লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বরখাস্ত-মেজর জিয়া উল হক সহ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের পাঁচ সদস্যকে আজ ঢাকার একটি আদালত সাজা দিয়েছে। এই নির্মম হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী- মেজর জিয়া উল হক – পলাতক; কর্তৃপক্ষের তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। এও লক্ষণীয় যে, তদন্তকারীরা এই হত্যাকাণ্ডে ১২ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার পরেও ছয়জন চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছিল কারণ এই ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন মুকুল রানা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন তথাকথিত ক্রসফায়ারে মারা গিয়েছিল। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করি যে, অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদের সাক্ষ্য নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছিল, যিনিও একই হামলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমরা অনুভব করি যে সরকার এই মামলাগুলো বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় চরমপন্থা নির্মূলের কোনও সৎ অভিপ্রায় ছাড়াই পরিচালনা করেছে।

অভিজিৎ রায় হত্যার ছয় বছর হয়ে গেছে। সরকার প্রথমে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে কোন ব্যবস্থা নিতে অনীহা দেখায় এবং এর ফল হিসাবে অভিজিৎ হত্যার কয়েক মাসের মধ্যেই ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলয় চক্রবর্তী এবং ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়েছিল। এই লেখকরা পুলিশ আশ্রয় চেয়েছিলেন কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও সমর্থন পাননি। ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য লেখক এবং প্রকাশকের উপরও আক্রমণ হচ্ছিল। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে ১৭ বিদেশী সহ ২৮ জন নিহত হয়েছিল; এরপরেই  সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল।

মামলা পরিচালনায় সরকারের মারাত্মক অবহেলার একটা নমুনা এই ভিডিও

জঙ্গীবাদ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষের অনীহা দেশের ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উন্মাদনাকে পুঁজি করে সরকারের ক্ষমতায় থাকার উদগ্র ইচ্ছাকে প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতি উসকে দিতে সরকার মসজিদ নির্মাণ ও ইসলামিক ধর্মযাজকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করেছে। গভীর ইসলামীকরণ ধীরে ধীরে বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ম্লান করে দিচ্ছে । নাস্তিকদের হত্যাকে ওয়াজিব বলে ফতোয়া দেয়া ‘হেফাজতে-ই-ইসলাম’ এবং সরকারের নিজস্ব ইসলামিক শাখার চাপের মধ্যে দিয়ে  নিয়মিতভাবে প্রখ্যাত অমুসলিম ও সেক্যুলার লেখকদের স্কুল পাঠ্যক্রম থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। সরকার উগ্রপন্থী ইসলামী সংগঠনগুলির দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সামনে ‘লেডি অফ জাস্টিস’ এর ভাস্কর্য অপসারণ করে। মেয়েদের  বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ এর ব্যতিক্রমের ব্যবস্থা করে সরকার এদের দাবির প্রতি আনুগত্য জানিয়েছে।  সম্প্রতি একটি আদালতের রায়ে মুসলিম বিবাহ নিবন্ধিত করার জন্য মহিলাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার অধিকার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ডিজিটাল সুরক্ষা আইন নামে একটি উদ্ভট আইন প্রণয়ন করছে যেখানে ধর্মীয় অনুভূতি লঙ্ঘনকারীকদের কারাদন্ড ও জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আমরা স্পষ্ট বলছি যে, বাংলাদেশ সরকার কেবলমাত্র অভিজিৎ রায় এবং অন্যান্য লেখকদের হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের ধরতে ব্যর্থ হয়নি, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসারের ক্ষেত্রে বাক-স্বাধীনতা রোধ করেছে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।  প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল অসাম্প্রদায়িক আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ, যা দিক হারাচ্ছে সরকারের অদূরদর্শী ও হঠকারী নীতির ফলে। আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘদিন থেকে দেশটির ইসলামীকরণ ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের মূল সংবিধানের মতাদর্শগত প্রতিশ্রুতিকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছে এবং জঙ্গীবাদিদের উত্থান ঘটিয়েছে যার ফলে হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎ রায় সহ জাতির অনেক সূর্যসন্তানকে।