লিখেছেন: অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা যুক্ত হলেই একটি কাঙ্খিত সামগ্র‍্যের আভা চতুর্দিকে কীর্ণ হয়ে পড়ে । আর তখনই আমরা ঠাহর করে নিতে পারি, বই পড়লেই শেখা যায় না, অথবা বই পড়ে শিখতে পারলেও অধ্যয়নের আরব্ধ সম্পূর্ণতা আসে অধিকতর পারমিতার অর্জনে [অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত]

Reading. Credit: Google/Internet

লীলা মজুমদার লিখেছিলেন যে, “প্রতিমাসে কলকাতা থেকে জ্যাঠামশাইরা ছোটোদের বইয়ের পার্সেল পাঠাতেন । আমাদের কাছে পার্সেল মানেই ছিল নতুন নতুন বই । কী তার গল্প, কী তার ছবি, কী তার রং, কী তার সুগন্ধ! নতুন বইতে নাক ডুবিয়ে যে ছোট ছেলে-মেয়ে পাঁচ মিনিট তার গন্ধ উপভোগ করেনি, সে বড়ো হতভাগা, সে আর কী বলব !” । বলার আর কিছু নেই, হতভাগা ছেলে-মেয়ের সংখ্যা দিনে-দিনে বেড়ে যাচ্ছে – সে-সব দেখে যত না দুঃখ হয়, তার চেয়ে বেশি করুণা হয় এদের বাবা-মায়ের নিঃস্পৃহ অথচ ক্রূরহাস্য আদর-আহ্লাদপনা দেখে । বলতে ইচ্ছে হয়, ‘হে বিশ্বপিতা! তুমি এদের ক্ষমা কর, এরা জানে না এরা কী করেছে’ । একটি শিশুর কাছ থেকে বইয়ের বিশ্ব কেড়ে নেওয়ার অর্থ একজন হবু পাঠকের ভ্রূণহত্যা করা । একাডেমিক বইপত্র পড়ে মানুষ ভাল পড়ুয়া হয় । কিছুজনের জৌলুশময় পড়ুয়া-জীবনের বিজ্ঞাপন বোকাবাক্সের পর্দায় অহরহ দেখা যায় তাও সত্যি, কিন্তু হায়! তাদের বেশিরভাগই বঞ্চিত হয় দুনিয়ার এক অনির্বচনীয় অমৃতসুধাভাণ্ডারের অধিকার থেকে । বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে নৈরাশ্য, বিষন্নতা, একাকীত্ব, পরাজয় ও হতাশার গ্লনিতে তারা হারিয়ে ফেলতে থাকে নিজেকেই । জীবনের ‘হাসি কান্না হীরা পান্না’গুলি আর তাদের আয়ত্তাধীন থাকে না । কেননা অল্পবয়সেই যে এরা সাবলীল স্বপ্নদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে । একটি শিশুর কাছে বইয়ের আশ্রয় না থাকা মানে তো একটি শিশিরবিন্দুর কাছে ঘাসের ঘর না থাকা । উত্তর-আধুনিক প্রযুক্তিবাদী বাবা-মা নিজেদের সদাব্যস্ত জীবনে যখন শিশুর মন ভুলিয়ে শান্ত রাখতে মোবাইল কিংবা কার্টুন চ্যানেল খুলে দিচ্ছেন তখন একই সঙ্গে পাঠের রূপকথার মধ্যে দিয়ে শিশুমনের কল্পনাশক্তির বিকাশের দরজাটিকে চিরতরের জন্য বন্ধও করে দিচ্ছেন । সত্যি বলতে কী, তারাও বোধহয় নিরুপায় । আজকের বাবা-মারা গল্প জানেন না । তারাও যে শোনেননি – পড়েননি – কী উমনো-ঝুমনো কী সোনারকাঠি-রূপোরকাঠি কিংবা বাঘ ও গরু। এই উত্তরাধিকার ঠিক যেভাবে এসেছে, আজকের শিশুও সেভাবেই গল্পকল্পের উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে । প্রতি বছর এদেশে গড়ে ১০ হাজার ছোট-ছোট ছাত্রছাত্রীরা আত্মহননের পথ বেছে নেয়, লক্ষজনকে মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় – কেবলমাত্র ব্যর্থতা স্বীকারের শিক্ষা না থাকা আর বন্ধুত্বাভাবের কারণে । মনে রাখা জরুরি, শিশুবেলার কল্পনাপ্রবণতার মধ্যে বড়োবেলার স্বাধীন সৃষ্টিশীল ও আনন্দময় জীবনের মূল সোপানটি নিহিত থাকে । এটি তৈরি করে মানবিক নৈতিকতার ভিত্তিভূমিকে । মুখ গুঁজে চোখ ছোট করে অবচেতনে বোনে স্বপ্নাশ্রয়ের আবাসস্থলটিকে । সেটিকে অবহেলা করে সাফল্যের নিক্তি হাতে দাঁড়িয়ে থাকলে কিংবা ইঁদুরদৌড়ে সামিল হলে এমনটা যে হবেই । দাসত্ববোধের ব্যাধী গ্রাস করবে । অথচ এটাই যেন এখন চরম বাস্তব, তাই মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে হয়, “A land of slaves shall ne’er be mine” ।

কিন্তু আজও কিছুজন আছে যাদের জীবন এই অভিশাপ থেকে মুক্ত, যারা এখনও বইয়ের মধ্যেই খুঁজে পায় সজীবতার উদ্বাহু “কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ” সুরটিকে, তারা, তাদের পাঠকসত্তার ভাববিশ্বে অবগাহন করেই সঞ্চয় করে জীবনের জহর-মনি-মানিক্যগুলিকে । এই পাঠকমণ্ডলীকে দুনিয়ার তাবৎ বিদগ্ধজনেরা নানা শিরোনামে ভূষিত করেছেন, বিতর্ক করেছেন, তকমায়িত করেছেন। লেখক যেমন এক ধরণের হয় না, বহুধারার বহুমাত্রিকতায় তেমনই বিস্তৃত হয় পাঠকেরও অন্দরমহল । ‘পাঠ>পাঠক>পঠন>পাঠকৃতি>পাঠ-প্রতিক্রিয়া>পাঠ-নির্মাণ’– এই ধারার অনুবর্তনের প্রাকারে দেখা দেয় বিন্যস্ত সাকাররূপগুলি । আজ সেই বিশ্বকুটিরে নিমন্ত্রণ-রক্ষার পালা । তথাকথিত পড়ুয়াদের দলকে বাদ দিলে পাঠকশ্রেণী মোটের ওপরে তিনটি মেজাজে বিন্যস্ত – সাধারণ পাঠক, নিবিড় পাঠক ও আদর্শ পাঠক । ইয়োহান ফ্রেডরিখ রখলিৎসকে লেখা গ্যোয়েটের একটি চিঠি, যেখানে তিনি লিখেছিলেন যে, “There are three kinds of readers: one, who enjoys without judging; a third, who judges without enjoying; another in the middle, who judges while enjoying and enjoys while judging”।

পাঠকের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগ শুধুমাত্র কেতাবের অক্ষরমালার মাধ্যমে। পাঠক ওই অক্ষরমালার বীথিকাতেই হেঁটে পাড়ি দেন লেখকের ‘সাত সাগর তেরো নদীর’ দেশে । সপ্তম শতাব্দিতে ঈসিডোর বলেছেন, “letters have the power to convey to us silently the sayings of those who are absent”। জন শেভারের মত করে বললে, লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক গড়ে ওঠার মুহূর্তটি ঠিক যেন একটি প্রেমের চুম্বনকাল । এই অর্থে লেখক বহুগামী হলেও প্রত্যেকটি প্রেম-চুম্বনের অন্তরঙ্গতাটি আলাদা ও বিশেষ, যা একমাত্র সম্ভব হয় অক্ষরের বহুবিধ সমবায় ও বিন্যাসের অসীম আধারে। লেখকের মূল কাজ তাই পাঠকের সঙ্গে সংযোগস্থাপন করা। লেখক যে মানেরই হোন না কেন অন্তিমে এই সম্পর্কটির ভিত যদি প্রস্তুত না করা যায় তবে সেই লেখার কোনও মূল্য থাকে না । আর যে-সন্ধিক্ষণে এই সংযুক্তির অচিরপ্রভা মূর্ত হয়, একজন পাঠক তখনই বিস্ময়খচিত মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হন । এমনও দেখা গেছে যে, লেখকের সঙ্গে পাঠকের সঠিক নির্বন্ধটি খুঁজে পাওয়ার জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হয়েছে শত-শতবর্ষ, যেমনটা হয়েছিল ব্লেক-ফ্রাইয়ি কিংবা জীবনানন্দ-ভূমেন্দ্রর বেলাতে ইত্যাদি । তবুও অন্তিমে সেই সংযোগের আবহেই সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিক মূর্ছনা । লেখক যেমন তার পাঠককে খুঁজে ফেরে, পাঠকও তেমন ঘুরে বেড়ায় তার লেখকের সন্ধানে । ইসাবেল আলেন্দে “My Invented Country” তে এই সংযোগ ও অনুসন্ধান প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, “I never forget that a book is not an end in itself. Just like a newspaper or a magazine, a book is a means of communication, which is why I try to grab the reader by the throat and not let go to the end. I don’t always succeed, of course; readers tend to be elusive. Who is my reader?” । ‘Who is my reader?’ – এই প্রশ্নে যেমন আছে লেখকের মরুদ্যান্বেষন, তেমনই অহরহ মরীচিকাময় পাঠকসত্তাও সেখানে ভেঙে ভেঙে কখনো গড়ে নেয় একটি জলপ্রপাতীয় রামধনু কিংবা কখনো বাঁধ ভাঙা বন্যায় অন্তরের পললভূমি ভসিয়ে দেয় । এভাবেই চলে একে-অপরের সঙ্গে গ্যূঢ় সম্পর্কস্থাপনের পালা । প্রেমের যেমন অভিমান আছে, আছে কটাক্ষপাত, তেমনই থাকে তৃপ্তির আস্বাদনও । লেখক কখনো পাঠকের প্রতি অনুরাগী কখনো কঠিনচিত্ত । এই সম্পর্কসত্তার ভুবনমাঝির ডিঙায় চড়েছেন সকল লেখকই – শার্লকীয়ধারায় যাচিয়েছেন পাঠকের ভাববিগ্রহটিকে ।

রবীন্দ্রনাথেও তা বিরল নয় । ‘বাংলা-লেখক’ প্রবন্ধে তিনি যে পাঠকের কথা বলেছেন তা হল সাধারণ পাঠকের মর্মস্থল । তিনি লিখেছেন যে, “লেখকদিগের মনে যতই অভিমান থাক, এ কথা অস্বীকার করিবার জো নাই যে, আমাদের দেশে পাঠক-সংখ্যা অতি যৎসামান্য। এবং তাহার মধ্যে এমন পাঠক “কোটিকে গুটিক” মেলে কি না সন্দেহ, যাঁহারা কোনো প্রবন্ধ পড়িয়া, কোনো সুযুক্তি করিয়া আপন জীবনযাত্রার লেশমাত্র পরিবর্তন সাধন করেন। নির্জীব নিঃস্বত্ব লোকের পক্ষে সুবিধাই একমাত্র কর্ণধার, সে কর্ণের প্রতি আর কাহারও কোনো অধিকার নাই। … আমাদের দেশে পাঠক নাই, ভাবের প্রতি আন্তরিক আস্থা নাই, যাহা চলিয়া আসিতেছে তাহাই চলিয়া যাইতেছে, কোনো কিছুতে কাহারও বাস্তবিক বেদনাবোধ নাই; এরূপ স্থলে লেখকদের অনেক কথাই অরণ্যে ক্রন্দন হইবে এবং অনেক সময়েই আদরের অপেক্ষা অপমান বেশি মিলিবে। এক হিসাবে অন্য দেশ অপেক্ষা আমাদের এ দেশে লেখকের কাজ চালানো অনেক সহজ। লেখার সহিত কোনো যথার্থ দায়িত্ব না থাকাতে কেহ কিছুতেই তেমন আপত্তি করে না। ভুল লিখিলে কেহ সংশোধন করে না, মিথ্যা লিখিলে কেহ প্রতিবাদ করে না, নিতান্ত “ছেলেখেলা” করিয়া গেলেও তাহা “প্রথম শ্রেণীর” ছাপার কাগজে প্রকাশিত হয়। বন্ধুরা বন্ধুকে অম্লানমুখে উৎসাহিত করিয় যায়, শত্রুরা রীতিমতো নিন্দা করিতে বসা অনর্থক পণ্ডশ্রম মনে করে। সকলেই জানেন, বাঙালির নিকটে বাংলা লেখার, এমন-কি লেখামাত্রেরই এমন কোনো কার্যকারিতা নাই, যেজন্য কোনোরূপ কষ্ট স্বীকার করা যায়। পাঠকেরা কেবল যতটুকু আমোদ বোধ করে ততটুকু চোখ বুলাইয়া যায়, যতটুকু নিজের সংস্কারের সহিত মেলে ততটুকু গ্রহণ করে, বাকিটুকু চোখ চাহিয়া দেখেও না। সেইজন্য যে-সে লোক যেমন-তেমন লেখা লিখিলেও চলিয়া যায়” । এই হল সাধারণ পাঠক । মনের স্তরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে যেটুকু অংশ তার উপভোগ্য সাধারণ পাঠক সেটুকুকেই গ্রহণ করে । বাকি নতুনত্বের প্রতি যেন তার কোনও ঝোঁক নেই । ফলে লেখকের মনোবেদনাও এখানে অভিমানের মত করেই ঝংকৃত হয় । তবে লেখকদের কাছে এটা নতুন কিছু নয়, আর রবীন্দ্রনাথও প্রথম নন যিনি এই উপলব্ধি করেছিলেন । যুগ-যুগ ধরে সাধারণ পাঠকের এটাই মূল নির্ধারিকা । কতকাল আগে লেখা ‘মালতী-মাধব’-এও ভবভূতির কন্ঠে শোনা যায় এই অভিমান ও আত্মসান্তনার ধ্বনি, “য়ে নাম কেচিদিহ নঃ প্রভয়ন্তভজনা / জানন্তি তে কিমপি তানপ্রতি নেষ য়ন্তঃ / উৎপতস্যাতে তু মম কইঅপি সমানধর্মী / কালও হিয়ম নিরবধি বিপুলা চ পৃথ্বী”। মহাকালের ভরসাতেই ভবভূতি থেকে বিভূতিভূষণ সকলেই লিখেছেন তঁদের শিল্পের ভাষ্যরূপ।

সাধারণ পাঠকদের আসলে কোনও বিশেষ পরিচয়পত্র হয় না, তারা যেন মুখের মিছিল । অর্থাৎ এদেরকে বিশেষ কোনও মতাদর্শগত, জীবিকাগত কিংবা বিশ্বাসবোধের প্রকরণে স্তরে-স্তরে আলাদা করা সম্ভব নয় । কারণ এরা এই দায় থেকে মুক্ত । এরা শুধুমাত্র ওপর-ওপর উপভোগ করার জন্যই যেন পড়ে, বাকি কোনও গভীরতার পরোয়া করে না । কেউ কেউ পাঠকের এই হালকা চালের স্বচ্ছন্দগতিতে প্রাণের লক্ষন খুঁজে পায়, কেউ কেউ সমালোচনা করে । যারা সমালোচনা করে তারা বাস্তবে ভুল স্থানে এসে সন্ধান করে তার কাম্য পাঠকটির । ভার্জিনিয়া উলফ সে দলে নন । তিনি এই পাঠকদের প্রতি উদার এবং আনন্দচিত্ত । তিনি লিখেছেন যে, “I rejoice to concur with the common reader; for by the common sense of readers, uncorrupted by literary prejudices, after all the refinements of subtilty and the dogmatism of learning, must be finally decided all claim to poetical honours” । অর্থাৎ সুগভীর মনোযোগ কলরব তুলে বয়ান দেয় যে সাধারণ পাঠক আসলে সাদামাটা জনসাধারণ। এরাই স্যামুয়েল জনসনের বাস্তব পাঠক। অধ্যাপক রবার্ট ডিমারিয়া(জুনিয়র) জনসনের এই পাঠকভাবনার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, “‘The public’ is another name for Johnson’s ideal allegorical reader, and public opinion, when purified and rendered elementally human by the passage of time, is the final judge of literary merit” । পক্ষান্তরে উরি মার্জোলিন উদার হলেও কিন্তু এত সহজে জনসাধারনকে পাঠকসত্ত্বায় প্রশ্রয় ও মুক্তি দিতে নারাজ । সাহিত্য যেহেতু লেখক-পাঠকের মধ্যেকার মূল অনুরণন, তাই সেখানে পাঠের ভিন্নার্থের সঙ্গে সাহিত্যের অন্তঃস্থলকে তিনি পাঠকসত্ত্বার আলোচনায় মূল দাবিদার করে তোলেন । মার্জোলিন “The Demarcation of Literature and the Reader”-এ সাহিত্যধারাকে চারটি প্রাকারে ব্যবচ্ছেদ করেছেন– এক, বিন্যাস বা ফর্মে দুই, উৎকর্ষতা বা ভ্যালুতে তিন, স্তর বা স্ট্যাটাসে ও চার, গ্রহণযোগ্যতা বা রিসেপসনে । এবং এর ভিত্তিতেই সাধারণ পাঠকের অবস্থান নির্মান করছেন । তিনি সাধারণ পাঠক বলার বদলে বলেছেন ‘এমপিরিকাল রিডার’ । সাহিত্যের ভিন্ন স্তরভাগে ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের সমাবেশ দেখা গেলেও, সাধারণ পাঠক শুধু বেছে নেয় অনায়াসসাধ্যভাবে উপভোগের যোগ্য ‘পপুলার’ অংশটিকে। আর তাই মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, “’Classic’ – a book which people praise and don’t read” । এই ‘people’-ই যে প্রকৃত সাধারণ পাঠক । সাধারণত্বের এই জটিল চক্রব্যূহ থেকে খুব সহজে ও সাবলীলভাবে যদি সাধারণ পাঠককে শনাক্ত করতে হয় তবে দিদিয়ের কস্তের শরণার্থী হওয়াই শ্রেয় । তিনি বলছেন যে, “The commuter on the 8.47 train, standing between a big bosomed lady and a naughty brat imperturbably moves his bespectacled eyes over a page of the Reader’s Digest: this is an empirical reader although he does not know it” । এই অভিজ্ঞতা হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ স্টেশনে আজও হয় এবং এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে এই পাঠকই বাস্তব, সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সর্বোপরি সাধারণ । আর এরাই গল্প-উপন্যাস-কবিতার বাজারবোধের মূল নিয়ন্তা ।

কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই আবেগের বশে একইসঙ্গে উচ্চস্তরীয় কদর ও সমাদরের ব্যপ্তির প্রত্যাশা করেন সাধারণ পাঠকদের বৃত্তে । তা না পেয়ে তারা এদের সমালোচক হয়ে ওঠেন । ঐতিহাসিক দলিলদস্তাবেজও উচ্চস্তরীয় কদর ও সমাদরের ব্যপ্তির মধ্যে অন্তর্নির্হিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাক্ষী দেয় । এখানে লেখক ও পাঠকের মধ্যে একটা ‘দ্বন্দ্বের বিন্যাস’ প্রধান হয়ে ওঠে ও পাঠক লাভ করে একটি অন্য মার্গ । কমলকুমার মজুমদার যে মহান লেখক সেকথা সত্যজিৎ রায় বলে গেছেন । তাই সাধারণ পাঠকের মধ্যে কমলকুমারের প্রতি সমাদরের অভাব নেই, কিন্তু তাই বলে উচ্চস্তরীয় কদরের প্রত্যাশা এই শ্রেণির কাছ থেকে করা মূর্খামি । আবার বিভূতিভূষণের সাহিত্য-সৌরভে মুগ্ধ হননি এমন সাধারণ পাঠক নেই, কারও বলে দেওয়ার পরোয়া না করেই এখানে আবার সমাদর ও কদর একইসঙ্গে দেখা যায় । দ্বন্দ্বটা হল এই যে, সাধারণ পাঠক মাঝে মধ্যে উঁচুদরের সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন ঠিকই কিন্তু তা থেকে সাধারণ পাঠককে রসগ্রাহী-সমঝদারের উচ্চাসন দেওয়া যায় না । যেমন ব্যতিক্রম উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃতি পায় না, তেমনই । সাধারণ পাঠকের মধ্যে এই ব্যতিক্রম সৃষ্টিতে একমাত্র কৃতিত্ব লেখকের, পাঠকের নয় । যেমন ধরা যাক, তাজমহল । পূর্ণিমার রাত্তিরে পরিষ্কার আকাশে যখন সফেদ মেঘের ছোট-ছোট ভেলা মাঝে মধ্যে উঁকি দেয় আর তাজমহলের অপূর্ব রূপচ্ছটা বিস্তারিত হয় পরিবেশে, তখন মুগ্ধ হয় সকলে – কি বোদ্ধা কি সাধারণ – সকলেই । এর কারণ হল শিল্পটির আবেদন এখানে সর্বাঙ্গীন – বোদ্ধা ও সাধারণ নিজেদের মত করে রসগ্রহণে সক্ষমতা অর্জন করেন। আসলে কিছু মহান শিল্প থাকে যা সকল শ্রেণিকে ছুঁয়ে যেতে সক্ষম, সব শিল্পের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, বরং বলা ভাল বেশিরভাগ ঐশ্বর্যশালী শিল্পের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য নয় । যেমন খাজুরাহোর প্রতি সাধারণের মুগ্ধতার কথা ধরা যাক । সাধারণে খাজুরাহো দেখে ঠিকই কিন্তু রসগ্রহণ করতে পারে কি ? পারে না, তাই বলে খাজুরাহো তাজমহলের চেয়ে কোনও অংশে কম হয়ে যায় না । আসলে শিল্পের ভিন্ন ধারায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন আছেন তেমনই বিষ্ণু দে-ও তো আছেন । শিল্পের ভিন্নধর্মীতা তাই পাঠকের মধ্যেও সৃষ্টি করে একটি অনিবার্য বিভাজন । ফলে সর্বজনবোধ্য নয় কিন্তু দুর্দান্ত অপূর্ব সৃষ্টির গুণগ্রাহিতার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে পাঠকের অন্য প্রজ্ঞার । বেশিরভাগ লেখক এখানেই গুলিয়ে ফেলেন ও অভিমান করে বসেন । যে প্রজ্ঞার প্রতি কালিদাসও শ্রদ্ধাশীল, লেখেন, ‘আ পরিতোষাদ-বিদুষাং ন সাধুমন্যে প্রয়োগবিজ্ঞানম / বলবদ-অপি শিক্ষিতানাম-আত্মন্যপ্রত্যয়ং চেতঃ”, তাকে যে এত সহজে প্রত্যাশা করা যায় না । আর এই কঠিন প্রত্যাশাই হল আদর্শ পাঠকের উর্বর জমি । আলবার্তো মাঙ্গুয়েল আদর্শপাঠকের ভিত্তিভূমি রচনা করেছেন যথার্থভাবে । তাঁর মতে আদর্শ পাঠক তিনিই যিনি লেখককে বিশ্বাস করেন না এবং যার পাঠ ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উত্তর অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ধাবমান নয়, বরং শিল্পীর বীক্ষার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে চায় প্রতিমুহূর্তে। জাতীয়তাবাদে বেপরোয়া, দেশ-বিদেশ যে কোনও বইয়ের নির্বাচন ও কদরে এরা সজাগ বিবর্ধক কাঁচ । কেউ কেউ এদের আদর্শ সমালোচক বলে আখ্যায়িত করেন । এইসব পাঠকদের আবেগ যেন লেখকের আবেগের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে না, এগিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করে বিচারের দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে । এই বিচার হয় নিরপেক্ষ কিন্তু শুষ্ক ও কঠোর । এক্ষেত্রে কেবলমাত্র অতুগ্র অনমনীয়তাই মূল অভিপ্সা । এটাই আদর্শ পাঠকের ভুবন বা সমালোচকের দুনিয়াদারী।

ড্রাইডেন এদের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন একটি বিশেষ আসন – বৌদ্ধিকতার আসন – যিনি প্রকৃতার্থে গুণমান বিচারে যোগ্য । ব্যোদলেয়র যদিও এদের এই মহতী বোধে নির্দিষ্ট করতে চাননি। তিনি রচনা করেছেন চার ধরণের পাঠকসত্ত্বা যা পক্ষান্তরে কুঞ্চিতললাটের তেরছা-চোখে বরণ করতে চায় আদর্শ পাঠকরূপী সমালোচকটিকে । তাঁর মতে এই পাঠকরা হলেন, “the faultless poet, the perfect magician of French letters”, “peaceful and bucolic reader”, “curious suffering soul” ও “hypocritical reader” । রবীন্দ্রনাথও ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধে এদের দেখেছেন ঈষৎ সর্পিলভাবেই । তিনি বলেছেন, “আবার ব্যাবসাদার বিচারকও আছে। তাহাদের পুঁথিগত বিদ্যা। তাহারা সারস্বতপ্রাসাদের দেউড়িতে বসিয়া হাঁকডাক, তর্জনগর্জন, ঘুষ ও ঘুষির কারবার করিয়া থাকে; অন্তঃপুরের সহিত তাহাদের পরিচয় নাই। তাহারা অনেক সময়েই গাড়িজুড়ি ও ঘড়ির চেন দেখিয়াই ভোলে। কিন্তু বীণাপাণির অনেক অন্তঃপুরচারী আত্মীয় বিরলবেশে দীনের মতো মা’র কাছে যায় এবং তিনি তাহাদিগকে কোলে লইয়া মস্তকাঘ্রাণ করেন। তাহারা কখনো-কখনো তাঁহার শুভ্র অঞ্চলে কিছু-কিছু ধূলিক্ষেপও করে; তিনি তাহা হাসিয়া ঝাড়িয়া ফেলেন। এই-সমস্ত ধূলামাটি সত্ত্বেও দেবী যাহাদিগকে আপনার বলিয়া কোলে তুলিয়া লন দেউড়ির দরোয়ানগুলা তাহাদিগকে চিনিবে কোন্‌ লক্ষণ দেখিয়া? তাহারা পোশাক চেনে, তাহারা মানুষ চেনে না। তাহারা উৎপাত করিতে পারে, কিন্তু বিচার করিবার ভার তাহাদের উপর নাই” । ফ্রাইয়ির মতে আদর্শ পাঠক, ভাবে যেন লেখকের মতই সৃষ্টিশীল সত্তার অধিকারি কিন্তু ভঙ্গিতে নায়কোচিত অবস্থান তার। আদর্শ পাঠককে কেউ কেউ প্রকৃত বোদ্ধার মর্যাদা দিতে চান যেমন, কেউ কেউ তেমনই প্রস্তুত করেন বিদ্রূপ । জনাথন কুলার তাই বলছেন, “The ideal reader is, of course, a theoretical construct, perhaps best thought of as a representation of the central notion of acceptability” । এ প্রসঙ্গে স্টিভেন মাইলুক্সের “Interpretive Conventions: The Reader in the Study of American Fiction” গ্রন্থের “CONCLUSION: Reading “the Reader” অংশটি এই প্রবন্ধের আদর্শ পাঠকদের বিশেষ নজরটান হতে পারে । জয়েসকে তিনি কী চান তাঁর আদর্শ পাঠকদের সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি নাকি বলেছিলেন যে তাঁর আদর্শ পাঠকরা যেন অনিদ্রারোগের আদর্শ রুগি হয় ।

আদর্শ পাঠক বা সমালোচকের সঙ্গে নিবিড় পাঠক এতটাই ছায়াসঙ্গীর মত মিশে থাকে যে মাঝে মাঝে তাকে আলাদা করে ফেলা বেশ মুশকিল হয় । দুজন মার্জিনালিয়া ( যারা মার্জিনে মার্জিনে লিখে রাখে পাঠের শল্যচিকিৎসার দাগ ) একজন রবীন্দ্রনাথ যিনি আদর্শ পাঠকের সমালোচক, অন্যজন কোলরিজ যিনি আদর্শ পাঠককে দেন ‘কোহিনূরের’ মর্যাদা । লকের কাছে এরা হল, “the nicest readers” । মিলটন বলে ওঠেন “Fit audience find, though few” । কোনটা আদর্শ পাঠকের জন্য আর কোনটা নিবিড় পাঠকের জন্য নির্দিষ্ট – এত সহজভাবে ঔচিত্যের বিচার করে ফেলা বোধহয় সঠিক নয় । এইসব জটিল আবর্ত থেকে আদর্শ ও নিবিড় পাঠককে আলাদা করে যা, তা হল অনাবিল আবেগের মন্থন। বিচারবোধে অতুগ্র অনমনীয়তার মূল অভিপ্সার মধ্যেই যে পাঠকের অন্তরে আছে আবেগের ছলাৎ-ছলাৎ – সেই হল নিবিড় পাঠক । কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ, কোলরিজ, লক, মিলটন সকলেই এই নিবিড়তার প্রত্যাশী কিন্তু সেট-সাবসেট-সুপারসেটের মধ্যে অন্তর্ব্যবচ্ছেদ বা প্রতিচ্ছেদটিকে অলীক করে রেখেছেন যেন এঁরা । যদিও এমনটাই স্বাভাবিক । লেখকের মন কখনও চায় নির্মেদ সমালোচনা, কখনো চায় তার মধ্যেই ভালবাসার আলিঙ্গন । ফলে এই সাতরঙা চক্রটি এমন জোরসে ঘোরে যে সবকিছু সাদা হয়ে যায় – কাওকে আলাদা করা যায় না । তার মানে যে তারা নেই, তা কিন্তু নয় ।

নিবিড় পাঠকের স্তরটি আসলে বাঙালির আটপৌরে ব্যাপারের মত । জীবনের প্রকৃতার্থে যা একেবারে নিজের, যাকে উদযাপন করার মধ্যে নতুনত্ব নেই কিন্তু ধারন করার মধ্যে আছে এক অনন্য স্বকীয়তা ও মৌলিকতা । যেমনটা, নদীর ধারে বসে বাউল গান শোনার পরে হয় বা নকশীকাঁথার গল্পবুনন কিংবা যামিনী রায়ের ছবি দেখলে যে রেশ থেকে যায়, তেমনটাই হল নিবিড় পাঠকের দুনিয়া । প্রত্যেকটি জনজাতির জীবনে এরকম সাদামাটা রোজকার কিছু যাপনচিত্র থাকে যেগুলির মধ্যে থাকে অপরূপ শান্তির স্পর্শ – আর সেই স্পর্শেরই অন্য একটি মাত্রাই হল পাঠকের নিবিড়তা । এই পাঠক সাধারণ পাঠকের মত নিঃস্পৃহ নয় আবার আদর্শ পাঠকের মত কেবলই দুঁদেও নয় – এরা যেন একটি অন্তর্বর্তী স্তরে অবস্থান করে । কস্তের এই শ্রেণীকে ‘ইমপ্লায়েড রিডার’ বলেছেন । তিনি বলেছেন, “Its conditions of existence are defined by metaliterature by positing a certain construct as a model of reality and, within this model – dynamic, open to change – by giving the status of reality to the literary text… The implied reader is in the text, belongs to the text, is a text effect or a function of the text. Indissociable from the text it is a misnomer for a model of reacting, or, more interestingly, the projection – by the language of metaliterature – of a rapport into a character: the built-in text’s lover, the embodiment of textual narcissism” । এই ধারণাটির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হতে না পারলেও এর ভাববিগ্রহকে একেবারে ফেলে দেওয়াও যায় না । কুলার আবার যে অঙ্গিকে এই পাঠককে দেখেছেন সেটা খানিক ভিন্নধর্মী । কুলারের মতে এই পাঠক হল ‘কম্পিটেন্ট রিডার’ । পাঠকের কয়েকটি বিশেষ গুণ যা লেখকরা প্রত্যাশা করেন সেগুলি হল, “শিক্ষা”, “বুদ্ধির প্রখরতা”, “পরিপক্কতা” ও “রূপ ও ভাবসাগরে অবগাহনের ক্ষমতা”। আর এইগুলির মধ্যে প্রথম তিনটি মিলে গঠন করে আদর্শতম পাঠকটিকে আর চারটি একত্রে জন্ম দেয় নিবিড় পাঠকের। এইজন্যই আদর্শ পাঠক ও নিবিড় পাঠকের মধ্যে ব্যবধান নিদারুণ সূক্ষতায় দোদুল্যমান । স্ট্যানলি ফিশ এই অবগাহনে সক্ষম পাঠকদের জন্যে বলেছেন, “neither an abstraction, nor an actual living reader, but a hybrid-a real reader (me) who does everything within his power to make himself informed. That is, I can with some justification project my responses into those of ‘the’ reader because they have been modified by the constraints placed on me by the assumptions and operations of the method …” । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নিবিড়তারই পক্ষপাতী । এই পাঠকের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “যাহা ক্ষণিক, যাহা সংকীর্ণ, তাহা তাঁহাদিগকে ফাঁকি দিতে পারে না; যাহা ধ্রুব, যাহা চিরন্তন, এক মুহূর্তেই তাহা তাঁহারা চিনিতে পারেন। সাহিত্যের নিত্যবস্তুর সহিত পরিচয়লাভ করিয়া নিত্যত্বের লক্ষণগুলি তাঁহারা জ্ঞাতসারে এবং অলক্ষ্যে অন্তঃকরণের সহিত মিলাইয়া লইয়াছেন; স্বভাবে এবং শিক্ষায় তাঁহারা সর্বকালীন বিচারকের পদ গ্রহণ করিবার যোগ্য” । আদর্শ পাঠক হল নিবিড় পাঠকের উপসেট । সেইজন্যেই কেউ কেউ বিভ্রান্তির বশে আদর্শ পাঠকের সমালোচনাকে নিবিড় পাঠকের কীর্তি ধরে নিয়ে শুধুই প্রশংসা করেছেন অকুন্ঠচিত্তে, কেউ কেউ আদর্শ পাঠককে রসহীন সমালোচক ভেবে জুগুপ্সার টিপ্পনীও কেটেছেন । আদর্শ পাঠক আসলে তত্ত্বগতভাবে অস্তিত্ববাদী – অনর্থের ভাবে মাঝে মাঝে যা শরীরিরূপ ধরে ফেলে মাত্র ।

যেখানে, নিবিড় পাঠকের ভাববিশ্বে রয়েছে একটি অপরিমেয় স্বজ্ঞা, সেখান থেকে উদ্ভূত যেকোন মন্ত্যব্যই – কঠোর সমালোচনা বা অকুন্ঠ উচ্ছ্বাস কিংবা একইসঙ্গে দুই-ই – হল মন্থনে উত্থিত অমৃতপাত্র । তাই, তাই-ই, নিবিড় পাঠক আর কেউ নয়, স্বয়ং লেখক । শুধু তিনি নিজের লেখার ব্যাপারে এই ক্ষমতার প্রয়োগে খানিক অক্ষম । বাস্তবের পৃথিবীতে তাই পাঠকের তিনটি শ্রেণি – সাধারণ পাঠক, সমালোচক ও লেখক । লেখক-পাঠকের সম্পর্কে এই হল পাঠকের বিশ্বরূপ । লেখকের পাঠকত্বের নিবিড়তার প্রকাশই হল তার লেখনী । এই পাঠ শুধু পুঁথিপাঠে সীমাবদ্ধ নয়, এই পাঠ প্রকৃতির সঙ্গে অস্তিত্ব সন্ধানের পাঠ । আর লেখকের এই সন্ধানে প্রাপ্ত কিরণ যখন লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন তা সাধারণজনের মধ্যে চায় সমাদর, সমালোচকের কাছে চায় (বা অল্প চায় কিংবা একেবারেই চায় না) ভুলভ্রান্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ আর অন্যান্য লেখকের ( বা নিবিড় পাঠকের) কাছে চায় জাগতিক উচ্চস্তরীয় কদর। যুগে যুগে নিবিড় পাঠকরূপী লেখকরাই সাধারণ্যে উন্মুক্ত করেছেন অন্য লেখকের বহুমুখী মহানুভব অস্তিত্বটিকে, চোখে আঙুল দিয়ে বিশেষত্বগুলিকে চিনিয়ে দিয়েছেন, তার মধ্যে সমালোচনাও করেছেন। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মাল্যদান করেছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথকে, অনেক পরে অন্যান্যরা, তেমনই রবীন্দ্রনাথ ও পরে হীরেন মুখোপাধ্যায় থেকে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা অসীম রায় থেকে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দিষ্ট করেছেন বিষ্ণু দের আসনটি-কে। আর এটাই হল নিবিড় পাঠতন্ত্রের উদ্ভাসিত নৈবেদ্য ।

প্রবন্ধের অন্তিমে পৌঁছে, একথাই বলার যে, সাধারণ পাঠক থেকে শুষ্ক সমালোচক(আদর্শ পাঠক) হয়ে নিবিড় পাঠকত্বে উত্তোরণের মধ্যেই থাকে পাঠ-নির্মাণের সফল সাধনা। লেখক ও পাঠক এজন্যই একে অন্যের পরিপূরক। ছেলেবেলার পাঠের অভ্যেসেই এই বীজ উপ্ত হয় । কেউ কেউ তিনটি স্তর অতিক্রম করেন দাপটের সঙ্গে, কেউ কেউ মাঝপথেই হাল ছেড়ে দেন আর বেশিরভাগই স্তরে ওঠার চেষ্টাটুকুও করেন না । ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় অক্ষরমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চারটি স্তর – অমর লেখক, নশ্বর লেখক ও সাধারণ পাঠক । আর, অমর লেখক ও নশ্বর লেখকের মধ্যেকার একটি দোদুল্যমান দ্বিধাথরথর চূড়ে থাকে সমালোচকের অবস্থান । নিবিড় পাঠকের সংখ্যা নিতান্ত কম, ঐ ‘কোটিকে গুটিক’, তাছাড়া আছে বেশ কিছু ‘ব্যাবসাদার বিচারক’ ও ‘গণতান্ত্রিক আহাম্মক’ আর বাকি সবাই হল ‘সাধারণ পাঠক’ । আবার তাই, লেখক-পাঠক শুধু নয়, থাকে পাঠকে-পাঠকেও দ্বন্দ্ব । যেমন একবার (শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন) ‘কবিতা-পরিচয়’ পত্রিকায় অলোকরঞ্জনবাবু ও সুনীলবাবুর মধ্যে পাঠকস্বত্বার অধিষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক বেধেছিল, অলোকরঞ্জনবাবু বলেছিলেন, “স্বভাবী একজন পাঠক যেমন নিজের আবেগ/বাসনা/সংস্কারের সঙ্গে কবিকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেন, এক্ষেত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার বেশি কিছু করেননি”। জবাবে সুনীলবাবু প্রশ্ন করেছিলেন, “তাতে দোষ করেছি কি? অপরের কবিতা পাঠ করার সময় আমি শুধুই একজন বিনীত, নম্র ও উদগ্রীব পাঠক, এবং নিজস্ব আবেগ ও বাসনার সঙ্গেই কবিতাকে মিলিয়ে নিতে চাই”। পাঠকের ভাববিশ্ব তাই দ্বন্দ্বময় । কিন্তু তা যাই হোক, প্রকৃতপ্রস্তাবে, সাধারণের মধ্যেকার ভাল পাঠকই হল পাঠক-সমাবেশের প্রোটাগনিস্ট, ভাল পাঠকের ওপরেই প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ । কারা ভাল পাঠক ? ভ্লাদিমির নাবোকভের ভাষায়, “A good reader, major reader, an active and creative reader is a re-reader” । এই ভাল পাঠক হবার জন্য আসলে দরকার বড়ো হবার পরেও অন্তরের শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা । কেননা, “ছোটোরা বই পড়ে বেঁচে থাকার জন্য । আনন্দের জন্য” । তাই অল্প বয়স থেকেই বইয়ের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে হবে । উদযাপন করতে হবে পাঠের উৎসব, অযুত অক্ষরে রচিত চিন্তার বৈদগ্ধকে ধারণ করতে হবে, সেখানেই যে হবে আসল বেঁচে থাকা । নইলে লেখক-পাঠকের দুনিয়া শেষ হয়ে গিয়ে রচিত হবে একটি রাক্ষুসে পৃথিবী- হিংসার পৃথিবী, অশান্তির পৃথিবী, হতাশার পৃথিবী । মনে রাখতে হবে, একটি বইয়ের পাতায় থাকে সহস্র উদ্ভিদের প্রাণ । আর উদ্ভিদই হল মানুষের জীবনচক্রে অক্সিজেনের মূল উৎস ।

গ্রন্থপঞ্জী ও তথ্যসূত্রঃ

1. রবীন্দ্রনাথের পড়াশুনো – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার
2. পাঠক রবীন্দ্রনাথ – বিশ্বনাথ রায়
3. The Ideal Reader: A Critical Fiction – Robert DeMaria, Jr.
4. Three Concepts of the Reader and Their Contribution to a Theory of the Literary Text – Didier Coste
5. Alberto Manguel – A History of Reading
6. Stanislas Dehaene – Reading in the Brain
7. Alberto Manguel – A Reader on Reading
8. On Writing – Stephen King
9. রচনাসমগ্র ১ – লীলা মজুমদার
10. গদ্যসংগ্রহ – শঙ্খ ঘোষ
11. https://resource.acu.edu.au/acuskills/critlit/3_6.html
12. https://en.wikipedia.org/wiki/Reader-response_criticism
13. https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/when-rabindranath-tagore-read-books- he-used-to-write-notes-in-margin-1.608679
14. https://www.newyorker.com/books/page-turner/the-marginal-obsession-with-marginalia
15. অন্যান্য