লিখেছেন: পলাশ বাউরি

আমাদের বাড়ির পাশের চা দোকানে দুজন বৃদ্ধ কী বিষয়ে যেন তর্ক করছিল। কাছে গিয়ে মন দিয়ে শুনতেই বুঝলাম তাঁরা ঈশ্বর নিয়ে তর্ক করছে। একজন বৃদ্ধ বলছে যে ঈশ্বর নাকি সর্বশক্তিমান এবং তিনি সবকিছুই করতে পারেন। আরেকজন বৃদ্ধ বলছে যে এটা কোনো মতেই সম্ভব নয় , নিশ্চয়ই তার শক্তির কোন সীমা আছে , আর তা যদি নাই থাকত তাহলে তিনি কেন পৃথিবীর সব খারাপ লোকগুলোকে সরিয়ে ফেলছেন না। এভাবেই চলছিল তাদের যৌক্তিক অযৌক্তিক সম্বলিত তর্ক। আমি কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনতেই আমারও মনে প্রশ্ন জাগল , যদি সত্যিই ঈশ্বর বলে কিছু থাকে তাহলে সেই ঈশ্বর কি সর্বশক্তিমান যেমনটি ধর্মগ্রন্থগুলিতে দাবি করা হয় ?

ইন্টারনেট পাড়ায় এবিষয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই খোঁজ পেলাম “সর্বশক্তিমান প্যারাডক্সের” , যা মনে হল আমাদের এই আলোচনাতে সাহায্য করবে। তবে শুরু করার আগে আমাদের এই লেখার খাতিরে ধরে নিতে হবে যে , ঈশ্বর বলে সত্যিই কিছু আছে (তাদেরর জন্য যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না) । তবে প্যারাডক্সটি বোঝার আগে , ‘প্যারাডক্স’ আসলে কি সেটা জেনে নেওয়া উচিত।

প্যারাডক্স (Paradox) বা বাংলা অর্থে কূটাভাস এককথায় হল একটি অসঙ্গতি। সাধারণত প্যারাডক্স বলা হয় সেই সব বাক্য বা উক্তিকে যা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। নিজের বক্তব্যের সাথে নিজেই সংঘর্ষ করে , এই হল প্যারাডক্স। একটা উদাহরণ দিলে ব্যপারটা আরেকটু সহজভাবে বোঝা যাবে –

ধরো, আমি তোমাকে নিচের দুটি বাক্য লিখে দিলাম –
১। নিচের লাইনটি সত্য।
২। উপরের লাইনটি মিথ্যা।

এবার বলতো উপরের কোন লাইনটি সত্য ? প্রথম বাক্যটি সত্য হলে দ্বিতীয় বাক্যটি মিথ্যা; আবার যদি দ্বিতীয় বাক্যটি সত্যি হয় তাহলে প্রথম বাক্যটি মিথ্যা । প্রথম দেখায় ব্যপারটা সহজ মনে হলেও, আসলে এগুলো একটা অন্তহীন চক্রের মতো। মাথায় একটু জোর দিয়ে ভাবলেই দেখবে একেবারে মাথার চুল ছেঁড়ার উপক্রম হয়ে যাবে। অনেকে প্যারাডক্সকে ধাঁধার সাথে তুলনা করে কিন্তু আমার মনে হয় এটাকে ঠিক ধাঁধা বলা চলে না।

আশা করি , প্যারাডক্স কী সেটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি , এবার চলো তাহলে আমাদের মুল আলোচনা সর্বশক্তিমান প্যারাডক্সে ফেরা যাক।

আমরা সব ধর্মগ্রন্থ এমনকি লোকমুখে শুনেও অভ্যস্থ যে ঈশ্বর বর্তমান এবং তিনি নাকি সর্বশক্তিমান , তিনি সবকিছুই করতে পারেন। আচ্ছা এটা যদি সত্যি হয় তাহলে ঈশ্বর কি এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে অক্ষম ? নিজেই ভেবে দেখো…
এটিই হল ঈশ্বর প্যারাডক্স বা গড প্যারাডক্স বা সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স। ভেবে দেখো যদি ঈশ্বর এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে পারবেন না , তাহলে এমন একটি কাজের সন্ধান পেলাম যেটা ঈশ্বর করতে পারেন না।

আবার যদি তেমন একটি পাথর তৈরিতে তিনি অক্ষম হন তাহলে সহজভাবেই আমরা এমন আরেকটি কাজের সন্ধান পেলাম যেটা ঈশ্বর করতে পারেন না।
পূর্বোক্ত একটি উক্তিও যদি সত্য হয় তাহলে বলা চলে যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নয় ।

যুক্তিবিজ্ঞানে কোন জটিল সমস্যাকে সমাধানের জন্য সেটাকে অনেক ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করা হয় , চলো আমরাও সেটাই চেষ্টা করি –
সর্বশক্তিমান প্যারাডক্সের মুল প্রশ্নটি হল – যদি ঈশ্বর সবকিছু করতে সক্ষম হন তাহলে কি তিনি এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারবেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে অক্ষম ?
প্রশ্নটিকে যদি আমরা একটি বাক্যে প্রকাশ করি তাহলে সেটা কিছুটা হবে এইরূপ – ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন , অর্থাৎ তিনি এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারবেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে অক্ষম।

বাক্যটিকে যদি কয়েকটি খণ্ডবাক্যে বিভক্ত করি –
১। ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন।
২। ঈশ্বর সবকিছু তুলতে পারেন। (কারণ ১ম বাক্য)
৩। ঈশ্বর একটি ভারি পাথর তৈরি করতে পারেন যেটি তুলতে তিনি অক্ষম। (কারণ ১ম বাক্য)
৪। ঈশ্বর তার তৈরি করা পাথর তুলতে পারবেন না। (কারণ তিনি এমন একটি ভারি পাথর তৈরি করেছেন যেটি তিনি তুলতে অক্ষম)

১ম, ২য় এবং ৩য় বাক্যগুলিকে সর্বদা সত্যি হতে হবে। এবার আমাদের দেখতে হবে যে ৪র্থ বাক্যটি সত্য কিনা?
যদি ৪র্থ বাক্যটি সত্য হয় তাহলে ২য় বাক্যটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যাবে অর্থাৎ ১ম বাক্যটিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যাবে।
৪র্থ বাক্যটি সত্যি হলে (যা ৩য় বাক্যটি সত্য হলে হবেই) ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান হওয়ার পথে মুল যুক্তি “ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন” মিথ্যা হয়ে যাবে। এখন স্বাভাবিকভাবেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে , ঈশ্বর কখনই দুটি পরস্পর বিরোধী কাজ করতে পারেন না , যথাক্রমে ২য় ও ৪র্থ বাক্য। অর্থাৎ ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন না অতএব ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নয়।

আবার আস্তিকেরা বলবেন যে এইসবকিছু আলোচনা স্ট্রম্যান ফ্যালাসি দ্বারা আক্রান্ত, তাই আমাদের উচিত কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে আস্তিকদের যুক্তিগুলিও শোনা।
প্রথমে আস্তিকেরা যেটা বলবে সেটা হল সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স নাস্তিকদের একটি কুযুক্তিমাত্র এবং এর প্রধান উক্তির প্রশ্নটিই ভুল প্রশ্ন। উদাহরণ হিসাবে তারা বলবে যে, কোন চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমি কেন চুরি করেছো, বলো” । এবার এই প্রশ্নের উত্তরে ওই ব্যাক্তি যাই বলুক না কেন, সে চোর সাব্যস্ত হবেই। ওই ব্যাক্তি যদি দোষী না হয়ে থাকে তাহলে তার একমাত্র যুক্তিপূর্ণ উত্তর হতে পারে, প্রশ্নটির ত্রুটি প্রশ্নকর্তাকে ধরিয়ে দেওয়া।

আস্তিকেরা আরও বলবেন যে, যখন তাঁরা বলেন যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তখন তাঁরা সেটির আক্ষরিক অর্থ বোঝান না বরং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও পরিচালনার জন্য যে অসীম ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, ঈশ্বর সেই অসীম শক্তিরই আধান মনে করা হয়।
তারা বলেন যে ঈশ্বর ও শক্তি দুয়েই অসীম। তাকে কোনো বাঁধাধরা সীমারেখার মধ্যে ফেলা যায় না। যদি তিনি ইচ্ছা করেন যে এমন একটি ভারি পাথর তৈরি করবেন তাহলে তিনি সমান্তরালভাবে একইসাথে উত্তোলনযোগ্য শক্তিশালীও থাকবেন আবার অনুত্তোলনযোগ্য দুর্বলও থাকবেন। আস্তিকেরা বলেন যে ঈশ্বর ও ঈশ্বরের শক্তি আমাদের মত সাধারণ মানুষের সীমিত বোধগম্যতার বাইরে , কারণ সাধারণ মানুষের যুক্তিবিচার অর্থাৎ যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌছানোর প্রক্রিয়া খোদ ঈশ্বরেরই সৃষ্টি।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স একেবারেই ত্রুটিহীন নয়। আবার আস্তিকদের যুক্তিহীন যুক্তিও মেনে নেওয়া যায় না । আস্তিকদের যুক্তি খণ্ডন করতে হলে আমাদের আগে ঈশ্বর আছে কি নেই তার সিদ্ধান্তে আসতে হবে, তবে সে বিষয় যুক্ত করে আমার এই আলোচনার আকার বৃদ্ধি করে আমার পাঠকদের আর কষ্ট দিতে চাই না। তাছাড়া এবিষয়ে ইন্টারনেট পাড়ায় বহু নিবন্ধ , প্রবন্ধ ও বই ইতিমধ্যে বর্তমান আছে, যাদের মধ্যে প্রবীর ঘোষের ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা?’ বইটির কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে । এই বইতে লেখক আস্তিকদের বিভিন্ন মতবাদকে যুক্তিপূর্ণভাবে খণ্ডন করেছেন।

আবার যদি আমাদের মুল আলোচনার সিদ্ধান্তের কথায় আসি তবে আমাকে বাধ্য হয়ে বলতেই হয় শেষ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নির্ভর করছে তোমার ব্যাক্তিগত বিশ্বাস ও মতবাদের উপর কারণ আস্তিকদের মতবাদ ও বিশ্বাস এবং নাস্তিকদের সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স কোনোটিই শতভাগ ত্রুটিহীন নয়। তোমার যদি বিশ্বাস হয় ঈশ্বরে তাহলে তোমার কাছে ঈশ্বর বর্তমান ও তিনিই সর্বশক্তিমান এবং তোমার যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তাহলে তোমার কাছে ঈশ্বর বলে কিছু নেই তাই সর্বশক্তিমান হওয়ারও কোনো প্রশ্নই নেই।তবে আমার ব্যাক্তিগত মত যে কোনো বিশ্বাস বা মতবাদের পক্ষে কট্টরপন্থী হওয়া উচিত নয়। আমাদের বিজ্ঞানের মত নমনীয় বা ফ্লেক্সিবেল হওয়া উচিত। যেমন বিজ্ঞান কয়েকবছর আগে পর্যন্ত বলত যে অনুই পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ কিন্তু পরবর্তীকালে তা ভুল প্রমাণিত হলে বিজ্ঞান তার ভুল শুধরে নিতে একবারও দ্বিধাবোধ করেনি । আমাদেরও এমনি হওয়া উচিত । নিজের মতবাদ বা বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হলে সেটিকে শুধরে নিতে দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়, তবেই না গড়ে উঠবে এক সুন্দর সুস্থ পৃথিবী।