আমার ভেতরে যেই ‘মানুষনারী’ বাস করেন তার পরিচয় আমি আজ প্রকাশ্যে আনলাম – মুখপঞ্জিকা (Facebook)-এর পরিচিতির লৈঙ্গিক পরিচয়ে আজ পুরুষ শব্দটা পরিবর্তন করে নারী শব্দটা বসালাম । বন্ধুরা , অনেক অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম – প্রকৃতপক্ষে আমি আসলে একজন নারী ।

আমি শারীরিকভাবে সক্ষম বা সক্রিয় শিশ্ন (Activ Penis) সংযুক্ত পুরুষ হলেও মানসিকভাবে একজন সম্পূর্ণ নারী । আসলে সর্বোপরি আমি একজন মানুষ কিন্তু নিজেকে নারী ভাবতেই বেশী ভালো লাগছে !! এবং এই নারী পরিচয়ে আমি মোটেই লজ্জিত না – বরং উল্টা নারী পরিচয়ে আমি নিজেকে গর্বিত বোধ করছি !!

যদিও ‘শারীরিকপুরুষ’ হওয়া কোনো খারাপ কিছু না – কারণ , ‘মানসিকপুরুষ’রা খারাপ হলেও সমস্ত ‘শারীরিকপুরুষ’রা খারাপ না । আবার সকল নারীরাও দুধে ধোয়া তুলসী পাতা না – অনেক অনেক নারীই আছেন যারা – ‘মানসিকপুরুষ’রা যেইরম জঘন্য খারাপ – সেইরম জঘন্য খারাপ ।

তারপরেও – আমি নিজেকে শেষ পর্যন্ত ‘মানসিকনারী’ হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্বিত অনুভব করছি !! কারণ , আমার ভাবনাচিন্তার ধরন , অনুভূতি প্রকাশের ধরন এবং ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি সবকিছুই ‘শারীরিকনারী’র মতো অর্থ্যাৎ তাঁদের সাথেই মিলে যায় । শুধু শরীরটা বাদে নারীর সাথে আমার খুব একটা অমিল নাই ।

বন্ধুরা , জানেন কি – পুরুষ শরীরটা ও পুরুষতন্ত্রের তৈরী মেকি পুরুষত্বের মধ্যে বন্দি হয় আমি ছটফট করে মরে যাচ্ছি – আমি এই বর্বর অনিয়ম থেকে মুক্তি চাই !! আমি পুরুষ আর থাকতে চাই না – এইবার আমি পুরুষত্ব থেকে বেরিয়ে – মানুষ হতে চাই এবং সেই মানুষটা যদি আচরণে ও প্রকাশে নারীর মতো হয় – তাতে আমার আনন্দ ছাড়া অনুশোচনা নাই , কোনো ক্ষেদ নাই ।

আমার কথা শুনে কোনো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পুরুষরা হয়তো হাসবেন , তাতে আমার কিছুই যায় আসে না । হাসেন , তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে থাকেন – তবুও আমি সেই নারীর মতো মানুষ হতে চাই – যেই মানুষ – সাঁজতে , হাসতে , মন খুলে কথা বলতে , গাইতে , নাচতে , আঁকতে , আবৃত্তি ও অভিনয় করতে , শাড়ি-চুড়ি-গয়না পরতে , বড় চুলে ঝুঁটি বেঁধে রঙিন ফুল গুজতে ইত্যাদি ইত্যাদি শৌখিনতা ভালোবাসে ।

যে মানুষ পুরুষত্ব না , মনুষ্যত্বের চর্চা করতে চায় – আমি সেইরম মানুষের মতো প্রকৃত মানুষ হতে চাই !! পুরুষত্বের নিষ্ঠুর খোলসে গেঁথে থেকে আমি মরমে মরে যাচ্ছি , একটা বিষম যন্ত্রণায় ছটফট করছি !! পুরুষত্ব নামক একটা মেকি ও রুঢ় , নিষ্ঠুর ভাবমূর্তির মুখোশ পরে থেকে আমি আর বাঁচতে পারছি না !! এইভাবে আর বাঁচতে চাই না !!

ইদানিং বাংলাদেশের ঢাকাতে অনেক মানুষ আছেন যারা ‘মানসিকনারী’ কিন্তু ‘শারীরিকপুরুষ’ – তারা প্রকাশ্যে শাড়ি পরছে এবং সাজগোজ করছে – এইসব সাহসী মানুষগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । আর – তাদেরকে অনুপ্রেরণা ও সাহস দেবার মতো , তাদের পাশে বাস্তবে অনেক মানুষই আছে – তাই হয়তো তারা প্রকাশ্যে শাড়ি পরতে পারছেন – প্রকাশ্যে নিজেকে নারী বলতে পারছেন ।

কিন্তু আমার যৌবনের প্রারম্ভে আমার পাশে ওইরম সাহস ও অনুপ্রেরণা দেবার মতো কেউ ছিলো না বিধায় সারা জীবন নিজেকে দমন করেই গেলাম !! কারণ কি জানেন ? কারণ হচ্ছে – অন্যে মানুষের সমালোচনার ভয়ে । আমার হাটাচলা নিয়া সবসময় গালাগালি খেতে হয়েছে – তার উপরে যদি শাড়ি পরতাম তাহলে কথাই নাই , “সেরের উপর শোয়াসের” – গালি খেতে খেতে দফারফা সারা হয়ে যেতো !!

আমার বাস্তব জীবনে ঘটা করে একটা বিশ্রী বিষয় বলি : “মাইগ্যা” কিংবা “তোরে তো দেখতে ও হাঁটাচলা মাইয়াদের মতো , শরীরটা টুকুটুকে রাঙা ও নরম তূলতুলে এক্কেরে মাইয়াগো মতো” – এই কথাগুলা একসময় আমাকে ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখতো !! ইস কি ভয়ংকর সময়টাই না পেরে করেছি – কৈশোর ও কৈশোর পরবর্তী বয়ঃসন্ধীকালে !! 😢😢

‘শাড়ি’ শিরোনামে আমার একটা সুদীর্ঘ লেখা আছে – সেইটা যারা পরেছেন তারা নিশ্চয় জানেন যে ছোট বেলায় আমি মেয়েদের পোশাক পরতে ও মেয়েদের মতো সাজতে চাইতাম । কিন্তু আমি কেনো ওইরম চাইতাম ? কারণ , শরীরে শিশ্ন সহকারে পুত্র হিসেবে জন্ম নিলেও আমি মননে ছিলাম একজন কন্যা ।

আমার সেই কন্যা সত্তাই একদিন ‘মানুষনারী’র রূপ ধারনা করেছে । এতোদিন আমার সেই মানসিকনারী’ সত্তাকে গোপন রাখলেও – আজ এতদিনে এই পরিনত বয়সে এসে প্রকাশ করলাম । যদিও এতদিন এই ব্যাপারটা সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে , শংকায় , আতংকে চেপে রাখলেও – আর কতো !! ?? আর কতো নিজেকে দমন করা ?? যথেষ্ট হয়েছে । আর না ।

তাই , আজ জনসম্মুক্ষে সবাইকে জানিয়ে দিলাম – আমি একজন মানুষ – যে কি না – মানসিকভাবে নারী অর্থ্যাৎ ‘মানুষনারী’ এবং এর জন্য আমি গর্বিত !! ‘মানুষনারী’ হিসেবে হয়তো গর্ভিত হতে পারবো না – এই কথা ঠিক , তবে গর্বিত হতে পারবো – এইটা তো সত্য , তাই না ? ভুল কিছু বললাম কি ?

 

 

আপনারা আবার ভাববেন না যেনো – আমি ‘মানুষনারী’কে ‘মানুষপুরুষ’-এর চাইতে উর্ধে স্থান দিয়েছি !! বরং আমি বলতে চাইছি যে – ‘মানুষপুরুষ’ ও ‘মানুষনারী’ দুইজনেই সমান সম্মান , অধিকার , সুযোগসুবিধা ইত্যাদি পাবার বা ভোগ করার অধিকার রাখে – তাই , কেউ কারো চাইতে কম না আবার কেউ কারো চাইতে বেশীও না ।

কি , স্পষ্ট করে বুঝাইতে পারলাম তো , না কি ? আপনাদের কাছে যদি মনে হয় – ভুল কিছু বলেছি , তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করতে পারেন । এই বিষয়ে তুল্যমূল্য বিচার করে আরো বিস্তারিতভাবে আরেকদিন কিছু লেখার ইচ্ছা আছে – তবে আজ এইটুকুই থাক । ধন্যবাদ ও আন্তরিক ভালোবাসা রইলো সব্বার প্রতি !!

পুনশ্চ : আমার এই আত্মস্বিকৃতীমূলক লেখাটা পড়ে অনেক বন্ধুই মুক্তমণা ও আমার ব্যক্তিগত ফুটাখাতা বার্তাবাকসে (Facebook Inbox-এ) আমাকে ভুল বুঝে অভিযোগ করেছেন যে – আমি নাকি ‘মানুষনারী’কে ‘মানুষপুরুষ’-এর উপরে স্থান দিয়েছি !! কখনোই না – আমি তা করি নাই । তাইজন্যেই এই পুনশ্চের উল্লেখ করা ।

আসলে আমি কখনোই ‘মানুষনারী’কে ‘মানুষপুরুষ’-এর ওপরে স্থান দেই না , কারণ , ‘মানুষবৃহন্নলা’ ‘মানুষনারী’ ও ‘মানুষপুরুষ’ ইত্যাদি আমরা প্রতিটা মানুষই সমান ভালোবাসা , সম্মান , স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রাখে – কেউ কারো চাইতে কম না আবার কেউ কারো চাইতে বেশীও না । তাই এই লেখাতেও দেই নাই – তাহলে যে আমার মানব জন্ম ও জন্মের স্বার্থকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে !!

বন্ধুরা , আপনারা লেখাটা পুনরায় পড়ুন – তাহলেই বুঝতে পারবেন যে – এই বিষয়ে আস্ত একটা বাক্য আছে । যাইহোক , পাশে থাকুন ও পাশেই রাখুন !! আপনাদের মন্তব্য আমার জন্য সবসময়েই অনুপ্রেরণাদায়ক । ধন্যবাদ !!

”মানুষপুরুষ’-এর শরীরে আমি একজন ‘মানুষনারী”


সংযোজন

ছবি: ইন্টারনেট

পুনশ্চ:
[০২] :

সাইরাম আয়ারের (Sairam Iyer) মানুষপুরুষ ও মানুষনারী কন্ঠে “ইয়ে রাতে ইয়ে মওসম নদীকা কিনারা , ইয়ে চঞ্চল হাওয়া” (Ye Raatein Ye Mausam Nadee ka kinara, Yeh Chanchal Hawoa) গানটা যতবার শুনি আর ততবার চোখের জল ফেলি আর মনে পড় যায় বয়ঃসন্ধিকালে আমিও কাউকে না শুনিয়ে গোপনে একা একা কতো কতো গান যে মানুষনারীর কন্ঠে গেয়েছি । আহারে আমার মানুষনারী সত্তা !! আমি আসলেই মনে প্রাণে একজন মানুষনারী ছিলাম এবং এখনো আছি ……….

মানুষনারীরা পুরুষের চাইতে প্রায়শঃই ইতিবাচক ও সৃজনশীল হন, এই জন্যই আমি নিজেকে ‘মানুষনারী’ ভেবে গর্ব অনুভব করি । কিন্তু নারীতান্ত্রিক নারীরা ‘মানুষনারী’র এই ভাবমূর্তিকে পুরুষতন্ত্রের তৈরী “নারী” বলছে !! তারা বলছে, পুরুষতন্ত্র নারীকে এইভাবে তৈরী হতে বাধ্য করেছে !! , জানি না তাদের ভুল বুঝলাম কি না !! বন্ধুরা , আপনাদের কি মনে হয়, আমার ধারনা কি ভুল ?

শ্রদ্ধেয় মানুষ বন্ধুরা , আমি কিন্তু এখন থেকে থেকে আর নিজেকে একেবারেই পুরুষ মনে করি না , আমি নিজেকে নারী ও সর্বোপরি মানুষ ভাবি এবং নিজেকে নারী ভাবতে পারায় গর্বিত বোধ করছি । আমার Facebook Profile এর পরিচিতি বা ব্যক্তিগত তথ্যের জায়গায় গেলে দেখবেন লিঙ্গের জায়গায় “নারী” লেখা রয়েছে।
সুতরাং আমাকে ‘দিদি’ , ‘মানুষ’ বা ‘বন্ধু’ ইত্যাদি যা খুশি সম্বোধনে ডাকতে পারেন, কিন্তু অনুগ্রহ করে পুরুষ হিসেবে “ভাই” বলে আর সম্বোধন করবেন না । নিজেকে পুরুষ ভাবতে বা দেখাতে দেখাতে আমার ঘৃনা ধরে গেছে । আমি নিজেকে পুরুষ পরিচয় দিতে রীতিমতো লজ্জিত বোধ করছি । সুতরাং আমাকে দয়া করুন, পুরুষবাচক কোন সম্বোধনে ডেকে আর কষ্ট দিবেন না ।

পুন: পুনশ্চ:
[০৩]

“মানুষপুরুষ’ এর শরীরে আমি একজন ‘মানুষনারী” শিরোনামে আমার মূল লেখাটা প্রথমে সংক্ষিপ্ত আকারে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্ৰুপে প্রকাশ করেছিলাম। তারপর থেকেই আমি ভয়ঙ্কর অপ্রিতীকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছি এবং অনবরত হয়ে চলেছি। আমার ইনবক্সে ক্রমাগত অদ্ভুত সব যৌন সম্পর্ক তৈরীর প্রস্তাব ও আপত্তিকর ছবি আসছে। তাই আমি এই পূনশ্চে কিছু কথা খোলাখুলিভাবে জানাচ্ছি।

লেখাটিতে শারীরিকভাবে সক্ষম (Active) মানুষপুরুষ বলতে বোঝাচ্ছি যে, যৌনমিলনের সময় আমার শিশ্ন সক্রিয় (Active) থাকে এবং সক্রিয় উত্থিতশিশ্ন আমার যৌনসঙ্গীর শরীরে প্রবেশ করাই ও চালনা করি এবং সেইসাথে আমি এইটাও চাই আমার যৌনসঙ্গী আমাকে প্রচুর আদর করুক, আমার সমস্ত শরীর চুম্বনে-আদরে ভরিয়ে তুলুক এবং আমিও তার সমস্ত শরীর চুম্বনে আদরে ভরিয়ে তুলি।

এইখানে যৌনসঙ্গী বলতে ‘মানুষনারী’ এবং নিষ্ক্রিয় (Passive) ‘মানুষপুরুষ’দের বুঝিয়েছি । সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এই যে, আমি কিন্তু আমার শরীরে যৌনসঙ্গীর শিশ্ন প্রবেশ করাতে পারি না , আর এতে আমার কোনো আনন্দ , মজা বা সুখ নাই , করলে উল্টো প্রচন্ড ব্যাথা বা যন্ত্রণা পাই, অর্থ্যাৎ আমি (Passive) না । তারমানে এই দাঁড়ালো যে, সক্রিয় (Active) মানুষপুরুষের উত্থিত শিশ্ন আমার শরীরে প্রবেশ করাতে ও চালনা করাতে পারি না ।

কোনো কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অনুরোধে সেই প্রচেষ্টা করেছি কিন্তু কখনো সম্ভব হয়ে ওঠে নাই । অর্থ্যাৎ আমি যৌনমিলনের সময় আমি সক্রিয় (Active) থাকি, নিষ্ক্রিয় (Passive) নই । সুতরাং আমি নিজেকে ‘মানসিকভাবে নারী’ মনে করি বলে কেউ ভাববেন না যেনো আমি ‘নিষ্ক্রিয় মানুষপুরুষ’ (Passive) । বরং উল্টা যৌন মিলনের সময় আমার শিশ্ন সক্রিয় ভূমিকা (Active Role) পালন করে । সুতরাং আমার মত ‘মানসিক নারীত্ব’এর কথা শুনে সক্রিয় (Active) ‘মানুষপুরুষ’দের দূরে থাকবার পরামর্শ দেব। যারা কৌতূহলী তাদের বলতে পারি আপনারা বরং LGBTQA+ কমিউনিটি নিয়ে জানতে চেষ্টা করুন। মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবতে ও সম্মান করতে শিখুন।

— খান ওয়াহিদুজ্জামান