বর্তমান পৃথিবীতে দাসপ্রথা অবৈধ হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনো দাস প্রথা চালু আছে। কোথাও ভিন্ন চরিত্র, কোথাও ভিন্ন আঙ্গিকে, কোথাও অতীতের মতন একই পদ্ধতিতে। ‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স’এ দাসপ্রথার ওপর বিশদ অনুসন্ধান চালিয়েছে । তাদের মতে, বিশ্বে অন্তত সাড়ে চার কোটি (৪৫ মিলিয়ন) মানুষ দাসত্ব শৃঙ্খলের আবর্তে আবদ্ধ। এরা হলো দাস শ্রমিক, শিশু শ্রমিক, শিশু বিবাহের শিকার, বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োজিত কিছু কর্মচারী। যেমন; সুদান, হাইতি, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া, উজবেকিস্তান, ভারত এদের মধ্যে অন্যতম।বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ ভারতে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।

আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়াতে এখনো কয়েক লক্ষ মানুষ দাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জনসংখ্যার প্রায় ২০% মানুষ দাসের জীবন যাপন করছেন। যদিও মৌরিতানিয়া সরকার ১৯৮১ সালে দাস প্রথা অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত দাসপ্রথা ‘ক্রিমিনাল ল’এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না এবং কখনো প্রয়োগও করা হয়নি।

মৌরিতানিয়ার সরকার যদিও অস্বীকার করে যে তাদের দেশে কোন দাস প্রথা এখন আর নেই তবে বিষয়টি সত্য নয়। সেফ কাউসমেট হচ্ছেন একজন ফটো সাংবাদিক। যিনি এক মাস ধরে মৌরিতানিয়ার সাবেক ও বর্তমান দাসদের সাথে কথা বলেছেন, ছবি তুলেছেন ও তাদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছেন। আর এই কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। গ্রেফতারের পর তার কাছে থাকা ক্যামেরার মেমরি কার্ড, মোবাইল, ল্যাপটপ সব কিছু পুলিশ কেড়ে নেয়।

পৃথিবীর শেষ দেশ হিসেবে মৌরিতানিয়া ১৯৮১ সালে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। তা সত্ত্বেও, হাজার হাজার মানুষ বিশেষ করে সংখ্যালঘু হারাতাইন বা আফ্রো-মরিটানীয় গোষ্ঠী এখনো গৃহ-ভৃত্য, দাস শ্রমিক কিংবা শিশু বিবাহের সম্মুখীন হচ্ছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে; ২০% এর উপর এখন দাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর হারাতাইনদের দুই জনের একজন এখনো বিভিন্ন খামারে, বাসাবাড়িতে কোন রকম স্বাধীনতা, শিক্ষা ও বেতন ছাড়া কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।

মৌরিতানিয়ার দাস বিরোধী সবচেয়ে বড় সংগঠন Initiative for the Resurgence of the Abolitionist Movement (IRA) এর নেতা বিরাম ওলদ আবেদ যিনি একজন সংখ্যালঘু হারাতাইন, তিনি জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বেও তিনি কারাবন্দী হোন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি (২০০৮ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এবং নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্যে সিনেট ভেঙ্গে দেন) মোহাম্মদ ওলদ আব্দেল আজিজ এর অপসারণের আওয়াজ তোলেন।

উপরের ছবিতে ফাতিমাতো ও তার মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। রাজধানী নোয়াচোট (Nouakchott) থেকে ২৫০ কি.মি দূরে একটা পরিবারে তারা দাস হিসেবে কাজ করতো। পরিবারের সদস্যরা তাকে কাজের বেটি ফাতিমা বলে সম্বোধন করতো। ফাতিমা খামারের দেখা শোনা, মনিবদের খাবার তৈরি করা, কূপ থেকে পানি তোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজ করতো। ফাতিমা বলছে; যত্নের অভাবে সে তার দুটি শিশু সন্তানকে হারিয়েছিল। কারণ ফাতিমার কোন অবসর ছিল না, এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও ফাতিমাকে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। ১৯৯০ সালের দিকে SOS সংস্থার মাধ্যমে ফাতিমা ও তার সন্তানরা দাস জীবন থেকে মুক্তি লাভ করে। বর্তমানে সে ও তার পরিবার রাজধানীতে শ্রমজীবী মানুষের সমাজে স্বাধীনভাবে বসবাস করছে।

উপরের ছবিতে হাবি ও তার ভাই বিলালকে দেখা যাচ্ছে। বিলাল ও হাবি একসময় দাসের জীবন পার করেছে। বর্তমানে তারা দুইভাই রাজধানী নোয়াচোটের বাহিরে একটি গ্যারেজে কাজ করছে। মালিকের মারধরের কারণে বিলাল ঐ পরিবার থেকে পালিয়ে যায়। তার বোনও একটি পরিবারে দাস হিসেবে ছিল। পরবর্তীতে অনেক প্রচেষ্টার পর সে তার বোনকেও দাস জীবন থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। তার বোন অনেকবার মালিকের হাতে যৌন নিপীড়নেরও শিকার হয়। অবশেষে এসওএস (SOS) এর প্রচেষ্টায় ২০০৮ সালে দাসের জীবন থেকে তার বোনের মুক্তি মেলে।বর্তমানে সে একটি টায়ার মেরামত করার গ্যারেজ খুলেছে।

উত্তর আফ্রিকার আরব আগরেব এবং কালো বর্ণের সাব-সাহারা আফ্রিকাদের মধ্যবর্তী জায়গায় মৌরিতানিয়ার অবস্থান। ক্ষমতাসীন আরব বার্বার গোষ্ঠী সরকারের উচ্চপদে আছে অন্যদিকে কালো চামড়ার হারাতাইন ও আফ্রো মাউরিটানিয়ানরা সমাজের নিচু স্তরের কাজগুলো করছে এবং যেন নিচু কাজের জন্য তাদের অগ্রাধিকার, তারা সমাজে শিক্ষা থেকে শুরু করে সম্মানজনক জীবিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে।

হারাতাইন সম্প্রদায় অনেক কাজই করে যেগুলো আরব বার্বার সম্প্রদায় খুব নোংরা কাজ হিসেবে গণ্য করে। যেমন; স্থানীয় বাজারে কাজ করা। দাস বিরোধী সংস্থা এসওএস নিরক্ষর ও গরীব মহিলাদের জন্যে অনেক কর্মশালার আয়োজন করে। যেমন; হাতের কাজ ও সেলাইয়ের মতো কাজগুলো মহিলাদের তাদের শেখানো হয়। যেন তারা এগুলো শিখে পরবর্তী মুক্ত-জীবনে অর্থোপার্জন করতে পারে।

মাব্রুকা, বয়স ২০ বছর। সে যখন শিশু ছিল তখন তার মায়ের কাছে থেকে দাস হিসেবে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রোসো শহরে সে একটি পরিবারে দাস হিসেবে ছিল। ১১ বছর বয়স থেকে সে তার মনিবদের জন্যে রান্না করা শুরু করে এবং রান্না করতে গিয়ে তার বাম হাত পুড়িয়ে ফেলে। এখন সে সেই ব্যথায় ভুগছে। যখন তার বয়স ১৪, ২০১১ সালে মাব্রোকা দাসের জীবন তেকে মুক্ত হয়। স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য তার কখনো হয়নি। ১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। মাব্রুকা এখন চার বছরের কন্যা মরিয়ম ও দুই মাস বয়সী খালিদের মা।

এই নারী তারহিল আবাসিক এলাকার বাইরে একটি বস্তিতে থাকে। রাস্তা নির্মাণ করার জন্যে সরকার একবার তাদের বস্তি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। দুই সন্তান নিয়ে সে পথচারীদের কাছে বিস্কুট বিক্রি করে। তার স্বামী শহরে একটা ছোটখাট কাজ করে। সে বলছে, আমাদের যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে শহরে একটা ঘর ভাড়া নিতাম। কারণ এখানে আমাদের জন্যে কোন পানিরও ব্যবস্থা নেই। আলাদা করে পানি কিনতে হচ্ছে।

হারাতাইনরা নির্দিষ্ট কিছু পেশায় কাজ করে। এসব কাজে তাদেরকেই মনোনীত করা হয়। যেমন; কসাইয়ের কাজ, আবর্জনা সংগ্রহ করা, মেথরের কাজ ইত্যাদি। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুরুষরা মাংস বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডানপাশের ছেলেটির নাম ইউনেফ, বয়স ১৮। সে হাইস্কুলে তৃতীয় বর্ষে পড়ার পাশাপাশি পরিবারকে সাহায্য করার জন্যে রাস্তা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করছে।

মুক্তার আরব-বারবার (Arab-Berber) পরিবারের অধীনে থাকা এক দাস পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে। তার মা ও ভাইয়ের সাথে তাকেও কাজ করতে বাধ্য করা হতো। ২০১২ সালে সে ঐ পারিবার থেকে পালাতে সক্ষম হয় এবং দাস বিরোধী এক কর্মীর সাথে তার পরিচয় হয়। পালিয়ে আসার সময় মুক্তার সঙ্গে করে তার ভাই ও মা’কেও আনতে চেয়েছিল কিন্তু তারা আসতে চায়নি। এমনকি তার মা তার পালিয়ে যাওয়ার চিন্তাকে তিরস্কার করেছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আমার মা আমাকে বার বার বলতো যে; আমাদের মনিবদের সবসময় সম্মান করবে কারণ তারা আমাদের থেকে উচ্চবর্ণের গুরু মানুষ। ১৩ বছর বয়সে সে স্কুল যাওয়া শুরু করে। সে স্বপ্ন দেখে একদিন সে একজন আইনজীবী হবে এবং হারাতাইন গোষ্ঠীর অধিকারের জন্যে কাজ করবে।

মরিয়ম (নীল পোশাক) পূর্ব দাসদের গ্রাম জনাবেহ’তে বাস করে। ২০১৪ সালে মনিব মারা যাওয়ার পর তাদের সন্তানরা তাদের বাড়িতে থাকা দাস নারী ও শিশুদের মুক্ত করে দেন। এরপর সন্তান, নাতি-নাতনিদের নিয়ে পালিয়ে এসে এখানে বসবাস শুরু করে। তবে এখনও জীবন যাপনের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্য তাদের নেই।

 

সালমা (ডানে) ৫০ বছর এক সাদা মোরিস পরিবারের দাস হিসেবে ছিল। তার সন্তানরাও দাস হিসেবে গণ্য হতো।

২০১৩ সালে সালমা ও তার কন্যা ইমা তার পুত্র বিলাল ও সালেকের মাধ্যমে পালাতে সক্ষম হয়। যদিও ইমা দুইবার তার মনিবের পরিবারে ফিরে গিয়েছিল। বর্তমানে সে বিবাহিত ও দুই সন্তানের জননী। সালমা, ইমা ও তার দুই সন্তান দার নাইম শহরের এক বস্তিতে বসবাস করছে।

আইচেটো মিন্ট এমবারাক তার বোনের মতন রোসা অঞ্চলের বংশ পরম্পরায় দাস ছিলেন। ছোট বয়সে তার মায়ের কাছ থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়। মবিনের অধীনে থাকা অবস্থায় তার বিয়ে হয় এবং ৮ সন্তানের জন্ম দেন। আট সন্তানের মধ্যে দুই সন্তানকে অন্য পরিবারে দাস হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে IRA আন্দোলনের সময় তার বড় বোন দাস জীবন থেকে মুক্তি লাভ করে। আইচেটো মনিব পরিবার থেকে পালিয়ে গিয়েছিল আর এই কারণে ঐ পরিবারের কর্তা হত্যার উদ্দেশ্যে তার সন্তানদের উপর জ্বলন্ত কয়লা ঢেলে দেয়। বর্তমানে আইচেটো তার আট সন্তানকে নিয়ে এক সাথে বসবাস করছে।

জবাদার বয়স এখন ৭০ এর উপর। সেও তার মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিল। একটি তাবুতে তার দুই হাত বেঁধে রাখা রেখেছিল। তার একটি আঙুল পুরোপুরি কেটে ফেলা হয় আরেকটি মারাত্মকভাবে জখম হয়। এখন সে তার হাত স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারেন না। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত সে আরেকটি পরিবারে সে দাস হিসেবে ছিল। ঐ পরিবার তার হাতের জখম সারাতে সাহায্য করে। বর্তমানে সে তার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সাথে নোয়াকচোটে এক গরীব এলাকায় বসবাস করছে।

মূল প্রবন্ধ: The unspeakable truth about slavery in Mauritania