২০১৯ সনে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা Event Horizon Telescope (EHT) দিয়ে বেতার তরঙ্গে একটি কৃষ্ণ বিবরের ছায়ার ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এই বিবরটি আমাদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, M৮৭ নামে, একটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত। এর ভর হচ্ছে প্রায় ছ’শ ষাট কোটি সূর্যের ভরের সমান। বিবর অর্থ গর্ত বা গহ্বর, সেই অর্থে কৃষ্ণ বিবর হল ব্ল্যাক হোল কথাটির বঙ্গানুবাদ। 


আইনস্টাইনের দেয়া সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্বে দেশ-কাল, অর্থাৎ স্থান ও সময় মিলিতভাবে একটা অদৃশ্য চাদরের মত ছড়িয়ে আছে, অর্থাৎ যাকে আমরা শূন্যস্থান বলছি আসলে তাতে অদৃশ্য দেশ-কালের তন্তু বিস্তৃত। সেই দেশ-কালের চাদরে (একে বিজ্ঞানের ভাষায় মেট্রিক বলা হয়) যদি কোনো বস্তু রাখা হয় তবে তার ভর সেই দেশ-কালকে বক্র করবে, যেমন টানটান একটি চাদরের ওপর কোনো ভারী গোলক রাখলে সেটা চাদরটাকে বাঁকিয়ে দেবে। আমরাসহ যে কোনো বস্তু-কণা অথবা আলোক-কণা তখন দেশ-কালের সেই বক্র পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ ভ্রমণ করতে পারবে না। ১৯০৫ সনে আইনস্টাইন যে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দিয়েছিলেন তাতে বস্তুকে শক্তিতে রূপান্তর করার একটি সমীকরণ ছিল যাকে আমরা E = mc2 বলে জানি। কাজেই আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতায় শুধু যে বস্তু রাখলেই দেশ-কালের মেট্রিক বাঁকা হবে তা নয়, শক্তিও সেই মেট্রিককে বাঁকিয়ে দিতে পারে। সূর্য তার ভর দিয়ে আশেপাশের দেশ-কালের মেট্রিককে বক্র করে, পৃথিবী সেই বক্রতায় বাধ্য হয় সূর্যের চারদিকে ঘুরতে। সাধারণ আপেক্ষিকতা বস্তু ও শক্তির মহাকর্ষের প্রভাব নির্ধারণ করে, কিন্তু এই জ্যামিতিক বিজ্ঞানের গভীরতা নিউটনীয় মহাকর্ষ সূত্র থেকে অনেক শক্তিশালী, আপেক্ষিকতা সমীকরণ থেকে বহু অনুসিদ্ধান্ত আহরণ করা সম্ভব যা কিনা প্রকৃতির অনেক প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করে। 

এখানে বলে রাখি সূর্য যদি কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হয় (বাস্তবে তা হবে না), তার আকার হত ছয় কিলোমিটার ব্যাসের, তাতে পৃথিবীর ওপর কোনো মাধ্যাকর্ষণজনিত কোন প্রভাব পড়ত না, পৃথিবী তার আগের কক্ষপথেই চলত, সূর্যে পতিত হত না। সূর্য কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হলে মহাকর্ষের প্রভাব শুধুমাত্র সূর্যের বর্তমান ব্যাসের মধ্যেই পরিবর্তিত হত, এর বাইরে নয়।

১. সিংগুলারিটি ও কৃষ্ণ বিবরের সংজ্ঞা

১৯১৫ সনে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করার কয়েক মাসের মধ্যেই জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্ৎসশিল্ড আপেক্ষিকতা সমীকরণের একটি সমাধান বের করেন; একটি স্থির (ঘূর্ণীয়মান নয় এমন) বড় তারার চারদিকে দেশ-কালের মেট্রিক কীরকম হবে সেটা এই সমাধান থেকে পাওয়া যায়। এই মেট্রিক ব্যবহার করে আমরা দেখি যে, তারাটির সমস্ত ভর যদি একটি বিন্দুসমেত কেন্দ্রে আপতিত হয় তবে সেই বিন্দু থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত কোনো আলোক কণিকা থাকলে, সেই কণিকা তার উচ্চ গতি সত্বেও কেন্দ্রের মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্তি পাবে না এবং আমরা ঐ তারাটি সম্পর্কে সরাসরিভাবে কোনো তথ্যই পাব না। এই দূরত্বকে সোয়ার্ৎসশিল্ড ব্যাসার্ধ বলা হয় যা কিনা ঘটনা-দিগন্তকে নির্দিষ্ট করে। ঘটনা-দিগন্তের মধ্য থেকে কোনো সংবাদই আমরা বহির্বিশ্বে পাব না। 

 

কৃষ্ণ বিবরের যে ছবিটা EHT বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন (চিত্র ১) তাতে যে কালো অংশটা দেখা যাচ্ছে সেটা কৃষ্ণ বিবরের ঘটনা-দিগন্তের সমান নয় বরং তার থেকে বড়। কালো অংশটিকে কৃষ্ণ বিবরের ছায়া বলা হচ্ছে; সেটির ব্যাসার্ধ ঘটনা-দিগন্তের প্রায় আড়াই গুণ। ওই ব্যাসার্ধের মধ্যে কৃষ্ণ বিবরের কাছে বাইরের কোনো ফোটন (আলোক কণিকা) এলে হয় সেটি বিবরে পতিত হবে অথবা বিবরের চারদিকে, ঘটনা-দিগন্তের বাইরে ফোটন গোলক নামে একটি জায়গায় আবদ্ধ হবে, কাজেই সেটুকু জায়গা থেকে আমরা কোনো আলো দেখতে পাব না, সেখানে বিবরের ছায়া তৈরি হবে।

 

চিত্র ১: Event Horizon Telesope দিয়ে ধারণকৃত কৃষ্ণ বিবরের ছায়া। ছায়ার বাইরের আলোটি বেতার তরঙ্গদৈর্ঘে ধারণ করা হয়েছে। কাজেই এই ছবিটি দৃশ্যমান আলোকের নয়, বরং বেতার তরঙ্গের শক্তি অনুযায়ী আরোপিত রঙ দিয়ে সৃষ্টি। এর ভেতরের কালো অংশটি (ছায়াটি) আমাদের সৌর জগতের চাইতে অল্প বড়।


চিত্র ২: আমাদের থেকে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন বা সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরে M৮৭ নামের উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিটি অবস্থিত। এরই কেন্দ্রে ৬.৫ বিলিয়ন বা সাড়ে ছ’শ কোটি সৌরীয় ভরের কৃষ্ণ বিবরটির ছায়ার ছবি জ্যোতির্বিদরা তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
 

চিত্র ৩: M৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলের শিল্পীর আঁকা একটি কাল্পনিক ছবি। এক্দম কেন্দ্রে আমাদের সৌরজগতের সমান কৃষ্ণ বিবরটি অবস্থিত যার চারপাশে একটি চক্র আবর্তিত হচ্ছে এবং ক্রমাগতই সেখান থেকে বস্তুকণা কেন্দ্রের গহ্বরে আপতিত হচ্ছে। ঘুর্ণায়মান চৌম্বক ক্ষেত্র কিছু কণাকে জেট আকারে লম্বভাবে বিকিরিত করছে। চিত্র ১ এর ছবিটি মিলিমিটার বেতার তরঙ্গে গৃহীত কারণ ঐ তরঙ্গ গ্যালাক্সিটির কেন্দ্র থেকে তথ্য আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারে, চারপাশের বস্তুকণায় শোষিত হয়ে যায় না।     



সোয়ার্ৎসশিল্ড মেট্রিকের একটি পরিণাম হচ্ছে সিংগুলারিটি। সিংগুলারিটি কী? একটি বড় ভরের তারা, যদি সেটা সূর্যের চেয়ে অন্ততঃ পাঁচ গুণ বেশী ভরের হয়, তার সমস্ত জ্বালানী ফুরিয়ে ফেললে, অর্থাৎ তার জীবনের শেষে, একটি বিন্দুসমেত কেন্দ্রে, খুবই ক্ষুদ্র বস্তুতে, আপতিত হবে। সেই বস্তুর (তাকে বস্তু বলা হয়ত সঙ্গত নয়) ঘনত্ব এমনই, বা তার মহাকর্ষ বল এমনই, যে সেটি চারদিকে দেশ-কালের বক্রতাকে অসীম করে দেয়। সেই বক্রতা ভেতরের বস্তুটিকে পুরোপুরি ঢেকে দেবে। অর্থাৎ সে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে বিযুক্ত হয়ে যায়। এই অসীম ঘনত্বের বা অসীম মহাকর্ষীয় বলের বিন্দুটিকে ইংরেজীতে সিংগুলারিটি বলা হয়, সিংগুলারিটির অর্থ হল অনন্য, এমন অনন্য অবস্থা মহাবিশ্বের আর অন্য কোথাও বিরাজ করে না। কৃষ্ণ বিবর বা ব্ল্যাক হোল বলতে আমরা সিংগুলারিটিসহ ঘটনা দিগন্তের মধ্যে যা আছে তাই বোঝাই। 

সাধারণতঃ আমরা ধরে নিই যদি সিংগুলারিটি না ঘোরে, তবে সেটির আয়তন হবে শূন্য। একটি শূন্য আয়তনের বস্তু বা অব্স্থান কেমন করে সীমিত ভরকে ধরে রাখবে সেটা একটা বৈজ্ঞানিক সমস্যা। সোয়ার্ৎসশিল্ড মেট্রিক অঘূর্ণীয়মান কৃষ্ণ বিবরকে বর্ণনা করে। তবে মহাবিশ্বের প্রতিটি তারাই ঘোরে, কাজেই সেই তারা থেকে সৃষ্ট ব্ল্যাক হোল যে ঘুরবে সেটা মনে করাই স্বাভাবিক। ১৯৬৩ সনে নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী রয় কের ঘুরন্ত তারার কাছে আইনস্টাইনের সমীকরণের একটি সমাধান (মেট্রিক) বের করলেন যেটা ঘূর্ণীয়মান কৃষ্ণ বিবরের জন্য প্রযোজ্য। ঘূর্ণীয়মান কৃষ্ণ বিবরের সিংগুলারিটির আয়তন শূন্য নয়, বরং সেটির আকৃতি একটি চক্রের মত। অন্যদিকে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন সিংগুলারিটি আদৌ না সৃষ্টি হতে পারে। মেট্রিকের বক্রতা যখন অসীম হতে থাকবে তখন এক ধরণের কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া বক্রতার অগ্রসরতাকে থামিয়ে দেবে। কিন্তু বর্তমানে এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম, কারণ সেটি জানতে হলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মিশ্রণে একটা নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি করতে হবে যার নাম হল কোয়ান্টাম মহাকর্ষ। কোয়ান্টাম মহাকর্ষের ওপর অনেক তাত্বিক বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন, কিন্তু এখনো এই বিষয়ে কোনো সফল তত্ত্ব আমরা পাই নি।


২. আইনস্টাইন: ঈশ্বর নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে জুয়া খেলেন না

 

১৯১৫ সনে আইনস্টাইন যখন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের চূড়ান্ত রূপটি প্রকাশ করেন তখন পরমাণুর আকার সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান সবে দানা বাঁধছিল, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূচনা লগ্নের সময় ছিল এটা। ১৯২৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে সত্যেন বসু একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখলেন যা কিনা কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান বিদ্যার সূচনা করে। ১৯২৫ সনে হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা (বা অনির্দেশ্যতার) নীতি প্রণয়ন করেন: কণার অবস্থান এবং ভরবেগ (বা বেগ), এই দুটি জিনিসকে একই সঙ্গে যদৃচ্ছ সূক্ষ্ণভাবে পরিমাপ করা যাবে না। অর্থাৎ আমরা কণার যদি অব্স্থানকে সূক্ষ্ণভাবে মাপতে পারি তবে তার বেগ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা থাকবে অস্পষ্ট, যার ফলে সেটির পরমূহুর্তের অবস্থান থাকবে অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে কণার বেগকে যথার্থভাবে জানলে, সেটির অবস্থানকে নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এর ফলে নিউটনীয় চিরায়ত বলবিদ্যার পরিণামবাদী বা নিষ্পত্তিমূলক (deterministic) মহাবিশ্বের অবসান ঘটল। ১৮১৪ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী লাপ্লাস বলেছিলেন, এমন কোন অস্তিত্ব যদি থাকে যে সে কোনো একটা মুহূর্তে মহাবিশ্বের সমস্ত কণার অবস্থান এবং তাদের ওপর প্রযোজ্য বলের পরিমাণ জানবে, তাহলে তার পক্ষে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ ও অতীত অবস্থা নির্ধারণ করা কঠিন হবে না। এই অস্তিত্বকে অনেকে লাপ্লাসের দানব (demon) বলে অভিহিত করেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সুনিশ্চিতভাবে লাপ্লাসের দানবের পরিণামবাদী মহাবিশ্বের অবসান ঘটাল। শুধু তাই নয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলল কণাসমূহের শুধু কণা বৈশিষ্ট্যই নয়, একটি তরঙ্গ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। তবে এই তরঙ্গটি প্রকৃত বাস্তব তরঙ্গ নাকি একটি সম্ভাবনা (probabilistic) তরঙ্গ তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে, যদিও বেশীরভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন মুক্ত কণার (যেমন ইলেকট্রনের) অবস্থান প্রসারণশীল সম্ভাবনা তরঙ্গ দিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব যার প্রকৃতি নিতান্তই গাণিতিক। অন্যদিকে যে মুহূর্তে ঐ ইলেকট্রনটিকে অবলোকন করা হবে সেটি একটি কণায় রূপান্তরিত হবে। কণা ও তরঙ্গের এই যে দ্বৈত বাস্তবতা তা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরে; একটি ইলেকট্রন একটি বিন্দু থেকে আর একটি বিন্দুতে কীভাবে ভ্রমণ করে আমরা তা সঠিক জানি না, দুটি বিন্দুর মধ্যে অসংখ্য সম্ভাব্য পথ রয়েছে। সেই পথগুলিকে আমাদের মনে চিত্রিত করা সম্ভব নয়, শুধু গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। 

 

বিজ্ঞানের দর্শনে পজিটিভিজমের মত হল শুধুমাত্র সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বস্তু সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করা যাবে তাই একমাত্র সত্য, এর বাইরে কিছু বললে সেটা হবে জল্পনা। ভিয়েনার বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মাখ এর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। যেহেতু ১৮শ শতকের শেষে ও ১৯শ শতকের প্রথমদিকে পরমাণুকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার কোনো পদ্ধতি জানা ছিল না, পজিটিভিস্টরা পরমাণু সম্পর্কে আলোচনাকে বিজ্ঞান বহির্ভূত মনে করতেন। অন্যদিকে রিয়ালিস্ট বা বাস্তববাদীরা সরাসরি পরমাণু দেখা না গেলেও সেটিকে বাস্তব ধরে নিয়ে গবেষণা করতেন। আইনস্টাইনকে মাখ বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, কিন্তু ১৯২০ দশকের আইনস্টাইন পজিটিভিস্ট ছিলেন না, বরং বাস্তববাদী ছিলেন। অন্যদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রবক্তরা, বিশেষ করে নিলস বোর ও হাইজেনবার্গ পজিটিভিজমকে পুরোপুরি ত্যাগ করেন নি। তাঁরা মনে করতেন কোয়ান্টাম পর্যবেক্ষণের ফলাফল পরীক্ষক কী দেখতে চাইছেন সেটার ওপর নির্ভর করে: পরীক্ষক যদি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ মাপতে চান তো ইলেকট্রনকে তরঙ্গ হিসেবে দেখবেন, অন্যদিকে সে যদি তার ভরবেগ নির্ধারণ করতে চান তাহলে কণা হিসেবে দেখবেন। কণা বা তরঙ্গ এই দুটি বৈশিষ্ট্যের কোনো অর্থ নেই যতক্ষণ না পরীক্ষক তাঁর স্বাধীন চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে অবলোকন করবেন। বাস্তববাদী আইনস্টাইনের কাছে এরকম অজ্ঞেয়বাদ ছিল পুরোপুরিই পরিত্যায্য। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বলে কণার অবস্থান ও গতিবেগ একই সঙ্গে যথার্থভাবে জানা যাবে না; প্রকৃতি সম্পর্কে এটাও এক ধরণের অজ্ঞানতা, অর্থাৎ আমাদের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি যতই দক্ষ হোক না কেন আমাদের কাছে এই দুটি জিনিস একসাথে অজানা থেকে যাবে, এই অজ্ঞানতা দেশ-কালের কন্টিনিউয়ামের মধ্যেই প্রথিত, একে এড়ানোর উপায় নেই। আইনস্টাইনের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য ছিল না, তিনি বললেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব পূর্ণ নয়। লিখলেন, ‘ঈশ্বর পাশা খেলতে পারে, ঠিক আছে, কিন্তু সে যে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে জুয়া খেলবে এটা আমার ধারনার বাইরে।’ ঈশ্বর অর্থে এখানে তিনি প্রকৃতিকেই বুঝিয়েছিলেন। ১৯৩০ সনের ১৯শে আগস্টে আইনস্টাইনের সঙ্গে দ্বিরালাপে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর রাজ্যে আকস্মিকতা কাজ করে কাজেই অস্তিত্বের নাটক পুরোপুরি পূর্বনির্ধারিত নয়’, তখন আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞান থেকে কার্যকারণ (causality) বিদায় হয়েছে।’ কার্যকারণ আইনস্টাইনের দর্শনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল, তিনি বাস্তববাদী (realist) ছিলেন এবং মানব-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র বাস্তবতায় বিশ্বাস করতেন। 

 


চিত্র ৪: দ্বিরালাপে আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ, জার্মানী, ১৯৩০

 

তাই আইনস্টাইনের পক্ষে সিংগুলারিটির অস্তিত্ব মেনে নেয়া কঠিন ছিল, তাঁর কাছে সিংগুলারিটি হল প্রকৃতির খেয়ালীপনা যার বৈশিষ্ট্যকে আমরা কোনোভাবেই নির্ধারণ করতে পারব না। নিশ্চয় প্রকৃতি কোনোভাবে সিংগুলারিটি সৃষ্টিতে বাধা দেবে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পরিসংখ্যানগত অনিশ্চয়তাকে তিনি যেমন পছন্দ করেন নি, একটি তারার অন্তঃপতন সিংগুলারিটি সৃষ্টি করতে পারে সেটাও মেনে নেন নি।

তাই ১৯৩৯ সনে তিনি একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে যুক্তি দেখালেন যে একটি তারা (বা কণাসমষ্টি) কখনই সোয়ার্ৎসশিল্ড সিংগুলারিটিতে পতিত হতে পারবে না কারণ তার আগেই সেটির ঘুর্ণনের মাত্রা এত বেশী হবে যে বাইরের দিকের কণাসমূহ আলোর গতিবেগে ভ্রমণ করবে (যা কিনা সম্ভব নয়) এবং পুরো সিস্টেমটা অস্থিত হয়ে পড়বে (বা ভেঙ্গে পড়বে)। প্রবন্ধটি বৈজ্ঞানিক মহলে সমাদৃত হয় নি, ততদিনে অনেক গুণী বিজ্ঞানী নক্ষত্রর অন্তর্মুখী পতন গবেষণা করছিলেন শুধুমাত্র কাগজে কলমে বিশ্লেষণ করে নয়, বরং কম্পিউটারে জটিল গণনা করে। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে সিস্টেমটা অস্থিত হোক বা না হোক সেটি তারাটির পতন রোধ করতে পারবে না।

 


৩. চন্দ্রশেখর ও এডিংটন

এর ৯ বছর আগে, ১৯৩০ সনে, ১৯ বছর বয়সী সুব্রামনিয়ম চন্দ্রশেখর ভারত থেকে জাহাজে চড়ে বিলেত যাচ্ছিলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে। জ্যোতির্বিদরা ততদিনে জানতেন সূর্যের মত নক্ষত্ররা যখন তাদের জ্বালানী ফুরিয়ে ফেলে তখন তারা ছোট হতে হতে পৃথিবীর আকারের শ্বেত বামনে পরিণত হয়। জাহাজে বসেই চন্দ্রশেখর গণনা করলেন যে একটি শ্বেত বামনের ভর যদি সূর্যের ভরের চাইতে ১.৪ গুণ বড় হয় তবে সেটি অস্থিত হয়ে পড়বে। ১৯৩৪ সনে কেম্ব্রিজে বসে চন্দ্রশেখর কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতা সূত্র এক করে দেখালেন যে আরো বেশী ভরের তারাদের অন্তঃপতন রোধ করার কোনো উপায় নেই। চন্দ্রশেখরের অন্যতম উপদেষ্টা আর্থার এডিংটন এটা মানলেন না, প্রকাশ্য বিজ্ঞান সভায় চন্দ্রশেখরের বক্তব্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করলেন, বললেন গণনায় ভুল আছে। আইনস্টাইনের মতই এডিংটন ভেবেছিলেন প্রকৃতির মধ্যে নিশ্চয় এমন কোনো উপায় আছে যার ফলে নক্ষত্রের চূড়ান্ত পতন রোধ করা যাবে। আর্থার এডিংটনের মত প্রভাবশালী বিজ্ঞানীর এই প্রতিরোধ শুধুমাত্র চন্দ্রশেখরের গবেষণারই ক্ষতি করে নি, কৃষ্ণ বিবর সংক্রান্ত বিজ্ঞানের বিলম্ব ঘটিয়েছে।

 



চিত্র ৫: তরুণ সুব্রামনিয়ম চন্দ্রশেখর। প্রভাবশালী বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন তাঁর নক্ষত্রদের অন্তঃপতনের ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন, এর কারণে তিনি তারাদের অন্তিম পরিণতির বিজ্ঞান গবেষণা থেকে বহু বছর নিজেকে বিযুক্ত রাখেন।

 


অথচ ওই সময়ে কেউ যদি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বুঝে থাকেন সেই ব্যক্তি ছিলেন আর্থার এডিংটন। ১৯১৯ সনে এডিংটন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে সূর্যের চারদিকে দেশ-কালের বক্রতা প্রমাণ করতে দক্ষিণ আমেরিকায় সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর গবেষণা প্রমাণ করে যে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র আলোর পথ আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। এর পরে সাধারণ আপেক্ষিকতার গণিত ব্যাখ্যা করে তিনি বেশ কয়েকটি বই ও প্রবন্ধ লেখেন। এমনকি একটি বইয়ে কিছুটা খেলাচ্ছলে এমন একটি ঘন নক্ষত্রের আলোচনা করেন যার মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র আলোক কণিকাকে ধরে রাখবে। কিন্তু এডিংটন ও আইনস্টাইন উভয়েই সিংগুলারিটিতে বিশ্বাস করতেন না যদিও সেটি আপেক্ষিকতা সমীকরণের একটি সমাধান। মানসিকভাবে আহত চন্দ্রশেখর কিছুটা অভিমানেই পরবর্তী কয়েক যুগ আর নক্ষত্রের অন্তিম পরিণতি নিয়ে কাজ করলেন না, যদিও জ্যোতির্বিদ্যার অন্যান্য শাখায় বিশেষ অবদান রাখলেন। ১৯৮৩ সনে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয় হয় শুধু শ্বেত বামনের ভরের জন্য নয় সামগ্রিক্ভাবে তাত্বিক জ্যোতির্বিদ্যায় অবদানের জন্য।   

 


চিত্র ৬: আইনস্টাইন ও এডিংটন, কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি, ১৯৩০। এনারা, উভয়েই, কৃষ্ণ বিবরের সিংগুলারিটিতে বিশ্বাস করতেন না।  



৪. সুপারনোভা, নিউট্রন নক্ষত্র ও ওপেনহাইমার 

একজন সফল বিজ্ঞানী তাঁর আহরিত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে প্রকৃতির ঘটনার ব্যাখ্যা দেন, এমনকি কিছু জিনিসের ভাবীকথন করেন যা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করবে না। চন্দ্রশেখর যখন শ্বেত বামনের ওপর কাজ করছিলেন সেই সময়েই ক্যালিফোর্নিয়াতে গবেষণা করতেন এক সুইস জ্যোতির্বিদ, তাঁর নাম ফ্রিটজ জভিকি। জভিকি খুবই দূরদর্শী বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন খগোল কণা (বা কসমিক রে) যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আছড়ে পড়ে তার উৎস হিসেবে নক্ষত্রের অন্তিম বিস্ফোরণ, যাকে আমরা সুপারনোভা বলি, সেটাকে চিহ্নিত করলেন। সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরে সেটি একটি উচ্চ ঘনত্বের নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হতে পারে বলে বেশ কয়েকটি ছোট প্রবন্ধও লিখলেন। নিউট্রন বলে যে একটা কণা আছে সেটা তখন সবে আবিষ্কার হয়েছে। এখন আমরা জানি সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে তারার মধ্যে অতি উচ্চ চাপে পরমাণুর প্রোটন ও ইলেকট্রন মিথষ্ক্রিয়া করে নিউট্রন ও নিউট্রিনো কণায় পরিণত হয়; খুবই অল্প ভরের নিউট্রনো সহজেই তারাটি থেকে বিকিরিত হয়ে যায়। কিন্তু জভিকি তাত্বিক ছিলেন না, তাঁর ধারণাকে তত্ত্বের ভিত্তিতে দাঁড় করাতে পারলেন না, সেজন্য তাঁর এই ধারণা সর্বজনগ্রাহ্য হল না। তখনকার দিনের বিজ্ঞানীরা তাঁর সুপারনোভা ধারণাটি গ্রহণ করলেন, কিন্তু নিউট্রন তারাকে বললেন নিতান্তই জল্পনা। জভিকির নিউট্রন তারা আবিষ্কারের জন্য আমাদের ১৯৬৭ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল।

নিউট্রন নক্ষত্র ও ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রসঙ্গে রবার্ট ওপেনহাইমারের নাম না বললেই নয়। ওপেনহাইমারকে আমরা চিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা সৃষ্টির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। এই বোমাকে বাস্তবায়নের জন্য তাঁর আক্ষেপ হয়েছিল, গীতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, ‘আমি এখন মৃত্যুবহনকারী, জগতের বিনাশকারী।’ যুদ্ধের আগে তাঁর ছাত্র জর্জ ভলকভের সঙ্গে তিনি মিলিতভাবে আবিষ্কার করলেন যে নিউট্রন তারার একটি সর্বোচ্চ ভর রয়েছে, সেটি অর্ধেক সৌর ভর থেকে কয়েক সৌর ভরের মধ্যে। বর্তমানে আমরা জানি নিউট্রন তারাদের ভরের বন্টন ১.৪ থেকে ২ সৌর ভরের মধ্যে। শ্বেত বামনের যেমন ইলেকট্রনের অপজাত চাপ তারাটিকে সুস্থিত করে, একটি নিউট্রন তারাকে নিউট্রনের অপজাত চাপ অতিরিক্ত অন্তর্মুখী পতন থেকে রোধ করে।

 

চিত্র ৭: ১৯৪৭ সনে আইন্স্টাইনের সাথে আলাপরত রবার্ট ওপেনহাইমার। ওপেনহাইমার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমা প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন ও পরে এই বোমা সৃষ্টির জন্য আক্ষেপ করেন। তাঁর কাজে কৃষ্ণ বিবরের প্রথম ধারণা পাওয়া যায়। 

 

অনেক বিজ্ঞানীর মতে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিম বিশ্বের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই যদি না হত, তা হলে ওপেনহাইমেরর গবেষণা দল নিঃসন্দেহে কয়েক সৌর ভরের বেশী তারাদের চূড়ান্ত অন্তঃপতনকে যে নিউট্রন অপজাত চাপ দিয়ে আটকানো যেত না তা বের করে ফেলতেন। কারণ সেই সময়েই ওপেনহাইমার তাঁর আর একজন ছাত্র হার্টমান স্নাইডারের সঙ্গে সোয়ার্ৎসচাইল্ড মেট্রিক নিয়ে কাজ করে দেখান যে, একটি তারার অন্তর্মুখী পতন যখন রোধ করা যাবে না, তখন বাইরে থেকে একজন দর্শক তারাটির পৃষ্ঠদেশ ধীরে ধীরে ছোট হতে দেখবে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে দর্শক সেই অন্তঃপতন আর দেখতে পাবে না কারণ মহাকর্ষের প্রভাব আলোর তরঙ্গদৈর্ঘকে প্রায় অসীম করে তুলবে যা কিনা আমরা নিরীক্ষণ করতে পারব না। কিন্তু ওপেনহাইমার এই চিন্তাটাকে আর প্রসারিত করলেন না যদিও এই কাজটির মধ্যে কৃষ্ণ বিবরের পুরো ধারণাটাই বর্তমান ছিল। তাঁর সৃষ্ট পারমাণবিক বোমার ধ্বংসরূপ দেখে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরে ওপেনহাইমার হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং বস্তুতভাবে নানান রাজনৈতিক চাপের কারণে তাঁর সক্রিয় গবেষণার সমাপ্তি হয়। এমনকি তাঁকে সোভিয়েত গোয়েন্দা হিসেবে সন্দেহ করা হয় ও তাঁর নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স কেড়ে নেয়া হয়। ওপেনহাইমার সক্রিয় গবেষণা থেকে সরে যান।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রে জন হুইলার কৃষ্ণ বিবর গবেষণায় নেতৃত্ব দেন যদিও আদিতে তিনি কৃষ্ণ বিবর ও সিংগুলারিটি আইডিয়াতে বিশ্বাসী ছিলেন না, এবং আইনস্টাইন ও এডিংটনের মতই ভেবেছিলেন একটি পতনশীল তারাকে কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, হয় বিকিরণ বা ঘূর্ণন অথবা বিস্ফোরণ, সিংগুলারিটির অদ্ভূত পরিণতি থেকে বাঁচাবে। ধীরে ধীরে হুইলার একটি বিশাল তারা যে কৃষ্ণ বিবরে রূপন্তরিত হতে পারে সেটিতে বিশ্বাসী হতে থাকেন এবং ১৯৬৭ সনে ব্ল্যাক হোল নামটি ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ও তার অবব্যহিত পরেও মার্কিন দেশের মত সোভিয়েত বিজ্ঞানীরাও পারমাণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। স্তালিনের সময় বহু সোভিয়েত বিজ্ঞানীকে অন্তরীণ করা হয়, এদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। শুধুমাত্র ১৯৫০-এর দশকের শেষে, স্তালিনের মৃত্যুর পরে অনেক পদার্থবিদের সুযোগ হয় তাত্বিক বিজ্ঞানে তাঁদের কাজে ফিরে যাবার। তখন তারা তাঁদের মনোযোগ কৃষ্ণ বিবর গবেষণায় নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ইয়াকভ জেলদোভিচ, ভিতালি গিনজবুর্গ এবং ইগর নভিকভের নাম উল্লেখযোগ্য। ব্ল্যাক হোল নিয়ে আইনস্টাইন বা এডিংটন, বা হুইলারের আদি অবস্থানের মত তাঁদের কোনো দ্বিধা ছিল না, এবং কৃষ্ণ বিবরের প্রকৃতি নির্ধারণে তাঁরা বিশেষ অবদান রাখলেন।


৫. সাধারণ আপেক্ষিকতার পুনর্জাগরণ

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী ২০ বছর বিজ্ঞানীরা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। এই সময়টা ছিল কণাপদার্থবিদ্যা, কোয়ান্টাম তড়িৎবলবিদ্যা ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের। সাধারণ আপেক্ষিকতা নতুন জীবন পায় দুটি বড় পর্যবেক্ষণগত আবিষ্কার ও কিছু তাত্বিক অগ্রগতির ফলে। ১৯৬৩ সনে যুক্তরাষ্ট্রে মারটেন স্মিড মহাকাশে অতি-উজ্জ্বল কোয়াজার (এখন আমরা জানি এগুলো গ্যালাক্সির শক্তিশালী কেন্দ্র যা কিনা ব্ল্যাক হোল থেকে শক্তি পায়) ও ১৯৬৪ সনে উইলসন ও পেনজিয়াস মহাজাগতিক বিকিরণ (মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড) আবিষ্কার করেন, বিগ ব্যাং মডেলে মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে এরকম বিকিরণের একটা ভাবীকথন ছিল। প্রায় একই সময়ে রয় কের ঘুরন্ত তারার কাছে আইনস্টাইনের সমীকরণের একটি সমাধান (মেট্রিক) বের করলেন। EHTর ব্ল্যাক হোল ছবিটির জন্য রয় কেরের মেট্রিক ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজ রজার পেনরোজ কৃষ্ণ গহবরের ভেতরে স্থান-কালের চরম বক্রতায় অসীম ঘনত্ব (সিংগুলারিটি) সৃষ্টি হবে সেটা প্রমাণ করলেন। এই সবক’টি আবিষ্কারেই সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রয়োগ আছে, এর সাথে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা তখন একটা নতুন অঙ্গণে প্রবেশ করল। এই নতুন সময়ে ১৯৬০এর দশকে, স্টিফেন হকিং তাঁর পিএইচডি থিসিস লেখেন। সেখানে তিনি মহাবিশ্বের ঊষালগ্নে সমসত্ব বস্তু-ঘনত্ব থেকে পৃথক পৃথক গ্যালাক্সি সৃষ্টির সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করেন, মহাবিশ্বের আদি ও অন্তের সিংগুলারিটির সম্ভাবনার কথা লেখেন । ঐ সময় থেকেই পেনরোজের সঙ্গে হকিংএর বিজ্ঞানিক সহযোগিতা শুরু হয় এবং এই দুজনে মিলে পরবর্তী দশ বছরে কৃষ্ণ গহবর বিজ্ঞানকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন। 


চিত্র ৮: স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ, ২০১৭ সনে। এই দুজনে কৃষ্ণ বিবর বিজ্ঞানকে সুদৃঢ় তাত্বিক ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেন।

 

হকিংয়ের ১৯৬৫ সনের পিএইচডি থিসিসে অমল কুমার রায়চৌধুরীর নাম রেফারেন্সে উল্লিখিত হয়েছে, রায়চৌধুরীর একটি সমীকরণটিকে ভিত্তি করে সিংগুলারিটির সম্ভাবনা গণনা করা হয়েছে। অমল রায়কৌধুরী ১৯২৩ সনে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০-এর দশকে কলকাতার আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতার মধ্যেও সময় বের করে তিনি পরপর তিনটি গবেষণাপত্র লেখেন যেগুলো পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে উচ্চমানের Physical Review পত্রিকায় বের হয়। তাঁর তিন নম্বর গবেষণাপত্রটি ছিল যুগান্তকারী যেটা ১৯৫৫ সনে বের হয়। অমল রায়চৌধুরীর লব্ধ সমীকরণ মুক্ত বস্তুকণার পথকে বক্র স্থান-কালে বর্ণনা করে। এই ধরণের বর্ণনা পুরোপুরিই জ্যামিতিক এবং আইনস্টাইনের সমীকরণের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং আইনস্টাইনের সমীকরণের সঙ্গে রায়চৌধুরী সমীকরণ যুক্ত করলে শক্তি ও ভরবেগ কেমন করে বস্তুর গতিপথ নির্ধারণ করে সেটা পাওয়া যায়। স্টিফেন হকিং রায়চৌধুরী সমীকরণের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেটা ব্যবহার করে দেখালেন মহাবিশ্বের শুরুতে অতিঘন অবস্থায় সিংগুলারিটি বিরাজ করবে। সিংগুলারিটি তখনই হবে যখন রায়চৌধুরী সমীকরণ অনুযায়ী বস্তুকণার (বা আলোর) পথসমূহ বক্রস্থানে একজায়গায় মিলিত হবে। 

চিত্র ৯: অমল রায়চৌধুরী। তাঁর সমীকরণ সিংগুলারিটি কীভাবে সৃষ্টি হতে পারে তা নির্দেশ করে।


সাধারণ আপেক্ষিকতা একটা দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসেছে। আইনস্টাইন যখন তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করেন তাঁর কয়েক বছরের মধ্যেই সেটির সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় বুধ গ্রহের অনুসূরের স্থান পরিবর্তনকে সঠিকভাবে বুঝতে, সূর্যের পেছনে অবস্থিত তারার আলোর পথ বিশ্লেষণ করে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে দেশ-কালের বক্রতা নির্ধারণ করতে এবং মহাবিশ্বের অস্থিত প্রসারণ আবিষ্কার করে। কিন্তু পরবর্তী ৪০ বছর ছিল কণা বিজ্ঞানের সময়। আইনস্টাইন নিজে একজন কোয়ান্টাম বিদ্যার জনক হয়েও তাতে আস্থা রাখতে পারেন নি, নতুন আবিষ্কৃত নিউক্লীয় দুর্বল ও সবল মিথষ্ক্রিয়া নিয়ে তেমন মাথা ঘামান নি। অন্যদিকে একটি বড় তারার অন্তিম পরিণতি কৃষ্ণ বিবরে হবে এই ধারণাটি মানতে পারেন নি, সেইজন্য পরবর্তীকালে তাঁর নিজের সমীকরণের নানাবিধ সমাধানেও তেমন মনোযোগ দেন নি। তাঁর সমীকরণের সমাধানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পাওয়া যায়, এই নিয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধও আছে, কিন্তু সেগুলোতে এই তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর দ্বিধা স্পষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে তাঁর কাজকে ভিত্তি করেই। আজ কৃষ্ণ বিবর, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, মহাবিশ্বের প্রসারণ এরকম চমকপ্রদ জিনিসগুলোকে ব্যাখ্যা করা ছাড়াও সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র আমাদের দৈনন্দিন জিপিএস সংকেত, যা পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকে দেখায়, সেটিকে নির্ধারণ করতে ব্যবহার করা হয়। বলা যায় সঠিক সময়, এমন কি পৃথিবীর বুকেও, নির্ধারণ করতে সাধারণ আপেক্ষিকতা অপরিহার্য। এটা ভাগ্যের পরিহাসই বলতে হবে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দেবার এক শ বছর পরে এই তত্ত্ব আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে ফিরে এসেছে এমন বিজয়ের পতাকা নিয়ে যা আইনস্টাইন নিজে কল্পনা করেন নি।

 


৬. কৃষ্ণ বিবরের বাস্তব অস্তিত্ব

১৯৬০-এর দশকে জ্যোতির্বিদরা Cygnus X-1 নামে একটি খগোল বস্তু আবিষ্কার করেন যেটি প্রচুর পরিমাণে এক্স-রে বিকিরণ করছিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন এই সিস্টেমটিতে ২০ সৌর ভরের একটি অতিদানব নীল তারা ও ১৫ সৌর ভরের একটি ক্ষুদ্র তারা (যাকে দৃশ্যমান আলোয় দেখা যাচ্ছিল না) একে অপরের চারদিকে ঘুরছে। তাঁরা ১৫ সৌর ভরের তারাটিকে কৃষ্ণ বিবর বলে চিহ্নিত করলেন। এই হল প্রথম সম্ভাবনাময় ব্ল্যাক হোল। আমার মনে পড়ে ১৯৭৪/৭৫ সালে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় দেশ পত্রিকায় আমি প্রথম কৃষ্ণ বিবর নামটি দেখি যেখানে Cygnus X-1 নিয়ে একটা আলোচনা ছিল। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনার সময় দূরবীন দিয়ে Cygnus X-1 কে কয়েক রাত্রি ধরে পর্যবেক্ষণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল।

১৯৭০-এর দশকে জ্যোতির্বিদরা বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে দানবীয় কৃষ্ণ বিবরের সন্ধান পান যেগুলির ভর কয়েক লক্ষ থেকে কয়েক শ কোটি সৌর ভরের সমান। তবুও অনেক বিজ্ঞানীই কৃষ্ণ বিবরের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে আইনস্টাইনের মতই সন্দিহান ছিলেন। এরপর, কয়েক বছর আগে, এলো LIGO পর্যবেক্ষণ যা কিনা দুটি কৃষ্ণ বিবরের সংঘর্ষে উৎপন্ন মহাকর্ষ তরঙ্গ নিরূপণ করল। কিন্তু যেহেতু কৃষ্ণ বিবরের সংঘর্ষ মহাকর্ষ তরঙ্গ ছাড়া তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ (অর্থাৎ দৃশ্যমান আলো, বেতার তরঙ্গ, এক্স-রে, গামা রশ্মি ইত্যাদি) সৃষ্টি করে না তাই স্বাধীনভাবে LIGOর ফলাফলকেও অনেকে পুরোপুরি মানতে পারছিলেন না। বিশেষতঃ যখন বলা হচ্ছিল ওই কৃষ্ণ বিবরগুলোর ভর সূর্যের চাইতে ৩০ কি ৪০ গুণ বেশী। সূর্যের চেয়ে ৪০-গুণ বেশী ভরের ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি করতে হলে আদি তারাকে বিশাল ভরের হতে হবে। শুধুমাত্র তখনই, ২০১৭ সনে যখন LIGO দুটি নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষের ফলাফলে মহাকর্ষ তরঙ্গ মাপতে পারল, যেই সংঘর্ষ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গেও দেখা গেল, তখন LIGOর কৃষ্ণ বিবরের পর্যবেক্ষণকে পুরোপুরি মেনে নেয়া গেল। আর এখন EHT দূরবীনের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের ছায়াকে সরাসরি দেখা গেল। কাজেই কৃষ্ণ বিবরের যে বাস্তব অস্তিত্ব আছে সেটা আজ প্রায় সব বিজ্ঞানীই মানছেন। আমাদের সাধারণ বোধ যেমন প্রকৃতির কোয়ান্টাম কার্যকলাপে বিস্মিত হয়, প্রকৃতির খেয়ালীপনায় সিংগুলারিটি সৃষ্টিতেও চমৎকৃত হয়। 

আইনস্টান নিজে খেয়ালীপনায় সেরকম বিশ্বাস করতেন না, যদিও তাঁর অগোছালো চুলের যে ছবিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, তাতে তাঁকে মন-ভোলা খেয়ালী বিজ্ঞানী হিসেবেই আমরা দেখি। কোয়ান্টাম তত্বে ভরসা না রেখে তিনি জীবনের শেষ ২৫টি বছর আপেক্ষিকতা ও তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রতত্ত্বের সংমিশ্রণে পদার্থবিদ্যার চূড়ান্ত নীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। ‘প্রকৃতি জুয়া খেলবে না’ এই জীবন দর্শন তাঁকে এমন এই পথে পরিচালিত করে; তাঁর সেই উদ্যোগ সফল হয় নি। এই প্রসঙ্গে আমি সত্যেন বসুর কথা উল্লেখ না করে পারছি না। সত্যেন বসু আইনস্টাইনকে গুরুদেব বলে মানতেন, আমার মনে হয় গুরুদেবের কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে আস্থাহীনতা সত্যেন বসুকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় গবেষণায় অনুৎসাহীত করে। তাই ১৯২৪ সনে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান বিদ্যার জনক হয়েও সত্যেন বসু পরবর্তীকালে আর এই নিয়ে গভীর গবেষণা করেন নি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে আমরা একটা স্বাধীন, অনপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া ভাবি, কিন্তু তাতে ব্যক্তিগত দর্শন ও মতামতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শেষাবধি অবশ্য বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠা পাবে, শুধু তার পথ্টা বন্ধুর হবে।

 
———————————————————
দীপেন ভট্টাচার্য, জ্যোতির্বিদ ও অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ঢাকা থেকে তাঁর ৬টি উপন্যাস ও গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।