লিখেছেন: অসীম নন্দন
[ কয়েকটি রম্য রচনা। ঘটনা, সংলাপ এবং চরিত্র পুরাপুরিই লেখকের মনোজগতের কল্পনা ]

 

আগে মরিয়া বাঁচিয়া গিয়াছি

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেহেশতের পান খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। বেহেশতের পান খেয়ে তেমন কাব্য ভাবসাব পোয়েটিক ফিলিংস তাঁর আসে না! যখনই এইরকম বিরক্তি আসে তখনই তিনি খোঁজ-খবর করেন, ২/৪ দিনে বাংলাদেশ থেকে কেউ বেহেশতে আসছে কিনা! বাংলাদেশি অনেকেই বেহেশতে আসার সময় পান নিয়ে আসে। তাদের কাছ থেকে ২/১খিলি পান খেতে পারলেই আবার পোয়েটিক ফিলিংস চাঙ্গা হয়ে যায়।

খোঁজ নিতে গিয়ে কবি জানতে পারলেন, লালমনিরহাট থেকে শহীদুন্নবী জুয়েল নামে একজন সদ্যই বেহেশত-নসিব প্রাপ্ত হয়েছেন। কবি স্বয়ং জুয়েলের সাথে দেখা করতে গেলেন। গিয়ে দেখেন, জুয়েল বসে বসে দৈনিক প্রথম আলো পেপার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেছে।

— কী হে? এত মনোযোগ দিয়া কী পড়িতেছ?

— আরে কবিবর!! আপনে? কী সৌভাগ্য আমার। দুনিয়ায় তো আপনার চরণধূলা নিতে পারি নাই। তা বেহেশতে আইসা সেই ধূলাটুকু দেন।

— আরে থাক থাক। আর সালাম করতে হইবে না। দুনিয়ায় তো সালাম করলে তবু বলা যায় ‘দীর্ঘজীবী হও’। এইখানে সেইটা বলারও চান্স নাই।

— তা কবিবর কোনো বিশেষ দরকার আছে নাকি?

— বিশেষ দরকার আরকি। শুনলাম তুমি বাংলাদেশ থেকে আসিয়াছ। তাই সাক্ষাৎ করিতে আসিলাম। তা তোমার ট্যাঁকে পান-সুপাড়ি আছে নাকি?

— পান খাইবেন? একটু ওয়েট করেন। আপনারে এক খিলি জবরদস্ত পান বানায়া দেই। রতন-জর্দা চলবো তো।

— আরে জর্দা ছাড়া পান আর নুন ছাড়া ডাল একই কথা। দাও, খয়ের-জর্দা দিয়া একখানা পোক্ত পান বানাইয়া দাও। তা তোমার মরণ হইলো কেমনে? ইতিহাস বলো।

— কী কমু আর দুঃখের কথা, কবিবর। আপনে মনে হয় ফেইসবুক ইউজ করেন না। এইজন্যই এই ইতিহাস আপনে জানতে পারেন নাই। আচ্ছা সংক্ষেপে বলি।

— আগে পানখানা দাও তো দিকি, মুখে পুড়িয়া লই। তাহারপর বলো। হা সংক্ষিপ্ত করিয়াই বলো।

— “মানুষেরে ঘৃণা করি’/ ও’ কা’রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি’/ ও’ মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,/যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।/ পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!—মূর্খরা সব শোনো,/মানুষ এনেছে গ্রন্থ; — গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো! ”

— আরে ইহা তো আমার কবিতা। তোমার নিকটে তো আমি কবিতা শুনিতে চাহি নাই। তোমার মরণের ইতিহাস বলো।

— আজ্ঞে কবিবর, কবিতার মধ্যেই আমার মরণের ইতিহাস আছে। কোরান অবমাননা’র গুজব ছড়ায়া পাবলিক গণপিটুনি দিয়া আমারে মেরে ফেলছে। তারপর আগুনে জ্বালায়া দিছে।

— কী বলো? এতটা মর্মান্তিক কিছু আমি আশা করি নাই। বুঝিতেছ জুয়েল? আগে মরিয়া বাঁচিয়া গিয়াছি। তাহা না হইলে কবিতা লেখার অপরাধে পাবলিক আমার যে কী হাল করিয়া ছাড়িত তাহা খোদাই জানে। এই বুড়া বয়সে পাবলিকের রোষানল কোনোভাবেই হজম হইতো না।

 

শঙ্খনীল কারাগার

নরকের সবচেয়ে ফেমাস পাবের নাম শঙ্খনীল কারাগার। এই পাব’কে পরলোকের বাসিন্দারা সেকেন্ড প্যারিস বলে জানে। পরলোকগত তাবড়-তাবড় আর্টিস্টরা এই পাবে বসেই আড্ডা দেয়। ড্রিংক করে, পট করে আর দুনিয়ার দুঃখ-দুর্দশা’র জন্য হাহুতাশ করে। নাম থেকেই বোঝা যায়, এই পাবের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে আজকে পার্টি অর্গানাইজ করা হয়েছে। ইনভাইটেড প্রায় সবাই চলে আসছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানালার ধারে একটা টেবিলে আসন গ্রহণ করেছেন। তাকে ঘিরে আছেন বাংলা’র আরো কয়েকজন আর্টিস্ট। তিনি ভ্যাপে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, নাহ হে এটা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গই। যা-ই বলো হুক্কার মজা ভ্যাপে পাওয়া যায় না।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় বললেন, গুরুদেব ধর্মেও থাকেন জিরাফেও থাকেন। আজকের দিনে একটু মদ চেখে দেখেন।

রবিঠাকুর বললেন, না হে– ও আমার সয় না। বমি-টমি করে অসুস্থ হইতে চাই না। তা হুমায়ূন কই? অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয় না কেন? বাঙালির ভায়া সব কিছুতেই এই লেট হবার অভ্যাসটা মরার পরেও গেল না।

জহির রায়হান বললেন, হাজার বছর ধরে আমি একটা জিনিসই আইডেন্টিফাই করতে পারছি। তা হইলো ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের থেকে নরকটাই বেশি কমফোর্টেবল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, কই? কেউ তো কথা রাখলো না। ঐ তো হুমায়ূন। যাই, ডেকে আনি।

হুমায়ূন আহমেদ দরজার সামনে শামসুর রাহমানের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। বিরক্ত হয়ে বারবার রিস্টওয়াচ দেখছেন।

সুনীল এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার হুমায়ূন? সবাই তো এসে গেছেন। ঐ দেখো এরই মধ্যে শক্তি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেছে। আর ঐ দেখো জীবনানন্দ বাবু মহীনের ঘোড়াগুলো শুনতে শুনতে টেবিলে বসেই ঘুমিয়ে গেছেন। মূল পর্বটা শুরু করবে কখন?

হুমায়ূন বললেন, আরে তেত্রিশ মিনিটই তো কেবল হয়েছে। অস্থির হয়েছ কেন? কথা রাখবো তো আমরা।

শামসুর বললেন, এই সুনীল জানোই তো প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। ভাই কিছু মনে করো না। একটা বিপদ হয়ে গেছে। আহমদ ছফাকে তো চেনোই। তাকে নিয়ে গোলমাল। আর ছফাকে ছাড়া তো হুমায়ূন সেলিব্রেট করতে চায় না।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ পাড় মাতাল হয়ে লাল লাল চোখে বললেন, কী বিপদ? বাতাসে লাশের গন্ধ?

হুমায়ুন বললেন, আরে নাহ। হিসাবরক্ষক চিত্রগুপ্তের সাথে গেটের দারোয়ানদের গাভী-বৃত্তান্ত নিয়ে একটা ঝামেলা। গাভীর খাবারের জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ তা নাকি চিত্রগুপ্ত ঠিকঠাক দেয় না। লেবার সিন্ডিকেটের সবাই অনশন ডেকেছে। সেই প্রটেস্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক। তার সাথে জুটে গেছেন নবারুণ ভট্টাচার্য আর আহমদ ছফা।

রুদ্র চিৎকার করে বললেন, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।

সুনীল বললেন, ভাই মাফ করো। এবার তুমি ক্ষেপো না। আর হুমায়ূন, তোমাকে গুরুদেব ডাকছেন।

হুমায়ূন বললেন, চলো ভানুসিংহের কথা শুনে আসি। আর রুদ্র তুমি ভায়া একটু এগিয়ে দেখে আসতে পারবে মিটিং মিছিল শেষ হলো কিনা? রুদ্র হা-বোধক মাথা নেড়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

হুমায়ূন আহমেদ রবিঠাকুরের টেবিলে যাবার সময় শুনলেন কাজী নজরুল ইসলাম পিছন থেকে ডাকছেন।

হুমায়ূন বললেন, জ্বি কবিবর বলেন।

নজরুল বললেন, মাইকেল মধুসূদন’কে একটু মাতলামি কম করতে বলো প্লিজ। ঐ দেখো বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রো দেখে কেমন মেঘনাদকে বধ করতে গেছে।

হুমায়ূন বললেন, আচ্ছা ঠিকাছে। আমি রাহমানকে ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে বলছি। আমরা তো সাম্যের গানই গাই, তাই না?

নজরুল বললেন, ঠিকাছে। আর আমার জন্য একখানা পোক্ত পান পাঠিও তো। আর আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন গানটা।

হুমায়ূন আহমেদ সব বন্দোবস্তো করে রবিঠাকুরের কাছে গেল।

এরই মাঝে রবিঠাকুরের টেবিলে অন্তরাক্ষর খেলা শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন গিয়ে দেখেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেবদাসের মতন আমারো পরাণও যাহা চায় গেয়ে শোনাচ্ছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পুতুল নাচের ইতিকথার ড্রামার হয়ে টেবিল বাজাচ্ছেন। সৈয়দ শামসুল হক পরানের গহীন ভিতর থেকে একটা দোতরা বাজাচ্ছেন। হুমায়ুন আজাদ লাল নীল দীপাবলি’র মতো হেড-ব্যাং করছেন। রীতিমতো জমে গেছে আসর।

এমন সময় রুদ্রের সাথে ঋত্বিক, ছফা আর নবারুণ মেঘে ঢাকা তারা থেকে এসে শঙ্খনীল কারাগারে ঢুকলেন।
ঋত্বিক এসেই এক বোতল মদ টেবিল থেকে তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা সাবাড় করে চিৎকার দিয়ে বললেন,

‘কম্প্রোমাইজ করবো না বলেই মদ খাই। ওহে তোমরা সবাই আমার সঙ্গে চিৎকার করে বলো, শুভ জন্মদিন হে নন্দিত নরকের কবি’। ‘শুভ জন্মদিন’।

সবাই একসাথে বলে উঠলো, ‘শুভ জন্মদিন হে আর্টিস্ট’। ‘বহুব্রীহি সমাসের ভয়ে মৃন্ময়ীর মন ভালো না-ই থাকুক, কেউ কোথাও না থাকে তো না-ই থাকুক, শুভ্র বনে চলে গেলে–যাক; তবু আগুনের পরশমণি নিয়ে এই দারুচিনি দ্বীপের শঙ্খনীল কারাগারে আমরা থাকবো—আছি’।

 

পার্লামেন্টারি মিটিং

বেহেশতে বাংলাদেশ রিজিওনের পার্লামেন্টারি মিটিং শুরু হইছে। এইটা ৬৯ তম পার্লামেন্টারি মিটিং। মিটিংয়ের সাবজেক্ট ‘বাঙলার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ’। মিটিং চলতেছে ৩২ নম্বর বিল্ডিংয়ে। বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জে আছেন মেজর খালেদ মোশাররফ আর মেজর জিয়া। মেজর খালেদ আর মেজর জিয়া সিকিউরিটি রুমে বসে আছেন। এমন সময় ভাস্কর মৃণাল হক সিকিউরিটি রুমে এসে বললেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে চাই। খুব আর্জেন্ট।

মেজর খালেদ সিগারেটে আয়েশে লাস্ট টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, এইটা এখন পসিবল না। ভিতরে আরো আর্জেন্ট মিটিং চলে। আপনার ওয়েট করা লাগবে।

মৃণাল হক বললেন, আমাকে তো তিনি নিজেই মিটিংয়ে আসতে বলছেন।

মেজর জিয়া এইবার চেয়ারে একটু নড়া দিয়ে বললেন, সাথে পাস আছে? পাস না থাকলে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনে নিয়ে আসেন। পাসের ব্যবস্থা করতে হবে না?

মৃণাল হক বললেন, পাস আছে। সিগারেট খাইতে চাইলে এমনিই বলতে পারেন, খাওয়াবো। পাসের দোহাই দেন কেন?

অবস্থা বেগতিক বুঝে মেজর খালেদ বললেন, যান, সিগারেট লাগবে না। মিটিংয়ে লেট হয়ে যাইতেছে।

মিটিং-রুমের দরজা খুলে দাঁড়াতেই বঙ্গবন্ধু দরাজ গলায় বললেন, ‘কে মৃণাল নাকি? তুই তো লেট করে ফেলছিস। আয় ভিতরে আয়। চেয়ারে বইসা যা। মরার পরেও বাঙালের লেট হবার অভ্যাস আর গেল না। আমরা কবে পাঙচুয়াল হবো কে জানে’?

মৃণাল হক কাঁচুমাচু মুখে সরি বলে চেয়ারে বসলেন। এই কথার উত্তর আসলে দেয়া যায় না। দিতে গেলেও পুরা গল্প বলতে হয়। এত বড় মাপের মানুষের কথার পিঠে কথা বলাটা ধৃষ্টতা।

মিটিং অবশ্য বেশি দূর আগায় নাই। শেখ কামাল বর্তমান বাংলাদেশের ক্রীড়া বিষয়ক প্রতিবেদন দিতেছে সবার সামনে।

শেখ কামাল বললেন, ফেসবুকে ক্রিকেটার সাকিবকে প্রচুর গালাগাল করা হইতেছে। একজন তো ফেসবুক লাইভে এসে হত্যার হুমকিও দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু বললেন, সাকিব মানে ঐ অলরাউন্ডার টা? ভালোই তো খেলে। কেন কী করছে সে?

শেখ কামাল বললেন, সাকিব কলকাতায় কোনো এক দীপাবলি কালীপূজা’র অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে গিয়েছিল। তাতেই কাঠমোল্লারা ক্ষেপছে। কাফের বলা হইতেছে তারে।

বঙ্গবন্ধু বললেন, দীপাবলি একটা নস্টালজিক ব্যাপার। কলকাতায় যখন ছিলাম তখন দেখতাম আলো দিয়া গোটা শহর ভরায়া ফেলছে। মনে হইতো দুনিয়া আলোয় আলোকিত হয়া গেছে। এই সামান্য ব্যাপারের জন্য কাফের বলতেছে তারে? হত্যা করতে চায়? খুব অন্যায়। এতটা গোঁড়ামি আমি আশা করি নাই বাংলাদেশে।

তাজউদ্দীন বললেন, এইটার জন্য পুরাপুরি এরশাদ দোষী। বাংলাদেশে এরশাদই রাষ্ট্রধর্ম কায়েম করছে। দেশের মেনুস্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করে মেজোরিটিরে ফোকাস করছে। এর দায় এরশাদকে নিতেই হবে।

এরশাদ একটু ঢোক গিলে বললেন, একটু ওয়েট। এইভাবে একতরফা দোষারোপ আমি মানবো না। মেজর জিয়া কই? ওহ তিনি তো সিকিউরিটি ইন চার্জ। যাক, জিয়ার কি কোনো দোষ নাই? আর খন্দকার মোস্তাক তো সমসময়ই পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। তার কোনো দোষ নাই?

এই কথা শুনে মোস্তাকের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মোস্তাক আমতা আমতা করে ঢোক গিলে বললেন, আ…আমি? আমি তো মাত্র ৮৩ দিন ক্ষমতায় ছিলাম। তা-ও আবার অন্যের কথায় উঠবোস করছি। নিজের কোনো ক্ষমতাই ছিল না।

সোহরাওয়ার্দী বললেন, মোস্তাক তুমি তোমার দোষ এড়ায়ে যাইও না। তোমাকে দায় নিতে হবেই। তুমি বেঈমানী করছো। তুমি বঙ্গবন্ধুরে হত্যায় মদদ দিছ।

সিরাজ শিকদার বললেন, হ্যা। দায়-স্বীকার করতেই হবে। আর বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। সেইটার কোনো ইফেক্ট কি নাই?

বঙ্গবন্ধু বললেন, একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশরে রিপেয়ার তুমি কেমনে করবা সিরাজ? তোমার মতো শ্রেণীশত্রু মাইরা কি দেশরে রিপেয়ার করা যায়? সেই সময় কি আমাদের হত-দরিদ্র দেশের জন্য ভিক্ষার দরকার ছিল না? বিশ্বজনমত দরকার ছিল না? দেশটার স্বীকৃতি লাভের জন্য বিশ্বরাজনীতির সাথে কোলাবরেটের দরকার ছিল না? সর্বহারা হইয়া খালি শ্রেণিশত্রু মাইরা কি সেইসব করা যাইতো? আর হ্যা আমি ভিক্ষাই বলবো ঐটা। সাহায্য না।

সোহরাওয়ার্দী বললেন, তোমরা এগুলা দোষারোপের ফিরিস্তি বন্ধ করবা নাকি মিটিংয়ে এগুলাতেই সময় বরবাদ করবা? অতীতের ইতিহাস থেকে বাঙালাদেশিরা কিছু শিখতে পারছে কিনা সেইটাই এখন প্রশ্ন।

মৃণাল হক বললেন, আমার তো সেইরকম মনে হয় না। আমার জাস্টিস লেডি ভাস্কর্যটারে তো অশ্লীল, অর্ধামিক, কাফের কাজের তকমা দিয়ে মাঝরাতে পুলিশের পাহারায় কোর্টের সামনে থেকে সরায়া দিল। আমি তো আর্টিস্ট তাই না? আমারো তো খারাপ লাগে। এখন দেখেন, যে মৌলবাদী গোষ্ঠী আমার আর্টকে সহ্য করতে পারলো না তারাই আবার ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানাইতে বাধা দিতেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গার পানিতে ফেলে দিতে চাইছে মৌলবাদীরা। এই গোষ্ঠীর প্রেতাত্মারাই কিন্তু অতীতে শহীদ মিনার ভাঙছিল। তাইলে অতীত থেকে বর্তমান কী শিখলো আর বর্তমান থেকে ভবিষ্যতই বা কী শিখবে?

এতক্ষণ মিটিংয়ে বাংলার বাঘ এ. কে ফজলুল হক চুপচাপ শুধু সব কথা শুনছিলেন। এই প্রথম তিনি গমগম গলায় কথা বললেন, ‘শোনো আমরা অতীতে দেশটারে নিয়ে যেমনে ভাবছি তারই কম্পাউন্ড ইফেক্ট হইলো আজকের বাংলাদেশ। আর আজকের দিনের মানুষ যেইভাবে ভাবতেছে তার কম্পাউন্ড ইফেক্টই হবে দেশের ভবিষ্যৎ’।

মাওলানা ভাষানী সাহেব খুক খুক করে কেশে বললেন, কিন্তু আমার কিষাণ ভাইগোর কী হইবো? হেরা এখন মনের দুঃখে কৃষিকাজ ছাইড়াই দিতাছে। হুনছি– তারা ঢাকায় চইলা যায় চাকরি করতে, রিক্সা চালাইতে। তারা নাকি এখন আর চাষবাসের স্বপ্ন দেখে না। সবাই নাকি ছেলে-মেয়েরে কেরানী বানাইতে চায়। চাষবাস কী অপূর্ব কাজ তুমি জানো? কত দায়িত্বশীল হইতে হয় কাজের প্রতি তার কোনো আইডিয়া আছে তোমাগো? গাছ মানে তো জীবন, সেই জীবনের যত্ন করতে হয় দিনরাত। কয়জন পারে এতটা দায়িত্ব নিতে? তুমি আমি ঐরকম দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারছি?

ভাষানী সাহেবের কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। জাতীয় চার নেতাবৃন্দ মিটিংয়ে আর কিছুই বলতে পারলেন না। সবাই নিজের নিজের মনে সুন্দর একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন আঁকার চেষ্টা করলেন। যে স্বপ্নে মানুষ তাড়িত হয় ভীষণ ইচ্ছাশক্তির দিকে। তাঁদের স্বপ্নের ছবিতে একটা ফুটফুটে শিশুর মুখে বাংলার ছবি। সেই ছবিতে একটা ফোকলা দাঁতের খুকির হাসি।

 

এক কাপ সাংবিধানিক চা

বেহেশতে হিমেল হাওয়া বইছে। চায়ের দোকানগুলা একটু ফাঁকা-ফাঁকাই। তো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ইনফরমেশন পেয়েছেন যে, সিলেট থেকে নতুন চা ইম্পোর্ট করেছে বেহেশতের টঙ দোকানগুলা। তাই চা খেতে তিনি বের হয়েছেন। যেতে যেতে রাস্তায় ড. আনিসুজ্জামানের সাথে তার দেখা হয়ে গেল। আনিসুজ্জামান সাহেব কয়েকমাস হলো বেহেশত-নসিব করেছেন। এখনও পুরা এলাকাটা তিনি আয়ত্তে আনতে পারেন নাই। তাই একটু হেঁটে হেঁটে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন। দেখা হওয়ায় শিল্পাচার্য সাহেব প্রফেসর সাহেবকে চা খাওয়ার ইনভাইটেশন দিলেন। বললেন, ‘চলেন বেহেশতের টঙ দোকানগুলা আর আড্ডার ঘাঁটিগুলা আপনেরে চিনায়া দেই। টিএসসিতে তো বহুত রঙ-চা আর অপরাজিতা-চা খাইছেন। এইখানকার গ্রিন-টি খায়া দেখেন।

আনিসুজ্জামান সাহেব ইনভাইটেশন এক্সেপ্ট করে বললেন, চলেন যাওয়া যাক’।

তারা দুইজনে টঙ দোকানে গিয়ে দেখেন জাতীয় চার নেতা চা খেতে খেতে আড্ডা দিতেছে। ওনাদেরকে দোকানে আসতে দেখেই তাজউদ্দীন আহমদ খোশমেজাজে বললেন, ‘আরে দেখেন দেখেন কে এসেছে…আমাদের দুই লিজেন্ড। ও মনা লিজেন্ডগোরে চা খাওয়া। স্পেশাল সিলেটের গ্রিন-টি দে। আর আপনারা ঐ চেয়ার দুইটা টান দিয়ে বসেন এইখানে’।

শিল্পাচার্য সাহেব একটু লাজুকভাবে বললেন, আ..হা.. এগুলা কী যে বলেন! আপনেরা হইলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার প্রথম মন্ত্রী মিনিস্টার। আর আপনে এইভাবে বললে তো শরম লাগে। আচ্ছা কী লইয়া ডিসকাস হইতেছিল? দূর থেকে দেখে মনে হইলো খুব সিরিয়াস কিছু?

ক্যাপ্টেন মনসুর আলী একটু কেশে গলা সাফ করে বললেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েই কথা বলতেছিলাম। দেশে তো অনেক সমস্যা। বেহেশতে থেকে তো গসিপ করা ছাড়া আর কোনো কাজ করতে পারতেছি না।

আনিসুজ্জামান সাহেব বললেন, তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু স্পেসিফিক কোনটা ইন্ডিকেট করছেন তা বলেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাগী ভঙ্গিতে বললেন, ঐ যে কিছু দিন আগে সংসদে গিয়ে বগুড়া ৭ আসনের সাংসদ বাবলু ফেমিনিস্টদের উপর আর পোশাকের উপর রেইপের দায় চাপায়া দিলো–এইটা কেমন কথা? এইটা নিয়েই কথা বলতেছি আমরা।

আনিসুজ্জামান সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, ও আচ্ছা। বাংলাদেশের সাংসদদের তো অর্ধেকের বেশিই মূর্খ আর বর্বর। বাবলুও তাই। তার মধ্যে সে তো জিয়ার এলাকার লোক। বাবলু আসলে একটা পটেনশিয়াল রেপিস্ট। আসলে এইরকম যারাই রেইপের জন্য রেপিস্টরে ব্লেইম না দিয়ে ইনায়াবিনায়া মেয়েদের পোশাক বা আচরণ কিংবা ফেমিনিজমকে ব্লেইম দেয়–তারাই পটেনশিয়াল রেপিস্ট। কারণ সে ক্রাইমটারে রোমিং দিতেছে। এবং নিজে হয়তো মানসম্মান যাওয়ার ভয়ে ক্রাইম করতেছে না, কিন্তু ইনারা সুযোগ পেলে যে ক্রাইমটা করবে না–তার শিওরিটি দেওয়া যায় না।

আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বললেন, এইটা আপনি হক-কথা বলছেন প্রফেসর সাহেব। কিন্তু আমার কোয়েশ্চেন অন্য জায়গায়। এতগুলা নারী সাংসদ ছিল সেইখানে স্পিকারও তো নারীই ছিলেন তাহলে কেউ প্রটেস্ট করলো না কেন? প্রটেস্ট না করাটা মেনে নিতে পারতেছি না।

শিল্পাচার্য সাহেব চিন্তিতভাবে বললেন, আপনের সাথে আমিও একমত। প্রটেস্ট করা উচিত ছিল সংসদে। কিন্তু বাংলাদেশে আরেকটা সমস্যা যে কী বিশাল বপু ধারণ করছে সেইটা লইয়া আপনেরা চিন্তাফিকির কিছু করছেন?

তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, স্পেসিফাই করে বলেন। কোনটার কথা বলতে চাচ্ছেন?

শিল্পাচার্য সাহেব গলার স্বর একটু নামিয়ে বললেন, কাঠমোল্লাদের ফতোয়ার কথা বলতেছি। উনারা ওয়াজ-মাহফিল করে যেমনে মানুষরে ভরকায়া দিতেছে, উনারা যেইভাবে আর্ট-কালচারকে পলিউটেড করতে চাইতেছে, সংবিধানরে পলিউটেড করতেছে, যেইভাবে বারবার কুসংস্কারের অন্ধকারের কথা বলতেছে…এইভাবে চললে তো দেশে প্রগতিশীলতা বলতে কিছুই থাকবো না। মানুষ গান গাইবে, ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে, বিজ্ঞান জানবে তবেই তো প্রগতিশীলতা আসবে।

আনিসুজ্জামান সাহেব নিস্পৃহভাবে বললেন, এইটা কি আজকে নতুন নাকি বাংলাদেশে? বাকশাল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই তো সংবিধান ম্যানুপুলেটেড হইছে। ম্যানুপুলেট না বলে পলিউটেডও বলা যায়।

আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান আশ্চর্য হয়ে বললেন, এইটা আপনে কী বললেন? এই চরম পরিস্থিতির জন্য আপনে বাকশালরে ব্লেইম দিতেছেন কেন? আর সেইটা তো কার্যকরও না এই সময়।

আনিসুজ্জামান সাহেব বললেন, দেখেন বাকশালের যদি কোনো ইফেক্ট না থাকতো তা হলে তো আর ১৯৭৫ এর মতো কালো অধ্যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটতো না তাই না? এমন মর্মান্তিক একটা বছর ১৯৭৫ সেইটা আপনারা নিজেরাই বুঝতেছেন। আপনারা সবাই সেই ভয়াল গ্রাসের ভুক্তভোগী। বাকশালের জন্য সংবিধানের মূল চার নীতির মধ্যে গণতন্ত্র পলিউটেড হইছে। আর এরপর সংবিধানের ৫ম এবং ৮ম সংশোধনী করে জিয়া আর এরশাদ তো বাংলাদেশের খৎনা করে দিছে। এই জিয়া আর এরশাদের কারণে সংবিধানের মূলনীতিগুলা থেকে সেক্যুলারিজম পলিউটেড হয়েছে। আর এইসবের কম্পাউন্ড ইফেক্টই হলো আজকের বাংলাদেশ। দেশ তো মৌলবাদী কিংবা প্রগতিশীল হয় না, দেশের মানুষ হয়। মানে দেশের মানুষ যদি প্রগতিশীল হয় তবে দেশও হয়। এখন সংবিধানই যদি প্রগতিশীলতাকে কোয়েশ্চেনে ফেলে তাহলে আপনি কী বলবেন?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম বললেন, আপনে ঠিকই বলছেন। দেশের মানুষেই দোষ আসলে । আর জিয়া এবং এরশাদের সময় রিলিজিয়নটা এমন ভাবে সংবিধানে ঢুকানো হইসে যাতে পাবলিকই এইটার শিকার হয়, এই কারণে আজকে এই অবস্থা।

আনিসুজ্জামান সাহেব মৃদু হেসে বললেন, আপনারা তো বেহেশতে আছেন অনেকদিন যাবৎ তাই হয়তো আপডেট খবর একটু দেরিতে আসে। জিয়া আর এরশাদের পরেও দেশে মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়া হইছে। শুধুমাত্র ভোটব্যাংকের কথা মাথায় রেখে এই কাজ করা হইছে। বর্তমানে দেশে মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থেকেও মাদরাসা অনেক বেশি। দেশে প্রচুর এতিম এবং গরিব বাচ্চারা মাদরাসা থেকে এডুকেটেড হয়। গ্রামে ভালো স্কুল না থাকলেও মাদরাসা আছে। তো এই যে মাদরাসার জয় জয়কার। মাদরাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সাথে মিলিয়ে দেয়া হইছে এতেও মৌলবাদ ইগনাইটেড হইতেছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার এতিমদের এবং গরিবদের জন্য মূলধারার শিক্ষা কারিকুলামকেই আপডেটেড করতে পারতো। এতিম আর গরিবের উপযোগী করে তুলতে পারতো। মাদরাসার জায়গায় যদি পাড়ায় মহল্লায় গ্রামে গ্রামে ভালো সরকারি স্কুল থাকতো হোস্টেল থাকতো এতিমদের জন্য হোমস থাকতো তাহলে হয়তো দেশটা অন্যরকম হতো। শিক্ষাব্যবস্থা যদি এইভাবে শুধু মুনাফাখোরদের হাতে না চলে যেত তবে অন্যরকম হতো দুনিয়া।

তাজউদ্দীন সাহেব জিজ্ঞাসু সুরে বললেন, আচ্ছা প্রফেসর সাহেব তো সংবিধান বঙ্গানুবাদের টিমে কাজ করছিলেন তাই না? আর শিল্পাচার্য সাহেবও তো সংবিধান অলংকরণের টিমে কাজ করছিলেন?

শিল্পাচার্য সাহেব গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন, হ্যা আমরা সংবিধান সৃষ্টির সাক্ষী। আমরা একটা নতুন দেশ সৃষ্টির সাক্ষী। আমাদের স্বপ্নে একটা ছোট্ট সুন্দর খুকি হইলো আমাদের বাংলাদেশ।

তাজউদ্দীন উদাসভাবে বললেন, মাঝেমাঝে খুব কষ্ট হয়। আমরা কি এই দেশটা দেখার জন্যই বৈদ্যনাথ তলায় গিয়ে সরকার গঠন করছিলাম? দেশকে স্বাধীন করার জন্য এত এত সাংগঠনিক শক্তি সৃষ্টি করছিলাম কি এই দেশটা দেখার জন্য? মুক্তিযুদ্ধের ফসল কি এই পলিউটেড দেশ? ভাবতে খারাপ লাগে, কষ্ট হয়।

শিল্পাচার্য সাহেব বললেন, দেখবেন একদিন সব রঙ ফিরে পাবে আমাদের বাংলা। উজ্জ্বল মুখে ভরে উঠবে দেশ। পৃথিবীর বেহেশত হয়ে উঠবে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমদের প্রিয় খুকি।

কথাগুলা শুনতে শুনতে উপস্থিত সবার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল আবেগে। হয়তো সবার চোখের সামনে আবছা আবছা একটা দুনিয়ার জ্যান্ত বেহেশতের ছবি ফুটে উঠছে। যেখানে নদীর পাড়ে ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই ফড়িঙের পিছন পিছন ছুটছে এক ফোকলা দাঁতের দুই বেনি ঝোলানো খুকি।

মনা সবার জন্য সিলেটের গ্রিন-টি দিয়ে গেল। সবাই সেই চায়ের কাপে দেখতে পেল এক টুকরা বাংলাদেশ।

 

সেকুলার আমসত্ত্ব

‘মুর্শিদ যার সখা তার কিসের ভাবনা/ হৃদয় মাঝে কাবা নয়নে মদিনা,/ আমার হৃদয় মাঝে কাবা নয়নে মদিনা’

নরকের টঙ দোকানে বসে জর্জ হ্যারিসন গানের সুরে টাস্কি খেয়ে বললেন, Hey Rabi… Someone is singing Bengali nearby. Nice tune. What does it mean?

রবি শঙ্কর বললেন, yaap. It’s like if God is my friend then why shall I be worried. Kaba is in my heart and Medina is in my eyes.

হ্যারিসন বললেন, Great thinking! Lets find out who is singing this song?

রবি বললেন, আচ্ছা চলো দেখি। এটা তো আব্দুর রহমান বয়াতির গান। দেখি কে গাইতেছে?

নরকে হেমন্তের রঙ ছড়িয়ে গেছে। মাঠে মাঠে ধান কাটা শুরু হয়েছে। সকালবেলায় ঘাসের উপর শিশির চিকচিক করে। একরকম সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। কুয়াশার চাদরে দূরের গাছগুলো আগলে রাখে। হ্যারিসন আর রবি এসে দেখে রাস্তার পাশেই একটা মাঠে ঘাসের উপর বসে দুইজন একতারা বাজিয়ে গান গাইতেছে। দুইজনের মাঝে একজন লালন ফকির এবং অন্যজন আব্দুর রহমান বয়াতি।

লালনকে গান গাইতে দেখে হ্যারিসন বললেন, Oh my goodness! It’s Lalon…Shit! I left my guitar back at home! I wish I had it with me now, I could play with them!

রবি বললেন, হুম সত্যিই আফসোস।

আব্দুর রহমান বয়াতি তাদের দুইজনকে দেখে বললেন, আরে জর্জ..আরে রবি আপনারা? আসেন এই ঘাসের উপর বসেন। কী দারুণ এই নরকের হেমন্ত! এই হেমন্তে নরকের ধান কাটা মৌসুমে গান করা লাগবো না? এইটাই তো আমাদের জীবিত সময়ের হেরিটেজ-ট্রাডিসন। এনজয় করেন।

লালন সৌম্য হাসি হেসে বললেন, হ্যা হ্যা তাই তো.. দাঁড়াইয়া আছেন কেন? বসেন। আগে এই মৌসুমে পুঁথিপাঠ আর পালাগানের আসর বসতো গ্রামেগঞ্জে।

হ্যারিসন জিজ্ঞেস করলেন, What do you mean by ‘Pala gaan’? What kind of genre is this?

রবি মৃদু হেসে বললেন, পালাগান আসলে ফিলোসোফিক্যাল তর্কের মতো। It means debating by singing. The debates are subjected to religious, mythical and philosophical.

হ্যারিসন বললেন, Very interesting.

বয়াতি সাহেব বললেন, ইন্টারেস্টিং তো অবশ্যই। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে এই ট্রাডিশন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পালাগানকে হারাম বলা হইছে। It got silently banned in Bangla. Some folk singers got imprisoned just for singing such. এখন তো শুধু ওয়াজ-মাহফিল হয়। খালি ফতোয়া দেয়া চলে। গানের বিরুদ্ধে, আর্টের বিরুদ্ধে, নারীদের বিরুদ্ধে, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে, দর্শন আর বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ফতোয়া।

হ্যারিসন বললেন, But it is so wrong. Is that why we organized the Concert for Bangladesh in 1971?

লালন বললেন, ফতোয়াবাজরা তো আগেও ছিল এখনও আছে। আমারও ফতোয়া শোনা লাগছে একসময়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার সময়ে আমি যে মোল্লা-পুরুতগো দাবড়ানি খাইছি। সেই বাংলার চেহারা এখনও আগের মতই আছে। এইটাই দুঃখ। আমি তো এই জন্যই এত এত কাল আগে গান করছিলাম:

‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তা না না না’

রবি বললেন, কিন্তু সাঁইজি বাংলাদেশের তো ডেভেলপমেন্ট হইতেছে এখন। শুনলাম বুলেট ট্রেন চালু হবে। মেট্রোরেলের কাজও চালু আছে। প্রচুর বিদ্যুৎকেন্দ্র হইতেছে।

সাঁইজি মৃদু হেসে বললেন, বাইরের জিনিস গুছায়া কী হবে গো বন্ধু যদি ভিতরটাই ফাঁকা হয়া যায়! ভিতরের যা কিছু অজানা সেই অজানারে জানায় যদি বাঁধা দেওয়া হয়, তাইলে আর তোমার ঐ উন্নতি দিয়া কী করবো আমরা? মানুষ যদি মানুষরেই বিভক্ত করে ফেলায় তাইলে এই উন্নয়নে কী হবে? বাংলাদেশ তো পীর আউলিয়ার দেশ আছিল একসময়। বাউলের হাতে থাকতো একতারা দোতারা। নদীর পাড়ে, গাছের ছায়ায়, নৌকায় বসে বসে গান গাইতে গাইতে তারা খোদারে খুঁজতো। আজকে তো আর সেইদিন নাই। অবশ্য কেষ্টঠাকুর বইলা গেছেন, পরিবর্তনই ধর্ম।

হ্যারিসন বললেন, Rabi my friend, can you just translate for me the song that Shaiji just sung?

রবি বুঝিয়ে বললেন, Oh yes.. He is saying that nobody is searching for the truth. Everyone is just distracted from real work.

হ্যারিসন বললেন, So deep.. I just wanna learn Bangla and these songs. Would you help me Shaiji?

সাঁইজি বললেন, আলবাত তোমারে শিখাবো। তুমি আমার সাথে ধরতো দেখি। চেষ্টা করো।

‘ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি/ এক জলে সব হয় গো সুচি…’

নরকের হেমন্তে কৃষকেরা ধান কেটে ঘরে তুলতেছে। আর আকাশে বাতাসে ধানের ছড়ার গন্ধের সাথে গান মিশে আছে। সাঁইজি, বয়াতি, রবি আর হ্যারিসন গলা মিলায়ে গান গাইতেছে।

‘তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলেম আর পেলেম না/দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা..’

 

ফ্রি-থিংকারস ফ্রম বাঙলাদেশ

[ উৎসর্গ: পদার্থবিজ্ঞানের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অজয় রায়’র প্রতি ]

তো বেহেশত এবং দোজখের মাঝে একটা ‘No Men’s Land’ আছে। এই জায়গাটাকে পাবলিক ‘সক্রেটিসের ইউনিভার্স’ বলে। এইখানে ডান/বাম/উত্তর/দক্ষিণ/সাম্রাজ্যবাদী/আগ্রাসনবাদী কারোরই কোনো মাতব্বরি খাটে না। এইখানে সকল রকম ফ্রি-থিংকাররা মরণোত্তর পিরিয়ডে আড্ডা দেয়। এই আড্ডা বাঙালের টঙ দোকানে বইসা আড্ডার মতন না। মানে বাঙালরা তো আড্ডা মানে বোঝেই কেবল গসিপিং। কিন্তু সক্রেটিসের ইউনিভার্সে আড্ডা চলে মূলত যুক্তি এবং তর্কশাস্ত্রের নিয়ম মতো। নানান ইনোভেটিং আইডিয়া জেনারেট করা হয় এইসব আড্ডায়। এইখানে যারা আড্ডা দেয় তারা জীবিতকালে ফ্রী-থিংকার ছিলেন এবং মরণোত্তর পিরিয়ডেও তারা যুক্তিতর্কের ফিলোসোফিকেই এরাউজ করেন। মানে ঢেঁকি যেখানেই যাক, ধানই তো ভাঙবে নাকি! স্বয়ং সক্রেটিস থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং প্রমুখেরা এই ক্লাবের ফাউন্ডার। সক্রেটিসের ইউনিভার্সের বাঙলাদেশ রিজিয়নের আহবায়ক হলেন অজিত রায়।

তো শীতের মিষ্টিমধুর সকালে বাঙলাদেশের ফ্রি-থিংকাররা চাদর মুড়ি দিয়ে রোদ গায়ে মাখতে মাখতে ভাবতেছে বাঙলাদেশের বর্তমান ক্রাইসিসের কথা।

অনন্ত বিজয় রঙ চায়ে হালকা চুমুক দিয়ে বললেন, আচ্ছা? আপনাদের কী মনে হয়? বাঙলাদেশ কেন এখনও ‘শূণ্য থেকে মহাবিশ্ব’ থিওরিটা হজম করতে পারতেছে না?

অভিজিৎ রায় বললেন, হজম করার ব্যাপারটা তো তখনই সম্ভব যখন আপনে খাবারের মেন্যুতে ডিশটা ইনক্লুড করবেন। বাঙালরা তো বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত। ওরা খাবারের টেবিলেই ডিশটাকে একসেপ্ট করতে পারতেছে না। একসেপ্ট করার পর তো আপনে টেস্ট করবেন। তারপর টেস্ট খারাপ হইলে কিংবা বদহজম হইলে খাবারটা বাদ দিবেন আর নাহয় খাবারের রেসিপি একটু চেইঞ্জ করে খাবারটা সুস্বাদু করবেন। কিন্তু এই মাথামোটাগুলা তো কিছুই করতেছে না।

ওয়াশিকুর বাবু মলিন হাসি হেসে বললেন, আরে এই মডারেট বাঙাল মোল্লা মেন্টালিটি তো জীববিবর্তনের সাধারণ পাঠ’টাকেই চা-নাস্তায় এড করতে পারে নাই। এরা তো ফিমেলের স্মোকিংটারেই মেনে নিতে চায় না। মোল্লা মেন্টালিটির ফিলিংসে লাগে। বোঝেন কতটা পজেসিব মেন্টালিটির পাবলিক এরা! খালি চাপায়া দিতে চায়। অন্যের মনোভাব কেয়ারই করে না। আর আপনেরাও বলিহারি! বিজ্ঞানের কথা এগুলা যে কী বলেন? ওরা বোঝে নাকি!

অজয় রায় বললেন, বিজ্ঞান ও দর্শন-জড়ের সন্ধানে’র স্মেলটাই তো এরা নিতে পারতেছে না। আরজ আলী মাতুব্বরকেও তো এরা রিড করতে পারে না। বিজ্ঞানটাকে যদি এরা ঠিকঠাক এটলিস্ট স্মেল করতে পারতো তা-ও কাজ হইতো। কিন্তু এরা তো জাকির নায়েকরে বিজ্ঞানের পন্ডিত মানে। জাকির নায়েকের মতো মিথ্যাবাদীরে যদি বিজ্ঞানমনস্ক ভাবা হয় তাহলে তোমাদের কি আরো কিছু বলার থাকে? মানে মিথ্যাবাদীটা বলতেছে, বিজ্ঞানের সকল ইনোভেশনের কথাই আগে থেকেই কোরানে উল্লেখ আছে। তাহলে কোরান রিসার্চ করে বিজ্ঞানীরা কিছু পায় না কেন? মাতুব্বর সাহেবকে রিড করলেও এরা কিছুটা আলো পাইতো।

আরজ আলী মাতুব্বর রাগত ভাবে বললেন, আরে রাখেন আপনের আলো। এই বেকুবের দেশে কিছুই হবে না। বেকুবগুলা মরণোত্তর দেহদানের কথাই ভাবতে পারে না। মরার পরেও এগুলার শরীর দরকার হয়। কেয়ামতের সময় বলে এই দেহ মোল্লারা ফিরা পাবো। তারপর সে বেহেশতে ফূর্তি করবো। আরে গাধার বাচ্চা গাধা কেয়ামতের পরে তোর দেহ কোনডা..তোর রূহ টের পাবো কেমনে? গায়েবি দেহ লইয়া তুই ফস্টিনস্টিইবা করবি কেমনে? এগুলারে কেমনে বোঝানো সম্ভব? আপনেগো মামলার কী হইলো? এতগুলা মানুষরে যে কুপায়া মাইরা ফেললো তার বিচারের কী হইলো? ৬/৭ বছর তো হয়া গেছে।

নীলয় নীল বললেন, কেন? আপনের মনে নাই? অনন্ত বিজয় আর অভিজিৎ দাদারে তো পুলিশের সামনেই মার্ডার করছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। পুলিশরা বুড়া আঙুল চুষছে দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া।

অভিজিৎ রায় বললেন, আরে আমার কথা ছাড়ো। তোমারে তো তোমার বাসায় ঢুইকা খুন করছে। যে দেশে মানুষ নিজের ঘরেও সেইফ না সেই দেশে যুক্তি-বিজ্ঞান সেকুলারিজম ডেভেলাপ করতে আরো অনেক সময় লাগবে।

হুমায়ুন আজাদ উত্তেজিত ভাবে বললেন, আর কত সময় লাগবে? একদিন সবকিছুই নষ্টদের অধিকারে যাবে বলছিলাম; আর কিছু কি যাওয়া বাকী আছে? এরিস্টটল যেমন অসীমঅনন্তের ভয়ে ভীত হয়ে শূণ্যরে একসেপ্ট করতে পারে নাই, যে কারণে গণিত পিছিয়ে গেছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী; মোল্লারাও সেইরকম গোঁয়ার গোবিন্দ।

অজয় রায় বললেন, এই মোল্লাগুলা মরার পরেও যদি একবারের জন্য সক্রেটিসের ইউনিভার্সে জয়েন করতো; তবে কিছুটা আলোর সন্ধান দেয়া যাইতো। তা না কইরা গাধাগুলা পইচা মরবে, কিন্তু যুক্তির পথে মুক্তি খুঁজবে না।

এই সময় রাজীব হায়দার বললেন, তাইলে স্যার বাঙলাদেশের প্রাইম মিনিস্টার আর মানবাধিকার অফিসগুলাতে কয়েকটা লেটার পাঠাবো নাকি? যাতে বিচারকার্য তাড়াতাড়ি অগ্রসর হয় আরকি…

অজয় রায় দুঃখিত কন্ঠে বললেন, নাহ। এখন আর ইচ্ছা করে না। জীবিত যখন ছিলাম তখন তো ব্লগারহত্যার ব্যাপারটা নিয়ে দপ্তরে দপ্তরে কম ঘুরি নাই। দুনিয়াতে কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলা তুমি চাইলেও কোনোভাবেই প্রোটোকলের ব্যতিক্রম ঘটাইতে পারবা না। তাই সেই আশা এখন ছেড়ে দিছি। সক্রেটিসের ইউনিভার্সেই এখন শান্তিতে আছি। আর দেখো বাঙলাদেশ তো শান্তিতে নাই। সেই সময় প্রোপার টেইক কেয়ার করে নাই দেখেই তো এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার সাহস পাইছে মৌলবাদীরা। তোমাদের মতো সোনার ছেলেগুলারে মাইরা ফেললো। অথচ এক ফোঁটা মানবিকতাও দেশ তোমাদের দেখাইতে পারলো না। উল্টা নাস্তিকতার ট্যাগ দিয়ে হত্যারে জায়েজ কইরা ফেলার দুষ্ট ফন্দি করলো দেশ। তারপর দেখো হলি আর্টিজেনের মতো ব্যাপারও ঘটে গেল। আমি আর আশা রাখি না।

হুমায়ুন আজাদ বললেন, যা-ই বলেন… ছেলেগুলা লেটার পাঠাইতে চাইলে পাঠাক। সমস্যা তো নেই। আপনি আশা ছাড়লেও, ওরা তো এখনও স্বপ্ন দেখে।

হুমায়ুন আজাদের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। বসে বসে স্বপ্নে দেখলো একটা বাঙলাদেশ। কুয়াশায় ঢাকা মাঠের পর মাঠ। হেমন্তের ধান-কাটা শেষে হলুদ হলুদ হয়ে গেছে মাঠ। পুকুরে হাঁসগুলা মনের আনন্দে সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে। আর একজন পুরোহিত, একজন ইমাম, একজন প্রিস্ট, একজন চার্বাক, একজন বৌদ্ধ, একজন নাস্তিক আর একজন অজ্ঞেয়বাদী পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁসেদের জলকেলি উপভোগ করছে। নির্মল আনন্দে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেছে।