[লেখাটি ১লা এপ্রিল লেখকের ফেসবুক পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল]

করোনা ভাইরাস SARS-Cov-2 টেস্টিংঅর্থাৎ পরীক্ষা করে শনাক্ত করা একটা দুরুহ প্রক্রিয়া। যে দেশ যত দ্রুত এই পরীক্ষাটি করতে পেরেছে সেই দেশ ভাইরাসটির মোকাবেলাতে ততটা সফল হয়েছে বলা যায়। এই সাফল্যে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জার্মানিরর নাম বলা যায় ও ব্যর্থ দেশের তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম আসবে। বাংলাদেশের নামও আসতে পারে। কিন্তু এই টেস্টিং প্রক্রিয়া আমাদেরকে বুঝিয়ে দিল সমাজে বিজ্ঞানের কী বিশাল প্রয়োজন, বিজ্ঞানীদের কী প্রয়োজন। ভাইরাস টেস্টিং একটি জটিল প্রক্রিয়া যেটা আমরা প্রথমে বুঝতে অসমর্থ হয়েছিলাম। আমার মনে হয় অনেক দেশের কর্তৃপক্ষ এই জটিলতা বুঝতে পারেন নি, তারা জনসাধারণকে সতর্ক করে দেন নি যে, এটা রক্ত পরীক্ষার মত সহজ ব্যাপার নয়।

এই লেখাটিতে এই পরীক্ষার একটা সরল বর্ণনা দেবার চেষ্টা করব। একই সাথে বিভিন্ন দেশ কেমনভাবে এই টেস্টিং সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে সেটাও বলব। এখানে আমি ভাইরাসের জিনোমের অংশবিশেষ শনাক্তকরণের ওপর লিখছি, এন্টিবডি বা অন্যান্য টেস্টের ওপর নয়, কারণ জিন পরীক্ষাই করোনা ভাইরাসকে শনাক্ত করার মূল পরীক্ষা। এই আলোচনায় স্বেছা-সঙ্গরোধ, রোগী স্বতন্ত্রীকরণ, সামাজিক দূরত্ব এসব নিয়ে লিখছি না, লেখাটি মূলত জিন টেস্টিংএই আবদ্ধ রাখছি। এছাড়া যারা এই টেস্টিং প্রক্রিয়ার কারিগরিদিকগুলোতে কৌতূহলী নন তাঁরা নিচের কয়েকটি প্যারাকে অগ্রাহ্য করে সরাসরি সংবেদী টেস্টিং প্রক্রিয়া শিরোনামের প্যারাতে চলে যেতে পারেন। (SARS-Cov-2কে আমি এখানে লেখা ও পড়ার সুবিধার্থে করোনা ভাইরাস বলে অভিহিত করব।)

একটা ভাইরাসকে তার DNA জিনোম সিকোয়েন্সে (যাকে বাংলায় বলা হচ্ছে বংশাণুসমগ্র অনুক্রম) দিয়ে শনাক্ত করা যায়। এই শনাক্তকরণের পদ্ধতিটা গত চল্লিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে উন্নত হয়েছে। যে পদ্ধতির কথাটা আমরা বেশী শুনি সেটার নাম হল Reverse Transcription Polymerase Chain Reaction বা সংক্ষেপে RT-PCR। এই পদ্ধতিটা বেশ জটিল। আমাদের সামগ্রিক আলোচনার জন্য সেই জটিলতায় যাবার দরকার নেই, তবে খুব সংক্ষেপে এই প্রক্রিয়ার মূল অংশগুলো আমরা আলোচনা করব।

PCR পদ্ধতিতে ভাইরাসটি আবিষ্কার একটি জেনেটিক বা বংশগতিবিদ্যার পদ্ধতি। এটা কার্যকরি করতে হলে আমাদের জানতে হবে ভাইরাসটির DNA-এর গঠন কীরকম, অর্থাৎ সেটির জিনোম বা বংশাণুসমগ্র। ২০১৯ সনের ডিসেম্বর মাসে যখন দেখা গেল উহানের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রচুর নিউমনিয়া রুগী আসছে যাদের মধ্যে সাধারণ ফ্লুর ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে না তখন বেইজিং ও উহানের গবেষকরা উহানের জিন ইনটান হাস্পাতালের পাঁচজন রোগীর শ্বাসনালী ও ফুসফুস থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন (এর মধ্যে একজন পরে মারা যান)। তাঁরা তাদের গবেষণার ফলাফল জানুয়ারির ২০ তারিখে প্রকাশ করেন [1] । তাদের নমুনায় তাঁরা একটা নতুন ধরণের বিটা করোনাভাইরাসের সন্ধান পান। চার ধরণের করোনাভাইরাসের কথা আমরা জানি, এর মধ্যে আলফা ও বিটা বাদুড়ের মধ্যে পাওয়া যায় ও গামা ও ডেলটা পাখী ও শূকরের মধ্যে। SARS ও MERS ভাইরাসও বিটা করোনাভাইরাস।

এখানে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হল চীনা অণুজীববিজ্ঞানীরা এই গবেষণায় যে ক’টি যন্ত্র ব্যবহার করেছেন সেগুলোর প্রতিটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির – যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার Thermo Fisher Scientific এবং Zymo Research। জিন সিকোয়েন্সিং বা বংশাণুসমগ্র অনুক্রম সৃষ্টি করতে তাঁরা ক্যালিফোর্নিয়ার Illumina কোম্পানির যন্ত্র ও সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন। এটা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত প্রযুক্তি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত টেস্টিংএর প্রক্রিয়া কার্যকরি করতে ব্যর্থ হয় (যে সম্পর্কে পরে লিখেছি) । একটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুদক্ষ না হলে এরকম ফলাফলই আমরা আশা করতে পারি।

জানুয়ারি মাসেই অনেক চীনা বিজ্ঞানীই টেস্টিংএর প্রটোকল বা নিয়ম নির্ধারণ করে ফেলেন। SARS-Cov-2 ভাইরাসের জিনোমের কোনো একটা (বা অনেকগুলি) অংশকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করাই হল এই পরীক্ষার কাজ। ইউনিভার্সিটি অফ হংকংএর বিজ্ঞানীরা RT-PCR পরীক্ষার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস জিনোমের দুটি অংশকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। একটা হল ভাইরাসের ওপরের গজাল S প্রোটিনের (S spike protein) জিন ও অন্যটি হল ভাইরাসের ভেতরে RdRp (RNA-dependent-RNA Polymerase) জিন শনাক্ত করা। তারা দেখান যে মুখের লালার নমুনা সংগ্রহ করে সেখানে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব। তবে অনেক চীনা টেস্টিং প্রক্রিয়া ভুল ফলাফল দিয়েছে, অনেক সময় তাঁরা CT Scan-এর ওপর নির্ভর করেছেন ভাইরাসের প্রভাব শনাক্তকরণের জন্য।

করোনা ভাইরাসের RNA সংগ্রহ:

এই প্রক্রিয়ায় লালা বা অন্য নমুনাকে বেশ কিছু রাসায়নিক বস্তু (যাকে রিএজেন্ট বলা হয়) মিশিয়ে নমুনার নিউক্লেয়িক এসিডকে (Nucleic acid) আলাদা করে ফেলা হয়। RNA ও DNA উভয়কেই একসাথে নিউক্লেয়িক এসিড বলা হয়। DNA আমাদের বংশগতির (genetic) তথ্য সংরক্ষিত রাখে, আর RNA সেই তথ্যকে ভিত্তি করে প্রোটিন সৃষ্টি করে। নমুনায় শুধু যে করোনা ভাইরাসের RNA থাকবে তাই নয়, সেখানে নানাবিধ ব্যাক্টেরিয়ার, অন্য ভাইরাসের, দেহের কোষের, শ্বেতরক্তের নিউক্লেয়িক এসিডও থাকবে।

RNA ও DNA নিউক্লেইক এসিড

নতুন করোনা ভাইরাস ও SARS ভাইরাসের জিনোম। [3]

Reverse Transcription: RNA থেকে DNA গঠন

এরপরের পর্যায়টা হল Reverse Transcription (RT)। এতে ভাইরাসের RNA থেকে একটা পুরো দুই ফিতার DNA সৃষ্টি করা হয়। Reverse কারণ সাধারণত DNA থেকে RNA তথ্য নেয়, এখানে উল্টোটা হচ্ছে। এর জন্য একটি এনজাইম ব্যবহার করা হয় যার নাম হল Reverse Transcriptase। Howard Temin ও David Baltimore Reverse Transcriptase আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৫ সনে নোবেল পুরষ্কার পান।

PCR: কিছু ভাইরাস জিনের সঙ্গে মিল-খাওয়া DNAর অংশকে অনেকবার কপি করা
RT প্রক্রিয়া শেষ হলে PCR প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার মূল কাজ হল একটি DNA দুই-ফিতা থেকে প্রায় এক বিলিয়ন DNA সৃষ্টি করা। RT প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট DNA যে মাধ্যমে আছে সেখানে যোগ করা হয় প্রাইমার (Primer)। প্রাইমার হল এক-ফিতার নিউক্লেইক এসিড। প্রাইমারকে আগের থেকে এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যে তারা ভাইরাসের বিভিন্ন জিন – যেমন S বা RdRp ইত্যাদি –খুঁজে সেখানে জোড়া লাগে। প্রাইমার ডিজাইন করা হল এই টেস্টিং প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরপরে অন্য রিএজেন্ট (polymerase ও nucleotide) মাধ্যমে এবং তাপমাত্রা বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে ভাইরাসের DNAর ওই একটি অংশকে (যেখানে S ও RdRp বা অন্য জিন পাওয়া যায়) প্রায় একশ কোটি করা হয়। এই প্রক্রিয়ার একটি নক্সা নিচে দেয়া হল। এখানে DNAর (সবুজ) একটা নির্দিষ্ট অংশকে প্রাইমার (লাল) দিয়ে চিহ্নিত করে সেটিকে কপি করার প্রক্রিয়া দেখানো হচ্ছে। এটাই হল Polymerase Chain Reporoduction (PCR)। PCR প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য Kary Mullisকে ১৯৯৩ সনে রসায়নের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।

PCR প্রক্রিয়া

নিচের চিত্রে RNA extraction থেকে পুরো PCR প্রক্রিয়াটা দেখানো হচ্ছে।

RNA extraction থেকে PCR

PCR প্রক্রিয়ায় এত যে DNA সৃষ্টি করা হল সেটা কিসের জন্য? একটি DNA এতই ছোট যে সেটি সহজে ধরা পড়বে না। বহু DNAর কপি তৈরি করে Sanger প্রক্রিয়ায় ওই DNAর অন্তর্নিহিত কোড, অর্থাৎ সেগুলোর adenine, cytosine, guanine ও thymine অণুগুলো কীভাবে বিন্যস্ত আছে সেটা বার করা যায়। এটাই হল DNA জিনোম সিকোয়েন্স (বংশাণুসমগ্র অনুক্রম)। এই অনুক্রম যদি ভাইরাসের S বা RpRd (বা অন্য জিন) অনুক্রমের সঙ্গে মিলে যায় তাহলে ভাইরাস যে সেই লালা বা থুতুর নমুনায় ছিল তা প্রতিষ্ঠিত হয়। Sanger প্রক্রিয়া নিয়ে এখানে কিছু বলছি না, শুধু এটুকু বলি Frederick Sanger ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী যিনি দুবার রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান। ১৯৫৮ সনে প্রোটিন, বিশেষত প্রোটিনের ওপর গবেষণার জন্য, এবং ১৯৮০ সনে নিউক্লেইক এসিডের জিনোম সিকোয়েন্সের পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য।

q-PCR – Real Time PCR
Real Time PCR পদ্ধতিতে PCR প্রক্রিয়া হবার সময়ই এক ধরণের ফ্লুরোসেন্স আলোর মাধ্যমে S বা RdRpযুক্ত লক্ষ্য-DNAর সন্ধান পাওয়া সম্ভব। রিএজেন্টগুলোর সঙ্গে এক ধরণের ফ্লুরোসেন্ট অণু মেশানো হয় যা কিনা DNAর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। যত বেশী লক্ষ্য-DNA সৃষ্টি হবে তত বেশী আলো নির্গত হবে। সেই আলোর পরিমাণ দেখে লক্ষ্য-DNA উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই পদ্ধতি অনেক সময় বাঁচিয়ে দেয়। কয়েক ঘন্টা, এমনকী এক ঘন্টার মধ্যেও ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

সংবেদী টেস্টিং প্রক্রিয়া
এখন পর্যন্ত যতটুকু বলা হল সেটুকু থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই টেস্টিং প্রক্রিয়া বেশ জটিল। এর জন্য এমন ল্যাব চাই যা দূষণমুক্ত, এমন রিএজেন্ট দরকার যা অন্য কিছু দ্বারা সংক্রমিত হয় নি, শেষাবধি রোগীর দেহ থেকে যে নমুনা নেয়া হয়েছে সেটাও দূষিত হয় নি। এবং সেই নমুনা যেন পরীক্ষককে আক্রান্ত না করে সেটাও দেখতে হবে। প্রাইমার ও অন্যান্য রিএজেন্টের গুণগত মান ঠিক থাকতে হবে, সেগুলোর সাপ্লাইও থাকতে হবে পর্যাপ্ত। যারা পরীক্ষাটি পরিচালনা করছেন তাঁদের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। যদি qT-PCR না থাকে এবং ভাল ব্যবস্থাপনা না থাকে তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ হবে। এই জন্য রোগীদের তাদের টেস্টের ফলাফল জানার জন্য বেশ কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। টেস্টিংএর জটিলতা যে কী পরিমাণ সেটা বোঝা যাচ্ছে যখন চীন থেকে যে সমস্ত টেস্টং কিট বিদেশে যাচ্ছে তাদের গুণগত মান সম্পর্কে প্রশ্ন উঠছে। স্পেন, তুরস্ক, ফিলিপিন্স বলছে চীনে তৈরি অনেক কিটই ভুল ফলাফল দেখাচ্ছে। অন্যদিকে চীন বলছে ওই সমস্ত দেশের পরীক্ষকরা নির্দেশমত পরীক্ষা করছেন না।

দক্ষিণ কোরিয়া
টেস্টিংএর প্রস্তুতির ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ উল্লেখযোগ্য। সেই দেশটির কর্তৃপক্ষ জানুয়ারি মাসেই পাঁচটি বায়োটেক কোম্পানিকে ভাইরাস নিরীক্ষণের প্রক্রিয়া প্রস্তুত করতে বলে যদিও তার অনেক আগেই এই কোম্পানিগুলো নিজের থেকে কাজ শুরু করে দেয়। একটি কোম্পানি Seegen-এর কথা CNN-এর রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে। এই কোম্পানিটি জানুয়ারি মাসে তাদের কম্পুটারের AI (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) সিস্টেম ব্যবহার করে কী ধরণের প্রাইমার ও রিএজেন্ট করোনা ভাইরাসের E, RdRp এবং N জিন চিহ্নিত করতে পারে সেটা বের করে। মনে রাখতে হবে এই কোম্পানিগুলোর কাছে কোনো ভাইরাস হাতে ছিল না, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে চীনা বিজ্ঞানীরা যে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে তাদের কাজ করতে হয়। কম্পুটারের তথ্য অনুযায়ী তারা জানুয়ারির ২৪ তারিখের মধ্যে প্রাইমার, রিএজেন্ট এসব অর্ডার করেন। ২৮শে জানুয়ারি এসব রসদ পৌঁছায় এবং ৫ই ফেব্রুয়ারি তাদের টেস্টিং করাবার সমস্ত প্রক্রিয়া প্রস্তুত হয়ে যায়। এবার সরকার থেকে অনুমতির অপেক্ষা। অন্য সময় যেখানে এক থেকে দেড় বছর লাগে এই দুর্যোগের সময়ে মাত্র ৭ দিনে তাদের অনুমতি মিলল। ১২ই ফেব্রুয়ারি সবকিছু প্রস্তুত, শুধুমাত্র তখনই Seegen জানল তাদের তৈরি টেস্টিং প্রক্রিয়া কাজ করে কিনা।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দক্ষিণ কোরিয়ার সংক্রমণ বেশ বাড়ল। Seegen তাদের অন্য সব প্রডাক্টের কাজ বন্ধ করে দিল এবং তাদের ৩৯৫ জন কর্মচারিদের টেস্টিং কিট বানানোর কাজে নিয়োজিত করল। অন্য বিষয়ে গবেষণারত পিএইচডিধারী বিজ্ঞানীরাও পরীক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এসেম্বলি ও বাক্সে ভরার কাজ শুরু করল। এই কোম্পানিটি এখন সপ্তাহে ১০,০০০ কিট তৈরি করছে। প্রতিটি কিট ১০০ জন মানুষের পরীক্ষা করে, কাজেই কোম্পানিটি সপ্তাহে এক মিলিয়ন লোকের টেস্ট করার সরঞ্জাম প্রস্তুত করছে। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া তিন লক্ষ টেস্ট করেছে, অর্থাৎ প্রতি ১৭০ জন মানুষের মধ্যে একজনকে। পূর্ব থেকে টেস্ট করে আক্রান্ত মানুষদের আলাদা করা, তাদেরকে অনুসরণ করা এবং অক্লান্তভাবে সাধারণের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের সংক্রমণকে অনেকখানি বাগে আনতে পেরেছে।

কোরিয়ার Seegen কোম্পানিতে টেস্টিংএর সরঞ্জাম প্রস্তুত হচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্র
অন্যদিকে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমেরিকার ইতিহাস চরম ব্যর্থতার ইতিহাস। ফেব্রুয়ারি মাসে যখন দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি তাদের নাগরিকেদের পরীক্ষা করছিল তখন আমেরিকা তার সমস্ত সামর্থ কারিগরি ত্রুটি, সরকারি নিয়ন্ত্রণ, মন্ত্রী (সেক্রেটারি) ও আমলাদের গা-ছাড়া ভাব ও সামগ্রিকভাবে ওপর থেকে নেতৃত্বের অভাবে বলতে গেলে কিছুই করল না। আমেরিকার Centers for Desease Control and Prevention (CDC) এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার দিকে সারা পৃথিবীর সংক্রমণ গবেষকরা চেয়ে থাকেন। জানুয়ারি মাসে CDC সিদ্ধান্ত নিল যে সে নিজের টেস্টিং প্রক্রিয়া সৃষ্টি করবে এবং ৬ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেটি প্রস্তুত হল, কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই বোঝা গেল যে তার টেস্টিং-এ পদ্ধতিতে একটা বিশাল ত্রুটি রয়ে গেছে। ত্রুটিটা হল ভাইরাসের জিনকে চিহ্নিত করতে তারা যে সমস্ত প্রাইমার সৃষ্টি করেছে তারা ঠিকমত কাজ করছে না। অন্য বিজ্ঞানীরা তাদের কম্পুটারে প্রাইমারের অণুগঠনের তথ্য ঢুকিয়ে সাথে সাথেই বুঝলেন CDC কোথায় ভুল করেছে, অথচ এই সামান্য ত্রুটি ধরার কাজটা CDC করে নি। CDC তাদের ত্রুটি সংশোধন করতে করতে খুব জরুরী কয়েক সপ্তাহ চলে গেল, কিন্তু এর মধ্যে US Federal and Drug Administration (FDA) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ও বায়োটেক কোম্পানিগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে টেস্ট করার অনুমতি দিল না। অবশেষে ২৯শে ফেব্রুয়ারি আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়া হয়। ততদিনে অন্যান্য অনেক কারণ যুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত নিউ ইয়র্কে সংক্রমণ ছড়িয়ে গেছে।

CDC, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র

জার্মানি ও WHO
এদিকে জানুয়ারির ১০ তারিখের মধ্যে জার্মানির বার্লিন শহরের Charite Institute of Virology করোনা ভাইরাসের E এবং RdRp জিনের ওপর ভিত্তি করে একটি টেস্টিং প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে। কোরিয়ান বিজ্ঞানীদের চেয়ে জার্মান বিজ্ঞানীদের একটা সুবিধা ছিল যে তারা চীন থেকে ভাইরাসের নমুনা পেয়েছিলেন এবং সেটার ওপর সরাসরি পরীক্ষা করে তাদের শনাক্তকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন। জার্মানির TIB Molbiol কোম্পানি টেস্ট কিট তৈরি করা শুরু করে।The World Health Organization (WHO) জার্মান প্রটোকল গ্রহণ করে এবং জানুয়ারি ১৭র মধ্যে টেস্টিংএর প্রটোকলটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। CDC এই প্রটোকলটি গ্রহণ না করে নিজের টেস্ট তৈরি করতে চায়। এর ফল যে ভাল হল না তা আমরা জানি।

বাংলাদেশ
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বোঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের টেস্ট কেন এত দুরূহ। আগেই বলেছি শুধু টেস্ট কিট আসলেই হবে না। পরীক্ষা পদ্ধতি পুরো কার্যকর করতে যেমন দূষণমুক্ত ল্যাব লাগবে তেমনই দক্ষ টেকনিশিয়ান লাগবে। জেলায় জেলায় টেস্ট কিট পাঠালেই কাজ হবে না, সেখানে অন্য যন্ত্র বসাতে হবে, ল্যাব তৈরি করতে হবে । মনে রাখতে হবে চিকিৎসকরা এই টেস্টিং করছেন না। এই পরীক্ষার সম্পর্ক আছে অণুজীববিদদের সাথে, ভাইরাসবিশেষজ্ঞ দের সাথে, বংশগতিবিদ, জীববিজ্ঞান ও রসায়নের অন্য বিজ্ঞানীদের সাথে। সেই বিজ্ঞানীদের কাজ হল টেকনিশিয়ান তৈরি করা, প্রশিক্ষণ দেয়া। এটি বিশাল কাজ এবং সেজন্য হয়তো সমগ্র বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়। এখানে যা লিখলাম তা বাংলাদেশের এই বিষয়ের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন কিছু নয়, তাঁরা এই ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় লিখেছেন, তাঁদের গবেষণাগারে PCRসহ অন্য যন্ত্রপাতি আছে, সরকারের সহযোগিতা পেলে এই সংকটে তাদের ভূমিকা আরো বেশী হত। ICDDRBরও মনে হয় এই সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা আছে বহুদিনের। তবে বর্তমানে বেশ কিছু জায়গায় RNA স্বতন্ত্রকরণ ও q-PCR যন্ত্র বসছে, এর মধ্যে একটি হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। প্রথম আলোতে এর ওপর একটি প্রতিবেদন আছে। আজকের The Daily Star এও এই নিয়ে একটি ভাল প্রতিবেদন আছে। আমি বলব টেস্টিংএর সমস্যাটা কর্তৃপক্ষ নিজে যেমন বোঝে নি, জনগণকেও বোঝাতে সমর্থ হয় নি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিও এর জন্য কিছুটা দায়ী। করোনা ভাইরাস এত দ্রুত চলে যাবে না, আশা করব বাংলাদেশ এই টেস্টিং সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) RT-PCR যন্ত্র – প্রথম আলো

[1] Ren et al. 2020 Identification of a Novel Coronavirus Causing Severe Pneumonia in Human: A Descriptive Study, Chinese Medical Journal

[2] Kai-Wang To et al. 2020 Consistent Detection of 2019 Novel Coronavirus in Saliva, Clinical Infectious Diseases

[3] Corman et al. 2020 Diagnostic detection of Wuhan coronavirus 2019 by real-time RTPCR -Protocol and preliminary evaluation as of Jan 13, 2020, WHO Website