তিনি বৃদ্ধ হলেন।

তিনি বৃদ্ধ হলেন না।

প্রথমজন পিতা।

দ্বিতীয়জন পুত্র।

প্রথমজনের মৃত্যু স্বাভাবিক, বহুবর্ষ পেরিয়ে। দ্বিতীয়জনের আকস্মিক, তারুণ্যে। প্রথমজন শোককাতর হয়েও দৃঢ়চিত্ত। দ্বিতীয়জন দৃঢ়চরিত্র অথচ দূরগামী। প্রথমজন লড়াকু, সশস্ত্র সংগ্রামী দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। দ্বিতীয়জন লেখক ও সংগঠক, কিবোর্ড ও কলমে নিয়ত যোদ্ধা, আমৃত্যু।

দুজনের মধ্যেই মিল একটাই, জীবনের শেষদিন অবধি তাঁরা কেউই আদর্শের লড়াই থেকে বিচ্যুত হননি। আপোস করেননি, মাথা নোয়াননি, সরে আসেননি যা সত্য বলে জানেন সেটা থেকে।

একজন অজেয়, আরেকজন অজয়। একজন মাটির মানুষ, অন্যজন আকাশের অভিজিৎ নক্ষত্র।

ডক্টর অভিজিৎ রায় বা অভিদা বা অনেকের কাছে গুল্লু বা গুল্লুদার জন্মদিনটা, ১২ই সেপ্টেম্বর, নানান দিন থেকেই আমার কাছে তাৎপর্যবাহী। এর আগের দিন বিশ্বের মোড়ফেরানো ৯/১১, যা পৃথিবীর নানান দিক পাল্টে দিয়েছে পুরোপুরি। আর আমার নিজেরও কিছু ঘটনা রয়েছে এর আগে পরে, যা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে অভিদার জন্মদিন আমায় এতভাবে অভিভূত করে যে আমি প্রতিবারই ভাবি কিছু লিখব, প্রতিবারই হারিয়ে ফেলি সেই ভাবনা।

ফেরা যাক অভিদার কথায়।

কথাগুলো আমি নানান জায়গায় লেখায় ও কথায় একাধিকবারই বলেছি যে অনলাইনে ও অফলাইনে নানান লোকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে কমবেশি। কিন্তু অভিদার মত এমন ভদ্র, সুসভ্য, সুজনের দেখা আমি পাইনি তেমন একটা। পারিবারিক প্রভাব তো নিঃসন্দেহে আছেই, কিন্তু ব্যক্তিগত জিনেরও প্রভাব কম হওয়ার কথা নয়। যেকেউ তাঁকে ইমেল করলে জবাব পেতেন, ফেসবুকের মেসেঞ্জারেও তিনি অজস্রজনের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, অগণিত তরুণকে আহ্বান জানিয়েছেন মুক্তমনায় লেখার জন্যে বা লেখালেখিতে উৎসাহ যুগিয়েছেন অনেককেই। স্কুলের শিক্ষার্থী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সবার কাছ থেকেই লেখা যোগাড় করা, অনুপ্রাণিত করা, অন্য লেখকদের বই বা লেখালেখির সন্ধান দেওয়া এসবই তিনি একনিষ্ঠভাবে করে গেছেন। মান দিয়েছেন যাদের অনেকে পাত্তাই দিতে চায় না। এরকম অনেক নীরব কৃতজ্ঞজনা রয়ে গেছেন যাঁরা এখনো অশ্রুসজল ও নতশির হন তাঁর প্রসঙ্গে। আবার বিপরীত দিকে, তাঁর কাছ থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়েও কৃতঘ্নতার নজির খুব বেশি না-হলেও একেবারে অনুপস্থিত তাও নয়, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও।

অনেক খ্যাতনামা মানুষ ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই ইতরপ্রকৃতির। অভিদা এত পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় হয়েও সবদিকে এতটাই নিরভিমান ও নিরহঙ্কার ছিলেন যে কখনো কখনো সেটা রীতিমত অসাধারণ ও অবিশ্বাস্য ঠেকত। অভিদা অবিশ্বাসের পথচারী হিসেবে যাঁদের শ্রদ্ধা করতেন, এমনকি সেরকম খ্যাতিসম্পন্ন লোকজনও তাঁর মৃত্যুর পরে অশালীনভাবে তাঁকে বা তাঁর সঙ্গিনী বন্যা আহমেদকে আক্রমণ করেছেন। জড় পদার্থের মত আহত দৃষ্টিতে দেখে গেছি সেসব। তখনো শুকায়নি তাঁর রক্তের দাগ, তখনো মোছেনি পথের ওপর তাঁর মগজের টুকরো, তখনো জীবনমৃত্যুর দোলাচলে দুলেছেন রাফিদা আহমেদ বন্যা।

মানুষ আসলে কাকেই বা বলি?

অভিদা প্রাণপাত করেছেন ব্লগারদের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু ও মৌলবাদীদের মারণাস্ত্র থেকে বাঁচাতে। সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আর্থিক, সাংগঠনিক, ও অন্যান্যভাবে। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর আহত সহধর্মা রাফিদা আহমেদ বন্যাও তাঁর স্মৃতিতে সেই ধারাবাহিকতা বহনের চেষ্টা করে গেছেন। এবং আক্রান্ত হয়েছেন তার পরেও। এসাইলাম বা শরণার্থী হওয়াটা অনেকের কাছে ন্যাক্কারজনক শব্দ ও আচরণে পরিণত হয়েছে, কোনো কোনো সুযোগসন্ধানীর কদর্য ব্যবহারে। আমি ভাবি, আজ অভিদা বেঁচে থাকলে কি অনন্ত ভিসা পেতেন অন্য কোনো দেশের, বেঁচে যেত কি ওয়াশিকুর রহমান বাবু, লেখালেখি চালিয়ে যেত নিলয় নীল? কিংবা, একটু চুপিচুপি, আমার জীবনও কি অন্যরকম হত কিছু?

যে দেশে অবিশ্বাসী ব্লগার, এ্যাক্টিভিস্ট সবার নৃশংসতম খুন অন্যদের উপহাসের উপকরণ, প্রাণভয়ে পলায়ন আনন্দের আবাহনী, যে কোন ক্ষুব্ধ প্রতিবাদই উল্লাসের উচ্ছ্বাস, সেখানে তারা যে অস্পৃশ্যতম অবহেলিতের দলে থাকবে, সে তো বলাই বাহুল্য। অভিদা গর্বিত ভাবে নিজেকে এই আক্রান্ত, অবমানিত, ঘৃণিত অচ্ছুৎদের দলে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতেন কারণ তিনি ভাবতেন ইতিহাস এদেরই দায়মুক্তি দেবে সততা ও সভ্যতার প্রশ্নে। একইভাবে তিনি ছিলেন যৌনসংখ্যালঘুদের পক্ষে, নারীস্বাধীনতার সক্ষম কর্মীদের পক্ষে, পাহাড়ি ও সমতলের আদিবাসীদের পক্ষে, জাতিগত বা ধর্মীয় বা যেকোনো রকম নিপীড়িতদের পক্ষে।

প্রগতিশীল তো অনেকই দেখি আশেপাশে। প্রায় প্রতিটি কষ্টিপাথরে পার পান না কেউই। কেউ যৌনসংখ্যালঘুদের বিরোধী, কেউ নারীস্বাধীনতার, কেউ বর্ণবাদের ফাঁদে আটকা, কেউ জাতীয়তাবাদের। কেউ রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয়ের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ান না, কেউ ব্যক্তির ধর্মীয় মৌলবাদের। কেউ এক ধর্মের নামে অন্য ধর্মের ওপর অত্যাচারে দোষ দেখেন না, কেউ এক জাতির নামে অন্য জাতির ওপর।

একমাত্র অভিদাকেই দেখলাম অক্লান্তভাবে লিখে গেলেন প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, ইরাক, সিরিয়ার নিপীড়তদের জন্যে; বাংলাদেশের আদিবাসীদের জন্যে; সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদের জন্যে; নির্যাতিত নারীদের জন্যে; হিন্দুত্ববাদীদের বিপক্ষে; মৌলবাদী মুসলিমদের বিপক্ষে; উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদিদের বিপক্ষে; গোঁড়া খ্রিস্টানদের বিপক্ষে; বিবর্তনাস্বীকারকারীদের বিপক্ষে। এই সংখ্যা ও তালিকা অন্তহীন, তাঁর সদা সংগ্রামী চরিত্রের মতই, এবং এজন্যে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে ছিলেন না। এমনকি বামপন্থার পক্ষেও নয় কারণ এর ফলিত দশার নানা সমস্যা তাঁর চোখে, বাকি অনেকের মতই, পড়েছিল। এমনকি কেউ কেউ তাঁকে নব্য নাস্তিকদের মতোই পশ্চিমা সুবিধাভোগী, ইউরোকেন্দ্রিক, ইসলামবিদ্বেষী, একদেশদর্শী, বুর্জোয়া, উগ্র নাস্তিক (“সালাফি সেক্যুলার”) হিসেবে দাগিয়ে প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন, কখনো কখনো তাঁকে মুছে ফেলেছেন এই ভেবেও। এই দলে বাম থেকে ডান সবাইই আছেন। আছেন প্রগতিশীল থেকে প্রগতিবিরোধী দুই শিবিরের লোকজনই। যদিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান চোখ এড়িয়ে গেছে তাঁদের সবারই।

আজও তিনি আমার কাছে দ্রোণাচার্য, লেখালেখিতে। কোনো বিষয়ের প্রাচীন ও নবীন তথ্য নিংড়ে নিজের মত ও পথ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অক্লান্ত সংগ্রাম দেখে শত্রুরাও ঈর্ষায় জ্বলতে জ্বলতে বলত, বেটা লিখেছে বটে! আর বন্ধুরা হয়ে উঠত বিহ্বল, আবেগে, ধারে ও ভারে। তাঁর লেখার ধরন, ধাঁচ, কৌশল, গঠন, উপস্থাপন; পড়ার ব্যাপ্তি, বিস্তার, শক্তি নিয়ে তিনি আজো অনন্য। আজো তাই একলব্য শিষ্য হয়ে শিখতেই থাকি। শিখতেই থাকি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর বই থেকে, ব্লগপোস্ট থেকে, এমনকি মন্তব্য থেকেও।

আর আপাতদৃষ্টিতে যা দেখি, তিনি আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছেন তাঁর লেখা ও আদর্শ নিয়ে। আর ধীরে ধীরে তাঁর মাথা জেগে উঠছে সব নীতি, পথ, লড়াইয়ের মেঘ পেরিয়ে। ওয়ালেস, চে, সূর্য সেন যেমন তাঁদের আদর্শের জন্যে জীবন বিসর্জন দিয়ে দেশকালবিস্তৃত ভাবমূর্তি ধারণ করে আকাশের চাইতেও হয়ে উঠেছেন বড়, তেমনিই অভিজিৎ নামটি মাটি ছাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে সমনামী নক্ষত্রের কাছাকাছি।

আপনি জন্মেছিলেন বাংলাদেশের জন্মের সমসময়ে। আপনার মতই বাংলাদেশ লড়েছে অজস্র সম্ভাবনা ও রক্তপাতের ভেতর দিয়ে, লড়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে, একত্র করেছে তরুণদের, আদর্শের জন্যে প্রাণপাত করেছে, এবং মূর্ছিত হয়ে পড়েছে মৌলবাদীদের রাষ্ট্রীয় ও দলীয় আস্কারায় ও আশ্রয়ে।

বাংলাদেশের আশা হারিয়ে গেছে, পিছিয়ে গেছে অনেকদূর আজ সে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যে-দলটি এক নদী রক্ত পেরিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল তার জন্মযুদ্ধে ও মুক্তিস্বপ্নে, আজ সেই দলই তাকে ভাসিয়েছে ইসলামি মৌলবাদের নৌকায়, মদিনার খেজুরের খোয়াব দেখিয়ে।

আপনিও, অভিদা, প্রতিবাদের স্বপ্ন নিয়ে ও দেখিয়ে হারিয়ে গেলেও আজও লক্ষ তরুণের বুকে ও চোখে আপনি আছেন বেঁচে। অজস্র মুরতাদ, অবিশ্বাসী, নাস্তিক গড়ে উঠছে আপনাকে দেবতা ও প্রেরিত পুরুষ জেনে।

আপনার পিতৃদেব অজয় হয়েছিলেন দেশ অস্ত্রহাতে স্বাধীন করে।

আপনি কি মরণোত্তর জয়লাভ করবেন তরুণদের সংগ্রামের সফলতা এনে?

আমি আপনার জন্মদিনে আশার মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখি উদযাপনের অপেক্ষায়।

অভিদা, আপনি কি আপনার মৃত্যুতে জীবনকে অতিক্রম করবেন?

আমি কি বেঁচে থাকব ততদিন?

বাংলাদেশ কি কখনো আপনার আদর্শে আবারো জয়ী হতে পারবে?

যাই হোক, যেভাবেই হোক, অভিদা, এই জন্মদিনে, এই স্মৃতিরোমন্থনে, এই আশাসংবাদে, আপনাকে, তোমাকে ভালোবাসি।