২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুরুষ-নারী সবাই ফুল দিতে এসেছিল। সেই রাতে এক শ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল লোকজন মেয়েদের উপর বারবার হামলা চালিয়েছিল। ইত্তেফাক বলছে; “ অনেক মহিলার নিরাপত্তা, সম্ভ্রম ও ইজ্জত বিনষ্ট হইয়াছে, দুটি তরুণীকে শহীদ মিনারের পাদদেশ হইতে হাইজ্যাক করিয়া লাঞ্ছিত করার পর অর্ধ চৈতন অবস্থায় হাসপাতালে লইয়া যাওয়া হইয়াছে-সামগ্রিক অবস্থাদৃষ্টে বারবার সকলের মনকে নাড়া দিয়াছে।

বিশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর হইতেই শহীদ মিনারে ভিড় জমিতে শুরু করে-কিন্তু অন্যান্য বারের মতন এবার শহীদ মিনারের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে লওয়া হয় নাই। ফলে রাত্রি ১১ টার পর হইতে সেখানে অসংখ্য নারী-পুরুষের মধ্যে শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানীও সমবেত হইতে থাকে। গতবারের মতন এবার শহীদ মিনারে আলোর ব্যবস্থা করা হয় নাই। অন্ধকারের সুযোগ লইয়া এই সুযোগ সন্ধানীর দল যথেচ্ছ কাণ্ড করিয়াছে। ঢাকা নগর আওয়ামী লীগ মহিলা শাখার মিছিলটি যখন মধ্যরাত্রিতে শহীদ মিনারে পুষ্প মালা অর্পণ করিতেছিলেন তখন মিনারের বাঁ পাশের কোণায় উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের হাতে দুই জন তরুণী লাঞ্ছিতা হন। সবচাইতে জঘন্য ঘটনা ঘটে ভোর চারটা হইতে সাড়ে চারটার মধ্যে। এই সময় বিভিন্ন স্থান হইতে অনেক প্রভাত ফেরী শহীদ মিনারে আসিয়া উপস্থিত হয়। পুষ্পমালা অর্পণের ক্ষেত্রে অন্যান্য-বারের মতন এবার মহিলা ও পুরুষদের জন্যে কোন পৃথক ব্যবস্থা না থাকায় দেখা যায় যে, উচ্ছৃঙ্খল সুযোগ-সন্ধানীরা এক বিশেষ কায়দায় কয়েকটি মেয়েকে দল হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ঘিরিয়া শহীদ মিনারের পাদদেশে আনিয়া ফেলিয়াছে। তাহাদের আচরণ এমন এক পর্যায়ে চলিয়া যায় যে, অনেক কিশোরী ও তরুণীর পরিধানের বস্ত্র পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। শহীদ মিনার যে সামান্য প্রদীপ-সদৃশ আলোর ব্যবস্থা ছিল ডেসপাযোগে কয়েকজন তরুণের উপস্থিতির মাত্র কয়েক মিনিট পরেই অজ্ঞাতকারণে সেগুলো নিভিয়া যায় এবং তখনই এই লঙ্কাকাণ্ডের সূচনা হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে হইতে আগতা জনৈকা কিশোরীকে অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায় বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। ১৭ বৎসর বয়স্কা ও ২২ বৎসর বয়স্কা দুটি তরুণীও এই সময় নিখোঁজ হয়। তাহাদিগকে নিগৃহীত ও অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে লইয়া যাওয়া হয় এবং পরে তাহাদিগকে প্রাথমিক চিকিৎসা করাইয়া হইতে লইয়া যাওয়া হয় বলিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গিয়াছে।

তখন বঙ্গবন্ধু শহীদ মিনারে-

জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পুষ্পমাল্য অর্পণের জন্যে শহীদ মিনারে আসেন তখনও উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের তৎপর দেখা যায়। ধাক্কাধাক্কির ফলে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা পর্যন্ত বিপদাপন্ন হইয়া পড়ে।

এ দায়িত্ব কাহার?

শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব কাহার? সরকারের এই ব্যাপারে অবশ্যই একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করার রহিয়াছে। পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য দেশে যেখানেই স্মৃতিস্তম্ভের পবিত্র বেদী রহিয়াছে, সর্বত্রই তা সংরক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত।

লেলিন, কামাল আতাতুর্ক প্রমুখের পবিত্র দেহ যেখানে সমাহিত, সেখানে প্রতিদিনই দর্শক সমাগম হইতেছে। পরিপূর্ণ সরকারী দায়িত্বে ও সামরিক নিয়ন্ত্রণে সেখানকার শৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়। জাপানের হিরোশিমাতেও একই ভাবে স্মৃতি সৌধের পবিত্রতা রক্ষা করা হয়। অথচ আমাদের  দেশে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অনীহা কেন?

অনেকে মনে করেন, শহীদ মিনারের সমস্ত এলাকাটিকে সামরিক নিয়ন্ত্রণে আনিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রদ্ধা নিবেদনকারীদের সমাবেশ এবং সেখান হইতে সুশৃঙ্খল লাইন কইয়া শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করার মাধ্যমেও শহীদ বেদীর পবিত্রতা রক্ষা করা যাইতে পারে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ক্ষেতেও যাহাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্যে সতর্ক পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন বলিয়া অনেকে মনে করেন।

শহীদ মিনারের পাশে গাঁজার আসর?

পবিত্র শহীদ মিনারের আশেপাশে গাঁজার আসর বসিয়াছিল একুশে ফেব্রুয়ারিতে। গঞ্জিকা সেবনকারীদের সকলেই তরুণ বয়সের। শহীদ দিবসকে যতরকমভাবে অপমানিত ও অপবিত্র করা যায় তাহার চেষ্টা হইয়াছে। উচ্ছৃঙ্খল নৃত্যে গাঁজার আসর জমাইয়া তুলিয়া ‘দম মারো দম’ ফিল্মী গানে উচ্ছৃঙ্খলতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখান হইয়াছে।”

অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এতো বড় ঘটনার পরে কোন মামলা বা গ্রেফতার কিছুই হয়নি। পত্রিকার পাতায় আক্ষেপ-অভিযোগ আর ২৮ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে এমন বক্তব্য দিয়েই বিষয়টি সেখানে শেষ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু সেখানে ফুল দিতে গেলেন সেখানে ধর্ষণের মতন ঘটনা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে অথচ এর কোন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়নি! পরবর্তীতে অনেকেই অভিযোগ করেন-সরকার দলীয় মাস্তানরাই এই অপকর্ম সংগঠিত করে শহীদ মিনারকে কলঙ্কিত করে।