[যতোই হামলা করো, সব সামলে নেব/ চ্যালেঞ্জ করছি তোমায়, যদি মারতে পারো…]

কিশোরী পাহাড়ি মেয়ে লাকিংমে চাকমা প্রথমে অপহৃত, পরে ধর্মান্তরিত, বিবাহিত ও নিহত হয়েছে, স্যোশাল মিডিয়ায় এ খবর ভাইরাল না হলেও, যারাই বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীর খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের কাছে এ খবর কিছুটা পুরনো।

তবে বিস্ময়কর, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ১৪ বছরের মেয়েটির লাশ এখনো মালিকানা বিতর্কে কক্সবাজারের মর্গে অন্তত দুই সপ্তাহ ধরে পঁচছে, আদালতও মৃতদেহ সৎকারের সুরাহা করতে পারেনি।

আরো বিস্ময়কর, লাকিংমের মানবাধিকারের প্রশ্নে দেশের ডজনখানেক ফেসবুক সেলিব্রেটি আইনজীবী, স্বেচ্ছাসেবী, সম-সংখ্যক শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠন বা সামাজিক-রাজনৈতিক দল এখনো কুটোটিও নাড়ায়নি, তারা যেন করোনার নতুন ধরণ, বড়দিন ও থার্টিফাস্টের হুল্লোড়ে প্রসঙ্গটি ধামাচাপা দিতে পারলেই বাঁচেন।

আর যারা বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন, তাদের খুব সংক্ষেপে জানাই, খবরে প্রকাশ, লাকিংমের বাবা লাল অং চাকমার দাবি, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি তার মেয়েকে কক্সবাজারের টেকনাফের শিলাখালির চাকমা পাড়া থেকে অপহরণ করা হয়। একই উপজেলার বাহারছড়া মাথাভাঙা এলাকার আতাউল্লাহর দলবল তার মেয়েকে অটোরিকশায় তুলে নিয়ে যান। টেকনাফ থানা মামলা নিতে না চাইলে ২৭ জানুয়ারি তিনি কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়, লাকিংমে নিজেই অভিযুক্তদের সঙ্গে চলে গেছে, মেয়েটির পরিবারের সদস্য ছাড়া অপহরণের অপর কোনো প্রতক্ষ্যদর্শী নেই।

বাবা লাল অং চাকমার দাবি, ১১ মাস পর তিনি জানতে পারেন মেয়ে লাকিংমের লাশ মর্গে পড়ে আছে। তিনি লাশ নিতে গিয়ে জানতে পারেন, অপহরণ, নাবালিকা বিয়ে ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার অভিযোগে যে আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছিলেন, সেই আতাউল্লাহ স্বামী দাবি করে লাশ নেওয়ার আবেদন করেছেন।

জানা যায়, আতাউল্লাহর পরিবারের দাবি অনুযায়ী, লাকিংমে চাকমার বর্তমান নাম হালিমাতুল সাদিয়া, স্বামী-স্ত্রীর কথা কাটাকাটির জেরে ৯ ডিসেম্বর বিষপানে মেয়েটি আত্মহত্যা করে। মারা যাওয়ার ১২ দিন আগে মেয়েটি একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়। এছাড়া আদালতে জমা দেওয়া জন্মসনদ অনুযায়ী, মেয়েটির বয়স নাকি ১৮ বছরের বেশি। তদন্ত সাপেক্ষে মৃতের “ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত” হয়ে লাশ সৎকারের জন্য র্যাবকে নির্দেশ দিয়েছে কক্সবাজারের একটি আদালত।
লক্ষ্যনীয়, প্রথমত, লাকিংমের বাবা স্থানীয় ইউপি সদস্যর কাছে ঘটনার বিচার দাবি করে পাননি। দ্বিতীয়ত, টেকনাফ থানাও তার অপহরণের মামলা নেয়নি। আর তৃতীয়ত, পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনেও স্পষ্টতই গাফিলতি আছে। কারণ পারিবারিক সদস্য ছাড়া অন্য সাক্ষী না থাকলে অপহরণের ঘটনা ঘটতে পারে না, তা তো নয়। তাছাড়া একটি স্কুল পড়ুয়া কিশোরি পাহাড়ি মেয়ে ভিন্ন জাতির বাঙালি কয়েক যুবকের সঙ্গে মধ্য দুপুরে বাড়ির সদস্যদের সামনে অটোরিকশায় চড়ে বেপাত্তা হয়ে যাবে, এটি নিছকই অবান্তর, অসম্ভব ঘটনা।

…অথচ শুরু থেকেই এটি অপহরণের ঘটনা হিসেবে আমলে নিয়ে তদন্ত করলে হয়তো কিশোরী পাহাড়ি মেয়ে লাকিংমের সন্ধান পাওয়া যেত, অপহরণের পর ১১ মাস ধরে মেয়েটিকে কিভাবে কোথায় কোথায় রাখা হয়েছে, কিভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে তার ধর্ম, ভূয়া জন্ম সনদে কিভাবে বাল্যবিবাহে বাধ্য করা হয়েছে সবই বেরিয়ে আসতো। হতভাগ্য মেয়েটিকেও হয়তো এভাবে জীবন দিতে হতো না।

সবচেয়ে বড়কথা, ১২ দিন আগে সন্তানের জন্ম দিয়েই একটি মেয়ে তুচ্ছ পারিবারিক কলহের জেরে বিষপানে আত্মহত্যা করবে, বিষয়টি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়! …

মেয়েটিকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না সত্য, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। জোর দাবি জানাই, এখনই এই মামলার পুনর্তদন্ত হোক। আর তদন্তেরই শুরুতেই অভিযুক্তরা যেন পালাতে না পারে, সে জন্য নজরবন্দি রেখে আগে হোক বাবা লাল অং চাকমার দেওয়া জন্মসনদ ও কথিত স্বামী আতাউল্লাহর দ্বিতীয় জন্মসনদের সত্যতা যাচাই। তাহলেই একে একে বেরিয়ে পড়বে থলের বেড়াল, অর্থাৎ লাকিংমের অপহরণ, ধর্মান্তর, বাল্য বিয়ে ও বিষপানে কথিত আত্মহননের প্রকৃত কাহিনী।

তবে সন্দেহ থাকে, আদৌ রাতারাতি মেয়েটির পরিবার সুবিচার পাবে কি না। কারণ, পরিসংখ্যান বলছে, কক্সবাজার সীমান্তের জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাহাড়ি মেয়ে অপহরণ, ধর্ষণ বা গুমখুনের বিচার হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসনের স্পষ্ট গাফিলতিতে বহিরাগত বাঙালি অভিবাসিত (সেটেলার) অপরাধীরা থেকে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

অনুসন্ধিৎসু পাঠকের হয়তো মনে পড়বে, বছর দেড়েক আগে রাঙামাটির দুর্গম বিলাইছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণ ও যৌন নিগৃহের শিকার দুই মারমা বোনের কি হয়েছিল। সে সময় রাতের বেলা হাসপাতাল ব্ল্যাক আউট করে রীতিমতো অভিযান চালিয়ে, মানবাধিকার কর্মী, চাকমা রাণী ইয়ান ইয়ানের ওপর হামলা করে দুই বোনকে ছিনিয়ে নিজেদের জিম্মায় নিয়েছিল বীর পুলিশ বাহিনী। আর ঘটনার যেন ইতি ঘটেছে সেখানেই।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে সেটেলার বাঙালিরা খাগড়াছড়িতে মাইনর স্কুল ছাত্রী কীর্তিকা ত্রিপুরাকে গণধর্ষন ও খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি। পাহাড়ি জনপদে আতংক ধরাতে তার কচি হাত-পা বিভৎসভাবে ভেঙে উল্টে দিয়েছিল, তার লাশও বিকৃত করেছিল।

এভাবে একের পর এক বিচারহীনতার ফিরিস্তি দিয়েও আসলে এই নির্যাতন-নিষ্পেষনের কাহিনী যেন শেষ হওয়ার নয়। আর বিচারহীনতার সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ বোধহয়, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাঙামাটির বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্যাঘোনার নিজ বাড়ি থেকে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক অপহরণের শিকার হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমা।

তাই যতদিন লাকিংমের পরিবার সুবিচার না পাচ্ছেন, অভিযুক্ত আতাউল্লাহ কোং গারদ না খাটছেন, ততোদিন বরং কথিত মানবাধিকারের মুখে পদাঘাত করে মেয়েটির মৃতদেহ না হয় মর্গে সৎকারহীনই পড়ে থাক!