লিখেছেন: অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

[ পাঠ্যাভ্যাসের ক্রমে, পড়ুয়া থেকে সাধারণ পাঠক, আদর্শ পাঠক ও নিবিড় পাঠক হয়ে ওঠার মধ্যেই নিহিত আছে পাঠকতন্ত্রে পৌঁছনোর সোপানগুলি । বাঙালির মধ্যে পড়ুয়া হয়ে ওঠার প্রাথমিক প্রেরণাটুকু মোটের ওপর বহুকাল আগেই দেখা গেছিল । কেননা জীবনযাপনের প্রয়োজনেই তার কদর ছিল । বাঙালির আদি-সমাজে জীবনযাপনের এই রীতি যে স্তরে বিন্যস্ত ছিল তার সঙ্গে সভ্য সমাজের পাঠক তন্ত্রের কোনো যোগ নেই । পড়ুয়া হয়ে ওঠা সম্পূর্ণভাবে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত একটা বিষয় । পাঠকতন্ত্রের উচ্চস্তরে পৌঁছনোর মনোপ্রবৃত্তি গঠনের সঙ্গে এর সঙ্গতি ক্ষীণ । তবুও পড়ুয়া হওয়ার প্রাথমিকতার মধ্যেই ভবিষ্যতের পাঠকের বীজটি উপ্ত আছে, এটুকু স্বীকার করতেই হয় । তাই সাধারণ বাঙালি সমাজে পড়ুয়ার ইতিহাস বিষয়ে দৃকপাত করার পরেই প্রকৃত চিত্রটি স্পষ্টতর হবে ।]

 

“আজ বাঙালী জীবনে যে জিনিসটা প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ সেটা এই : মৃত্যুযন্ত্রনারও অনুভূতি নাই; আছে হয় পাষাণ হইয়া মুখ বুজিয়া সহ্য করা, অথবা সংজ্ঞাহীন হইয়া প্রাণ মাত্র রাখা; আরেকটা ব্যাপারও আছে – জাতির মৃত্যুশয্যার চারিদিকে ধনগর্বে উল্লসিত বাঙালী প্রেত ও প্রেতিনীর নৃত্য”
-নীরদচন্দ্র চৌধুরী

শিবনারায়ণ রায়ের লেখা একটি বইয়ের নাম ‘মূঢ়তা থেকে মানবতন্ত্রে’ । পড়ুয়া থেকে পাঠকতন্ত্রে যাত্রাপথের দ্যোতনা এর চেয়ে কিছু আলাদা নয় । বাঙালির সমাজে পড়ুয়ার ইতিহাসে প্রাচীনত্বের খোঁজ মিললেও পাঠকসত্তাকে শুধুমাত্র উনিশ শতকের নবজাগরণের একটি অন্যতম ফল বলা যায় । নবজাগরণের প্রভাবে বাঙালির সমাজে ও জীবনে যে-কটি নতুন দিক খুলে গেছিল তার মধ্যে পাঠক হয়ে ওঠার দক্ষিণ দুয়ারখানি ছিল সবচেয়ে মৌলিক । এবং বলাই যায়, বাঙালি যদি না এই পাঠকসত্তায় উত্তরণ করতে পারত তবে বাকি দিকগুলির প্রকট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল বড়ই ক্ষীণ, একপ্রকার অসম্ভব। ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবেই যে বাঙালি মানসিক জীবনে পাঠকসত্তায় উন্মোচিত হয়েছিল তার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষনগুলিও প্রচ্ছন্ন নয় । এর প্রধানতম হল, বাঙালিত্বের ইতিহাসসন্ধানের মধ্যে দিয়ে আত্ম-গৌরবের স্পর্শ পাওয়ার প্রচেষ্টা । তাইতো, একদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের, ‘বাঙ্গালির ইতিহাস নাই’ থেকে ইউরোপীয় ধাঁচে ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখের আবির্ভাব যেমন দেখা যায়, তেমনই ইংরেজি-বর্জনের মধ্যে দিয়ে জাত্যাভিমানের বিপ্লবীয়ানার নজিরও অপ্রতুল নয়।  অন্য আরেকটা ইঙ্গিত হল এই যে, এই সময়েই অর্থাৎ উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে গ্রন্থ-হাতে আত্ম-প্রতিকৃতি আঁকানোর বা তোলানোর যে পরম্পরাটি দেখা যায় তা ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী সময়ে ছিল বিরলতম ঘটনা । রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র প্রায় প্রত্যেকরই এরকম প্রতিকৃতি আছে । আসলে এই যুগ থেকেই গ্রন্থ হয়ে ওঠে শিক্ষায়-দীক্ষায়, শিষ্টাচারে-গরিমায় মননগত অভিজাততন্ত্রের প্রতীক । প্রত্যয়ের সঙ্গেই বোধহয় বলা যায়, বাংলায় বিদেশি ধারার মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাবই বাঙালিকে তার চিরকালীন পড়ুয়াসত্ত্বা থেকে পাঠকতন্ত্রে অগ্রসর হবার পথে ঠেলা দিয়েছিল । হাতে লেখা পুঁথির দ্বারা যা সম্ভব ছিল না, বিদেশের মুদ্রণযন্ত্র এসে সেটাকেই বাস্তবায়িত করেছিল । আর সেজন্যেই বোধহয় আজও বিদেশের গোঁতার ছাপ কারো নাম-পদবীর আগেপিছে জ্বলজ্বল করলে, তার প্রতি একটা সম্ভ্রমের ভাবে গদগদ হবার ঠাট বাঙালি বজায় রেখেছে, তার জ্ঞান-বুদ্ধিবৃত্তি-মানসিক স্তর এখানে জরুরি নয় । নইলে আজকের দিনে এসে কি উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধের শেষে আত্ম-পরিচয়ের ঢক্কা-নিনাদের প্রয়োজন হত, শুধুমাত্র লেখক পরিচয়ই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা যেত না । বিশেষজ্ঞতা প্রমাণের জন্য লেখার মানের থেকে কেন বেশি দরকারি হবে দেশের কিংবা বিদেশের পদ কিংবা ডিগ্রীর তপ্ত গালার আইএসআই চিহ্ন ? সে-হিসেব ধরলে তো রবীন্দ্রনাথ একেবারে আনাড়ি লেখক প্রতিপন্ন হয় । হলে হোক, লেখকের অদৃষ্টে যা আছে তা লেখকের আত্মসম্ভ্রমবোধের বিষয় কিন্তু দেশের পাঠকতন্ত্র ব্যক্তিগত সত্ত্বা নয়, জাতিগত সামগ্রিকতার প্রতিফলন । সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করাই উচিৎ, অন্তত গ্রন্থের কল্যাণের খাতিরে। পাঠকতন্ত্র এদেশে যেন ক্ষুদ্রগোষ্ঠির মানসিক আভিজাত্যের মানদণ্ড হয়েই রয়ে গেছে । সাধারণ্যে বিকশিত হতে পারেনি । সাধারণ উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত বাঙালির সার্বিক অন্তরে পড়ুয়া হবার রেওয়াজই মূল সুর হয়ে টিকে আছে, পাঠক হয়ে ওঠার অনুরণন ধ্বনিত হয়নি । যদিও বিশ শতকের একসময়ে মধ্যবিত্তের কাছে অর্থের চেয়ে শিক্ষা-রুচি ও জীবনের মেজাজ খানিক প্রাধান্য পেয়েছিল, কিন্তু আজ সে ধারা সম্পর্কে প্রকাশক ও লেখকদের মধ্যে অভিযোগের অন্ত নেই । আজকের দিনে পাঠতন্ত্র আবার এমন এক বিদ্রূপাত্মক কটাক্ষের শিকার হয়েছে যে, পাঠচর্চাকারীর মধ্যে উন্নত জীবনযাপনের দরুন উদ্ভূত স্পর্ধা তো দূরে থাক, হয় চোর ধরা পড়ার লজ্জা নয় স্রেফ বিনয়ের ভঙ্গিতে তা স্থানত্যাগের কৌশলে পরিণত হয়েছে । অদ্ভুতভাবে পালিয়ে বাঁচার ধুম লেগেছে হৃদকমলে – বইপড়া যেন ভারি অপরাধ । আজকাল জীবিকার সঙ্গে পাঠের সরাসরি যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ বাঙালির পাঠ্যাভ্যাসের লক্ষন একেবারেই দেখা যাচ্ছে না । আর যাদের সে বালাই নেই তাদের তো কথাই নেই । শুধুমাত্র যাপনের আঙ্গিকেই বই-পড়া যে সভ্য সমাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এমনটা যেন আর কেউ-ই মনে করতে পারছে না । কোনও মহলেই আর এই ধারণা তিলমাত্র স্থান পাচ্ছে না । আর তাই-ই ফ্ল্যাট-বাড়ি হোক বা পৈতৃক-বাড়ি, স্বচ্ছল পরিবারেও পড়ার ঘরের দেখা পাওয়া দূরস্থান, কেবলমাত্র বইয়ের জন্যই বরাদ্দ দুটো আলমারিও বেশিরভাগ জায়গায় নেই । সেজন্যেই কি আজকাল একটাও প্রকাশক কোনও লেখকের নন-একাডেমিক বই সম্বন্ধে এতটা আত্মবিশ্বাসী হন না যে দু-হাজার বইয়ের ফরমায়েশ মুদ্রণালয়ে পাঠাতে পারেন ? হয়তো সেটাই, পারলে কি আর ‘প্রিন্ট অন ডিম্যান্ডের’ রমরমা হত, নাকি চৈত্রসেলের মত বইমেলা করে মেলার হুজুগে বই বিক্রির কৌশল প্রকাশকদের অস্তিত্বরক্ষার জন্য ভেবে ভেবে বের করতে হত? তথ্য বলছে, ১৩৫ কোটির দেশে নন-একাডেমিক সফল বই হিসেবে ২০০০ কপি ও বেস্টসেলার হিসেবে ১০০০০ কপিই যথেষ্ট, পার্সেন্টেজের হিসেব সৌজন্যের খাতিরে না করাই মঙ্গল । এটা যদি সভ্য সমাজের পাঠকতন্ত্রের অতিমারী না হয় তবে কোনটা ? একাডেমিক ক্ষেত্রেও ‘নোট-পত্র’র দৌলতে বাজারের অবস্থা কদিন মঁ-মঁ করে সেটাও দেখার । সুতরাং, বাংলার চিরকালীন পড়ুয়া ও পাঠকের দুনিয়ায় গোত্তা মেরে দেখতেই হয়, যদি ‘আজকালকার’ বা একুশ শতকের ‘পাঠ-বর্জনেই সুখ’ নামক মানসিক-ব্যাধীর উৎসটুকুও জানা যায় তাতে, তাহলেই বলা যাবে ‘অনেক দিয়েছ নাথ’ ।

 

বাঙালির শিক্ষা ব্যবস্থা মোটের উপর জীবিকা-নির্ভর । অতীতে জীবিকার মূল আশ্রয় যেহেতু ছিল ধর্ম ও ধর্মশাস্ত্রের ভাষা হিসেবে ছিল মূলত সংস্কৃত, তাই ধর্মকেন্দ্রিক ও সংস্কৃত ভাষাকেন্দ্রিক পড়াশুনোই ছিল প্রধান । তাছাড়া অন্যান্য অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রের পারদর্শীতাগুলিও এই ধর্মাচারণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই সৃষ্টি হয়েছিল । সুকুমার সেনের ‘বঙ্গ-ভূমিকা’ গ্রন্থ থেকে মধ্য সপ্তম শতাব্দির বাঙালির শিক্ষাপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যাচ্ছে যে,

 

“সেকালে সংস্কৃত-শিক্ষার প্রথম পাঠ্য পুস্তক কী এবং কেমন ছিল সে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান দিয়ে গিয়েছেন চীনীয় পরিব্রাজক বৌদ্ধ ই-সিঙ (মধ্য সপ্তম শতাব্দী) । … ই-সিঙ বলেছেন – সংস্কৃত শিক্ষার্থীর প্রথম পাঠ্য বই ‘সি-তন-চঙ’ (= সিদ্ধপ্রবন্ধ?), নামান্তর ‘সিদ্ধিরস্তু’ । (‘সিদ্ধিরঅস্তু’ বলে গ্রন্থারম্ভ হত তাই এই নাম প্রচলিত হয়েছিল, অনেকটা যেমন বর্ণপরিচয়ের নাম হয়েছে ‘প্রথম ভাগ’ ।) বইটির এই নাম পরবর্তীকালেও প্রচলিত ছিল । সিদ্ধাচার্য সরহ তাঁর দোঁহাকোষের এক শ্লোকে বলেছেন, ‘সিদ্ধিরত্থু মই পঢমে পঢিঅউ / মণ্ডু পিঅন্তেঁ বিসরিঅ এমউ’।… ই-সিঙ বলেছেন, সিদ্ধিরত্থুতে ঊনপঞ্চাশৎ বর্ণের উপদেশ ছিল । ছ’বছর বয়সে ছেলেরা এই বই ধরত আর ছ’মাসে তা শেষ করত” ।

 

সে-সময়ে ‘ব্রহ্মচর্য’ বা ১৪ থেকে ২০ বছর বয়স অব্দি গুরুগৃহে থেকে বেদ-উপনিষদ চর্চা করে জ্ঞান অর্জন করার ক্ষয়িষ্ণু যুগধর্মই ছিল চলতি রীতি । অন্যদিকে ছিল বৌদ্ধযুগের মঠ কিংবা বিহার-মহাবিহারের শিক্ষার ধারা, নালন্দা যার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ । সেখানে শিক্ষার পাঠক্রম সম্বন্ধে মহম্মদ তহিদুল ইসলাম লিখেছেন যে,

 

“All the Buddhist vihars and sangharamas in Bengal were centers for the cultivation of Buddhist learning. The curriculum included various subjects such as grammar, philology, medicine, astronomy, music and arts, chaturveda, sankhya, Mahayana shastras, yoga shastra etc” ।

 

গুরুগৃহ থেকে টোল-পাঠশালা কিংবা মঠ-বিহার অব্দি যে পাঠতন্ত্র প্রচলিত ছিল তাকে জীবনধারণ ও ধর্মাচারণের জন্য প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না । জনজীবনে এর বাইরে বড়জোর রামায়ণ-মহাভারতের নানা ঘটনার স্মৃতিটুকু ছিল । এই যুগ কেটে গেলে পরে, পরবর্তীকালে সুলতান সাম্রাজ্যের বিস্তারের ফলে বৈদিক শিক্ষাপ্রণালীর ধারা আরও ক্ষীণ হয়ে গিয়ে একপ্রকারের লৌকিক বা গ্রাম্য জীবনাচার প্রচলিত হয়েছিল – সেটিও ধর্মজীবনকে অতিক্রম করতে পারেনি । যার অনুবর্তনেই ফল হিসেবে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এর দেখা মেলে । এই ধারা চলেছিল প্রায় ইংরেজ আগমণের কাল অব্দি । এই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাঙালির পড়ুয়া জীবনের বর্ণনা পাওয়া যায় রাজশেখর বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে । শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ লিখছেন যে,

 

“পঞ্চম বর্ষ অতিক্রম করিলেই হাতেখড়ি দিয়ে বিদ্যারম্ভ করানো হইত । … একমাত্র শিক্ষক, গুরুমহাশয় বেত্রহস্তে মধ্যস্থলে একটি খঁটি ঠেসান দিয়া বসিয়া থাকিতেন । সর্দ্দার পড়ুয়ারা অর্থাৎ উচ্চশ্রেণীর বালকেরা সময়ে সময়ে শিক্ষকতা কার্যে তাঁহার সহায়তা করিত । বালকেরা স্বীয় স্বীয় মাদুর পাতিয়া বসিয়া লিখিত । লিখিত এইজন্য বলিতেছি, তৎকালে পাঠ্যগ্রন্থ বা পড়িবার রীতি ছিল না । কিছুদিন পাঠশালে লিখিয়া ব্রাহ্মণ পন্ডিতের সন্তানগণ টোলে গিয়া ব্যাকরণ পড়িতে আরম্ভ করিত এবং যাঁহারা সন্তানদিগকে রাজকার্য্যের জন্য শিক্ষিত করিতে চাহিতেন, তাঁহারা তাহাদিগকে পারসী পড়িতে দিতেন । যারা জমিদারী সরকারের কর্ম করিতে বা বিষয়-বানিজ্যে নিযুক্ত হইতে চাহিত, তাহারাই শেষ পর্যন্ত গুরুমহাশয়ের পাঠশালে থাকিত”।

 

তারপরে কী হত ? রাজনারায়ণ বসু ‘সেকাল আর একাল’-এ বলেছেন,

 

“দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত তালপাতে; তারপর পনের বৎসর বয়স পর্যন্ত কলার পাতে; তারপর কুড়ি বৎসর বয়স পর্যন্ত কাগজে লেখা হইত । সামান্য অঙ্ক কষিতে, সামান্য পত্র লিখিতে ও গুরুদক্ষিণা ও দাতাকর্ণ নামক পুস্তক পড়িতে সমর্থ করা, গুরুমহাশয়দিগের শিক্ষার শেষ সীমা ছিল । … যে জ্ঞানের দ্বারা হৃদয় মন সমুন্নত হয়, জগত ও মানবকে বুঝিবার সহায়তা হয়, এমন কোনও জ্ঞান দেশে বিদ্যমান ছিল না । এমন কি বেদ বেদান্ত গীতা পুরাণ ইতিহাস প্রভৃতি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থসকল পন্ডিতগণেরও অজ্ঞাত ছিল” ।

 

সুতরাং, কাজ চালানোর বিদ্যে অর্জনের মধ্যে দিয়েই বাঙালির জীবন চিরকাল অতিবাহিত হত । সেখানে মানবজীবনের বৌদ্ধিকতা অর্জন কেবলমাত্র ব্যতিক্রমের মতই ছিল, উদাহরণের শূণ্যস্থান পূরণে ছিল অকৃতকার্য । ব্রিটিশ আগমনের পরে শিক্ষার এই হাল দেখে  তৎকালীন মিন্টো সাহেব লেখেন যে,

 

“এদেশিয়দের মধ্যে বিজ্ঞান আর সাহিত্য অবনমন ব্যাপক । এখানে শুধু যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে তাই নয় বরং যে যে বিদ্যার চর্চা তাঁরা করেন সেসব গণ্ডিও সংকীর্ণ হচ্ছে । মনোবিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি লোকজন বুঝতে পারছে না, এমনকি অতিসুন্দর সাহিত্যের রুচি নিম্নগামী, শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাস ছাড়া অন্য কোনও কিছুই যেন মনে জায়গা পাচ্ছে না। ফলে যত ভাল ভাল বই আছে সব হারিয়ে যেতে বসেছে” ।

 

এটাই ছিল উনিশ শতক অব্দি হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার নমুনা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পড়ুয়ার আদি-জীবন । এখানে পাঠকসত্ত্বা কোথাও নেই । অন্যদিকে মুসলিম সমাজেও যে এর ব্যপক ব্যতিক্রম দেখা গেছিল এমনটা নয় । তবে এই সময়ে মুসলমান সমাজে হিন্দুদের চেয়ে আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার অন্য একটি রূপ দেখা দিয়েছিল। তহিদুল লিখেছেন,

 

“After the Muslim conquest of Bengal, different types of centers developed in different places of Bengal. The earliest center was Masjid, which was primarily a center for prayer. Maktab was developed as primary educational center. The formal educational institution was Madrasah. Majilis, Khanqah were developed as centers of divinity around Sufi-saints, which in course of time turned into higher educational centers” ।

 

যদিও জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চিনদেশে যাওয়ার কথা মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত আছে, তবুও এ-দেশের মুসলমানের পড়ুয়াজীবন তাকে অর্জন করতে পারেনি । একই গতের বাঁধনে তা ছিল টানা দেওয়া । হিন্দুদের সঙ্গে মূলগত পার্থক্য এখানে প্রায় কিছুই ছিল না । তহিদুল এ প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন যে,

 

“The content of primary education included all the basic courses of Islamic studies and practices such as correct recitation of the Holy Qur’an, principles relating to ablution, five time prayers (salah), fasting, Pilgrimage (hajj), zakah, and basic teachings from the Holy Qur’an, Hadith and Fiqh. Along with these subjects, the elements of Arabic, Persian and Bangla languages, some basic education on diverse subjects such as arithmetic, history, mathematics, geography etc. were also taught to the students in the Maktabs” ।

 

এবং এরপরের ধাপে অর্থাৎ উচ্চস্তরের শিক্ষায়,

 

“The Madrasahs were institutions of secondary and higher secondary level education and the Majilises were the institutions used for higher education. Different branches of Islamic Sciences, such as Tafsir (Exegesis), Hadith (Traditions of the Prophet), Fiqh (Islamic law), Usul-al-Fiqh (Principles of Islamic law), Tasawwuf (Mysticism), Adab (Literature), Nahu (Grammer), Kalam (Scholaticism), Mantiq (Logic) were mainly taught in the Madrasah and Majilis…. They learnt Persian books Panjnama, Gulistan, Amadnama, Bostan, Yusuf-Zuleikha, Sikandarnama, Bahar Danish and Arabic books Mizan, Munshaib, Sarf Mir, Miat Amil, Sarh-i-Miat Ami and others. The chief aim was to attain such proficiency in the Persian language as might enable them to earn their livelihood” ।

 

পক্ষান্তরে জীবিকার জন্যও যেটুকু শিক্ষা ছিল তাও ছিল কেবলমাত্র উচ্চশ্রেণির জন্য বরাদ্দ – হিন্দু-মুসলমান সমাজ নির্বিশেষে । সুতরাং, উচ্চস্তরীয় সাহিত্য সম্বন্ধে বা পাঠ্যাভ্যাসে সকল সমাজে নিম্নবর্গের জন্য কোনও উন্মুক্ত দ্বার ছিল না । ফলে, নিম্নস্তরে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও আনুগত্য ছাড়া আর কিছুই প্রচলিত ছিল না । ব্রিটিশ আগমণের পরে এই দেশে শিক্ষার হাল কিছুটা ফেরে, একথা সত্য । কিন্তু হিন্দুর সমাজ এই শিক্ষাকে যতটা গ্রহণ করেছিল বা করতে পেরেছিল, মুসলমান সমাজ আবার যেন ঠিক ততটাই প্রত্যাখ্যান করেছিল । ফলস্বরূপ হিন্দুর সমাজে জ্ঞানের প্রতি একটা ঝোঁক দেখা যায় ও খুব দ্রুততার সঙ্গে হিন্দুর এক অংশ জ্ঞানে-বিদ্যায় ও যাপনে অনেকটা এগিয়ে যায় । আর তার ধাক্কা এসে লাগে জনজীবনে । প্রাথমিকভাবে তা সমগ্রসত্তায় প্রসারিত না হলেও, পরবর্তীকালে এর প্রভাব জনসমাজেও বিস্তারিত হয়েছিল । কিন্তু, মুসলমান সমাজে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় কোনও ইউরোপিয়ান ধারার প্রভাব সেখানে আহামরি ছিল না । ধর্মের খাতিরেই বোধহয় তারা এই প্রভাবকে অস্বীকার করেছিল । সে কারণেই আজও মুসলমানদের মধ্যে ইসলামীয় ধারার একটা আদি অনড় অবস্থান দেখতে পাওয়া যায় । এ ব্যাপারে উত্তরাপথের হিন্দুর সঙ্গে এ দেশের মুসলমানের ফারাক নিতান্ত মামুলি । তবে ইউরোপীয় প্রভাবে হিন্দু সমাজে যে সবাই পড়ুয়াস্তর অতিক্রম করে হু-হু করে পাঠকস্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিল – তা মোটেই নয় । বরং আদি ধারার জীবিকার খাতিরে পড়াশুনোকেই বাঙালি ধরে রেখেছিল । স্বাধীনতার পরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি । তাই উনিশ শতকের ওকালতির ইঁদুরদৌড় থেকে বাঙালি বিশ শতকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র হয়েছে মাত্র এবং আজও সরকারি চাকুরির মোহে প্রাণপাত করছে । এই অবস্থা আরও অধোগতিপ্রাপ্ত হয়েছে একুশ শতকে । বাঙালি সত্যিই অবস্থারই বশীভূত, অবস্থা বাঙালির নয় । ব্রিটিশ আমলের সঙ্গে এই ধারাকে কোনভাবেই আলাদা করা যায় না । ব্রিটিশ আমলে বাঙালি পড়ুয়ার ইংরেজি শিক্ষার দশা কীরকম হয়েছিল সে কথাও রাজনারায়ণ বসুর জবানি থেকেই জানতে পারা যায় । তিনি লিখেছেন যে বাঙালি ইংরেজি শিখে কেরানির চাকুরির হুজুগে ডিকশনারি মুখস্ত করেছিল এই ধারায়,

 

“পমকিন লাউ কুমড়া, কোকোম্বার শশা / ব্রিঞ্জেল বার্তাকু প্লোমেন চাষা” ।

 

শুধু তাই নয়, অপরিচিত ব্যক্তির নাম জিজ্ঞাসা করল, ‘What denomination put your papa?’ এই বলে আর বাবার শরীর খারাপ হলে পরিচিত কেউ খবর নিতে এলে তাকে উত্তর দিত নাকি এই বলে যে,

“আমার father yesterday কিছু unwell হওয়াতে doctor কে call করা গেল, তিনি একটি physic দিলেন । physic বেশ operate করেছিল, four five times motion হল, অদ্য কিছু better বোধ কচ্চেন” ।

এ ব্যপারে যেন ১৮৭৪ সাল আর ২০২০ সালে কোনও ফারাক দেখতে পাওয়া যায় না, গেলে ‘বাবার হল আবার জ্বর সারিল ঔষধে’র ইতিহাসচেতনা বাজারমাত করত না । আক্ষেপের সুরে রাজনারায়নবাবুও যা জানান, আজকের বিদগ্ধজনেরাও তো তাই-ই বলেন । রাজনারায়ণবাবুর সঙ্গে  মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে । তিনি জানাচ্ছেন যে,

 

“এক্ষনে স্কুল কলেজে যে শিক্ষা প্রদত্ত হইতেছে, তাহাতে কি বিশেষ উপকার দর্শিতেছে ? কই অদ্যাবধি দুই একটি লোক ব্যতীত সাহিত্য কিম্বা বিজ্ঞান বিষয়ে কেহ নতুন রকম লিখিতে অথবা আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইলেন না । বাহিরে শেক্সপীয়র, মিল্টন ও ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের চাকচিক্য ভিতরে সব ভুয়া”।

 

কত ঢিল ছুঁড়লে পরে বাঙালির মন-ডোবায় সামান্য তরঙ্গ ওঠে, কেউ জানে না । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও জানেন না । তবুও তিনি ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে আরেকটি পাটকেল নিক্ষেপ করেছিলেন । একুশ শতকে নতুন শিক্ষানীতির আনয়নের আগে অব্দি তার সঙ্গে যার বিশেষ পার্থক্য করা সম্ভব নয় । ব্রিটিশ প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিনি ছাঁচে ঢালা শিক্ষানীতি ২০২০ কী ফল দেবে সেকথার বিচার সময়সাপেক্ষ কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালেও কেন বাঙালির পড়ুয়া জীবনের মর্মার্থ বদলালো না, প্রমুখ শিক্ষাবিদ সহ নানা চিন্তকের কন্ঠে বারংবার অভিযুক্ত হতে থাকল সেটাই আশ্চর্যের । কিন্তু একথাও সত্য যে এর বিচার করতে যাওয়া মুর্খামি । কেননা এর উত্তর একেবারে সাদা-সাপটা ।

ঐতিহ্যপ্রিয় বাঙালিমনে পূর্বপুরুষীয় প্রথানুগত্যের টানা তো ছিলই, তার ওপরে এসে ঠেকেছিল বামপন্থী-অতিবামপন্থী ধারার মোক্ষম পোড়েনটি । ফলে, বাংলায় কংগ্রেসি আমল অব্দি পড়ুয়াসত্ত্বার যেটুকু শুচিতা শিক্ষাঙ্গনে বজায় রাখা গেছিল তা পরবর্তীকালের অতিবামপন্থীবাদের পরাজয়ের পরে একেবারেই রক্ষা করা গেল না । বাঙালির পড়ুয়াজীবনটিকে ‘ইংরেজি হঠাও’ কিংবা ‘কম্পিউটার পুঁজিবাদের অস্ত্র’ ইত্যাদি স্লো-গান একেবারে ধূলিসাৎ করে দিল। বামপন্থার ট্রাডিশনাল রেজিমেন্টেশনের দলতান্ত্রিক ‘আমরা-ওরা’র সংস্কৃতি বাঙালির পড়ুয়াজীবনকে রুজিরোজগারের জন্য পড়াশুনোর চাপ থেকেও মুক্ত করে দিয়েছিল । এবং আজ তার অমলিন প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। রুজিরোজগারের জন্যও পড়াশুনোর প্রয়োজন নেই, কেবল ডিগ্রিটুকু বা ‘আমাদের লোক’ হলেই হবে – এমন মনোভাবই সাধারণ বাঙালিকে আর পড়ুয়াটুকুও থাকতে দেয়নি । ফলে এখন সেইসব বাবা-মায়ের সন্তাদের মধ্যে থেকে যারা সাহিত্যের ছাত্র তারা বিজ্ঞানের ধার মাড়ায় না, বিজ্ঞানের ছাত্ররা সাহিত্যের ছায়া দেখে না ও সর্বোপরি সিলেবাসের বাইরে কোনকিছুতেই আগ্রহ আর জনমানসে চোখে পড়ে না – এ যেন ঠিক সেই যুগ যখন বাবা-মায়েদের মধ্যে যাহারা সন্তানদিগকে রাজকার্য্যের জন্য শিক্ষিত করিতে চাহেন, তাঁহারা তাহাদিগকে বিশেষ প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আয়েসে পড়িতে পাঠান । যাহারা সরকারের কেরানি কর্ম করিতে দিতে চাহেন তাহারা মাস্টার্স অব্দি ঘষটানি দেন আর যাহারা বিষয়-বানিজ্যে নিযুক্ত হইতে চাহে তাহারা সচরাচর প্রতিবেশীর গালিগালাজ খাইয়া নিবৃত্ত হইয়া যায়, বাকিরা মুখপুস্তিকায় বিনা প্ররোচনায় স্বাধীনভাবে কবিতা লেখে কিংবা ছবি তোলে।

 

এমতাবস্থায় বরং ব্যক্তিগত মতামতের খাতিরে বললে বলা যায় তৃণমূল শাসিত সময়ে পাঠক্রমের কয়েকটি ধারায় উন্নতির চেষ্টাই হয়েছে – নিন্দুকরা যে যাই বলুক, নইলে সতীনাথ ভাদুড়ির লেখা মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরে আসত না, আর পাটিগণিত ও বীজগণিত যে আলাদা নয় তাও বোঝা যেত না – কিন্তু ততদিনে যেহেতু বাংলা মিডিয়মের শেষ নিঃশ্বাস ওঠার দিন চলে এসেছে ও শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কটি ক্রেতা-বিক্রেতার আদলে গঠিত হয়ে গেছে, তাই এই উন্নতি কেবলই কেতাবি হয়েই রয়ে গেছে, ফলপ্রসূ হয়নি । ফলে বাঙালি আজও পড়ুয়াতন্ত্রকে অতিক্রম করতে পারেনি । সেই মধ্য সপ্তম শতাব্দি থেকে একুশ শতাব্দি অব্দি । বরং আজ যেন তার পশ্চাদপসারনই দেখা যাচ্ছে । ফলে অদূর ভবিষ্যতেও যে পারবে এমন আশা না করাই শ্রেয় । সুতরাং, প্রকাশক ও লেখকদের অভিযোগের দিন সোনার চাদরে মোড়া । যে দেশে লিটেরাসির সংজ্ঞা, কোনও মানুষের যে কোনও একটি ভাষায় লিখতে, পড়তে ও বুঝতে পারার সক্ষমতা হয়, সে-দেশে পাঠকস্তরে উন্নীত হবার প্রবৃত্তি দেখা দেবে কী করে – সেটাই প্রশ্ন । মোটের ওপর এই হল সাধারণ বাঙালির পড়ুয়াজীবনের ইতিবৃত্ত, সেখানে পাঠকজীবন কোথাও নেই । বাঙালি কোনকালে পাঠকতন্ত্রে উত্তীর্ণই হয়নি – না সেকালে না একালে – এটাই সত্যি ।

 

তাই বলে, বইপত্র একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না, কেউই পড়ছে না – এমনটা বলা ঠিক নয় । নিশ্চয় পড়ছে, নিশ্চয় কিনছে কিন্তু সেই ব্যতিক্রমি জনসংখ্যার দ্বারা একটি সভ্য-জাতির পাঠকস্তরের সামগ্রিকতাকে বিচার করা যায় না । সাড়ে ন’কোটির রাজ্যে কেন প্রকাশক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রথমবারেই ১০০০০ কপি বই ছাপাতে পারবেন না, কেন লেখককে লেখার জীবন ছাড়াও অন্য একটি আয়ের উৎস খুঁজতে হবে, কেন লেখককে লেখা ছাড়াও ছাপার খরচের ভাগ বহন করতে হবে, কেন লেখক-প্রকাশকের মধ্যেকার সম্পর্কগুলি এতটা অবিশ্বাসের ও তিক্ততার গরলে নীল হবে ? এর মূল কারণ হল পড়ুয়াস্তর থেকে সভ্য বাঙালির পাঠকতন্ত্রে উত্তীর্ণ না হতে পারার নিবীর্যতার পঙ্গুত্ব । সঙ্গীতের দুনিয়াতেও এই প্রবণতা শুরু হয়ে গেছে । চলচ্চিত্রের সঙ্গীত ছাড়া শিল্পীর ব্যক্তিগত অ্যালবামের দিন শেষ হয়ে গেছে । ফলে একদিকে পড়া অন্যদিকে শোনা – দু’দিকেই বাঙালি ভ্যানিস । একটি জাতির পক্ষাঘাতগ্রস্থ বেঁচে থাকা ছাড়া একে তাই আর কিছুই বলা যায় না, তবুও যদি বাণিজ্য করে পয়সা করতে পারত তাহলেও রক্ষা করা যেত একটা কিছু । সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জবানিতে, “মন্বন্তরে মরি নি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি/বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশীষে অমৃতের টিকা পরি” অর্থাৎ ‘বিধির আশীষ’ ব্যতীত যে বাঙালির পক্ষে বেঁচে থাকাই কঠিন ব্যাপার, সেখানে নিজের উদ্যমে পাঠক হয়ে উঠে জীবনের ব্যাপ্তি প্রসারিত করে আলোকপ্রাপ্ত হবে – এমন প্রত্যাশা সোনার পাথরবাটি । কিন্তু কেন এমন হল ?

 

যে দেশে দু-দু’বার নবজাগরণ ঘটেছে সে দেশে কেন এরকম জাতীয় দুর্ভাগ্য দেখা দিল ? পড়ুয়া থেকে পাঠকস্তরে উত্তীর্ণ হবার পথে প্রকৃত বাধাটা কোথায় ? বাধা হল শিক্ষার পদ্ধতিতন্ত্রে । রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

 

“যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎপরিমাণে আবশ্যকশৃঙ্খলে বন্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎপরিমাণ স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা অর্থাৎ অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না– বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।”

 

চিরকাল ধরে বাঙালির এই শিক্ষাব্যবস্থা ছেলেবেলাতেই একজন হবু পাঠকের ভ্রূণহত্যা করে এসেছে। কীভাবে, সে ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

 

“বর্ণবোধ, শিশুশিক্ষা এবং নীতিপুস্তকের অভাব নাই, কিন্তু তাহাকে আমি শিশুদিগের পাঠ্যপুস্তক বলি না।  পৃথিবীর পুস্তকসাধারণকে পাঠ্যপুস্তক এবং অপাঠ্যপুস্তক, প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। টেক্‌সট বুক কমিটি হইতে যে-সকল গ্রন্থ নির্বাচিত হয় তাহাকে শেষোক্ত শ্রেণীতে গণ্য করিলে অন্যায় বিচার করা হয় না। কেহ-বা মনে করেন আমি শুদ্ধমাত্র পরিহাস করিতেছি। কমিটি দ্বারা দেশের অনেক ভালো হইতে পারে; তেলের কল, সুরকির কল, রাজনীতি এবং বারোয়ারি পূজা কমিটির দ্বারা চালিত হইতে দেখা গিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত এ দেশে সাহিত্য সম্পর্কীয় কোনো কাজ কমিটির দ্বারা সুসম্পন্ন হইতে দেখা যায় নাই। মা সরস্বতী যখন ভাগের মা হইয়া দাঁড়ান তখন তাঁহার সদ্‌গতি হয় না। অতএব কমিটি-নির্বাচিত গ্রন্থগুলি যখন সর্বপ্রকার সাহিত্যরসবর্জিত হইয়া দেখা দেয় তখন কাহার দোষ দিব” ।

 

আর তাই এই দৈন্য বাঙালি সমাজ থেকে দূর করতে হলে ছেলেবেলাতেই শিশুর হাতে তুলে দিতে হবে পাঠ্যক্রমের সঙ্গেই সমান্তরাল একটি অন্য পাঠক্রম । ছেলেভুলানো মোবাইল কিংবা কার্টুনের দ্বারা পাঠকতন্ত্রে উত্তরনের শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয় । পাঠকতন্ত্র আর মানবতন্ত্র যেখানে সভ্য জীবনের মূল অভিধা সেখানে তাই,

 

“ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই, তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে, নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না। শিশুকাল হইতেই কেবল স্মরণশক্তির উপর সমস্ত ভর না দিয়া সঙ্গে সঙ্গে যথাপরিমাণে চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির স্বাধীন পরিচালনার অবসর দিতে হইবে। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবলই লাঙল  দিয়া চাষ এবং মই দিয়া ঢেলাভাঙা, কেবলই ঠেঙা লাঠি, মুখস্থ এবং একজামিন– আমাদের এই ‘মানব-জনম’ আবাদের পক্ষে আমাদের এই দুর্লভ ক্ষেত্রে সোনা ফলাইবার পক্ষে, যথেষ্ট নহে” ।

 

তবে একথা সঠিক নয় যে এদেশে একজনও আর পাঠক অবশিষ্ট নেই । আজকের দিনেও পাঠচর্চা ক্ষুদ্রগোষ্ঠিতে হলেও অব্যাহত আছেই । কিন্তু জনজীবনের সঙ্গে যেহেতু এই মানুষজনের আর কোনও যোগ নেই, তাই এত প্রকট অব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে । বঙ্কিমচন্দ্র, ধুর্জটিপ্রসাদ কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলীর অভিযোগগুলি ক্রমাগত চোখকে শলাকাবিদ্ধ করছে । আজকাল বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়েনি এমন বাঙালিও দেখা যাচ্ছে। পড়লে তক্ষুনি বাঙালি উদ্ধার করতে পারত বাঙালি পাঠকের অন্তরাত্মাটিকে । তাই ছেলেবেলাতেই অবশ্য পাঠ্য হিসেবে ‘চাঁদের পাহাড়’কে নির্দিষ্ট করা উচিৎ । সেখানেই আছে বাঙালির নিবিড়তম পাঠজীবনের টিমটিম করে জ্বলে থাকা প্রদীপটি ।

 

নিঝুম রাত্তিরে যখন বাইরে বিবশমান চাঁদের আলো কুয়াশা বিস্তার করে, সৃষ্ট হয় একটি অন্য নীরবতার প্রাকার, তখন যদি মুনলাইট সোনাটার মন্থর ধ্বনি ঘরের অন্তরাবহে তরঙ্গিত হয় এবং পাঠকের স্থির নয়ন টেবিল ল্যাম্পের আলোয় উদ্ধার করে একটি অনাবিল স্বপ্ন – “প্রদীপের মৃদু আলোয় সেদিন রাত্রে” “ওয়েস্টমার্কের বড় ভূগোলের বইখানা খুলে” যা দেখেছিল ‘সে’। কতবার ভেবেছিল হাউপ্টমানের মত “সেও একদিন যাবে মাউন্টেন অফ দ্য মুন জয় করতে । স্বপ্ন!” – তখনই বাঙালি হৃদয়ের পাঠচর্চার নিভুমান আলোকরশ্মিটি দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে । বোঝা যায় বাংলার প্রকৃত পাঠকমনের অনুরণনখানি । সে যে ঘরে বসেই সারা বিশ্বচিন্তার তৃষ্ণাকে তৃপ্ত করতে চায় বইয়ের মাধ্যমে । তপন রায়চৌধুরী ‘বাঙালনামা’-তে নিবিড় পাঠক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর সম্বন্ধে ঠিক কথাগুলিই লিখেছেন, বলেছেন যে,

 

“দেশভ্রমণ করার মত সম্বল ওঁর ছিল না । কিন্তু পুস্তকের পৃষ্ঠা থেকে ওঁর বিশ্বদর্শন হয়েছিল । বিশেষ করে ইউরোপ সম্পর্কে এ কথাটা খাঁটি সত্য । ঈজিপ্ট থেকে ফিরে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি । উনি ব্যালি অফ কিংস সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব প্রশ্ন করতে লাগলেন । আমি ট্যুরিস্ট হিসেবে গিয়েছি । যদিও আমরাও এম.এ. ক্লাসে মিশরের ইতিহাস পড়েছি, কিন্তু অত খুঁটিয়ে পড়া হয়ে ওঠেনি । ওঁর প্রশ্ন শুনে মনে হল – উনি যেন কালই ও-দেশ থেকে ঘুরে এসেছেন । ওঁর ঘরে আমি মিশর বিষয়ক কোনও বই দেখিনি । তাই জিগ্যেস করলাম- আপনি শেষ কবে মিশর সম্বন্ধে পড়াশুনো করেছেন ? হিসেব করে বললেন – সত্তর বছর আগে” ।

 

বাঙালির অন্তরে থাকা এই পাঠকসত্তার বীক্ষাই যে আজও প্রকাশকদের ও লেখকদের আকৃষ্ট করছে । লিটল ম্যাগাজিনের নিষ্কাম পরিশ্রমে কত যুবক-যুবতী উজাড় করে দিচ্ছে জীবন । মনে রাখতে হবে, যেদিন এই ধারাটিও শেষ হয়ে যাবে – হয়তো খুব তাড়াতাড়িই – সেদিনই হবে বাঙালির মুখাগ্নির দিন । নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন যে,

 

“যতদিন ধরিয়া বাঙালি-মনের ইতিহাস আছে, ততদিন ধরিয়াই এই মনের উপর সাহিত্যের প্রভাব দেখা যায় । সুতরাং, বলিতে হইবে সাহিত্য ছাড়া খাঁটি বাঙালি মন ও চরিত্র কল্পনা করা যায় না” ।

 

আর তাই শত অভিযোগের মধ্যেও বাঙালির নিবিড়তম এই পাঠকসত্ত্বাকে আরেকটিবার ধাক্কা দিতেই হয় । পাঠকসত্ত্বা অর্জনের সাধনায় দুজন সফল সাধকের উদাহরণ দিলে বোধহয় কিছু অনুপ্রেরণা বাঙালির মনে উঁকি দিলেও দিতে পারে । সেই প্রত্যাশাতেই ও যদি কোনদিন বাঙালির সামগ্রিক জাতীয় জীবনে পাঠকতন্ত্রের দেখা মেলে সেই দুরাশাতেই, সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তথাকথিত নিন্দিত বাঙালি নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পাঠকজীবনের কথা বলে শেষ করা যাক, মনে করে নেওয়া যাক সেই মন্ত্র বা প্রজ্ঞা যা বায়রন ‘ডন জুয়ানে’ লিখেছিলেন,

 

“But words are things, and a small drop of ink,

Falling like dew, upon a thought, produces

That which makes thousands, perhaps millions, think;

‘T is strange, the shortest letter which man uses

Instead of speech, may form a lasting link

Of ages; to what straits old Time reduces

Frail man, when paper — even a rag like this,

Survives himself, his tomb, and all that’s his.”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঠতন্ত্র

লেখক রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলার যা কিছু এখনও বাকি আছে তা ভাষা-সাহিত্যের গবেষকরা নিশ্চয় বলবেন আরও । কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছেন পাঠক রবীন্দ্রনাথ । প্রত্যেকটি লেখকের ছায়াজীবন হল তার পাঠকজীবন । সেই-ই তাকে আজন্মকাল সতেজ ও অনুসন্ধানী রাখে । রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাতেই তাঁর পড়ুয়া জীবন ব্যর্থতার গহীন অরণ্যে কীভাবে হারিয়ে গেছিল তা অপরিচিত নয় । আর তারপরে বাদবাকি যে জীবন রবীন্দ্রনাথের রয়ে গেছিল তা হল পাঠকজীবন । এ প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ রায়ের ‘পাঠক রবীন্দ্রনাথ’ ও উজ্জলকুমার মজুমদারের ‘রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনা’ বইদুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এছাড়া বিভিন্ন লেখায় ও চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পাঠ সম্বন্ধে নানা তথ্য জানতে পারা যায় । সে-সব কিছুকে একত্র করে অনির্বান রায় প্রকাশ করেছেন ‘রবীন্দ্র-রচনায় গ্রন্থ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়’ বইটি, সেটিও সবিশেষ নজরটান । সেসব তথ্য থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ কত বড় পাঠক ছিলেন । স্বয়ং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন যে,

 

“কত রকমের কত বই তিনি পড়েছিলেন, তা লোকে জানে না । তাঁর কবিখ্যাতি না থাকলে পাণ্ডিত্যখ্যাতি র’টত”।

 

যুগধর্মগত কারণে রবীন্দ্রনাথের পড়ুয়াজীবন অন্যদের মত গতে বাধাভাবে শুরু হলেও, তাতে কিছুটা মুক্তির স্বাদ ছিল ঠাকুরবাড়ির পরিবেশের কারণে । আর তাই-ই পড়ুয়াজীবনের ব্যর্থতার পরেও তাঁর পাঠকজীবনে উত্তীর্ণ হওয়াটা ব্যাপক সংঘর্ষময় হয়ে ওঠেনি । তবুও তাঁর এই জীবন সম্পর্কে অভিযোগের অন্ত ছিল না, রবীন্দ্রনাথ নিজের পড়ুয়া জীবন সম্বন্ধে লিখেছেন,

 

“আমার পড়া না করবার অদ্ভুত জেদ দেখে ক্লাসের মাস্টার ডিক্রুজ সাহেবের কাছে নালিশ করেছিলেন। ডিক্রুজ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পড়াশোনা করবার জন্যে আমরা জন্মাই নি, মাসে মাসে মাইনে চুকিয়ে দেবার জন্যেই পৃথিবীতে আমাদের আসা। জ্ঞানবাবু কতকটা সেইরকমই ঠিক করেছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি একটা পথ কেটেছিলেন। আমাকে আগাগোড়া মুখস্থ করিয়ে দিলেন কুমারসম্ভব। ঘরে বন্ধ রেখে আমাকে দিয়ে ম্যাকবেথ তর্জমা করিয়ে নিলেন। এ দিকে রামসর্বস্ব পণ্ডিতমশায় পড়িয়ে দিলেন শকুন্তলা। ক্লাসের পড়ার বাইরে আমাকে দিয়েছিলেন ছেড়ে, কিছু ফল পেয়েছিলেন। আমার ছেলেবয়সের মন গড়বার এই ছিল মালমসলা, আর ছিল বাংলা বই যা-তা, তার বাছবিচার ছিল না” ।

 

তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে বাঙালির পাঠকতন্ত্রের উন্মেষপর্বের সূচনালগ্নে । ফলে সে সময় বাংলা বইও যে আহামরি কিছু লব্ধ ছিল তা নয় । মনে রাখতে হবে, ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস । সেসময় রবীন্দ্রনাথ চার-পাঁচ বছরের বালকমাত্র । সেই যুগেই রবীন্দ্রনাথের বেড়ে ওঠা, আজকের ছেলেমেয়ের মত বাংলা লেখার উত্তরাধিকার তাঁর ছিল না । তবুও সেই অভাবেও তিনি নির্বিচারে পাঠ্যাভ্যাস বজায় রেখেছিলেন, তিনি লিখেছেন যে,

 

“আমার বাল্যকালে বাংলাসাহিত্যের কলেবর কৃশ ছিল। বোধ করি তখন পাঠ্য অপাঠ্য বাংলা বই যে-কটা ছিল সমস্তই আমি শেষ করিয়াছিলাম। তখন ছেলেদের এবং বড়োদের বইয়ের মধ্যে বিশেষ একটা পার্থক্য ঘটে নাই। আমাদের পক্ষে তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় নাই। এখনকার দিনে শিশুদের জন্য সাহিত্যরসে প্রভূত পরিমাণে জল মিশাইয়া যে-সকল ছেলে-ভুলানো বই লেখা হয় তাহাতে শিশুদিগকে নিতান্তই শিশু বলিয়া মনে করা হয়। তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা হয় না। ছেলেরা যে বই পড়িবে তাহার কিছু বুঝিবে এবং কিছু বুঝিবে না, এইরূপ বিধান থাকা চাই। আমরা ছেলেবেলায় একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম— যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুই-ই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত। সংসারটাও ছেলেদের উপর ঠিক তেমনি করিয়া কাজ করে। ইহার যতটুকু তাহারা বোঝে ততটুকু তাহারা পায়, যাহা বোঝে না তাহাও তাহাদিগকে সামনের দিকে ঠেলে” ।

 

আর ঠিক এভাবেই গঠিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের পড়ুয়াস্তর থেকে পাঠকস্তরে উত্তীর্ণ হবার মার্গখানি । অবশ্য তখন যে ইংরেজি সাহিত্যও বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচলিত ছিল তা নয় । তবুও তাঁর পাঠক-মন খুঁজে নিয়েছিল আশ্রয়, এই বলে যে,

 

“আমি যে বাল্যকালে ইউরোপীয় সাহিত্য পড়বার ভালো সুযোগ পাইনি – এবং তার পরিবর্তে বৈষ্ণব পদাবলী পড়েছিলুম ও তার থেকে আমার লিরিকের ভঙ্গী ও ভাষা গ্রহণ করবার সুযোগ পেয়েছিলুম এটা আমার পক্ষে একটা বাঁচোয়া” ।

 

স্থূলভাবে বললে মাতাল যেমন ঠিক খুঁজে নেয় শুঁড়ির সন্ধান, তেমনই পাঠকও খুঁজে নেয় নিজের আবাসস্থল । এটাই পাঠকজীবনের প্রকৃত আকুতি । রবীন্দ্রনাথও যার ব্যতিক্রম নন, তিনি কৈফিয়ত দেন এই বলে যে,

 

“আমি তামাকটা পর্যন্ত খাই নে। আমার এক অভ্রভেদী নেশা আছে, তারই আওতায় অন্য সকল নেশা একেবারে শিকড় পর্যন্ত শুকিয়ে মরে গেছে। সে আমার বই-পড়ার নেশা। আমার জীবনের মন্ত্রটা ছিল এই- ‘যাবজ্জীবেৎ নাই-বা জীবেৎ / ঋণং কৃত্বা বহিং পঠেৎ’ । যাদের বেড়াবার সখ বেশি অথচ পাথেয়ের অভাব, তারা যেমন ক’রে টাইম্‌টেব্‌ল্‌ পড়ে, অল্প বয়সে আর্থিক অসদ্ভাবের দিনে আমি তেমনি ক’রে বইয়ের ক্যাটালগ পড়তুম” ।

 

কী পড়ব কী পড়ব না সেই বিষয়ে যখন সিদ্ধান্ত নেবার মত মন মানুষের তৈরি হয় না তখন মানুষ যেভাবে শুরু করে, সেটাই সাধারণ পাঠকের জীবনের তপস্যাকাল । রবীন্দ্রনাথও সেই ভাবেই শুরু করেছিলেন – অগোছালোভাবেই । এমনকি এই তপস্যাকালে অনেকের এমন এক দুর্নিবার নেশা চেপে বসে যে জেদের বশে শালীনতাবোধও অগ্রাহ্য করা যায় । রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘জামাইবারিক প্রহসন’ অনুনয় বিনয় করে আত্মীয়ার কাছ থেকে আদায় করতে না পেরে শাসানি দিয়েছিলেন, “এই বই আমি পড়িবই” – কিছুটা সেরকমই। ছেলেবেলাতেই রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদিত ‘বিধিধার্থ সংগ্রহ’ এবং সেই সাথে যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রকাশিত ‘অবোধবন্ধু’ হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথের মনের ওপর বিস্তারিত হয়েছিল ব্যাপক প্রভাব, তিনি সে-প্রসঙ্গে লিখেছেন,

 

“রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয় বিবিধার্থ-সংগ্রহ বলিয়া একটি ছবিওয়ালা মাসিকপত্র বাহির করিতেন। তাহারই বাঁধানো একভাগ সেজদাদার আলমারির মধ্যে ছিল। সেটি আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বারবার করিয়া সেই বইখানা পড়িবার খুশি আজও আমার মনে পড়ে। সেই বড়ো চৌকা বইটাকে বুকে লইয়া আমাদের শোবার ঘরের তক্তাপোশের উপর চিত হইয়া পড়িয়া নর্হাল তিমিমৎস্যের বিবরণ, কাজির বিচারের কৌতুকজনক গল্প, কৃষ্ণকুমারীর উপন্যাস পড়িতে কত ছুটির দিনের মধ্যাহ্ন কাটিয়াছে” ।

 

অন্যদিকে ‘অবোধবন্ধু’ সম্পর্কে তাঁর আবেগের স্ফুরণ এই বলে যে,

 

“বাল্যকালে আর-একটি ছোটো কাগজের পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম। তাহার নাম অবোধবন্ধু। ইহার আবাঁধা খণ্ডগুলি বড়দাদার আলমারি হইতে বাহির করিয়া তাঁহারই দক্ষিণ দিকের ঘরে খোলা দরজার কাছে বসিয়া বসিয়া কতদিন পড়িয়াছি। এই কাগজেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা প্রথম পড়িয়াছিলাম। তখনকার দিনের সকল কবিতার মধ্যে তাহাই আমার সবচেয়ে মন হরণ করিয়াছিল। তাঁহার সেই-সব কবিতা সরল বাঁশির সুরে আমার মনের মধ্যে মাঠের এবং বনের গান বাজাইয়া তুলিত। এই অবোধবন্ধু কাগজেই বিলাতি পৌলবর্জিনী গল্পের সরস বাংলা অনুবাদ পড়িয়া কত চোখের জল ফেলিয়াছি তাহার ঠিকানা নাই। আহা, সে কোন্ সাগরের তীর! সে কোন্ সমুদ্রসমীরকম্পিত নারিকেলের বন! ছাগল-চরা সে কোন্ পাহাড়ের উপত্যকা! কলিকাতা শহরের দক্ষিণের বারান্দায় দুপুরের রৌদ্রে সে কী মধুর মরীচিকা বিস্তীর্ণ হইত! আর সেই মাথায় রঙিন রুমাল-পরা বর্জিনীর সঙ্গে সেই নির্জন দ্বীপের শ্যামল বনপথে একটি বাঙালি বালকের কী প্রেমই জমিয়াছিল” ।

 

আর এই প্রেমের টানেই সাধারণ পাঠক উন্নীত হয় নিবিড় পাঠকের স্তরে । সেখানে সে যেন দেবতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে পাঠসুখ ছাড়া অন্য কোনও বর চাইতে পারে না । ধীরে ধীরে তপস্যার ফল নয়, তপস্যাই হয়ে ওঠে আনন্দের অধিকার । যেমনটা দীর্ঘ অপেক্ষার পরে ‘বঙ্গদর্শন’ হাতে পেলে রবীন্দ্রনাথের হত । তিনি লিখেছেন,

 

“বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, এখন যে-খুশি সেই অনায়াসে একেবারে একগ্রাসে পড়িয়া ফেলিতে পারে কিন্তু আমরা যেমন করিয়া মাসের পর মাস, কামনা করিয়া, অপেক্ষা করিয়া, অল্পকালের পড়াকে সুদীর্ঘকালের অবকাশের দ্বারা মনের মধ্যে অনুরণিত করিয়া, তৃপ্তির সঙ্গে অতৃপ্তি, ভোগের সঙ্গে কৌতূহলকে অনেকদিন ধরিয়া গাঁথিয়া গাঁথিয়া পড়িতে পাইয়াছি, তেমন করিয়া পড়িবার সুযোগ আর-কেহ পাইবে না”।

 

এসব আমোদ ছাড়াও ছিল সারদাচরণ মিত্র ও অক্ষয় সরকারের প্রাচীনকাব্যসংগ্রহ ।  এখান থেকে তিনি ‘বিদ্যাপতি’র সন্ধানে মগ্ন হয়েছিলেন ও নিবিড় পাঠকে উত্তোরণের সোজা পথটি পেয়ে গিয়েছিলেন যেন,

 

“বিদ্যাপতির দুর্বোধ্য বিকৃত মৈথিলী পদগুলি অস্পষ্ট বলিয়াই বেশি করিয়া আমার মনোযোগ টানিত। আমি টীকার উপর নির্ভর না করিয়া নিজে বুঝিবার চেষ্টা করিতাম। বিশেষ কোনো দুরূহ শব্দ যেখানে যতবার ব্যবহৃত হইয়াছে সমস্ত আমি একটি ছোটো বাঁধানো খাতায় নোট করিয়া রাখিতাম। ব্যাকরণের বিশেষত্বগুলিও আমার বুদ্ধি অনুসারে যথাসাধ্য টুকিয়া রাখিয়াছিলাম” ।

 

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় পাঠের নয়া-দিগন্তরেখা ছুঁতে যাওয়ার স্পৃহাও প্রবল হয়ে ওঠে । তিনি হয়ে ওঠেন আদর্শ মার্জিনালিয়া । তাঁর ব্যবহৃত বইগুলির মধ্যে থেকে প্রায় ৪০টি বইয়ে আছে এর বহু উদাহরণ । উজ্জ্বলবাবু তাঁর বইয়ে পরিশিষ্ট ১ –এ রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত বইয়ের একটি তালিকা দিয়েছেন যাতে তাঁর মার্জিনালিয়া হয়ে ওঠার পরিচয় পাওয়া যায় । তিনি পাঠের সময়ে বোধহয় “হাতে রাখতেন একটা পেনসিল, কালেভদ্রে কলম। বইয়ের অধিকার বজায় রাখতে কখনও সই করেছেন, কখনও শুরুর পৃষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন নিজের সিলমোহর” । তিনি চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য ও গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদারের ‘প্রাথমিক বিজ্ঞান’ যখন পড়েছিলেন তখনও এর অন্যথা হয়নি, তিনি “‘তড়িৎ সুপরিবাহী’ কেটে লিখলেন ‘সুসম্বাহী’, আর ‘কুপরিবাহী’ হল ‘তড়িৎ নসম্বাহী’। আকাশে ভাসমান ধূলিকণার পাশ দিয়ে আলো আসে বলেই আকাশ নীল— লেখকের এই অভিমত পড়ে মার্জিনে লিখলেন, ‘সে জন্যই নীল রং হতে হবে এযুক্তি ছেলেরা গ্রহণ না করতে পারে।’ কোথাও ঠেকে গেলে লিখলেন, ‘অত্যন্ত বিস্তৃত করায় দুরূহ হইয়াছে।’ আবার তড়িৎ-ঘণ্টার বিবরণ পড়ে লিখেছিলেন, ‘চোখে না দেখলে পড়ে বোঝা দুঃসাধ্য’” । এভাবেই “দাগ দিয়ে, কখনও মনের কথা লিখে লিখে রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’, কালিদাসের ‘মেঘদূত’ অথবা ম্যাথু আর্নল্ড-এর ‘কালচার এন্ড অ্যানার্কি’-র মতো বই” । এছাড়া নানা চিঠিপত্র সহ ছিন্নপত্রের নানা স্থানে তাঁর নিবিড়তম পাঠকজীবনের সন্ধান মেলে ।  যেমন, চার নম্বর চিঠিতে আমরা পাই ’ Anna Karenina’ ’র উল্লেখ। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, “‘Anna Karenina’ পড়তে গেলুম, এমনি বিশ্রী লাগল যে, পড়তে পারলুম না- এরকম সব Sickly বই পড়ে কী সুখ বুঝতে পারি নে।’” এছাড়া ‘আমিয়েলস জার্নাল’, ‘ক্রিটিসিজম অন কনটেম্পোরারি থট অ্যাণ্ড থিংকারস’- এর উল্লেখ পাওয়া যায় । অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও কবিতাগুলি আকীর্ণ করে রেখেছে তাঁর পাঠকসত্তার আবেদনটিকে । তিনি যে নিবিড়তম পাঠক সে সন্ধান স্পষ্ট হয়ে যায়, ছিন্নপত্রের ২৫১ নম্বর চিঠিতে । সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

 

‘আজকাল আমি আমার লেখা এবং আলস্যের মাঝে মাঝে কবি কীটসের একটি ক্ষুদ্র জীবনচরিত অল্প অল্প পাঠ করি। .আমি যত ইংরাজ কবি জানি সবচেয়ে কীটসের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আমি বেশি করে অনুভব করি। তার চেয়ে অনেক বড় কবি থাকতে পারে, অমন মনের মতো কবি আর নেই।’

 

আবার এই চিঠিতেই তিনি ‘টেনিসন সুইনর্বন’ প্রসঙ্গে লিখছেন,

 

“অধিকাংশ কবিতার মধ্যে একটা পাথরে খোদা ভাব আছে- তারা কবিত্ব করে লেখে এবং সে লেখার প্রচুর সৌন্দর্য আছে কিন্তু কবির অন্তর্যামী সে লেখার মধ্যে নিজের স্বাক্ষর করা সত্যপাঠ লিখে দেয় না” ।

 

এই হল নিবিড় পাঠকের বিস্মিত মন যে একই সঙ্গে উপভোগ ও সমালোচনা দুই-ই করে । রবীন্দ্রনাথের এই পাঠকজীবনটুকুই বাঙালির পক্ষে আদর্শ উদাহরণ হয়ে থেকে যেতে পারে । বাঙালি উপলব্ধি করতে পারে যে, একজন মানুষের অন্তরে কী পরিমাণ পাঠচৈতন্য থাকা জরুরি, তবেই সে নিবিড় পাঠকের স্তরে পৌঁছতে পারে । এটা আমাদের ভাবায় না শুধু, বিহ্বলও করে । অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির প্রভাব কিন্তু সকলের থাকে না । সাধারণ মধ্যবিত্ততা সত্ত্বেও হয়ে ওঠা যায় নিবিড় পাঠকটি । অবস্থা তাকে পরাভূত করে ফেলতে পারে না । আর সে ব্যাপারে চরমতম দৃষ্টান্ত হলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী ।

 

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পাঠতন্ত্র

এবারে যে বিখ্যাত মনীষার পাঠকজীবনের সন্ধানে প্রবৃত্ত হব, তাঁকে অল্পবয়সের অভিমানের বশে হয়তো ‘আত্মঘাতী মনীষা’ বলা যায় কিংবা গোঁড়ামির বশে ‘ইংরেজের পা-চাটা’ কিন্তু কোনও শত্রুও তাঁর পাঠকের অভিনেবেশকে উপেক্ষা করতে পারবে না । তাঁকে আমি ‘তথাকথিত নিন্দিত বাঙালি’ বলেছি, কেননা তিনি যেরকমের ‘ইংরেজ বাঙালি’ ও ‘বাঙালি ইংরেজ’–এর জীবন সমাপতিত ভঙ্গিমায় যাপন করেছেন তাতে করে বারবার তাকে কুৎসার সম্মুখীন হয়ে নিজের বাঙালিত্বের নিদর্শন পেশ করতে হয়েছে । তবে অবশ্যই তা আতিপাতি বিনয়ের সঙ্গে নয়, ছিল সপাট স্পর্ধার সঙ্গে – তিনি যে ছিলেন বাংলা লেখক ও বাঙালি শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী এবং ইংরেজি লেখক ও ইংরেজ মিঃ নীরদ সি চৌধুরী । তাঁর পাঠক জীবন সম্বন্ধে সাতানব্বই বছর বয়সে তিনি লিখেছেন,

 

“আমি সারা জীবনে কম হইলেও দশ হাজার বই পড়িয়াছি । উপরন্তু যাহা এ পর্যন্ত নানা ভাষায় স্থায়ী ও উৎকৃষ্ট সাহিত্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি বহুবার পড়িয়াছি”।

 

এর বশেই বোধহয় তিনি, তিনিই লিখতে পেরেছিলেন, শারীরিকভাবে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দুর্বল হলেও বুদ্ধিতে নন এবং নিন্দুকদের কথার জবাবে লিখেছিলেন, “মালিনী তখন কয় / শূল তো বাঁশের হয় / প্যাকাটির তোর / ঢুকিবে না*… মোর / তারে নাহি করি ভয়” । তাঁর ছেলেবেলার পাঠও তৎকালীন প্রথাতেই শুরু হয়েছিল ।  তবে তিনি বোধহয় যুগের থেকে এগিয়ে ছিলেন খানিক । আর তাই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সন্ধান পেয়েছিলেন নিজের পাঠকসত্ত্বাটির । তিনি সাত বছর বয়সে রামায়ণ-মহাভারত হাতে পেয়েছিলেন, আর মাত্র ন’বছর বয়সের মধ্যে দুটিকেই মুখস্থ করে ফেলতে পেরেছিলেন । তাঁর পাঠে নিবিড়ত্বের দিশাপ্রাপ্তি সম্পর্কে লিখেছেন,

 

“তখন আমাদের অল্পবয়সে উপন্যাস পড়িতে দেওয়া হত না, তবে মার মাসিক পত্রিকা হইতে ছোট গল্প পড়িয়া ফেলিতাম, বিশেষ করিয়া প্রেমের গল্পগুলি । উপন্যাস প্রথম পড়ি, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, ১৯১০ সনে, তাহাও চুরি করিয়া । উপন্যাস পড়িবার ‘লাইন-ক্লীয়ার’ মা আমাকে দিলেন ১৯১১ সনে, তাহাও মশারির নীচে গভীর রাত্রে লুকাইয়া ‘দেবীচৌধুরানী’ পড়িতে দেখিয়া । … সাহিত্য হইতে বাঙালীত্বে দীক্ষা আমার প্রথম ও প্রধানত হইয়াছিল মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আদ্যোপান্ত পড়িয়া ও ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র কিছু কিছু পড়িয়া । … আসলে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ই আমার অতিশয় প্রিয় ছিল, এবং ১৯০৭ সনে আমি উহা আদ্যোপান্ত পড়িয়া প্রায় মুখস্ত করিয়া ফেলিয়াছিলাম” ।

 

মনে রাখা জরুরি যে ১৯০৭ সালে নীরদবাবু মাত্র দশ বছরের বালক । এই ছিল তাঁর পাঠকসত্ত্বার নিবিড়ত্ব । অন্যদিকে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে মূলত ছবির মাধ্যমে ।  তখনকার দিনে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত নানাবিধ ছবির মধ্যে দিয়ে তিনি খুঁজে পান ইউরোপীয় জীবনের বীক্ষা । তিনি মায়ের কন্ঠে ছয়-সাত বছর বয়স থেকে শেক্সপীয়ার সম্বন্ধের পরিচিত হতে শুরু করেছিলেন এবং ১৯০৬ সালে তিনি প্রথম ইংরেজিতে একটি কবিতা পড়েছিলেন, কলি সিবারের লেখা ‘দ্য ব্লাইন্ড বয়’ । এরপরে রবীন্দ্রনাথের মতই যেন তিনি বলে ওঠেন, যা পাই তাই পড়ি, কিছু বুঝি কিছু বুঝি না । তবুও পাঠের বিহ্বলতা যেন তাঁকে গ্রাস করে । রবীন্দ্রনাথ যেমন বিদ্যাপতির পদ না বুঝলেও মুগ্ধ হয়েছিলেন, নীরদবাবুর বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি । নীরদবাবু লিখেছেন,

 

“কাব্যের উপলব্ধি মূলত বুদ্ধি দিয়া হয় না, হয় হৃদয় দিয়া । তাই মানবজাতির বুদ্ধি পূর্ণবিকশিত হইবার আগেই কাব্যরচনা হইয়াছে । কাব্য যদি বুদ্ধির অপেক্ষা রাখিত, তবে আমি ইহারও (কীটসের কবিতা) আগে, সংস্কৃতভাষা শিখিবার বহু পূর্বে, ‘কপালকুণ্ডলা’র প্রথম অধ্যায়টি দাদার একটি বাংলা পাঠ্যপুস্তকে যে উদ্ধৃত হইয়াছিল, তাহাতে একটি শ্লোক পড়িয়া অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলাম এবং সারাজীবনেও ভুলি নাই, তাহা ঘটিত না” ।

 

এরপরেই তাঁর ছেলাবেলার সাধারণ পাঠক যেন ডুবে গেছিল নিবিড় পাঠকের অন্দরমহলে । তিনি ছোটদের ‘দ্য চিল্ড্রেন্স ট্রেজারি অফ লিরিকাল পোয়েটরি’ পড়ে প্রায় স্থবির হয়ে গেছিলেন । তাঁর এই পাঠ-নৈসর্গের ধারাটিই যেন অব্যাহত ছিল আজীবন । যদিও তিনি জানিয়েছেন যে একটা সময়ের পরে তিনি প্রায় কোনও নতুন বইই আর পড়েননি যা তাঁর কাজের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ছিল না । কিন্তু যাঁর জীবনের প্রথম দশ বছর এরকম পাঠ্যাভাসে মধ্যে ডুবে যায় তাঁর পরবর্তী পাঠকজীবন যে কতদূর বিস্তৃত হতে পারে তা বলাই বাহুল্য ও সহজেই অনুমেয় । অথচ পড়ুয়া হিসেবে তিনিও কিন্তু চরম ব্যর্থ । গ্রাজুয়েশনে অসাধারণ ফলের পরেও তিনি পোস্টগ্রাজুয়েশনে আর ভর্তি হননি । চাকুরি করেননি কেবলমাত্র বৈদগ্ধ্য অর্জনের তপস্যার জন্যে । এই বিদগ্ধতাই আসলে নিবিড় পাঠকসত্ত্বার অভিজ্ঞান । তাই তিনি বোধহয় দশ হাজার বই পড়তেই পারেন না কেবল, মনেও রাখতে পারেন । এই পাঠকত্ব যে কি নিবিড়ত্বে আগাগোড়া মোড়া তা বোঝা যায় তাঁর আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখে । তিনি লিখছেন যে,

 

“ম্যাথিউ আর্নল্ডের কবিতা খুবই ভাল লাগিল – যেমন Forsaken Merman, Dover Beach, Sohrab and Rustum ইত্যাদি । কিন্তু চাকুরি ছাড়িবার জন্য উদ্দাম বাসনা যাহা হইতে জাগিল সে-কবিতাটি Scholar Gypsy, উহাতে গতানুগতিক সাংসারিক জীবন যাপন না করিয়া নিজের স্বভাব অনুযায়ী অন্য পথ ধরিবার কথা আছে যেপথকে একধরনের সন্ন্যাস বলা যায় । … আমার মনে হইল ম্যাথিউ আর্নল্ডের We-এর একজন যেন আমি । সেই মুহূর্তেই স্থির করিলাম, আমিও Scholar Gypsy-র মত হইব – জীবনে একাগ্র সাধনা আনিব । এই কবিতাটি পড়িবার ফল হইল পরীক্ষা দিতে গেলাম না, একটা ছুতা দিলাম । চরম ফল হইল সরকারি চাকুরি ছাড়িয়া দেওয়া” ।

 

এ যেন ঠিক রবীন্দ্রনাথের কথাখানির মত হল । ‘বাংলা-লেখক’-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “আমাদের দেশে পাঠক-সংখ্যা অতি যৎসামান্য। এবং তাহার মধ্যে এমন পাঠক “কোটিকে গুটিক” মেলে কি না সন্দেহ, যাঁহারা কোনো প্রবন্ধ পড়িয়া, কোনো সুযুক্তি করিয়া আপন জীবনযাত্রার লেশমাত্র পরিবর্তন সাধন করেন” । সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে নীরদচন্দ্র চৌধুরী হলেন সেই ‘কোটিকে গুটিক’ পাঠকের একজন । এই ব্যতিক্রমি মনীষা যদি আত্মঘাতী হয় তবে পড়ুয়া বাঙালির ঘরে ঘরে যেন এমন আত্মঘাতী পাঠকের জন্ম হয়, এমনটা প্রত্যাশা করাই এই সমাজের পক্ষে মঙ্গলময়। কেননা এই মনীষা শুধু যে অল্পবয়সে এইসব আবেগ দেখিয়েছিলেন তাই নয়, শতবর্ষব্যাপী জীবনে তাঁকে আদর্শচ্যুতও করা যায়নি । এটাও ‘কোটিকে গুটিক’ একটি দৃষ্টান্ত । বহু বাঙালি অল্প বয়সে আবেগের ভারে ন্যুব্জ হয়ে নানা ধরণের অতিবিপ্লবীয়ানা দেখায় ঠিকই কিন্তু জীবনের চাকা একটু গড়াতেই দেশে-বিদেশের প্রতিষ্ঠা-খ্যাতিতে সে অধ্যাবসায় ধরে রাখা তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে যায় । ক’জন বাঙালি, ঘরে ছেলের দুধ কেনার পয়সা নেই, বউয়ের শাড়ি ছেঁড়া অথচ নিজে বিখ্যাত ইংরেজি কাগজের লেখক, এই অবস্থাতে শুধুমাত্র অনন্য জীবনযাপনের প্রতিজ্ঞায় আপোষের পথ না ধরে থাকতে পারবে ?  তাইতো তিনি যখন বলেন,

 

“যখনই আমার মনে হইত যে, দুর্বলতা বা অক্ষমতার জন্য আমি জীবনে কোনো বড় কাজ করিতে পারিব না তখন এই(মিল্টনের একটি) সনেটের শেষ কথা আবৃত্তি করিয়া নিজের অধৈর্য সংযত করিবার চেষ্টা করিতাম । কথাগুলি এই – ‘They also serve who only stand and wait’” ।

 

তখনই তাঁকে অকপটে গ্রহণ করা যায় । আসলে যে মানুষের জীবনটাই বই দিয়ে গড়া – ‘দিনের বেলা ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরিতে গিয়া পড়িতাম । অন্য সময়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিতাম’  – যাঁর জীবনটাই দেবোত্তর সম্পত্তি, যেখানে একমাত্র, একমাত্র, একমাত্রই বিগ্রহ হল বই – বই – বই, সেখানে তাঁকে নিবিড় পাঠক বলব না তো কাকে বলব, জানা নেই । তাঁর পাঠকজীবনের এমন বহু দৃষ্টান্ত তাঁর প্রত্যেকটি বাংলা বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । পক্ষান্তরে তাঁর ইংরেজি বইগুলির মধ্যে অন্যগুলিকে ছেড়ে একেবারে অন্তিম বয়সে লেখা বইটি ‘Three Horsemen of the new Apocalypse’ যে পাঠকের দরজায় একবার কড়া নেড়েছে, তিনি জানেন, কোন মহতী পাঠকের স্তরে উন্নীত হলে এমন দানবীয় স্মৃতিশক্তি ও চৈতন্যে দীক্ষিত হওয়া যায় । আর এটাই হল বাঙালির প্রকৃত পাঠকতন্ত্র, সে পথে দৃষ্টান্ত কিন্তু কম নেই, শুধুমাত্র জাতিগত শৈথিল্য ও উপেক্ষার কারণে সাধারণ বাঙালি এই সাধকদের আশীর্বাদপুষ্প থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে । নয় কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ পড়ুয়া করে, পাঠক কর নি । এটা কেবলমাত্র ভাবনার বিষয় নয়, যন্ত্রণার কান্নাও বটে ।

 

গ্রন্থসূত্র ও তথ্যসূত্রঃ

 

  1. রবীন্দ্র রচনাবলী
  2. আমার দেবোত্তর সম্পত্তি – শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী
  3. আত্মঘাতী বাঙালি – নীরদচন্দ্র চৌধুরী
  4. পাঠক রবীন্দ্রনাথ – বিশ্বনাথ রায়
  5. রবীন্দ্রনাথের পড়াশুনো – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার
  6. রবীন্দ্র রচনায় গ্রন্থ ও প্রাসঙ্গিক বিষয় – সম্পাদনা – অনির্বান রায়
  7. গদ্যসংগ্রহ – শঙ্খ ঘোষ
  8. https://www.tagoreweb.in/
  9. http://en.banglapedia.org/index.php?title=Education
  10. http://visiblemantra.blogspot.com/2011/05/siddhir-astu.html
  11. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE
  12. https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%9A%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF
  13. An outline of educational system in Muslim Bengal under the Turko-Afghan Sultanate (1204-1576) – Md. Thowhidul Islam
  14. https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/when-rabindranath-tagore-read-books-he-used-to-write-notes-in-margin-1.608679
  15. অন্যান্য