অনন্ত বিজয় দাশের হত্যার পর পাঁচটা বছর চলে গেল।

এই পাঁচ বছরে দেশ কিছুই বদলায় নি, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়সহ অন্যান্য নিহত লেখকদের হত্যাকারীদের সুষ্ঠুভাবে চিহ্নিত করে বিচারকার্য তো সমাধা হয়ইনি, বরং এই করোনা ভাইরাসের বিপর্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশে নির্লজ্জভাবে তথ্য নিরাপত্তা আইন আরো জোরদার করা হয়েছে যার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা, কার্টুনিস্টরা এবং গবেষকরা। শুধু বাংলাদেশেই নয় করোনাভাইরাসের কারণে আজকের বিশ্বব্যবস্থার দুর্বলতা, অন্যায় এবং হিপোক্রেসিগুলো নগ্নভাবে ফুটে উঠছে, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি অন্যায়, অবিচার, বৈষম্যের আরেক মহামারী।

প্রতিটা বড় মহামারীর পরে নাকি সমাজের বড় কোন পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগের প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ নাকি ইউরোপের ভূমিদাসদের অনুপ্রাণিত করেছিল জেগে উঠতে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং পুঁজিবাদ ত্বরান্বিত করতে। ১৯১৮-এর ফ্লুর মহামারিতে নাকি ৩-১০ কোটি মানুষ মরেছিল, তার মধ্যে আবার সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সে সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশে। এর পরে নাকি ইউরোপ জুড়ে সাধারণ মানুষের জন্য গণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। হয়তো এবারও বড় কোন পরিবর্তন হবে, কে জানে?

হয়তো কিছুই বদলাবে না, হয়তো সবকিছু এভাবেই চলতে থাকবে, সভ্যতা তো কখনোই লিনিয়ারভাবে আগায়না, কখনো দু’পা আগায় তো আবার এক পা পিছায় কিন্তু তারপরও অনন্তেরা জীবন দিয়ে হলেও প্রতিবাদ করে যায়। আর সেটাই সাহায্য করে আগানোর প্রক্রিয়াটাকে – কখনো পরোক্ষভাবে কখনো বা প্রত্যক্ষভাবে প্রবলভাবে।

অনন্ত একজন সিরিয়াস লেখক ছিলেন। চরমপন্থীদের নিষ্ঠুর চাপাতি তাঁর পূর্ণ বিকাশের আগেই তাঁকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেল। সারা পৃথিবীর এই দুঃসময়ের মধ্যে অনন্তের এভাবে অসময়ে চলে যাওয়াটা শুধু কষ্টই দেয় না, স্মৃতি যত ঘাঁটি মন ততই যেন মন এক অজানা শূন্যতায় ভরে ওঠে, নতুন করে লিখতে গেলে আঙুলগুলো স্থবির হয়ে আসে। দু’বছর আগে অনন্তকে নিয়ে লিখেছিলাম, এখানে সেই কথাগুলি আবার স্মরণ করছি।

অনন্তের সাথে আমার প্রথম পরিচয় কবে মনে নেই, ২০০৩, ২০০৪? তবে মনে আছে, ২০০৬ সালে যেবার দেশে গিয়েছিলাম তখন ও ঢাকায় এসেছিল আমার আর অভির সাথে দেখা করতে। ২০০৭ সালে আমার বিবর্তনের পথ ধরে বইটার ইনডেক্স বানিয়ে দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, “আর ধৈর্য নেই, ইনডেক্স ছাড়াই বই হোক”; ও জোর করেছিল, বলেছিল, “না দিদি তাহলে ভাল দেখাবে না, আমি ঢাকায় গিয়ে কয়েকদিন থেকে বানিয়ে দিচ্ছি।”

২০০৯ সালেও ঢাকায় দেখা করতে এসেছিল, কিছুতেই নেবে না, জোর করে ফিরতি পথের বাসের ভাড়াটা গুঁজে দিয়েছিলাম ওর পকেটে; বলেছিলাম, “তুমি ছাত্র মানুষ, দিদির কাছ থেকে নিতে কি অসুবিধা?” বারবার অনুরোধ করেছিল সিলেটে যেতে ওর সাথে, ও নাকি আমাদের নিতে এসেছে। এত কমসময়ে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি, অভিমান নিয়েই ফিরে গিয়েছিল সেবার।

শুনেছি আমাদের উপর আক্রমণের পরে হাসপাতালে এসে বসে ছিল আমার মায়ের পাশে দু’দিন। আমি দেশ ছাড়ার পর ইমেইল করে বলেছিল, আমি পড়ি না পড়ি, আমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ও আমাকে প্রতিদিন সকালে উঠে একটা করে ইমেইল করবে। এখনো ভেবে কষ্ট লাগে যে, তখনো বেশি কিছু করার মত ক্ষমতা ছিল না আমার শারীরিকভাবে। তবে বাবু হত্যার পর দেশ ছাড়তে বলেছিলাম ওকে অনেক করে, বলেছিলাম, “আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তবু তুমি যাও” । অনন্ত উত্তরে বলেছিল, “আমি চলে গেলে অসুস্থ বাবাকে দেখবে কে?” “তুমি মরে গেলে বাবাকে কে দেখবে সেটা ভেবেছ?”, জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি সেদিন।

তবে অনন্ত তার প্রতিজ্ঞা রেখেছিল – সেদিন সকালেও ওর কাছ থেকে একটা ইমেইল পেয়েছিলাম। ওকে সেদিন উত্তর দেওয়া হয়নি, তার আগেই ফোনে ওর মৃত্যুর খবর এসেছিল। মনে হয়েছিল আবার যেন নতুন করে সেই ২৬শে ফেব্রুয়ারির পুনরাবৃত্তি ঘটছে, আমার দেড় মাসের সেরে-ওঠা ধুলোয় মিলেমিশে যাচ্ছে এক নিমেষে! ইতিহাসের বিচারে ওরা ঠিক কি ভুল তাতে আসলে কিছুই এসে যায়না; কিন্তু যুগে যুগে অনন্তদের বারবার খুন হতে হয়। হয়তো এটা প্রমাণ করার জন্যই একদল মানুষ সবসময়েই প্রশ্ন করে, জানতে চেয়ে, ভুল করে, আবার বুঝে শুনে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করে সচেতন একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চায়।

প্রশ্ন, সংশয়, অবিশ্বাসের ভেতর দিয়েই আমরা আগাই, সভ্যতা বিকশিত হয়। অনন্তেরা সেই পথের অগ্রপথিক। আশা করি, ইতিহাস এভাবেই মনে রাখবে তাঁকে- অন্যদের মত।