লিখেছেন: রুবি জাহান

আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ; নাম শুনলেই ভেতরে একটা আবেগ কাজ করে যে, এটা আমাদের নিজেদের জন্মভূমি। কিন্তু একদিক দিয়ে আমরা অনেকেই এ কথা ভেবেও চিন্তিত হই যে, আমাদের দেশ বাংলাদেশের সমাজ অনেক রক্ষণশীলতাবাদী; আমরা আমাদের প্রিয় মানুষটির সঙ্গে চাইলেই যত্রতত্র দেখা করতে পারিনা এবং পারিনা নিজেদের ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে বাসা ভাড়া নিতে, অবাক হলেন নিশ্চয়ই, যে স্বামী-স্ত্রী বাসা ভাড়া নেবে এতে আবার সমস্যা কোথায়, তারা তো খুব সহজেই নিতে পারে; কিন্তু আমি স্বামী-স্ত্রীর কথা বলছিনা, আমি বলছি প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে ছাড়াই একত্রবাসের কথা। হ্যাঁ, বিয়ে ছাড়া একত্রবাস বা ইংরেজিতে live-in relationship বা living together.

একত্রবাস [ ছবি: ইন্টারনেট থেকে ]

বিয়ে ছাড়া একত্রবাসের তথ্য বাংলা সাহিত্যে আমি সর্বপ্রথম দেখি হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ নামক উপন্যাসে যদিও আমি বিয়ে ছাড়া একত্রবাসের ইংরেজি প্রতিশব্দ এবং এর অর্থ আগেও জানতাম তবে বাংলা সাহিত্যে খুব ভালো করে বিষয়টি ফুটিয়ে তুলিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ তার ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’-এ, এই উপন্যাসে হাসান রশিদ নামের মূল চরিত্র বিয়ে ছাড়া একত্রবাসের কারণে মার খান, উপন্যাসের শেষের দিকটা হাসান রশিদের করুণ পরিণতি দেখায়। হুমায়ুন আজাদ উপন্যাসটি লিখেছিলেন নব্বইয়ের দশকে, তিনি যদি এখনো বেঁচে থাকতেন তবে বাংলাদেশের সমাজে প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনের বিভিন্ন সমস্যা দেখে অবশ্যই মন্তব্য করতেন।

আপনি কি মনে করেন, যে আমাদের বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীর সমাজ যথেষ্ট প্রগতিশীল যেখানে নারী এবং পুরুষের অবাধ মেলামেশা রয়েছে, আপনি যদি ঢাকা কখনো না এসে থাকেন বা ঢাকা সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন তাহলে জেনে নিন যে, ঢাকা মোটেও প্রগতিবাদী নগর নয়, ঢাকা হচ্ছে রক্ষণশীল, পুরুষতান্ত্রিক এবং ইসলামপন্থীদের শহর। ঢাকায় ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে সহজে কথাই বলতে পারেনা, প্রেমই সহজে করতে পারেনা সেখানে বিয়ে ছাড়া একত্রবাস অনেক দূরের জিনিস; ঢাকায় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ রয়েছে যেটি অনেক ইতিহাসের সাক্ষী, অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আড্ডা দিয়েছে, দিচ্ছে; হুমায়ুন আজাদের ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ছিলো ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হুমায়ুন আজাদ প্রেমের চিত্র অঙ্কন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পটভূমিতে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়জন প্রেমিক-প্রেমিকা বিয়ে ছাড়া একত্রবাস করেছে বা করে? এর উত্তর হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে গোণা কয়েকজন প্রেম-যুগল বিয়ে ছাড়া একসাথে থাকতে পারছে এবং পেরেছে; অবশ্য যুগলদের মন-মানসিকতাও রক্ষণশীল, সবাই যে বিয়ে ছাড়া একসাথে থাকার চিন্তা মাথায় আনে তা কিন্তু না; অল্প কিছু যুগল আনে আবার অনেকে আছে মাথায় এই রকম চিন্তা আনলেও তারা বিয়ে ছাড়া একত্রবাসকে ঋণাত্মক মনে করে এই দিকে পা বাড়ায় না।

ভারতের উচ্চ আদালত দুই বছর আগে প্রাপ্তবয়স্ক যুগলদের বিয়ে ছাড়া একত্রবাস অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছে, শুধু তাই নয় ভারতের আইনে সমকামিতাও আর শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। তবে প্রশ্ন হলো যে, ভারতের আইনে এতো ভালো ভালো জিনিস এলেও ভারতের সমাজে কি ছেলেমেয়েরা অবাধ মিশতে পারছে? আমার এর সঠিক উত্তর জানা নেই যদিও তবে প্রায়ই ভারতের বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যমে আমি অনেক খবর পড়ি যেমন, বিয়ে ছাড়া একত্রবাসের কারণে প্রেমিক খুন কিংবা ভিন্ন ধর্মের হয়ে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার কারণে খুন কিংবা আরো দেখি ভালোবাসা দিবসে প্রকাশ্য চুম্বনের কারণে প্রেমযুগল প্রহারের শিকার ইত্যাদি। এইগুলো আসলে কি আমার জানা নেই তবে আমি বলবো আমাদের দেশে আমরা প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রকাশ্য চুম্বন বা বিয়ে ছাড়া একত্রবাস করতে যেয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারিনা; না আমাদের দেশে সমকামীরা আইনের আশ্রয় নিতে সমর্থ হয়।

প্রেমিক-প্রেমিকারা আগেকার যুগে আমাদের দেশে বিয়েই করে এসেছে; যুগলদের এখনো ৯০ শতাংশের উপরে বিয়েই করছে; বিয়ে ছাড়া একত্রবাসের কোনো প্রচারণা বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই, আইনসিদ্ধ তো নয়ই। যারা বিশ্বাস করেন যে বিয়ে হচ্ছে একটি পুরুষতান্ত্রিক এবং রক্ষণশীল মতবাদের অংশ তারা কিন্তু চাইলেই বাংলাদেশের সমাজে বিয়ে ছাড়া একত্রবাস করতে পারবেননা, অনেক ঝামেলায় পড়তে হবে তাদেরকে। বাংলাদেশের সমাজে বিয়ে ছাড়া একসাথে থাকতে গিয়ে অনেক নারীই তাদের প্রেমিকদের হাতে খুন হয়েছেন, আমরা এই রকম সংবাদও বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে দেখেছি, কি রকম পুরুষতান্ত্রিক আমাদের বাংলাদেশী পুরুষেরা যারা নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে খুন করতেও কার্পণ্য করেনা। সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা চলার কারণে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পায়না, পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা তো এটাই যে, ছেলে হয়ে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবেনা, প্রেম করা যাবেনা, মেয়ে মানেই আমাদের সমাজে হচ্ছে বোন, মা এবং স্ত্রী; পুরুষ আগে রোজগার করবে তারপর বিয়ে করতে পারবে না হলে পারবেনা; ঠিক এই কারণেই আমাদের দেশে ছেলেরা চাকরিজীবী না হলে বিয়ে করেনা বা করতে পারেনা, পুরুষরা পুরুষতন্ত্রবাদী নীতিতেই গুঁতা খায় আবার মেয়েদেরকে পাষাণ বলে গালি দেয় যে তারা (মেয়েরা) তো ছেলেদের সঙ্গে কথাই বলেনা; আরে ভাইয়েরা আগে সমাজ থেকে পুরুষতন্ত্রবাদ এবং ইসলামী মৌলবাদ মুছুন দেখবেন যে, মেয়েরা ঠিকই কথা বলছে।