দ্বিতীয় পর্ব: দাসত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: স্বাধীনতার সীমানা

চারশো বছর হয়ে গেল আফ্রিকানদেরকে বন্দী করে দাস বানিয়ে ভার্জিনিয়াতে আনা হয়েছিল অথচ বেশীরভাগ আমেরিকান এখন পর্যন্ত দাসত্বের পুরো ইতিহাস জানে না। মানুষ মনে হয় ইতিহাস বিস্মৃত একটা প্রাণী। ১৬১৯ সালের কোন একসময় সাও জোয়াও বাতিস্তা নামের একটা পর্তুগিজ জাহাজ দাস-ভর্তি বোঝাই করে আটলান্টিক পাড়ি দেয়। জাহাজটি দাস পরিবহনের জন্যই পরিচিত ছিল। পর্তুগিজ নাবিক দলটি সশস্ত্র হামলা চালিয়ে আফ্রিকার দক্ষিণপশ্চিমের দেশ অ্যাঙ্গোলার এনডোঙ্গো এবং কঙ্গো থেকে নারী-পুরুষ শিশু-বালক সবাইকে ধরে ধরে জাহাজে বন্দী করে। মানুষ ভরা জাহাজ তখন রওনা দিতো আমেরিকার পথে আটলান্টিকের বুকে। খুব অমানবিক আর যন্ত্রণার যাত্রা তাদের। মেক্সিকোতে পৌঁছে তাদেরকে আজীবনের তরে বেচে দেয় দাস ব্যবসায়ীরা। বন্দীদের অর্ধেক নিহত হয় যাত্রাপথে দুইটা ইংরেজ দস্যু জাহাজের আক্রমণে। পর্তুগিজ দাস ব্যবসায়ীরা অবশিষ্ট আফ্রিকানদেরকে জেমস টাউন বন্দরের কাছে পয়েন্ট কমফোর্টে নিয়ে যায়। জেমসটাউন হল ব্রিটেনের ভার্জিনিয়ার রাজধানী। ব্যবসার জন্য ১২ বছর আগেই লন্ডনে ‘ভার্জিনিয়া কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করে উপনিবেশিক শক্তি। ভার্জিনিয়াতে উপনিবেশ বিস্তারের অন্যতম হোতা জন রলফ ভার্জিনিয়া কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ইংল্যান্ডের আইনসভার সদস্য স্যার এডউইন স্যান্ডিকে ১৯১৯ সালের আগস্টে একটা চিঠিতে লেখেন, “একটা ডাচ যুদ্ধজাহাজ ভিড়ল উপনিবেশের বন্দরে এবং বন্দী আফ্রিকানদের কিনে নিলো।” ভার্জিনিয়ার প্রশাসক এবং ব্যবসায়ী পর্তুগিজদের কাছ থেকে এই আফ্রিকানদের কিনেছিল রান্না ও গৃহস্থালি কাজ করানোর জন্য। ক্রীতদাসদের বেশিরভাগকে এই অঞ্চলের নতুন অর্থকরী ফসল তামাক চাষে নিয়োগ করা হয়েছিল।

জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত করা খুব সাধারণ দৃশ্য। আফ্রিকা এবং ইউরোপের ব্যবসায়ীরা ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে শত শত বছর ধরে পণ্য ও মানুষের কেনাবেচা করে আসছে। প্রথমদিকে দাস ব্যবস্থা গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি, বরং বর্ণের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে গায়ের ফর্সা রঙ ঠিক করে দিয়েছিল কারা দাস হবে। ইউরোপ আটলান্টিক অতিক্রম করে দাসব্যবসা শুরু করে ১৫শতকের শুরুর দিকে। ব্যবসায়ীরা দাসপ্রথাকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করে এবং তখন থেকেই কালো রঙের মানুষেরা বংশপরম্পরায় ক্রীতদাসে পরিণত হয়। ক্রীতদাসদেরকে কখনো মানুষ হিসেবে বিবেচিত করা হয়নি। পণ্যের মত ক্রীতদাস বেচাকেনা করা যায় এবং ইচ্ছেমত গাধার খাটনি খাটানো যায়। যদিও আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ নিজ ভূমিতে স্বাধীন ছিল কিন্তু তাদেরকে জোর করে ধরে এনে ১৫শতক থেকে উত্তর আমেরিকায় বেচে দেয় ইউরোপের বণিক ও নাবিক শ্রেণি। আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় প্রথম যে ক্রীতদাসের চালান আসে তাদেরকে “20 and odd” হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং তারাই আমেরিকার প্রথম ক্রীতদাস ব্যবস্থার শিকার।

এই লেখার শুরুতেই একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে নিউ অর্লিয়েন্সের সেইন্ট লুইস হোটেলের নোটিশ বোর্ডে ১৮৫৮ সালে ২৫ মার্চ দাস বিক্রির বিজ্ঞাপন এবং নিলাম কর্মসূচি। বিজ্ঞাপনে ১৮ জন কৃষ্ণাঙ্গ বিক্রির অপেক্ষায়, সেখানে একই পরিবারের ছয় সদস্য আছে যাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ জনের বয়স মাত্র এক বছর। নিলাম বিজ্ঞপ্তিটি The Smithsonian’s National Museum of African American History and Culture এখন প্রদর্শনীর অংশ। জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত আছেন মেরি ইলিয়ট যিনি নিজেও দাস ছিলেন এবং এই প্রবন্ধের সহলেখক। মেরি ইলিয়ট জাদুঘরের প্রদর্শিত তালিকা দেখে দেখে আমেরিকায় আফ্রিকান দাসপ্রথা বর্ণনা করে গেছেন।

১৫ শতকে রোমান ক্যাথলিক চার্চ পুরো পৃথিবীকে দুইটা ভাগে ভাগ করে ফেলে। নতুন স্থাপিত উপনিবেশের জমিকে কৃষিকাজের উপযুক্ত করা এবং সোনা আহরণের জন্য প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন পড়ে। তাই রোমান ক্যাথলিক চার্চ পর্তুগালকে একচ্ছত্র অনুমতি দেয় যেন তারা পশ্চিম আফ্রিকা এবং স্পেনে দাসব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। পোপ পঞ্চম নিকোলাস পর্তুগিজ অভিযানের প্রশংসা করেন এবং ১৪৫৫ সালে পর্তুগালের জন্য প্যাপাল স্টেটমেন্ট ‘Romanus Pontifex (পর্তুগালের রাজা আলফানসোর কাছে পোপের লেখা চিঠি)’ ইস্যু করেন যার ফলে পর্তুগালকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয় যে, পর্তুগাল পশ্চিম আফ্রিকার যতদূর খুশি ভূমির মালিকানা দাবি করতে পারবে এবং এই অঞ্চলে একমাত্র তারাই ব্যবসা করতে পারবে। রোমান ক্যাথলিক চার্চ পর্তুগালকে আফ্রিকাতে আক্রমণ, লুটতরাজ এবং চিরস্থায়ী দাস প্রথার মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলার অনুমতি দেয়। রাণী ইসাবেলা তার রাজ্যের ধনসম্পত্তি বৃদ্ধির জন্য ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সমুদ্র অভিযানে অর্থকড়ি বিনিয়োগ করলেন এবং সেই সাথে স্থানীয় আমেরিকানদের দাসবৃত্তি নাকচ করে দিলেন। কারণ হিসেবে জানালেন স্থানীয় আমেরিকানদের ভাগ্যে কী আছে সেটা স্প্যানিশদের বিবেচ্য বিষয়, ওখানে আমাদের হস্তক্ষেপের দরকার নেই। স্পেন ক্যাথলিক চার্চ এবং পর্তুগালের সাথে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, ফলে স্পেন সরাসরি আফ্রিকা থেকে বন্দী মানুষদেরকে আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশে পণ্য হিসেবে পরিবহন ও বেচা-বিক্রির অধিকার পায়। এর মধ্যেই ইউরোপের অন্যান্য জাতিরাষ্ট্র যেমন নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক এবং ইংল্যান্ড অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরির জন্য দাস ব্যবসায়ে যোগ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পশ্চিম আফ্রিকার যেসব অঞ্চলের নেতারা আত্মনির্ভরশীল টেকসই সমাজের অধিপতি, যাদের খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ, যাদের স্বর্ণ এবং মূল্যবান বাণিজ্যিক পণ্য আছে তাদের সাথে ইউরোপের দেশগুলো পণ্য ও দাস আদানপ্রদান করে সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। তারাও স্পেনের মত চুক্তি করে ব্যবসার অধিকার চায় এবং নতুন নতুন উপনিবেশ স্থাপন করতে চায়। ইউরোপিয়ানদের মিলিত প্রচেষ্টার ফলে দাসব্যবসা এবং দাসত্ব নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়। ইউরোপিয়ান জাতিরাষ্ট্রগুলোর অনুমোদন ও পৃষ্ঠপোষকতায় শুধু গায়ের রঙের কারণে ঘটে যায় সারাবিশ্বের জোরজবরদস্তির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কালো মানুষের দেশান্তর। তারা প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ আফ্রিকান নারী,পুরুষ,শিশুকে আটলান্টিক পার করে আমেরিকার দাস বাজারে বেচে দেয়। কালোদের শরীর এবং তাদের শ্রমের দেয়ার যন্ত্রপাতি উত্তর আমেরিকার উপনিবেশে নিয়ে আসা হয়। উপনিবেশে গায়ের রঙের ভিত্তিতে শুরু হয় সামাজিক মর্যাদা ও শ্রেণি। দাসব্যবসার প্রসার এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যই স্থানীয় সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করা হয়।

ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারি, লন্ডন। রাণী আনা এনজিঙ্গা

১৬২৪ সালে আনা এনজিঙ্গা তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর এনডোঙ্গো রাজ্য শাসনের অধিকার পায়। এনডোঙ্গোর বর্তমান নাম অ্যাঙ্গোলা। সেই সময়ে পর্তুগিজরা এনডোঙ্গো এবং আশেপাশের অঞ্চল দখলের চেষ্টা করে যাতে বেশি পরিমাণ কালো মানুষকে বন্দী করে দাস-বাজারে বেচা যায়। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দুইবছরের মাথায় আনা এনজিঙ্গা পর্তুগীজ আক্রমণে রাজ্য ছাড়া হয়ে পড়েন। কিন্তু তবুও তিনি মাতাম্বা নামে পাশের একটি রাজ্য জয় করতে সক্ষম হন। আনা এনজিঙ্গা দীর্ঘদিন অ্যাঙ্গোলাতে পর্তুগিজ বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছেন কালো মানুষদের মুক্ত করতে, চেষ্টা করেছিলেন পর্তুগিজদের হাতে বন্দী কালোদের মুক্তির জন্য আশ্রয় এবং উপায় বের করতে। সময়ও বুঝি বৈরি, কালো মানুষদের মুক্তির দিশারী আনা এনজিঙ্গা মারা যান ১৬৬৩ সালে। মরার আগ পর্যন্ত তিনি প্রভাবের সাথেই পর্তুগিজ বাহিনীর সাথে শান্তি সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন এবং মাতাম্বার সাথে পর্তুগিজ বাহিনীর সমঅধিকারের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই মহান বিদ্রোহী স্বাধীনতাকামী আনা এনজিঙ্গা’র প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ২০০২ সালে অ্যাঙ্গোলার রাজধানী লুয়ান্ডাতে তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যে এই মহান নারী প্রতিরোধ এবং সাহসের নিদর্শন বহন করে দাঁড়িয়ে আছেন।

ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল:

সিজার নামের একজন ক্রীতদাস আর্তনাদ করে বলেন, “আফ্রিকা থেকে বন্দী অবস্থায় জাহাজে চড়ে আমেরিকায় আসার সময় আমাদের হাতে জোর করে পরিয়ে দিতো ও হাতকড়া। লোহার শলাকা আমাদের শরীর ভেদ করে হৃদয় দিয়ে আত্মায় ঢুকে যায়”। হাতে পায়ে ডাণ্ডা-বেড়ির লোহা আফ্রিকার রোদে পোড়া কালো চামড়া কেটে মাংসে ঢুকে যেতো আর সমুদ্রপথের দীর্ঘ সময়ে লোহার ঘষায় ঘষায় চামড়ায় কড়া পড়ে যেতো, বন্দীদের প্রায় ২৬ শতাংশ শিশু কিশোর, কারণ নিরাপত্তার খাতিরে সরকার আইন পাশ করেছে দাস পরিবহনের একটা জাহাজ কত টন ওজনের মানুষ পরিবহন করতে পারবে। ফলে কম ওজনে বেশি মানুষ নেয়ার জন্য দাস ব্যবসায়ীদের কাছে শিশুদের বেশি চাহিদা। তাদের জন্য জাহাজে জায়গাও কম লাগে, ফলে জাহাজের কম জায়গায় বেশি মানুষ পরিবহন সম্ভব। বন্দী আফ্রিকানে ভর্তি তিল ঠাই আর নাহিরে জাহাজ চলতে শুরু করলো, তারা কেউ জানতেও পারল না কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কবে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি মিলবে সেটাও কেউ জানে না। পর্তুগাল ও স্পেনের ব্যবসায়ীরা আফ্রিকা থেকে মানুষদেরকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে উত্তর আমেরিকায় দেশান্তরের ত্রিভুজাকৃতির সামুদ্রিক পথকে “মিডল প্যাসেজ” বলে। লেখক ওলাউদা ইকুইনো তার ক্রীতদাসের জীবন-স্মৃতিতে লিখেছেন, “আমাকে ধাক্কা মেরে জাহাজের পাটাতনের নিচে ফেলে দিলো, সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল নারকীয় পরিবেশ। এত দুর্গন্ধ যে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না, আমি জীবনে এমন পরিস্থিতির শিকার হইনি। মল-মূত্র, মানুষের গাদাগাদি ভিড়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি এত অসুস্থ হয়ে গেলাম যে, কিছু খেতেও পারলাম না, কোন কিছু মুখে নেয়ার ইচ্ছে পর্যন্ত হলো না। এখন আমার একমাত্র প্রার্থনা, হে মৃত্যু, আসো আমার শেষ বন্ধু, মুক্ত করো আমাকে”।

অতিরিক্ত গরম, পিপাসা, ক্ষুধা এবং সংঘর্ষ দাস জাহাজের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।” প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ মরে যেতো জাহাজ বন্দরে নোঙর করার আগেই। আত্মহত্যার প্রবণতা এত বেশি ছিল যে ‘মনুষ্য-পণ্য’ মরে গেলে লাভ কমে যাবে তাই জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজের চারপাশে শক্ত দড়ির জাল দিয়ে ঘিরে রাখতো। কালো মানুষদের উপর অত্যাচার দেখে আত্মগ্লানিতে ভুগে অনেক সময় ইউরোপিয়ানরাও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতো বা নৃশংসতা এড়াতে বন্দর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতো। বন্দী আফ্রিকানরা ভিতু পরাজিতের ন্যায় তাদের ভাগ্য মেনে নেয়নি। হয়ত দশটার মধ্যে একটা জাহাজে বিদ্রোহ দেখা দিতো, ব্যক্তিগত বাধা তো ছিলই। অনেকেই অনশন করতো কেউবা জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ে যেতে চাইতো। কখনোবা পরিণতি ছিল ভয়াবহ দাঙ্গা, তখন একসাথে মারা যেত সবাই।


সেন্ট লুই আর্ট মিউজিয়াম

বিত্ত-বৈভব আর ক্ষমতার চাষাবাদ:

দাসব্যবসা একসময়ে ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি, নতুন উপনিবেশের অর্থনীতিতে, ব্যক্তি-পর্যায়ে এমনকি চার্চকেও দিয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা এবং অঢেল সম্পত্তি। ১৭৫২ থেকে ১৭৫৮ সালের মধ্যে জন গ্রীনউডের আঁকা তৈলচিত্র “সুরিনামে সমুদ্র নাবিকদের পানোৎসব” চিত্রকর্মটিতে জন গ্রীনউড নেদারল্যান্ডের উপনিবেশ সুরিনামের একটা সরাইখানায় রোড আইল্যান্ডের একদল নাবিকের সাথে ব্যবসায়ীদের মদ্যপানের দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে। সরাইখানাগুলো ছিল দাস কেনাবেচার প্রাণকেন্দ্র। এই চিত্রকর্মে দাস ব্যবসায়ের সাথে জড়িত সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির সম্পর্ক দেখানো হয়। ইউরোপের এই ব্যবসায়ী নাবিকদল আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে এনে হাতেপায়ে শিকল পরিয়ে দাস হিসেবে উত্তর আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এবং দক্ষিণ আমেরিকা বেচে দেয়। দাসদের পারিশ্রমিক-বিহীন শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের উদ্বৃত্ত-মূল্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হতো অভিজাত শ্রেণির রাজনৈতিক অবস্থান এবং নির্ধারিত হতো জাতির ভবিষ্যৎ। চিত্রকর্মটিতে অঙ্কিত মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যৎ শাসক নিকোলাস কুক, জোসেফ ওয়ানটন, ইজেক হপকিন্স; যিনি ভবিষ্যতে আমেরিকা অঞ্চলের নৌবাহিনীর প্রধান হবেন এবং স্টিফেন হপকিন্স যিনি হবেন আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

এই দেশে জন্ম নেয়া শিশু বন্ধন মুক্ত না যুক্ত হবে তা নির্ভর করবে মায়ের সামাজিক অবস্থার উপর। — ১৬৬২ সালে কার্যকর ভার্জিনিয়ার আইন।

জাতি ও বর্ণের আইনে রূপান্তর:

১৬৬২ সালে ভার্জিনিয়াতে একটা আইন পাশ করা হয় যেখানে দাস শ্রমের বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে। দাসব্যবসা যেন বাধাবিপত্তি ছাড়া চলতে এবং প্রসার লাভ করতে পারে সেজন্য আইনি সিদ্ধান্ত হলো শিশুর মায়ের সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করবে সন্তানের ভবিষ্যৎ। এই আইনের উদ্দেশ্য এবং অর্থ হলো ক্রীতদাস নারী জন্ম দেবে পরবর্তী প্রজন্মের আফ্রিকান ক্রীতদাস। জন্মসূত্রে ক্রীতদাস সন্তানটি আসলে একটা পণ্য। উপনিবেশের মালিক শ্রেণি এইসব দাসদের সন্তান উৎপাদনে সানন্দে অনুমতি দিয়েছে কারণ এতে নতুন দাসের জন্ম হবে, এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দাস বংশের সূচনা। ১৬৬২ সালের ক্রীতদাস আইনে ঘোষণা দেয়া হয় যে, মায়ের সামাজিক মর্যাদার উপর ভিত্তি করে সন্তানের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হবে। আইন নিশ্চিত করে যে ইউরোপীয় উপনিবেশিক গোষ্ঠী এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এমনকি মুক্ত কালো বর্ণের মানুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় যেন তাদের সন্তানরা। একই সাথে আইনে পরিণত হয় জাতি ও শ্রেণিবিভাগ এবং শ্রেষ্ঠত্ব। ১৬৪০ সালে একবার জন পাঞ্চ নামের একজন কালো ক্রীতদাস আরও দুইজন শ্বেতাঙ্গ শিক্ষানবিশ শ্রমিক নিয়ে মালিকের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যায়। যখন তারা ধরা পড়ে তখন দুইজন শ্বেতাঙ্গকে আরও কয়েক বছরের শ্রমে নিযুক্ত করে এবং একই অপরাধে জন পাঞ্চের শাস্তি হয় আজীবন দাসত্ব। ভার্জিনিয়ার গভর্নর উইলিয়াম বার্কলে’র অপশাসনের বিরুদ্ধে ১৬৭৬ সালে নাথানিয়েল বেকনের নেতৃত্বে বিদ্রোহের দাবানলে জ্বলে ওঠে। নির্যাতনকারী সরকারের বিরুদ্ধে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে ক্রীতদাস কৃষ্ণাঙ্গরাও যোগ দেয়, বিদ্রোহে সামিল হয় দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী। গায়ের রঙ এবং সামাজিক শ্রেণি বিভাজন কঠোর আইনে পরিণত হয়ে গেলে শ্বেতাঙ্গ সামন্ত কৃষকও সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। গভর্নর বার্কলে কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। বিচারে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনের তরে ক্রীতদাস ঘোষণা করা হয় কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ সাধারণ ক্ষমা।

এরিকা ডীম্যান’র নিউইয়র্ক টাইমসে প্রতিবেদনে প্রকাশিত “Smithsonian’s National Museum of African American History and Culture” জাদুঘরের ছবি। মৃত্যুর মত ভয়ানক পণ্য ১৯ শতকের লোহা ও কাঠ নির্মিত আখ কাটার দা

তুলা-চাষ নির্ভর আমেরিকার অর্থনীতির আগে আখ-চাষ ক্যারিবিয়ান এবং স্প্যানিশ দাসব্যবসা এখানে আমেরিকায় টেনে নিয়ে আসে। আখ হলো এমন এক নির্দয় ফসল যার সপ্তাহের ছয় দিনই সার্বক্ষণিক তদারকির প্রয়োজন হয়। সারাদিন ক্লান্তিহীন কাজ করেও নিস্তার নেই, আখ চাষে জড়িত দুর্বল চাষিদের নির্মমভাবে পুড়িয়ে বা অঙ্গহানি করে হত্যা করা হয়েছিল। আখ চাষি ক্রীতদাসদের জীবনের আয়ু ছিল গড়ে সাত বছর। বিবেকের তাড়নাহীন আখের খামার মালিকরা ক্রীতদাসদেরকে আখ খেতে উদয়াস্ত কাজ করতে বাধ্য করত। সারাদিন অনাহারে অর্ধাহারে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলে মরে যেত অনেকেই তখন মৃত দাসদের স্থানে নিয়মিত দরকার পড়ত নতুন শ্রমিক। ব্রিটিশ কবি ইউলিয়াম কাউপার আখ খামার মালিকদের এমন অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে শ্লেষাত্মক কবিতা লেখেন, “I pity them greatly, but I must be mum, for how could we do without sugar or rum?” মানুষের জীবনের থেকেও কফি এবং চা মিষ্টি করার জন্য চিনির প্রয়োজন বেশি। সেজন্যই আফ্রিকা থেকে ধরে আনা কালো মানুষদের আমেরিকায় বাধ্যশ্রমে নিয়োগ করত, কাজ করাতো আমৃত্যু। মানুষের রক্ত ঘাম মিশে আছে আখ চাষে তাই হয়ত চিনি এত মিষ্টি।

নিয়মিত প্রতিরোধ:

ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে আমেরিকা আসার আগ পর্যন্ত আফ্রিকানদেরও স্বাধীনতা ছিল। সেই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য তারা নিয়মিত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, যুদ্ধ চালিয়ে গেছে যখন তাদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তারা আখ চাষের সময় খামার মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, শহরেও প্রতিবাদ করছে তাদের দাসত্বের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ ক্যারোলিনার উপনিবেশে ১৭৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জেমি নামের একজন ক্রীতদাসের নেতৃত্বে একদল আফ্রিকান ক্রীতদাস চার্লস্টনের বাইরে জড়ো হতে থাকে, সেখানে তারা অস্ত্র গোলাবারুদের দোকানে হামলা চালিয়ে দুইজন কর্মী হত্যা করে এবং অস্ত্রের দোকানটি লুণ্ঠন করে। ব্রিটিশ জাতীয় সংসদ সদস্য এবং জর্জিয়া উপনিবেশ স্থাপনকারী জেনারেল জেমস ওগেলথর্প লিখেছে, “মুক্তি চাই” শ্লোগান দিয়ে বিদ্রোহীরা হাতে রঙিন পোস্টার নিয়ে তারা মিছিল করে রাস্তায় নামে। স্টোনো নদীর তীর ঘেঁষে দুইটা ঢোলের তালে চলতে থাকে মিছিল, মিছিলে যোগ দেয় পিঁপড়ের মত দাস মানুষের সারি। তার লক্ষ্য স্প্যানিশ ফ্লোরিডা যেখানে তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল ব্রিটিশ সামরিক প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করবে। সংঘবদ্ধ এই আন্দোলনের নাম “স্টোনো বিদ্রোহ” আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশে দাসদের এটাই সবচেয়ে বড় আন্দোলন। আন্দোলনে অংশ নেয় ৬০ থেকে ১০০ জন কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্রোহী। বিদ্রোহে ৪০ জন কৃষ্ণাঙ্গ এবং ২০জন শ্বেতাঙ্গ নিহত হয় কিন্তু অন্য মুক্তিযোদ্ধারা ধরা পড়ে এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে বিচারের আওয়তায় আনা হয়। কোনমতে বিদ্রোহ দমন করা গেলেও দক্ষিণ ক্যারোলিনার শ্বেতাঙ্গ আইনপ্রণেতারা ভয় পেয়ে যান, ভবিষ্যতে আরও বিদ্রোহের আশংকা করেন। তারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ১০ বছরের জন্য আফ্রিকা থেকে দাস আমদানি নিষিদ্ধ করে এবং ১৭৪০ সালে নিগ্রো আইন পাশ করে নিগ্রোদের একত্রিত হওয়া, বিদ্যার্জন করা এবং বিদেশগমন আইনত দণ্ডনীয় ঘোষণা দেয়। আমেরিকার ২৪৬ বছরের দাস ব্যবসার ইতিহাসে সংঘটিত অনেক আন্দোলন বিদ্রোহের মধ্যে স্টোনো বিদ্রোহ অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ।

আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদেরকে বন্দী করে আমেরিকায় ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দিয়েছিল ইউরোপিয়ানরা। আফ্রিকাতে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিসত্ত্বা ছিল। তাদেরকে অস্ত্রের মুখে বন্দী করে যখন আমেরিকায় পাচার করা হয় তখন তারা ছিল রিক্তহস্ত। কিন্তু সাথে করে নিয়ে এসেছিল সব মানবিক গুণাবলী, তাদের মনের মানুষের স্মৃতি, তাদের গোত্র, সামাজিক রীতিনীতি, নৈতিক মূল্যবোধ, তাদের সাথে ছিল গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তর্দৃষ্টি, শৈল্পিক মেধা, ছিল বংশপরম্পরায় সাংস্কৃতিক প্রথা ও চর্চা, স্বতন্ত্র ধর্ম বিশ্বাস এবং হস্তশিল্পে দারুণ দক্ষতা। পরিবর্তিত নতুন বৈরি পরিস্থিতিতে তারা পুরনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। ক্যারোলিনা এবং জর্জিয়ার নিম্ন সমতল ভূমির খামারিরা ইউরোপের দাস ব্যবসায়ীদের কাছে অনুরোধ করত সেনেগাল বা লাইবেরিয়া থেকে ধান চাষে অভিজ্ঞ কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে আনার জন্য। ফলে অতি দ্রুত চার্লস্টন বন্দর হয়ে গেল পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাস কেনাবেচার ব্যস্ত বাজার। ধান থেকে খোসা ছাড়ানোর জন্য বিশেষ শৈল্পিক প্রযুক্তির প্যাঁচানো বোনা বেত বা বাঁশের ঝুড়ির ব্যবহার আফ্রিকা থেকে উপনিবেশে আগমন এবং গোড়াপত্তন ঘটে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের হাত ধরে। ঝুড়ি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো এবং এই ঝুড়ির ছিল শিল্প মর্যাদাবোধের জায়গা, কারণ যাদের কিছু না থাকে তাদের জন্য আছে সাংস্কৃতিক চর্চা। সে কারণেই হয়ত আফ্রিকান দাস তাদের সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে তাদের জন্মভূমির স্মৃতি বহন করত মনের অতল গহীনে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (The New York Times) এ প্রকাশিত মূল প্রবন্ধ: এখানে