অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান আমার গুরু। স্কুলজীবন থেকে যার কথা-আলোচনা-লেখা-বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে! উনার অনেক কিছুই আমার অতি আগ্রহের বিষয়। বাংলা ভাষার পন্ডিতদের মধ্যে যাকে আমি অনন্য প্রতিভা মনে করি। কওমী মাদ্রাসা নিয়ে তিনি অনেক কথাই বলেন। সম্প্রতি কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা নিয়ে আমাদের সময়ে ড. সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্য পড়লাম। সেখানে তাঁর কিছু বক্তব্য আমার কাছে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে। তাঁর যে বক্তব্যগুলো আমার কাছে অধিক অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে সেগুলোকে শিরোনাম রেখে তার একটি সমালোচনা এখানে হাজির করেছি।

 

 

. ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা থাকলে, আরবী মাধ্যমের শিক্ষাকেও নৈতিকতা দেয়া যায়!

ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, আরেকটি হচ্ছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা। একটি হচ্ছে মাধ্যম, অন্যটি হচ্ছে ধারা! মাধ্যম আর ধারার মধ্যে পার্থক্য অনেক! মাধ্যম মানে কোন শিক্ষা-জ্ঞান অন্য কোন ভাষায় গ্রহন করাকে বোঝায়! যে জ্ঞান সার্বজনীন, এবং বিশ্বের যে কোন প্রান্তে স্বীকৃত ও গ্রহনযোগ্য। আর কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা হচ্ছে মুসলমানদের বিভিন্ন মাজহাবের একটি ধারার কাছে স্বীকৃত। কতিপয় দেশেও তার সবটুকু না, আংশিক গ্রহনযোগ্যতা আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ধর্মভিত্তিক শিক্ষার জ্ঞান ধারণা জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে (Academic World) স্বীকৃত না! কারণ এই জ্ঞান কোন ভাবেই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষিতি প্রমানিত না! এজন্য অনেক পন্ডিত একে প্রকৃত শিক্ষা বলতে নারাজ, এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে যেহেতু এই জ্ঞান কোন স্বীকৃত কাঠামোয় অর্জন করা হয় না, তাই তাকে জ্ঞান বলা যায় না!

একটি দেশের শিক্ষানীতি-পদ্ধতি-ব্যবস্থা কি হবে, তা সাধারণত নির্ধারণ করা হয়, সে দেশের চলমান আর্থসামাজিক প্রবণতার উপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশে একধারা, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার আকাঙ্খা ছিল দীর্ঘদিনের। সে বিবেচনায় ইংলিশ মিডিয়ামকে সমর্থন করার কোন কারণ নেই। কিন্তু এখানে অভিযোগ উঠছে, ধর্মভিত্তিক ও কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে যে পরিমান আলোচনা হচ্ছে, সে পরিমান আলোচনা ইংলিশ মিডিয়াম নিয়ে হচ্ছে না! অভিযোগ অমুলক নয়, এবং সেটা না হবার কারণ কওমী মাদ্রাসা নিজেই! তারা যে শিক্ষা গ্রহন করছে, সেই শিক্ষা তারা রাষ্ট্র ও সমাজে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে চায় এবং করছে! ইংলিশ মাধ্যমের শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কি সেই কাজ করতে যাচ্ছে? মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মত দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করছে? তারা কি সরকারের উন্নয়ন নীতি ও কর্মসূচীর বিরোধীতা করছে? সরকার-রাষ্ট্র, সমাজ-রাজনীতির কোন বিষয়ে নাক গলাচ্ছে? বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপ করছে? ভোটের রাজনীতি করছে? তারা কি সভ্যতা, আধুনিকতা ও উন্নয়ন বিরোধী? নাগরিকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে? গণতন্ত্রের বিপক্ষে? এদেশের ভাষা, স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির বিরোধীতা করে? সাধারণ শিক্ষায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও ভাবধারা প্রবেশ করাচ্ছে? এর সবকিছুই কওমী মাদ্রাসাওয়ালারা করছে, আর সে কারণেই ভূক্তভোগী ও আতঙ্কগ্রস্থ জনগোষ্ঠী তাদের আকাঙ্খা ও কর্মকান্ড নিয়ে উগ্বেগ জানাচ্ছে, আলোচনা করছে! সে কারণেই এদের নিয়ে আলোচনা অধিক শোনা যায়। সেটা তো আপনার মত একজন পন্ডিত ব্যক্তির না বোঝার কোন কারণ নেই!

একটি অভিন্ন ধারার শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজী মাধ্যম এবং ধর্মভিত্তিক শিক্ষা উভয়ই বড় সমস্যা। প্রশ্ন হচ্ছে আজকে ইংরেজী শিক্ষা বন্ধ করে দিলে, কালকেই কি মাদ্রাসা শিক্ষা উঠিয়ে দেয়া যাবে? এবং তার নৈতিক ভিত্তি তৈরী হবে যাবে? নৈতিক দূর্বলতার কারণেই কি কওমীর প্রসার ও প্রভাব বাড়ছে, আমাদের দেশে? একটা মন্দের কারণে আরেকটি মন্দ উৎসাহিত হয় সত্য! সেই মন্দকে মন্দ না বলে, তাদের বন্ধের কথা না বলে, তাদের পাশাপাশি টিকে থাকার নৈতিক ভিত্তির কথা বললে, কওমীর উদ্দেশ্যই গ্রহনযোগ্যতা পায়! এমন কৌশলী বক্তব্য একমূখী শিক্ষার আকাঙ্খা-আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ কররে! এই আকাঙ্খার একজন হিসেবে নিশ্চয়ই শ্রদ্ধেয় খান সেটা চাইবেন না!

 

. মাদ্রাসার শিক্ষকরা কম জানেন বা কম জ্ঞানী এমন ধারণা ঠিক না..

মাদ্রাসা শিক্ষার লোকেরা লেখাপড়া জানে না, ধর্মান্ধ, এমন প্রচারণা আছে, সত্য। কিন্তু সে আলোচনা অসম্পূর্ন! কিন্তু এমন সমালোচনা কারা করে? করে শহরের মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানরা! যাদেরকে মর্ডান মুসলিম বলা হয়! এই মুসলিমরাই মনে করেন আল্লামা শফি, চরমোনাই, বাবুনগরী, শাইখুল হাদিস, সাঈদী এরা ধর্মের কিছুই জানে না! তারা ধর্মান্ধ, কাঠমোল্লা, ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী! এ্ই সব মাদ্রাসায় যারা শিক্ষকতা করে, এবং যারা লেখাপড়া করে তারা অধিকাংশই প্রকৃত ইসলাম ধর্ম জানে না! কেন এই মর্ডানরা এমনটা বলে? তাদের স্বার্থ, সুবিধা ও চরিত্রের কারণেই বলে!

 

শফি সাহেবরা যখন নারী নিয়ে তেঁতুল তত্ত্ব দেয়, নারী নেতৃত্ব হারাম বলে, সহশিক্ষা নিষেধ বলে, নারীকে পুরুষের শষ্যক্ষেত্র বলে, নাস্তিক কতল করা ওয়াজিব বলে, সংস্কৃতি, আধুনিকতা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ইসলাম ধর্মের বিধি-নিষেধ তুলে ধরেণ, তখন এই মর্ডান মুসলিমরা ক্ষিপ্ত হয়, তাদের বিরুদ্ধে বিষোধাগার করে! হাদিস-কোরআনে সত্যিই যদি এমন কথা বলা থাকে, তাহলে এই মর্ডান মুসলিমদের জীবন-যাপন নানা ভাবে নিয়ন্ত্রিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনারাই বলছেন, মাদ্রাসার শিক্ষকরা অনেক জানে, তারা বিতর্কে চ্যাম্পিয়ান হবে, কিন্তু তারা যখন হাদিস-কোরআনের নির্দেশনা তুলে ধরে তখন বলছেন তারা কিছুই জানে না! অথচ এরাই হচ্ছে এই ধারার প্রধান বা শীর্ষ কয়েকজন আলেম-ওলামা! যারা হাদিস-কোরআন পড়েন, পড়ান ও পুস্তক রচনা করেন! এবং জীবনভর এই কাজই করছেন। তারা যদি হাদিস-কোরআন না বোঝেন, তাহলে কি সেটা বোঝেন এই সব মর্ডানরা..! সমগ্র কওমী মাদ্রাসার আন্তর্জাতিক ধারার বাংলাদেশের প্রধান পুরুষ আল্লামা শফি ইসলাম ধর্ম জানে না, বোঝে না, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা তা বোঝে, সেটাই কি মানতে হবে?

 

. খান যদি মধ্যবিত্তদের এই সমালোচনাকে সাধারণীকরণ করেণ তাহলে এখানে দুইটা বিষয় আসে। এক. হয় স্বীকার করতে হবে আল্লামা শফীরা যা বলেন, তাই প্রকৃত ইসলাম কারণ তারা ইসলামের স্বীকৃত পন্ডিত এবং বাংলাদেশের একজন শীর্ষ ব্যক্তি! দুই. আর যদি বলেন, না তিনি আসলে যা বলেন, তার সাথে প্রকৃত ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, তাহলে কিভাবে বলি মাদ্রাসার শিক্ষকরা মস্তবড় পন্ডিত। আর তিনি তো সমগ্র মাদ্রাসার একজন প্রধান ব্যক্তির এবং এই ঘরণার সর্বজন শ্রদ্ধেয়! বলবেন কি আপনার কোন বক্তব্যটাকে আমি গ্রহন করব?

 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তারা জানে, কিন্তু তাদের জানা ও বোঝার বিষয়টি একমূখী, এককেন্দ্রীক ও বিশ্বাসভিত্তিক! কেন একথা বলছি? যেখানে মুক্তভাবে জানার কোন সুযোগ নেই, সেখানে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব না! জ্ঞান অর্জনের শর্তই হচ্ছে শত প্রশ্ন ও পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে তা গ্রহন করা। তবু তা আপত এবং স্বতসিদ্ধ নয়! তাকে যে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে! যে যা জানে সেটাই কি জ্ঞান? তারা যে জ্ঞান অর্জন করে সে জ্ঞানের সাথে কি স্বীকৃত জ্ঞানে তুলনা চলে? তুলনামুলক গবেষণায় কি সেটা মানানসই ও সঙ্গতিপূর্ণ কোন আলোচনা?

 

. সাধারণ শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার মান উন্নত! উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, সেখানে যুক্তিবিদ্যা পড়ানো হয়!

সাধারণ শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার মান উন্নত সেটা তিনি কিসের ভিত্তিতে বলেছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না! তিনি কোন গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে এমন কথা বললেন? শিক্ষার মান নির্ণয়-নির্ধারণের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে।  সেরকম কোন গবেষণা আমি কোথাও দেখিনি, পাইনি! উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, সেখানে যুক্তিবিদ্যা পড়ানো হয়। যদিও তাদের সিলেবাসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যুক্তিবিদ্যা বলে কোন বিষয় পড়ানো হয় না। তারপরও বলছি, যুক্তিবিদ্যা পড়ানো হলেই কোন শিক্ষার মান উন্নত হয়ে যায়, সেটা কোন ভাবেই বোধগম্য না! যুক্তিবিদ্যা আমারও পাঠ্য ছিল। কিন্তু তারা যে যুক্তিবিদ্যা পড়ে সেটা কি প্রচলিত যুক্তিবিদ্যা? নিখাদ ও বিশুদ্ধ যুক্তির ভিত্তিতে সত্যকে ও অনুমানকে গ্রহন করা হয়? সেটা যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন, বিশ্বাস আর যুক্তি কি এক সাথে যায়? মৃত্যুর যুক্তি ও মৃত্যুর বিশ্বাস কি এক কথা? সেখানে কি আত্বঘ্যাতি যুক্তির দর্শন শেখানো হয়? সেটা হলে তো সেখানে প্রকৃত জীব ও প্রকৃতি বিজ্ঞানই তাদের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত হতো, তাই না?!

 

যে ধারার-শিক্ষার মান এত উন্নত, তাহলে বলুন, সমসাময়িক ইতিহাসের এমন কয়েকজন মেধাবী ব্যক্তির কথা, তাদের আলোচিত কিছু গবেষণা, সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার কথা? যে কর্ম ও প্রতিভায় প্রমান মিলবে- তাদের শিক্ষার মানের! সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি ও পরিবেশের কোথায় তার ছাপ ও প্রভাব? বরং আমি তো এসব শিক্ষক-আলেম-ওলামাদের ক্ষমতা ও সুবিধার স্বার্থে-প্রশ্নে বিলীন হয়ে যেতে! নারায়নগঞ্জের একজন গডফাদেরর পক্ষে নানা ইস্যুতে পথে নামে! যাকে-তাকে, যখন-তখন নাস্তিক-বিধর্মী ঘোষণা করে! ব্যক্তিক্রম বাদে, এই তো তাদের নৈতিকতার স্তর ও তাদের শিক্ষারও মান!

 

যারা কেবল ভিন্নধর্ম জন্মগ্রহন করা, অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী হবার কারণে, কোন লেখকের লেখা-দর্শণকে গ্রহন করে না, বর্জন করে, তাদেরকে কিভাবে বলি, তারা অনেক লেখাপড়া জানা মানুষ? তারা লেখাপড়া করে সেটা সত্য, কিন্তু সেটা করে তারা একটি যুক্তিহীন, প্রশ্নহীন, অন্ধবিশ্বাসে আস্থা রেখে! বিশ্বাস কি জ্ঞানের ভিত্তি হতে পারে? বা জ্ঞান অর্জনের শর্ত হতে পারে? মানুষ যখন কোন কিছু জানতে চায় বিশ্বাস নামক মস্তিষ্ক দিয়ে, তখন কি প্রকৃত জ্ঞান অর্জন সম্ভব? তাহলে কিভাবে বলি তিনি-তারা বস্তু ও প্রাণী জগতে থেকে অনেক জ্ঞান অর্জন করছে?

 

. মাদ্রাসার শিক্ষকরা ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষকদের চেয়ে বেশী জ্ঞানী, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন অধ্যাপকও নেই যারা মাদ্রাসার শিক্ষকদের সাথে যুক্তিতর্কে পারবেন!

বাংলাদেশের ১২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার শিক্ষকের মধ্যে ৫ জন অধ্যাপক নেই, যারা যুক্তি-তর্কে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষকদের সাথে পারবেন! এমনই মন্তব্য করেছেন ড. সলিমুল্লাহ খান! বিষয়টি তিনি এমনি বললে এতটা গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু তিনি বিষয়টি নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মান নিয়ে বিস্তর আলোচনাসমালোচনা আছে! কিন্তু এতটা করুণ সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে! এটা খুবই লজ্জার বিষয়! ইংরেজের দেশে থেকে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে আসা নামকরা অধ্যাপকদেরও যদি এমন অভিযোগ মেনে নিতে হয়, তাহলে বলতেই হয় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনকোমায় আছে! সেই স্থানে মাদ্রাসার শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে অবস্থার একটু উন্নত করা হোক! তাতে যদি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের একটু লজ্জা হয়! খুব জানতে ইচ্ছে করছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, হারুর অর রশীদ, জাহাঙ্গীর তারেকসহ খ্যাতিমান অধ্যাপকদের বক্তব্য!

 

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাটাহাজারী কওমী মাদ্রাসার পরিচালক, বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের আইকন ও শীর্ষনেতা মাওলানা আহমেদ শফি বিভিন্ন সময় ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীনীতি, নারী অধিকার, বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি, সহশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে কি মনে হয়েছে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকদের চেয়ে অনেক জ্ঞানী? তার কয়েকটি বিশ্বমানের একাডেমিক পাবলিকেশনের নাম বলতে পারবেন কি? তাহলে কোন বিবেচনায় সেটা মনে হয়েছে ড. খান বলবেন কি?

 

উপমহাদেশে বেশ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। সেই সময় মাদ্রাসা শিক্ষা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তখন ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও মাদ্রাসায় যেত। রাজা রামমোহন বছর তিনেক প্রাথমিক পর্যায়ে মাদ্রাসায় গেছেন! আবুল ফজলসহ অনেকেই গেছেন, কিন্তু তাদের কর্মের সাথে মাদ্রাসার সম্পর্ক কি? এখন কি সেরকম কারো কথা উল্লেখ করতে পারবেন? যারা মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে প্রগতিশীল সংগ্রামে ভূমিকা রাখছেন?

 

মাদ্রাসা শিক্ষা কোন এক সময় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সত্য। তার ধারাবাহিকতায় এই ভূখন্ডে সেই গৌরবোজ্জল ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে, এমনটা বলার সুযোগ ও বাস্তবতা কি এখন আছে? যেমন ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলন কোথাও কি তাদের ভূমিকা দেখাতে পারবেন? তখন মাদ্রাসা শিক্ষা গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট-বাস্তবতা কি এক? তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পন্ডিত জওহুর লাল নেহেরু, তিনি ছিলেন একজন নাস্তিক! তখনকার মাদ্রাসা তা মেনে নেয়ার উদারতা দেখালেও এখন কি তা করতে পারবে?

 

. ইংরেজী সিলেবাস যেমন আন্তর্জাতিক তেমনি মাদ্রাসার সিলেবাস শিক্ষার মানও আন্তর্জাতিক!

বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষা টিকে থাকার কারণটা কি কেবল ইসলাম ও দর্শনচর্চার কোন নীরিহ রুপ? আমাদের দেশের প্রচলিত মাদ্রাসা কি তাহলে ইসলাম থেকে বিচ্যুত কোন ধারা? তাহলে কোথায় কিভাবে বিচ্যুত? বলবেন কি? কেন তা হলো, কারা তা করল? মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুসরণ করলেই কি তা আন্তর্জাতিক মান ও গ্রহনযোগ্য পেয়ে যায়? পাকিস্তান, আফাগানিস্তান, ভারতে অভিন্ন মাজহাবের একটি আন্তদেশীয় সংযোগ তৈরী হয় ঠিকই কিন্তু তার রাজনৈতিক সংযোগটা কি অস্বীকার করতে চান? সেটা নিয়ে কথা না বললে, এই খন্ডিত আলোচনা ভুলবার্তা দেবে! কেন তারা সরকারের নিয়ন্ত্রন মানতে নারাজ? সরকার কি তাদের শিক্ষার ধারা পাল্টে দিতে চেয়েছে? সরকার তো তাদের উন্নয়নের জন্যই সেই উদ্যোগ নিয়েছে। সেটা নিয়ে কিছু বলছেন না যে..?

 

ইংরেজী সেলেবাস যেমন আন্তর্জাতিক, তেমনি মাদ্রাসার সিলেবাসও আন্তর্জাতিক! কওমী মাদ্রাসায় যা পড়ানো হয় সেটা ভারত, সউদী আরবে পড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক সংযোগ থাকলেই কি তাকে একটি আন্তর্জাতিক গ্রহনযোগ্য মান বলা যায়? তাহলে জামায়াতে ইসলাম ও আইসিসকেও সেই কৃতিত্ব দিতে হয়, আন্তর্জাতিক সংযোগ ও অভিন্ন চিন্তা-দর্শণ-কর্মের কারণে! সৌদি আরব কি বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে? একটি অন্ধ বিশ্বাস ভিত্তিক শিক্ষা আরেকটি বৈজ্ঞানিক শিক্ষা। দুইটার তুলনা করা কি শোভন? মেরাজের বোরাকের সাথে কি বিজ্ঞানের রকেটের তুলনা করা যায়? হারবারর্টের সাথে কি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, দেওবন্দের সাথে কেমব্রিজের তুলনা করা কি সঙ্গত? যে প্রতিষ্ঠানগুলো এশিয়ার র‍্যংকিংয়ের মধ্যেই নেই, সেটাকে বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা করা বেমানান! তারপরও সংস্কারের বাইরে থাকা ভারতের অনেক শিক্ষাবীদি-নীতি নির্ধারক মাদ্রাসা শিক্ষাকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহন করতে নারাজ! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচী, শিক্ষাদান পদ্ধতি, লাইব্রেরী, গবেষণাগার, ফলাফল ইত্যাদির তুলনামুলক গবেষণা ও জরিপের তথ্য-উপাত্ত ছাড়া, কিভাবে আপনি মাদ্রাসাকে ‘উন্নত মানের সনদ প্রদান করলেন’, তা বোধগোম্য না!

 

. মাদ্রাসার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, এরা সংবিধান লঙ্ঘন করছে, কিন্তু ইংরেজী মাধ্যমের ক্ষেত্রে সেটা বলা হচ্ছে না!

সংবিধানে পরিষ্কার ভাবে অভিন্ন ধারার শিক্ষার কথা বলা হলেও আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অভিন্ন নয়! প্রধানত ৩ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক ও ইংরেজী মাধ্যমও চালু আছে। এক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ কেবল মাদ্রাসার বিপক্ষে না, ইংরেজী মাধ্যমের বিরুদ্ধেও আছে। কিন্ত মাদ্রাসার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অধিক শোনা যায়, কারণ মাদ্রাসার কর্মকান্ডই সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মাদ্রাসা আমাদের সমাজ-রাজনীতিকে যে ভাবে বাধার সৃষ্টি করছে, অন্য মাধ্যমে সেটা করছে না। যে কারণে তাদের নিয়ে আলোচনা ঘুরেফিরে আসছে। এবং সেটা হতে থাকবে- যতদিন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না হবে। তাকে নিয়ে তো কেবল আলোচনা না, গণজাগরণ সৃষ্টি করা উচিত! আপনি তো জানেন, বাঙালী বেশী কথা বলে, আর কাজের চেয়ে অকাজের কথা অধিক বলে! আলোচনা কম না বেশী হলো সে বিষয়ের চেয়ে কি হওয়া উচিত, কি করতে হবে, সে আলোচনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আপনার কাছ থেকে খুব আশা করি!

 

. অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা, মাদ্রাসা সংস্কার আত্মসংস্কারের প্রশ্ন

“মাদ্রাসার উপরই আমার সমস্ত ঘৃণা ঢেলে দিচ্ছি। ঘৃণার রাজনীতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। মাদ্রাসাকে সংস্কার করতে হবে। তার চেয়ে বেশী দরকার আত্মসংস্কারের।” ঘৃণা মাদ্রাসার উপর ঢেলে দেয়া হচ্ছে না। ঘৃণা ঢেলে দেয়া হচ্ছে তাদের উপর- যারা মাদ্রাসা নিয়ে বাণিজ্য ও রাজনীতি করছে। যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্রতা ও ধর্মাভীরুতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে। বিভিন্ন সময় সরকার কওমী মাদ্রাসার কিছু সংস্কার ও উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারাই সেই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্থ করেছে। অভিন্ন শিক্ষানীতি-২০১০, মাদ্রাসা শিক্ষানীতি-২০১২, শিক্ষা আইন ২০১৩, সংস্কার প্রস্তাব ২০১৬ কোন উদ্যোগেই তাদের রাজী করানো যায়নি। কিন্তু সব উদ্যোগই ছিল অন্তত তাদের জন্য খুব ইতিবাচক! তাদের বক্তব্য সরকারের যে কোন উদ্যোগ মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র! তাহলে আলিয়া মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও কি তাই ছিল? এবং সেটা কি ধ্বংস হয়ে গেছে? ড: খান বলবেন কি মাদ্রাসা সংস্কারের আগে কার আত্বসংস্কার জরুরী..? এ শিক্ষা নিয়ে সমাজ-রাজনীতির নানা কারণ-সমীকরণ থাকলেও, বলবেন কি, কাদের কারণে- কওমীর সংস্কার করা যায়নি, যাচ্ছে না?

 

এই আলোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এক্ষেত্রে মতামত হতে হবে অতি সুনির্দিষ্ট। বিষয় পরিস্থিতির সাধারণীকরণ করা এবং প্রকৃত চিত্র এড়িয়ে যাওয়া হবে বিপদজনক! এখানে নিজেদের দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। ভারসাম্যমুলক কোন অংশের সহানুভূতির আলোচনা জাতী আশা করে না! বর্শার ফলার মত তীব্র যুক্তিবান নীতিনির্ধারকদের বাধ্য করুক- পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে! যে কথায় প্রতিপক্ষ পুলকিত হয়, চেনা বলয় বিভ্রান্ত হয়, তা নিজের বিপক্ষেও যায়। নিজের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে-, আক্ষেপ করেছেন কওমী মাদ্রাসায় না পড়তে পারার ! এতে আর কিছু না হোক, কওমীওয়ালারা একটু শান্তনা পাবে! তাদের অবস্থান অধিক সংহত করার সুযোগ পাবে। সে পরিস্থিতি, অভিন্ন ধারার শিক্ষার আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। অন্যান্য বিষয়ের মতই এক্ষেত্রেও আশা করি আপনার সুনির্দিষ্ট বক্তব্য ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভোঙ্গীর।

———————————————————————–

ডঃ মঞ্জুরে খোদা, প্রাবন্ধিক-গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।