লকডাউনের একেকটি সন্ধ্যারাতে ভূতের শহর ঢাকা মহানগরী। ছয় কিলোমিটার মাত্র পথ। অফিস গাড়ি বাদে নিত্য হেঁটে ডেরায় ফেরা। মুখোশে, ক্যাপে, হেভারশেকে ও ঝুলন্ত আইডিতে পদাতিক জবরজং।

অবশ্য এই রীতি বছর পঁচিশ বা তারও কিছু বেশী। রিপোর্টারের কর্মস্থল বদলে বদলায় দূরত্ব, দুই, পনের হয়ে এখন ছয়। সময়ে এখন উঁচু পদে পোর্টার, বাস্তবে নিউজক্লার্ক, নিতান্তই করে খাওয়ার চেষ্টা। মার্ক টালির স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সাপ্তাহিকীতে বলপয়েন্ট-নিউজপ্রিন্টে জীবন ক্ষয় করারকালেই।

আর এই সেদিন নাস্তিকব্লগার হ্যাশট্যাগে চাপাতিতন্ত্রের ব্লাসফেমাসে হন্টনে বিরতি। দেহরক্ষীতেও কী অষ্টপ্রহর সুরক্ষা নিশ্চিত? বা কোমরবন্ধের খাপে আত্মরক্ষা?

অকাতরে অভিজিৎ রায়দের গলা কাটার আস্কারায় হোলি আর্টিজান গদিতে ছেটায় সুলেখা কালি, কলংকের চেয়েও কালো। নিব্রাস গংদের অটোমেটিক আর ধারালো অস্ত্রের ঘায়ে উল্টে যায় পাশার দান।

একের পর বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, কাউন্টার টেরোরিজমের পারম্পরায় আবার পথ থেকে পথে।…

সমতলে এসব আসলে ছেলেখেলা, যুদ্ধদিনে দূর পাহাড়ে টানা ২২ কিমি লংঘনের রেকর্ড, একদমে ক্রেওক্রাডং গিরি অতিক্রম সাইডস্টোরি মাত্র।

করোনা ছোবলে অধিকাংশই সংবাদপত্র, নিউজ পোর্টালকর্মী স্বেচ্ছা গৃহবন্দিতে অনলাইন অফিসে গেছে অনেক আগে। ফুটেজ-ভয়েজের হ্যাপায় টেলিভিশন-এফএমের সে সুযোগ নাই। মাঝে খবরের লোকেরাই করোনা ঘায়েলে খবর হয়ে আসে। প্রথমে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি, তার যমুনা, এটিএননিউজ ও দীপ্ত। পরিস্থিতি বিপর্যয়ে পক্ষকাল বন্ধই হয়ে যায় দীপ্তনিউজ।

এ হেন বৈরি দশায় বদলে যায় কর্মঘণ্টা। ১০ ঘণ্টার ঘানিতে এখন সপ্তাহে দুদিন ডে অফ। এই কর্মকৌশলে অফিসে কিছুটা লোকসমাগম হ্রাস! ঘাটে ঘাটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, জীবানু নাশক স্প্রে, টিস্যু, ব্যতি ব্যাস্ত ক্লিনার, প্রতি কাঁচের দরজায় ‘কী করিতে হইবে’ নির্দেশনা। সঙ্গরোধের শর্তে পিক অ্যান্ড ড্রপের গাড়িতে একজন করে আরোহী।

সে সবই বাইলাইন, ব্লগর ব্লগর মাত্র। বিষয়ে ফিরলে আবার সেই কিম্ভুদ গা ছমছমে পাষাণপুরীর সন্ধ্যারাত।
সিরামিকের নকশাকাটা চেনা ফুটপাথের শুরুতেই সিদ্ধেশ্বরীতে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল। গেটে বিক্ষিপ্ত হাসাপাতালের লোকজন সুরক্ষা পোষাকে যেন নভোচারী। ব্যাটন, গলায় ঝোলানো বাঁশিতে দ্বাররক্ষী সনাক্ত হয়। প্রতি হাসপাতাল সংলগ্ন উপচে পড়া ডাস্টবিন যেন আবশ্যিক।

ঊনমানুষের দিনরাত্রি

গতি মন্থরে দেখে নেওয়া ল্যাম্পপোস্টের নীচে ট্রলি, রিকশা ভ্যানে নগর আবর্জনা সংগ্রহকারী নারী-পুরুষ কর্পোরেশন কর্মী। হাতাকাটা সবুজ জ্যাকেটে স্টেনসিল ছাপে পেশাগত পরিচয়। বেলচা আর আকশিতে পুঁতি-দুর্গন্ধময় উচ্ছিস্ট ঠেলে ঢোকানো বিশাল ডাস্টবিন কন্টেইনারে। সংলগ্ন ফুটপাথে পা ছড়িয়ে সিগারেট ফোঁকা হাড় সর্বস্ব নারী-পুরুষ। কারো সাথেদুধের শিশু, না হয় দুয়েকটি বোচকা। কয়েকজনের মুখে আনাড়ি মুখোশ। সংক্রামণ সুরক্ষা এইমাত্র, অধিকাংশের তাও নাই।

বলাই বাহুল্য, এসবে গার্হস্থ্য বর্জ্যের সার্থে হাসপাতাল বর্জ্যও মিশে আছে।

আরেকটু এগিয়ে মগবাজার ওয়ারলেস গেট লাগোয়া কমিউনিটি হাসপাতাল প্রবেশ পথ। আবশ্যিকভাবেই সেখানেও দু-তিনটি খোলা ডাস্টবিন কন্টেইনার। আর সেসব ঘিরে যেন একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। সবুজ জ্যাকেটের ভিতর চোয়ালভাঙা, কৃশকায় নারী-পুরুষও অনুরূপ।

মিডিয়াতে আসে সামান্যই করোনা যুদ্ধের এইসব সৈন্যদল কথা। আর বোধগম্য কারণেই মান্যবর সরকার বাহাদুর, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, নেতা, তস্য নেতা, টকশো ব্যক্তিত্ব বা মুখস্ত কলমচি – প্রত্যেকের দ্বারা উহারা হন উপেক্ষিত।

রাজস্বের কেন্দ্রের পরিযায়ী পোশাক শ্রমিকই যখন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বাইরে থেকে যান, তখন এইসব মেথর, ধাঙড়, চণ্ডাল, সুইপার (হালে ‘পরিচ্ছন্নকর্মী!’, কি দারুণ গালভরা নাম) কোন ছাড়?

সম্প্রতি গণপরিবহন বন্ধের ভেতরেও কারখানা খোলার খবরে হাজার হাজার গার্মন্টেস কর্মী গিজগিজে ভীড়ে (সামাজিক দূরত্ব?) শত শত মাইল পথ হেঁটেই পাড়ি দেন। মিডিয়ার খবরের একদিন পর চটজলদি কারখানা বন্ধ করে মালিক কোং হাত ধুয়ে ফেলেন, করোনা ফ্রি হন।

অন্যদিকে কর্তব্যজ্ঞানে পুলিশমন্ত্রীর লাঠিপেটায় ঢাকামুখি মহাসড়ক খালি হয় শিগগিরই।

ফিরতি যানের অভাবে ফের সেই একই পথ ভোগান্তি, গাদাগাদি নারী-পুরুষ শ্রমিক। উন্নয়নের মহাসড়কের কি দারুণ সমন্বয়!

‘মানুষের লাথি খেতে খেতে বড় হয়েছি
তবু এখনো এতে ঠিক অভ্যাস হলো না।
প্রতিটি লাথিকেই মনে হয় প্রথম লাথি
গলাধাক্কাগুলোও থাকে একইরকম নতুন।
এখনো অভ্যাস হলো না অহেতুক চড়ে
প্রতিবারই বুক কাঁপে, ভারসাম্য হারাই,
মাথাটা এদিক থেকে ওদিকে যায় সরে।
প্রতিবারই বুক কাঁপে, ভারসাম্য হারাই,
আমার মাথা মানুষের পায়ে পায়ে ঘোরে!’
(ইমতিয়াজ)

গাড়ি রেখে ইস্টিশান দৌড়চ্ছে

লাগোয়া রাজপথ ও ফ্লাইওভার ফাঁকা পড়ে থাকে অতিকায় মৃত এনাকোন্ডার মতো। মাঝে মাঝে সাঁই সাঁই করে ছুটে যায় অ্যাম্বুলেন্স। শুন্যগর্ভ শহরে সাইরেনের বালাই নাই। আরো কিছু এগুলো ফুটপাথের পাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কতিপয় ভিখিরি, ডান্ডিখোর নেশাড়ে, গলির মুখে মুখে দু-একটি রিকশা।

এছাড়া মোড়ে মোড়ে চেনা পুলিশ ভ্যান, লাঠি হাতে, হ্যান্ড মাইকে তৎপর। পাশেই সেনাগাড়িতে ক্লান্ত উর্দি পিকআপ। গাড়িতে ঝোলানো ব্যানার ‘ঘরে থাকুন’ ইত্যাদি।

আরো এগুলে ইস্কাটনের জাতীয় চার্চ পরিষদের গেটের সেই চেনা বয়েজকাট আধপাগল বুড়ির সাক্ষাৎ। দেখেই তোবড়ানো গালে হাসি, ‘আইজও দিবি? ১০ টেকা দিয়া যা বাজান। খায়া দোয়া করুম!’

বঙ্গবন্ধুর জলছাপের মূদ্রার বিনিময়ে প্রাপ্ত দোয়ায় ভাগ্য ফেরে নাকি? নাস্তিবাদের বাইরে শুভ কামনায় মায়া থাকে তো! এটি সব জ্ঞানের মহানজ্ঞান- কাণ্ডজ্ঞান। হোক পথের লোক, নোংরা, এলোমেলো মাথা ও পারিপার্শ্ব। স্বীয় জন্মদাত্রীও তো একই বয়সী, তারও তো স্মৃতিভ্রষ্ট অনেককাল—অ্যালঝেইমার্স। দুইজন সার্বক্ষণিক নার্স, সাবেক রেডিও অফিসের কেরানী, চিরদুঃখি মা জননী গো (গুগল করে দেখুন, আমার মা সিরাজী বিটি)!

সন্ধ্যারাতের এই টুকরো দৃশ্যের বিপরীতে, দিনের বেলা যেন চোর পুলিশ খেলা। লাকডাউনের ভেতরেই আড্ডাবাজী, দেদারছে ঘোরাঘুরি, বাতিল বৈশাখি মেলার ঘাটতিপূরণ যেন, কিসের সামাজিক দূরত্ব? ‘আমরা আসলে বাইরাইছি লকডাউন দেখতে!‘…

ওদিকে, একের পর এক খবর আসে ভুখা মিছিলের। টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে ত্রাণ, আর ত্রাণ। রথি-মহারথিরা কর্মক্ষম মানুষকে পরিস্থিতির সুযোগে ভিখিরির মতো লাইন করান, চালডালআলুর বস্তায় ফটো সেশনে চেহারা মোবারক দেখান, সেলফির পর সেলফিতে সাইবার স্পেসের কি গুচ্ছের অপচয়!

এক কিল মারার গোঁসাইয়ের জিজ্ঞাস্য, গরীব-বধের রাজনীতির ফুটেজ হচ্ছে তো? মোবাইলে ফোং ব্লকের পর ঢং করে পাহাড়ে বাজে অতিকায় কাঁসার ঘণ্টা। ‘বুদ্ধং শরনাং গাচ্ছামি… হে বুদ্ধ, আমি তোমার শরণাপন্ন হচ্ছি, ধর্ম্মং শরনাং গাচ্ছামি… হে ধর্ম, আমি তোমার শরণাপন্ন হচ্ছি, সংঘং শরনাং গাচ্ছামি… হে সংঘ, আমি তোমার শরণাপন্ন হচ্ছি’…।

মনে পড়ে, রিডার্স ডাইজেস্ট, লাফটার, দ্য বেস্ট মেডিসিন।

প্রতি সন্ধ্যায় স্বামী (প্রভু?) মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে বউকে অকথ্য গালিগালাজে কাঁদিয়ে ক্ষান্ত হতেন। শান্তশিষ্ট বউটি কান্না চাপতে বাথরুমে ঢুকে গিয়ে কিছুক্ষণ পর বেরুতেন হাসিমুখে।… স্বামী প্রবর অবাক হন, কিন্তু কৌতুহল চেপে যান।

পরে একদিন জেরার জবাবে বউটি জানায়, গালমন্দ খেয়ে তিনি বাথরুমে গিয়ে স্বামীর টুথব্রাশে কমোড পরিস্কার করেন, আর এতেই চিত্ত হয় প্রফুল্ল!

তবে সরকার পক্ষ, বরাবরই অস্বীকার করেন, খাদ্য সংকট। ভুখা মিছিলে নাকি বিরোধীদের উস্কানী আছে, মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে পাকা তথ্য আছে হয়তো।

পাশাপাশি সোনার (আওয়ামী) ছেলেদের এন্তার চালচুরির খবরও আসছে। এক টিকিটে দুটি ছবি, দেখতে চোখ রাখুন :

অলি আল্লাহর দেশে করোনা-মরোনা আইতো ন’

সাধারণ শিক্ষিত, খুব সচেতন উচ্চবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তের বাইরে আম জনতা মোটেই করোনা কামড়ে চিন্তিত নন। প্রথম থেকেই নীতির শৈথিল্য, মসজিদে মসজিদে কুমন্ত্রণা, প্রতিভা সরকারের লেখায় নামগোত্রহীন বছিরুদ্দি(ন?) যেরূপ বলেন বা নওমুসলিম যুব সমাজের ক্র্যাশ, নুরানি নেতা তাহেরি যেমন বলেন, “ব্রাদার ইসলাম, করোনা থিকা বাঁচার জন্য মসজিদ, ওয়াজ বন্ধ করা চ’লবে না!” (লাখো কণ্ঠের হুংকার ধ্বণী : নারায়ে তাক্ববীর! আল্লাহু আকবর!)

“শুইন্যা রাখেন সকলে, দেড়শ টাকা দিয়া মাস্ক না কিইন্যা, ২০ টাকা দিয়া টুপি কিনেন মিয়া!”…

ফলতঃ ইসলামিক রোদ্দুরের ক্লিপিং দ্রুতই ভাইরাল, টিকটক হলেও তাই। “বুঝলে বুজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা!” দুষ্টজনে টি-শার্টে এই অমৃতবচন লিখে গাঞ্জা আর তেজপাতার ছবিতে কোলাজ করেন!

আসমানী শিক্ষার হাইব্রিড চাষাবাদের ফল হাতেহাতে, সব বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো হয় ফাঁস। লকডাউনের ভিতর খেলফত নেতার নামাজে জানাজায় লাখ লাখ আল্লাহর সৈনিকের সমাবেশ, এ সময়ের বৃহৎ গণসমাগম!

কী চমৎকার ফল গো গুরু, ধরে ওই গাছে…


ছবি: অমিতা চক্রবর্তী, জাপান গার্ডেন সিটি, ঢাকা।