লেখকঃ মেঘবতী রাজকন্যা

ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন এবং হঠাৎ দেখলেন ফুটপাথে একজন কৃষ্ণবর্ণের তরুণী ভিক্ষা করছে বসে, তার শরীর অনেক রোগা এবং পাতলা। আপনি কি ঐ তরুণীর সঙ্গে প্রেম করতে চাইবেন? বা ধরুন একজন পুরুষ কুষ্ঠ রোগীকে একজন ফর্সা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণী রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখলো, এক্ষেত্রে তরুণীটি কি পুরুষটির সঙ্গে প্রেম করতে চাইবে? দুটি প্রশ্নের উত্তরই একই, না; না একজন সফল ছেলে ভিখারিনীর সঙ্গে প্রেম করতে চাইবে, আবার না একজন সফল মেয়ে পুরুষ ভিক্ষুকের সঙ্গে প্রেম করতে চাইবে; এটার কারণ কি?

উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যাবেন যে, আর্থসামাজিক কারণেই এমনটা হয়েছে, হ্যাঁ, কারণটা আর্থসামাজিকই। অন্য দিকে বাংলাদেশের সমাজে ভালো পরিবারের ব্যর্থ ছেলেরাও মেয়েদের সঙ্গ পায়না কেন? এর কারণ কি হ’তে পারে? এখানে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতা, এছাড়া রক্ষণশীলতা এবং ধর্মীয় অনুশাসন তো রয়েছেই। বাংলাদেশের সমাজে কখনো দেখেছেন, যে, মেয়েদের কর্ম আর ছেলেদের বেকারত্বের মিলন অর্থাৎ একটি বেকার ছেলেকে একটি কর্মজীবী মেয়ে বিয়ে করেছে, এমনটি দেখেছেন কখনো? দেখলেও সেটা অনেক কম দেখবেন, আমাদের দেশ বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো অনেক ঋণাত্মকভাবে তৈরি করা, সামান্য ম্যাট্রিক পাশ ছেলে কখনো স্নাতক পাশ তরুণীর সঙ্গ পেতে পারেনা আমাদের সমাজে, পায়ও না; নারীতন্ত্র যদি থাকতো আমাদের সমাজে যে, নারীরা সব দিক দিয়ে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র্য তখন বেকার ছেলেরা ঠিকই নারীসঙ্গ পেতো। স্নাতক পাশ তরুণ, বড়ো চাকরি করে এরকম অনেক আছে আমাদের দেশে যারা কিন্তু অল্প শিক্ষিত তরুণীকে বিয়ে করে, আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক বলেই এমনটা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক প্রেমযুগল দেখা যায়, এইসব প্রেমযুগলদের প্রেমের মধ্যে কি শর্ত থাকে? তাদের প্রেমের মধ্যে কি বিনিময়মূল্য থাকে? হ্যাঁ, শর্ত থাকে, বিনিময় মূল্য থাকে, সব ধরণের ঋণাত্মক জিনিসই থাকে, সত্যিকারের প্রেমই শুধু থাকেনা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণীদের সঙ্গ না পাওয়া তরুণদের সংখ্যা প্রেমযুগলদের চেয়ে কম কি না? না, কম না, প্রেমযুগলদের চেয়ে তরুণীদের সঙ্গ না পাওয়া তরুণদের সংখ্যাই বেশি। অথচ আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের গর্ব, আমাদের বাঙালি জাতির জন্য একটি গর্ব, একটি খ্যাতিমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠান তরুণ-তরুণীদের মেলামেশার ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা অবলম্বন করে। প্রতিষ্ঠানটিতে তরুণরা তরুণীদের সঙ্গে মিশতে পারলেও তরুণদের মনে থেকে যায় অনেক অশান্তি কারণ তারা তরুণীদের সঙ্গে ভালো করে মিশতে পারেনা, আজকাল আবার দেখা দিচ্ছে প্রেমের সম্পর্কে ফাটল যা তরুণ এবং তরুণী উভয়ের জীবনেই মারাত্মক অশান্তি ডেকে আনছে।

আমরা বাংলাদেশের যে কোনো প্রেম-ভালোবাসার দিকেই তাকাই না কেন, যদি ভালো করে ভেতরটা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যাবে যে, ঐ প্রেমের ক্ষেত্রে তরুণীটি তার প্রেমিকের কোনো না কোনো সফলতা দেখেই তার সঙ্গে প্রেম করেছে, মেয়েদের অবচেতন মন আমাদের দেশে এমনভাবে তৈরি হয়ে গেছে যে এখন চাইলেও কোনো মেয়ের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, মেয়েরা তাদের মনস্তত্ত্ব আমাদের দেশের পরিবার এবং সমাজ থেকে শিখেই তৈরি করে নেয়। একটি মধ্যবিত্ত তরুণীর লক্ষ্য থাকে কোনো একটি সফল তরুণ বা পুরুষের সঙ্গে প্রেম করার বা বিয়ে করার, সে নিজে শিক্ষিত হয়ে চাকরি করলেও তার পুরুষসঙ্গীটিকে সে কোনোভাবেই বেকার হিসেবে চাবেনা, আমাদের দেশের সামাজিক শিক্ষা হচ্ছে এটাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, উপন্যাসটির প্রধান নায়ক তার প্রিয়তমা সুফিয়াকে অনেক ভালোবাসে, তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তরুণী সুফিয়া উপন্যাসটির সর্বশেষে একজন সফল পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, কেন তরুণীটি একজন কর্মজীবী পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হলো, এখানে হুমায়ুন আজাদও পাঠকদেরকে একভাবে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে, পুরুষদের সফলতা সত্যিই নারীদেরকে আকর্ষণ না করে পারেনা, উপন্যাসটির প্রধান নায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকে, আর সুফিয়া থাকে তারই সহপাঠিনী। আমাদের বাঙালি তরুণীরা পুরোনো রক্ষণশীলতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি এখনো, আবার তরুণরাও অধিকাংশই পুরুষতান্ত্রিক, উল্টোদিকে তরুণীরাও পুরুষতন্ত্রবাদে দীক্ষিত।

বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন, আমাদের বাংলাদেশের সমাজে এই শিক্ষাটাই দেওয়া হয়; ছেলেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে তাদের উপরে সামাজিক চাপ আসে যে বিয়ে করতে হবে, এটা মেয়েদের উপরেও আসে, অথচ বাংলাদেশের সমাজে বিয়ে করা কঠিন, শুধু কঠিন না বলে অনেক ক্ষেত্রে দুরূহ বলা ভালো কারণ ছেলেরা কর্মজীবী না হতে পারলে তাদের জীবনে বিয়ে বা প্রেম কোনোটাই আসেনা বলা যায়, আবার মেয়েদের জীবনে ঠিকই এগুলো আসে, তাদের বিয়ে বা প্রেম করার ক্ষেত্রে সফলতার দরকার পড়েনা শুধু দরকার পড়ে চেহারার সৌন্দর্য, এটাই তো রক্ষণশীলতা এবং পুরুষতান্ত্রিকতা; আমাদের সমাজে আবার শরীর-সর্বস্বতাও আছে, নারীরা কম যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের শিকার হয়নি আমাদের সমাজে, সব কিছুর জন্য দায়ী রক্ষণশীলতা এবং পুরুষতান্ত্রিকতাই। আমাদের সমাজে প্রেম তো একভাবে নিষিদ্ধ এবং প্রেম করার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বিয়ে করে একটি রক্ষণশীল পরিবার তৈরি করা, সমাজে মাত্র হাতে গোণা কয়েকটি প্রেম সফল হয়, অধিকাংশ মানুষের জীবনেই বাংলাদেশের সমাজে প্রেমের ছোঁয়া লাগেনা, বাংলাদেশের অধিকাংশ তরুণ এবং তরুণী সত্যিকারের প্রেমের স্বাদ পায়না।

আপনি দেখেছেন না, যে, আমাদের দেশের প্রেমিক এবং স্বামীরা অধিকাংশই কৃষ্ণ বর্ণের হয়, এবং প্রেমিকা আর পত্নীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফর্সা হয়, ফর্সা হচ্ছে আমাদের সামাজিক আদর্শ অনুযায়ী সুন্দরী এবং টাকা-পয়সা ওয়ালা পুরুষ হচ্ছে সামাজিক আদর্শ অনুযায়ী ‘ভালো পুরুষ’। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের সমাজে সব মেয়ের কি ফর্সা শরীর-চেহারা থাকে? বা সব ছেলে কি সফলতা অর্জন করতে পারে? প্রশ্ন করুন নিজেকে, না, পারেনা, না সব মেয়ে জন্মগতভাবে ফর্সা হয়, না সব ছেলে বড়ো হয়ে সফলতা অর্জন করতে পারে, কিন্তু তাও আমাদের অন্ধ-বদ্ধ সমাজ ছেলেমেয়ের উপর অনেক ধরণের রক্ষণশীল নিয়ম চাপিয়ে দেয়, যদিও কালো মেয়েদের বিয়ে হয় কিন্তু বেকার ছেলেদের কি বিয়ে হয়? রক্ষণশীলতা এবং পুরুষতান্ত্রিকতাবাদে ছেলেরাই বেশি বিপদে পড়ে। ফর্সা ছেলেরাও বেকার থাকলে মেয়েদের সঙ্গ পায়না আমাদের দেশে।

প্রাকৃতিকভাবে নারীসঙ্গ পাবার কামনা পুরুষদের জাগবেই, জাগাটা অস্বাভাবিক কিছুনা; কিন্তু বাংলাদেশের নিজস্ব রক্ষণশীলতাবাদ, পুরুষতান্ত্রিকতাবাদ এবং শরীর-সর্বস্ব মতবাদ আর নারী-পরাধীনতাবাদ বাংলাদেশের সমাজে সব পুরুষকে নারীসঙ্গ দিতে পারেনা, পারছেনা, এর জন্য নারী এবং পুরুষ উভয়কেই মিলে বাংলাদেশের সমাজ থেকে সব ধরণের রক্ষণশীলতা মুছতে হবে, মুছতে হবে পুরুষতান্ত্রিক মতবাদ এবং শরীর-সর্বস্বতাবাদী মতবাদ; নারীদের সত্যিকারের স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্যতা বাংলাদেশের সমাজে আনতেই হবে, নারীরা সত্যিকারের অর্থে স্বাধীন হলে তখন আর পুরুষদের নারীসঙ্গ পাবার ক্ষেত্রে সফলতা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হিসেবে কাজ করবেনা।