লিখেছেন: ইশরাত জোনাকি
বাঙালি নারীর প্যান্ট-শার্ট পশ্চিমি পোশাককে অনেকেই অপসংস্কৃতি বা বাঙালি সমাজে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে মনে করেন। প্যান্ট-শার্ট কিন্তু নারী-পরাধীনতার প্রতীক নয় বরং হিজাব-বোরকাকেই অপসংস্কৃতি বা বাঙালি সমাজে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কূ-ফল বলা যেতে পারে, কারণ হিজাব প্রায় একভাবেই নারী-পরাধীনতার প্রতীক।
আমরা বাংলাদেশী বাঙালি মেয়েরা সবাই এখন হিজাব শব্দটির সঙ্গে পরিচিত; এই হিজাব আমাদের বাঙালি সমাজে কবে থেকে চালু হয়েছে এই প্রশ্ন করলে আমি বলবো হিজাব বাংলাদেশের সমাজে ২০০০’এর দিকে চালু হয়, তবে ভালো করে চালু হয় ২০১০’এ কারণ আমি এই দশকে হিজাব পরিহিতাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়তে দেখেছি। ঢাকা শহর যেটাকে আমরা বাংলাদেশের অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় প্রগতিশীল বলে দাবি করি এই শহরেই হিজাবী নারীর সংখ্যা অনেক বেশি, বলা যায় বিদ্যালয়গামী ছাত্রী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণী সহ চল্লিশোর্ধ্ব নারীরা মাথায় রঙ-বেরঙের হিজাব পরিধান করেন। হিজাব প্যান্ট-শার্ট পরা মেয়েদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে আমাদের ঢাকা শহরে। ঢাকাকে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে ‘বাঙালি হিজাবিনীদের শহর’।
প্রশ্ন আসতেই পারে এই হিজাব পরার কারণটা আসলে কি? কেন মেয়েরা হিজাব পরে; শিক্ষিত মেয়েরাই বা হিজাব কেন পরছে? আমি অনেক জায়গায় উত্তর পেয়েছি; পুরুষদের যৌন নজর থেকে বাঁচার জন্য হিজাব পরে; কিন্তু হিজাব কি আসলেই মেয়েদেরকে ছেলেদের ঋণাত্মক যৌন নজর থেকে বাঁচায় নাকি ছেলেরা হিজাব দেখে আরো বেশি যৌন-উত্তেজনা লাভ করে! রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক ছেলেরা মেয়েদের মাথা এবং তাদের মাথার চুলকে যৌন-আবেদনময়ী ভাবতে পারে বা হিজাব পরিহিত নারীর চেহারা দেখে ছেলেরা আরো বেশি যৌন-উত্তেজনা প্রাপ্ত হয়; যেহেতু ঢেকে রাখা শরীর – এটা ছেলেদের মধ্যে কৌতূহল আরো বেশি তৈরি করবেই – স্বাভাবিক। হিজাব যে একটি পুরুষতান্ত্রিক পোশাক – এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, হিজাবের উদ্দেশ্য নারীদের মাথার চুলকে ঢেকে পুরুষদের জন্য যৌনাবেদনময়ী করে তোলা – এটা বাস্তবিক; তবে আমাদের সমাজের মেয়েদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয় যে হিজাব মেয়েদেরকে ছেলেদের যৌন নজর থেকে বাঁচায়! আশ্চর্যজনক একটা অবস্থা, মেয়েরাও মানুষ, ছেলেরাও মানুষ, মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের বন্ধুত্ব না করতে দিয়ে এই মধ্যপ্রাচ্যীয় সংস্কৃতির পোশাক মেয়েদের মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে সমাজের পুরুষতন্ত্রবাদী ছেলেদেরকে ঠিক না করে সমাজের লোকজন বড়ো বড়ো কথা বলে।
আমি একটু পেছনের দিকে যাই, নব্বইয়ের দশক এবং আশির দশক অর্থাৎ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের বিংশ শতাব্দীর শেষ দুটি দশক; আমার জন্মই যদিও আশির দশকের একেবারে শেষ দিকে এবং নব্বইয়ের দশকে আমি শিশু ছিলাম, তারপরেও বলছি, তখনকার সমাজে হিজাব পরিহিতা নারী দেখাই যেতোনা; ধার্মিক পরিবারের তরুণীরা কালো বোরকা পরতো – তাও এটাও সংখ্যায় কমই ছিলো। ২০০০ সালের দিকে আমি যখন কিশোরী তখনো হিজাবের প্রচলন অতো শক্তিশালীভাবে আমি লক্ষ্য করিনি। যদিও বাংলাদেশের সমাজে তখনো পুরুষতান্ত্রিকতা ছিলো, এখনকার চেয়ে বেশিই ছিলো কিন্তু মেয়েদের পোশাকের উপর পুরুষতান্ত্রিক নজরদারি বা ইসলামপন্থী নজরদারি ভালো করে আসেনি তখনো।
পোশাক পরার স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাসী, আমি মানুষের পোশাক পরার স্বাধীনতাটাকে সমর্থন করি কিন্তু পোশাকের নামে অযৌক্তিকতা বা কপটতা আমি পছন্দ করিনা; হিজাবকে অনেকেই ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা শৈলী হিসেবে চালিয়ে দেয় কিন্তু হিজাব কি আসলেই ব্যক্তি স্বাধীনতা নাকি পোশাকের আড়ালে ব্যক্তি-শৃঙ্খলতা বা শেকলাবদ্ধতা; আজকাল তরুণীরা বিয়ের সময়ও লাল হিজাব পরে, পরছে; প্রেমিকারা তাদের প্রেমিকদের সঙ্গে হিজাব পরে আড্ডা দেয়, দিচ্ছে; একসঙ্গে ঘোরাফেরা করছে, এরা বলে ‘মাই হিজাব, মাই চয়েজ’ – এই ধরণের কথা। পুরুষতান্ত্রিকতাবাদ বাংলাদেশের সমাজে যতোটুকু মুছেছে সেটা হলো মেয়েরা ধর্ষিত হলে তাদের ধর্ষকরা শাস্তির আওতায় আসছে অর্থাৎ ‘নারীসুরক্ষা আইন’-এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে কিন্তু মেয়েদের পোশাক-সংক্রান্ত বিধি-বিধান বাংলাদেশের সমাজে কাদের তৈরি করা? সমাজে তাবলীগের লোকদের দৌরাত্ম্য আছে; আছে বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন যারা মেয়েদের সম্পর্কে অনেক অনেক কথা বলে; অনেক মেয়ে এতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে, তারা নিজেদের জন্য ভালো মনে করে নেয় ইসলামের রক্ষণশীল বিধানগুলো; তারা বোঝেনা যে মানুষ হিসেবে তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেবার জন্যই পুরুষতান্ত্রিক ইসলামপন্থী মোল্লারা তাদের সম্পর্কে কথা বলে, তাদেরকে হিজাব-বোরকা পরতে বলে, ধর্ষণের জন্য মেয়েদের পোশাকের উপর দোষ চাপায়, মেয়েদের বাইরে ঘুরতে নিষেধ করে, ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করে – ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজে বখাটে ছেলেরা যে গাঁজা-মাদক সেবন করে এইগুলো আবার ডানপন্থী মুসলিম সংগঠনগুলো কিন্তু ইচ্ছে করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; কিন্তু তারা কি করে? তারা নিজেরাও পুরুষতান্ত্রিক, বখাটে মাদকসেবীরাও পুরুষতান্ত্রিক; পুরুষতান্ত্রিক পুরুষেরা পুরুষতান্ত্রিক ছেলেদেরকে কিছু বলতে চায়না। অসুস্থ আমাদের সমাজব্যবস্থা।
জন্মভূমির বাঙালিদের প্রগতিশীল ভাবনা ভাবতে সাহায্য করুন। মধ্যপ্রাচ্যীয় ফালতু সংস্কৃতির পোশাক মেয়েদের মাথার উপর না চাপিয়ে বরং সমাজের পুরুষতন্ত্রবাদী ছেলেদের মানসিকতা ঠিক করুন, সুস্থতা আনুন।
হিজাব বাংলাদেশি মেয়েরা মূলত তাদের পরিবারের কথায় পরে। আর ইদানিং তো মেয়েরা আপাদমস্তক বোরকা পরে নিজেদের শরীর ঢেকে রাখছে। বোরকা, হিজাব সবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি, এর চেয়ে আর বেশি কি বলা যেতে পারে, আগেকার যুগে মেয়েরা শাড়ি সালোয়ার কামিজের বাইরে যেতোনা আর এখন বাংলার ঘরে ঘরে হিজাব আর বোরকা। প্রশ্ন হচ্ছে হিজাবি মেয়েরা কি সব ধার্মিক নাকি ওরা ফ্যাশনের জন্য পরছে বা মাথার চুল পরিস্কার রাখার জন্য পরছে কোনটা? মনে তো হয়না সব হিজাব পরিহিত মেয়ে ধার্মিক, এরা অনেকে সমাজকে দেখানোর জন্যও হিজাব পরে, আমাদের সমাজকে পোকায় খাচ্ছে।
বাঙালি নারীর প্যান্ট-শার্ট পশ্চিমি পোশাক অপসংস্কৃতি বা বাঙালি সমাজে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন । প্যান্ট-শার্ট কিন্তু নারী-পরাধীনতার প্রতীক
সত্য কথাই; ঢাকা হচ্ছে হিজাবিনীদের শহর। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও হিজাব পরিহিতারা ফুল দিতে আসে।
কলকাতাতেও প্রচুর হিজাবি মেয়ে দেখা যাচ্ছে আজকাল। যেটা বছর পাঁচ আগেও ছিল না। এমনকি ৩/৪ বছরের মেয়েকেও হিজাব পরানো হচ্ছে (my choice 🤣🤣) ।
তবে এই ব্যাপারে লিবারেলদের ও দায়িত্ব আছে। এমন খোলা মেলা “অশালীন” পোষাক পরছে যে অভিভাবকরা মেনে নিতে পারছে না। এই পোষাক পরিধানের স্বাধীনতা তাদের ক্ষতি করছে বলে তাদের অভিভাবকরা মনে করে। পোষাক নির্বাচনের বিষয়ে যদি একটি সাংস্কৃতিক চর্চার পরিসর থাকতো তা হলে হয়তো অভিভাবকরাও “কিছুটা” স্বাধীনতা মেনে নিত। কিন্তু তারা দেখলো বানিজ্যিক সংস্থাগুলো পোষাক জনপ্রিয় করার পুরো সংস্কৃতিটাই হাইজ্যাক করে নিয়েছে। সেখানে বিরুদ্ধ মতামতের কোন পরিসর রাখা হয় নি। তাই অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের “নিরাপদে” রাখার জন্য কট্টর পন্থা অবলম্বন করেছে।
৩০ বছর আগে যেমন বোরখা ছিল না। তেমনি ৩০ বছর আগে শাড়ির প্রচলন ছিল। “আধুনিক” খোলা মেলা পোষাকও ছিল না।
এই কট্টর পন্থায় পেছনে শরীর প্রদর্শন করার আগ্রাসি সংস্কৃতি দায়ী হতে পারে।
সব শেষে বলি নারী নিগ্রহ সম্পর্কে পোষাকের ভূমিকা নিয়ে লিবারেলদের ধারনা এবং অভিভাবকদের ধারনা আলাদা কেন সেটাও বিশ্লেষণ করা দরকার।
লেখাটা ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ আপনাকে।