৩ নম্বর চিত্রে এই ত্রিভূজ গ্রুপটি দেখানো হল। এই মৌলিক গ্রুপটি ব্যবহার করে খুব সহজেই অষ্টাঙ্গিক পথ বা ৪ নম্বর চিত্রের বৃহত্তর ত্রিভূজটি গঠন করা সম্ভব।
চিত্র ৩: SU(3) গ্রুপের মৌলিক গ্রুপ হল ওপরের ত্রিভূজটি। এখানে I অক্ষ হল আইসোস্পিন ও S স্ট্রেঞ্জনেস। এই গ্রুপটি ব্যবহার করে দিয়ে চিত্র ২এর ষড়ভূজ বা চিত্র ৪এর বৃহত্তর ত্রিভূজটি সৃষ্টি করা সম্ভব।

SU(3) দিয়ে ১০টি কণার যে প্রতিরূপ পাওয়া গেল তা গেলমানকে একটি অনাবিষ্কৃত নতুন কণার ভাবীকথন করতে সাহায্য করল। ৪ নম্বর চিত্রটি যখন গঠিত হল তখনও নিচের শীর্ষের কণাটি আবিষ্কৃত হয় নি। ১৯৬২ সনে গেলমান বললেন এই অনাবিষ্কৃত কণাটির স্ট্রেঞ্জনেস হবে -৩, আইসোস্পিন ০ এবং তড়িৎ আধান -১। পাঠক ৪ নম্বর চিত্রটা একটু মনোযোগ সহকারে দেখলেই বুঝতে পারবেন কেমন করে গেলমান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। এই অনাবিষ্কৃত কণাটির নাম দেয়া হল ওমেগা মাইনাস (Ω-) যেটি ১৯৬৪ সনে কণাত্বরক যন্ত্রে ধরা পড়ল। সবল মিথষ্ক্রিয়ায় SU(3)র রূপরেখা ও কোয়ার্ক মডেল প্রতিষ্ঠিত হল।

চিত্র ৪: চিত্র ৩এর SU(3) মূল ত্রিভূজ গ্রুপ দিয়ে ওপরের দশটি কণার বৃহত্তর ত্রিভূজটি তৈরি করা সম্ভব। এই চিত্রটি অবলম্বন করে মারে গেলমান সর্বনিম্ন ওমেগা মাইনাস (Ω-) কণাটির অস্তিত্বের ভাবীকথন করেন।

তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসই এমন যে এক্সপেরিমেন্ট ও তত্ত্ব যখন এমন জায়গায় পৌঁছায় তখন তার ফলাফল নিয়ে ভাববার মানুষের অভাব হয় না। গেলমান যখন অষ্টাঙ্গিক পথ ও SU(3)র সাথে সেটার সম্পর্ক আবিষ্কার করছিলেন প্রায় একই সময় ইউভাল নিমান নামে একজন ইজরায়লি বিজ্ঞানী স্বতন্ত্রভাবে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। নিমান পেশাগতভাবে পদার্থবিদ ছিলেন না, তাঁর ডিগ্রী ছিল প্রকৌশল বিষয়ে। তারপর সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত যখন লন্ডনে ইজরায়লি দূতাবাসে কাজ করছিলেন তখন তিনি বিজ্ঞানী পাকিস্তানী বিজ্ঞানী আবদুস সালামের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করেন এবং ১৯৬১ সনে তিনি SU(3) প্রতিসাম্য ব্যবহার করে কোয়ার্ক মডেলের ধারণা পান। প্রায় একই সময় জর্জ ৎস্ভিগ নামে এক রুশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী কোয়ার্কের ধারণা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন যা পরে প্রকাশিত হয়। ৎস্ভিগ নতুন কণাদের নাম দিয়েছিলেন এইস (ace)। ১৯৬৯ সনে যখন গেলমান এককভাবে নোবেল পুরস্কার পান, তিনি ভেবেছিলেন এই কাজের জন্য আর দু-একজনের নোবেল পাওয়া উচিত ছিল, বিশেষত ইউভাল নিমানের।

 


চিত্র ৫: ইউভাল নিমান ও জর্জ ৎস্ভিগ, কোয়ার্ক মডেল প্রতিষ্ঠার
জন্য এদের বিশেষ অবদান আছে।

কোয়ার্কের ধারণা প্রবর্তন করার ফলে সমস্ত পারমাণবিক কণাগুলোর ধর্ম বোঝা সম্ভব হল। প্রোটন দুটি আপ (u) ও একটি ডাউন (d) কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত, এর ফলে তার আধান হবে +২/৩ + ২/৩ – ১/৩ = +১। আইসোস্পিন হল +১/২ + ১/২ – ১/২ = +১/২। নিউট্রন একটি আপ ও দুটি ডাউন কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত +২/৩ – ১/৩ – ১/৩ = ০ আধান ও +১/২ – ১/২ – ১/২ = -১/২ আইসোস্পিন। এই মডেলে মেসন কণারা, যেমন পাই মেসন বা মিউ মেসন দুটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে মধ্যম মানের ভারি কণারা, যেমন ইলেকট্রন, মিওন ও টাউ কণারা, যারা কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি নয়, তারা সবল মিথষ্ক্রিয়া অংশগ্রহণ করে না, দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় করে। এদের লেপটন বলা হয়। 

সমস্যা হল পাউলির বর্জন নীতি অনুযায়ী দুটি কণা একই কোয়ান্টাম দশায় থাকতে পারবে না। ৪ নম্বর চিত্রে দেখা যাচ্ছে ওমেগা মাইনাস তিনটি স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, এদের আইসোস্পিন, তড়িৎ আধান, স্ট্রেঞ্জনেস সবই একরকম। প্রোটনে অবস্থিত দুটি u আপ কোয়ার্কেরও একই দশা। এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে, ১৯৬৪ সনে, অসকার গ্রীনবার্গ নামে একজন মার্কিন বিজ্ঞানী বললেন কোয়ার্কদের তড়িৎ আধান, আইসোস্পিন ও স্ট্রেঞ্জনেস ছাড়াও আর একটি কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য আছে। গেলমান এই দশাকে বর্ণ বা রঙ (colour) বলে অভিহিত করলেন। অবশ্য রঙ বলতে এখানে একটা কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যই বোঝানো হয়েছে, প্রকৃত রঙের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। একটি কোয়ার্কের লাল, নীল বা সবুজ রঙ থাকতে পারে। এই রঙগুলো (যা কিনা আসলে রঙ নয়) হল সবল মিথষ্ক্রিয়ার আধান, অর্থাৎ তড়িৎ আধান ছাড়াও কোয়ার্কেদের বর্ণ আধান রয়েছে। কিন্তু প্রোটনের সামগ্রিকভাবে কোনো বর্ণ আধান নেই, তার মানে প্রোটনের মধ্যে যে তিনটি কোয়ার্ক আছে তাদের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রঙে থাকতে হবে যেমন লাল, নীল ও সবুজ যাতে তাদের মিশ্রিত বর্ণ সাদা বা আধান বিহীন হয়। 

এখান থেকে শুরু হল কোয়ান্টাম বর্ণবিদ্যার (chrmodynamics) জয়যাত্রা। আপ, ডাউন ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ককে বলা হল কণার স্বাদ (flavor) আর প্রতিটি স্বাদের কোয়ার্ক আবার রঙের অধিকারী। কণাদের স্বাদের আবার উল্টো বা প্রতিরূপ আছে, প্রতিআপ, প্রতিডাউন ও প্রতিস্ট্রেঞ্জ। আবার রঙগুলোর উল্টো বা প্রতিরঙ আছে – প্রতিলাল, প্রতিসবুজ ও প্রতিনীল। SU(3)র প্রতিসাম্য অনুযায়ী লাল, সবুজ ও নীলকে যতি একটি সমবাহু ত্রিভূজের তিনটি শীর্ষে বসানো হয় এবং ত্রিভূজটিকে ঘোরানো হয়, তবে QCD তত্ত্বের কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ একটি লাল আপ কোয়ার্ককে একটি নীল আপ কোয়ার্ক থেকে আলাদা করা যাবে না। এই যে ঘূর্ণনের কারণে রঙের অবস্থান বদলাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না তার অর্থ হল যে কোনো রঙ সবল মিথষ্ক্রিয়ায় অপরিবর্তিত থাকবে, অর্থাৎ যে রঙগুলো মিথষ্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে সেই রঙগুলোই বের হয়ে আসবে। যেহেতু লাল, নীল বা সবুজ কোয়ার্ক বলতে গেলে একই জিনিস, সেটা এক ধরণের প্রতিসাম্য যা কিনা একটি কোয়ান্টাম ক্ষেত্রর সূচনা করে (স্থান ও সময়ের স্বল্পতা হেতু এই আলোচনাটা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা হল)। এই ক্ষেত্রটি সৃষ্টি করে গ্লুয়োন নামে এক ধরণের বিনিময় কণা।

 

চিত্র ৬: দুটি কোয়ার্কের মধ্যে গ্লুয়োন বিনিময় করে রঙ পরিবর্তন।

ফোটন যেমন তড়িৎচুম্বকীয় বলের মাধ্যম, সবল মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যম হল গ্লুয়োন। ফোটন ও গ্লুয়োন দুটির ভরই শূন্য, দুটিরই তড়িৎ আধান শূন্য। অন্যদিকে গ্লুয়োনের বর্ণ-আধান আছে, অর্থাৎ গ্লুয়োন কোয়ার্কের মতই রঙ বহন করে। একটি গ্লুয়োন দুটি গ্লুয়োনে ভেঙে যেতে পারে, আবার দুটি গ্লুয়োন একে অপরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে নতুন দুটি গ্লুয়োন সৃষ্টি করতে পারে, ফোটন এগুলো করতে পারে না। একটি গ্লুয়োন আবার একটি কোয়ার্ক ও একটি পরাকোয়ার্কে ভেঙে যেতে পারে, আবার একটি কোয়ার্ক ও একটি পরাকোয়ার্ক মিলিত হয়ে একটি গ্লুয়োন সৃষ্টি করতে পারে। এর মানে হচ্ছে একটি প্রোটন বা নিউট্রনের মধ্যে শুধু যে তিনটি কোয়ার্কই আছে তা নয়, সেগুলির মধ্যে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কোয়ার্ক-পরাকোয়ার্ক সৃষ্টি ও ধ্বংস হচ্ছে। ৬ নম্বর চিত্রে দেখা যাচ্ছে একটি সবুজ কোয়ার্ক সবুজ ও পরানীল গ্লুয়োন বিকিরণ করে একটি নীল কোয়ার্কে রূপান্তরিত হচ্ছে। অন্যদিকে একটি নীল কোয়ার্ক একটি সবুজ ও পরানীল গ্লুয়োন আত্মস্থ করে সবুজ কোয়ার্কে পরিণত হচ্ছে। সবুজ ও নীল আসছে এবং নীল ও সবুজে রূপান্তরিত হচ্ছে, রঙ সংরক্ষিত হচ্ছে। প্রতিটি গ্লুয়োন একটি রঙ ও একটি প্রতিরঙ দিয়ে তৈরি। এই বিক্রিয়ায় কিন্তু আপ কোয়ার্ক ডাউনে বা ডাউন কোয়ার্ক আপে রূপান্তরিত হচ্ছে না। কাজেই গ্লুয়োন কোয়ার্কের রঙই শুধু বদল করে, স্বাদ নয়। স্বাদ বদলাতে হলে, অর্থাৎ আপকে ডাউন করতে বা ডাউনকে আপ, আমাদের দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার আশ্রয় নিতে হবে। 

প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে কোয়ার্করা গ্লুয়োন ক্ষেত্র দিয়ে দিয়ে সংবদ্ধ থাকে, কিন্তু নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রনেরা আবদ্ধ থাকে পায়ন বিনিময় বা কোয়ার্ক-পরাকোয়ার্ক বিনিময় দ্বারা। অনেকে দুটি প্রোটন বা দুটি নিউট্রন বা একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রনের আকর্ষণকে কোয়ার্কগুলোর মধ্যে সবল মিথষ্ক্রিয়ার একটা অংশ হিসাবে ধরেন, এই আকর্ষণ সবল বল থেকে কম। কিন্তু নিউক্লিয়নগুলি (প্রোটন ও নিউট্রন) কেমন করে নিজেদের মধ্যে আকর্ষিত থাকে সেটার বিজ্ঞানকে মডেল করা সহজ নয়। ৭ নম্বর চিত্রে এরকম একটা প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। সেখানে প্যাঁচানো রেখাগুলি গ্লুয়োনকে বোঝাচ্ছে। বলা যায় পায়ন কণার ব্নিময় গ্লুয়োন ক্ষেত্রেরই একটি দূরবর্তী প্রভাব। সবল মিথষ্ক্রিয়ার কার্যকরী দূরত্ব খুব বেশী নয়, ১০-১৫ মিটার, একটি মাঝারি ধরণের নিউক্লিয়াসের আকারের সমান, এর পরে প্রোটনদের মধ্যে তড়িৎ বিকর্ষণ প্রাধান্য পায়। এই ধরণের তড়িৎ বিকর্ষণ ইউরেনিয়ামের মত বড় নিউক্লিয়াসকে অস্থিত করে দেয় ও তাদের তেজষ্ক্রিয় অবক্ষয় হয়।

চিত্র ৭: প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে পায়ন বিনিময়। এই প্রক্রিয়া প্রোটন ও নিউট্রনকে সংবদ্ধ করে রাখে।

কণাত্বরক যন্ত্রে খুব উচ্চ শক্তি সম্পন্ন পরীক্ষাতেও কোয়ার্কে আলাদাভাবে দেখা যায় নি। এর মূল কারণ হল কোয়ার্করা গ্লুয়োনের ফ্লাক্স দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে, দুটি কোয়ার্ককে আলাদা করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করলে সেই শক্তি থেকে নতুন এক জোড়া কোয়ার্ক তৈরি করা হয়। পরবর্তীকালে দেখা গেল কোয়ার্ক পরিবার শুধু মাত্র আপ, ডাউন ও স্টেঞ্জের মধ্যে আবদ্ধ রইল না, চার্ম, টপ ও বটম কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হল। কিন্তু সেই কাহিনী এখনকার জন্য নয়। ১৯৬৯ সনে মারে গেলমান সবল মিথষ্ক্রিয়া আবিষ্কারে তাঁর অবদানের জন্য এককভাবে নোবেল পুরস্কার পান, যদিও তিনি নিজেও ভেবেছিলেন ইউভাল নিমানেরও এই কাজের জন্য পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। 

মারে গেলমান অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর বাবা মা আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে এসেছিলেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ২১ বছর বয়সে MIT থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। আমি এই লেখাটা শুরু করেছিলাম ফাইনম্যানের সঙ্গে গেলমানের তুলনা দিয়ে। ফাইনম্যানের ও গেলমানের ব্যক্তিত্ব ছিল একেবারেই উল্টো, ফাইনম্যান কোনো লৌকিকতার ধার ধারতেন না, অন্যদিকে গেলমান ছিলেন ফরমাল – সর্বদা স্যুট টাই পরা – বুদ্ধিজীবী যিনি একাধারে বিজ্ঞানী ও ভাষাবিদ যিনি আমাদের কোয়ার্ক, স্ট্রেঞ্জনেস, রঙ ও গ্লুয়োনের মত বিশেষ্য উপহার দিয়েছেন। মারে গেলমানের হয়তো আক্ষেপ ছিল যে তাঁর নাম ফাইনম্যানের মত জনপ্রিয় হয় নি, কিন্তু পদার্থবিদ্যায় শেষাবধি গেলমানের নাম দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা বেশী কারণ তিনি প্রকৃতির মূল উপাদান কোয়ার্ক আবিষ্কার করেছিলেন।

 

চিত্র ৮: ২০০০ সনে The Atlantic ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে Barry Blitt’এর আঁকা মারে গেলমান ও রিচার্ড ফাইনম্যানের কার্টুন। চিত্রটিতে গেলমান ও ফাইনম্যনের স্ব্তন্ত্র ব্যক্তিত্ব যথাযথভাবেই ফুটে উঠেছে।