আজ সেই ভয়াবহ ২৬ ফেব্রুয়ারি, যে দিনটি্তে আমি আমার জীবনের সব চেয়ে বেশী আতংকিত কর্তব্যবিমূঢ় শোকাহত মর্মাহত হয়েছিলাম। এ দিনটিতে ঘটেছিল জীবনের সব চেয়ে বেশী অবিশ্বাস্য ঘটনা। যে ছোট ভাইটি আমাকে সর্বপ্রথম মুক্তমনা ফোরামের ঠিকানা জানিয়েছিল সেই সংবাদটা দিল, “আমাদের অভিজিৎকে বই মেলায় খুন করা হয়েছে”। শরীরের সুগার লেভেল ডাউন হলে যেমন ডায়েবেটিক রোগীর শরীর দূর্বল হয়ে কাঁপন ধরে তেমনি একটা কিছু আমার হয়েছে যেন টের পেলাম। বিছানায় পড়া মুমুর্ষ রোগীর মতো ক্ষীণ স্বরে একটি কথাই আমার মুখ থেকে দীর্ঘ শ্বাসে বের হয়েছিল “না–হ”। ছোট ভাইকে বললাম, “টেলিফোন ছেড়ে দাও আমি পরে ফোন করবো”। কম্পিউটার অন করে পুরো ওপেন হওয়ার আগ পর্যন্ত আশা করছিলাম অভিজিৎ আক্রান্ত হয়েছেন, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন কিন্তু অভিজিৎ জীবিত আছেন। শেষ পর্যন্ত আমার লেখালেখির জন্মের ঠিকানা মুক্তমনায় প্রবেশ করে চোখের সামনে ব্লাকস্ক্রিন দেখে, চোখ মেলা নির্জীব মৃত মানুষের মতো কতক্ষণ স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রয়েছিলাম আজ আর মনে নেই।

২০০১ সালের ২৬ মে আলোচনাচক্রের মাধ্যমে মুক্তমনা আত্মপ্রকাশ করে। আমার লেখা মুক্তমনা প্রকাশ করবে সেটিও ছিল আমার জীবনের এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। প্রথম লেখাটি প্রকাশ করে অভিজিৎ একটি ইমেইল করলেন, বললেন আমার লেখা তার পছন্দ হয়েছে। সেই থেকে শুরু আর শেষ পর্যন্ত অভিজিৎ নিজের হাতে প্রচ্ছদ এঁকে আমার ‘যে সত্য বলা হয়নি’ বইটি পিডিএফ করে ই-বুক বানিয়ে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করে দিলেন। বইয়ের ভেতরে বই নিয়ে তার মন্তব্যে লিখে দিলেন:

আকাশ মালিকের ‘যে সত্য বলা হয়নি’ গ্রন্থের পান্ডুলিপি পড়তে গিয়ে নিজের অজান্তেই একটা বড় ধাক্কা খেলাম। তিনি তার পুরো বইটিতে সাহসিকতার সাথে যে কথাগুলো উচচারণ করেছেন সেগুলো হয়তো আপনার আমার অনেকেরই মনের কথা। কিন্তু মনের কথা হলে কি হবে,সেই কথাগুলো সাহসিকতার সাথে উচচারণ করতে পারে ক’জন? তিনি ‘মানব জাতির বিবেক’ ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারের যে উক্তিটি ব্যবহার করেছেন ‘বোকার স্বর্গ’ প্রবন্ধে- ‘পৃথিবীর প্রথম পুরোহিত বা মোল্লা ব্যক্তিটি হচেছ পৃথিবীর প্রথম ধূর্ত বাটপার,যার মোলাকাত হয়েছিল প্রথম নির্বোধ ব্যক্তিটির সাথে। ধর্ম প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রারম্ভ আর তা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে এর চেয়ে নির্জলা সত্য আর কি হতে পারে! আমার প্রায়ই উচচস্বরে বলতে ইচেছ করে, যে যত বড় ধর্মপ্রচারক তিনি তত বড় ধর্মপ্রতারক। ডেভিড কপারফিল্ডের জাদুর চেয়েও যেন মোহনীয় ছিল তাদের প্রতারণার কৌশল। প্রতারণার ফাঁদ পেতে যুগের পর যুগ ধরে বিশ্বাসীদের হৃদয়ে গেড়ে আছেন একেকজন বিরিঞ্চিবাবা হয়ে- কেউ বা সেজেছেন ‘ঈশ্বরের পুত্র’ কেউ বা ‘ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ’ নবী-পয়গাম্বর’ কেউ বা ‘সত্য সাঁই’।
মনে পড়ে আঠারো শতকে এক অজ্ঞাত লেখক এক গ্রন্থ’ লিখেছিলেন ‘তিন ভন্ড’ (The Three Impostors) নামে যা পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। ‘তিন ভন্ড’ গ্রন্থে’ দাবী করা হয়েছিল,বিশ্ব তিনজন ভন্ডচুড়ামনি দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। আর সেই তিন ভন্ড হচেছন,মুসা,যীশু আর মুহাম্মদ।

আকাশ মালিকের তালিকায় অবশ্য ভন্ডচুড়ামনি হিসেবে এসেছে আরো একজনের নাম,হিন্দুদের ভগবান মনু। ‘তিন ভন্ড’ গ্রন্থে’র রচয়িতা হিসেবে দুই জনকে সন্দেহ করা হয়ে থাকে। একজন সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক, অন্যজন মুসলিম দার্শনিক আবু রুশদ। সম্রাট ফ্রেডারিককে অভিহিত করা হয়ে থাকে ‘The first modern man’ হিসেবে, আর আবু রুশদ বিশেষিত হন ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক’ অভিধায়। আমার কেন যেন মনে হচেছ ‘যে সত্য বলা হয়নি’ গ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে যেন আকাশ মালিক বাংলাদেশের আবু রুশদ হতে চলেছেন। এ সত্যই অতিশয়োক্তি নয়। সন্দেহ নেই বাংলাভাষায় এ ধরনের বই আগে লেখা হয়নি। পুরো গ্রন্থটি তার পরিশ্রম, মেধা এবং অধ্যাবসায়ের এক উজ্বল স্বাক্ষর। রসুনের মত খোলস ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আকাশ মালিক যেন পাঠকদের সামনে তুলে এনেছেন শ্বেত শুভ্র সত্যের নির্যাস। তার পরিশ্রমলব্ধ গবেষণায় পাওয়া সত্যের নির্যাস দেখে অনেক পাঠকই চমকিত হবেন। আমিও হয়েছি। বারবার পড়েছি তার পুরো পান্ডুলিপিটি। চমক কাটতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবিগুরুর বাণীতে খোঁজে পেয়েছি উত্তর-

‘সত্য যে কঠিন সে কঠিনেরে ভালবাসিলাম সে কখনো করেনা বঞ্চনা।’
অভিজিৎ রায়
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, মুক্তমনা
মার্চ ২০০৯

যখনই লেখালেখিতে কিছুদিন বিরতি দিয়েছি, অভিজিৎ ইমেইল করে তাগাদা দিতেন, “লেখা পাচ্ছিনা যে ব্যাপার কী? তাড়াতাড়ি লেখা দেন”। মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অভিজিৎ না হলে আমার মতো অনেকেই কোনোদিন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করতে পারতেন না। আমরা আবেগের বশে বলে থাকি, এক অভিজিৎ পরপারে লক্ষ অভিজিৎ ঘরে ঘরে, কথাটা সত্য নয়। তার শুন্যস্থান পুরণ করার এখন পর্যন্ত কেউ আসেন নি, ভবিষ্যতে এমন কেউ আদৌ আসবেন কিনা তাতেও প্রচুর সন্দেহ আছে। অভিজিতের মৃত্যুর পাঁচ বৎসর পর এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, অভিজিতের তুলনা একমাত্র অভিজিৎই। আমরাই শুধু নয় মুক্তচিন্তার জগতবাসী সবাই জানেন এই বিশ্ব কি হারিয়েছে।

মুক্তমনা ব্লগ ছিল একটি পরিবারের মত। পরিবারে মতানৈক্য দ্বিমত মনোমালিন্য হতেই পারে, অভিজিৎ ছিলেন সেই পরিবারের অভিভাবক পিতার মত। সংসার ভেঙ্গে কাউকেই গৃহ ত্যাগ করতে দিতেন না। নিন্দুকেরা অভিজিৎকে মুসলিম বিদ্বেষী বলে অপবাদ দিয়েছেন, আমি তাদের বলি আমাকে প্রাণ ভরে ইসলাম ব্যাশার মুসলিম বিদ্বেষী বলে গালি দাও কিন্তু অভিজিৎকে দিওনা, অভিজিৎ আপাদমস্তক রক্তে মাংসে একজন মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক, মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন। জগতের কাউকেই তিনি ঘৃণা করতেন না।

অভিজিৎ থাকবেন তার সৃষ্টি লক্ষ লেখক পাঠকের অন্তরের গভীরে। আমরা কেউ অভিজিৎ হতে পারবোনা, কিন্তু অভিজিৎ কথা দিলাম জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আপনার কথামত লেখা চালিয়ে যাবো। কবি গুরুর ভাষায় মনের কথা ব্যক্ত করি-

‘নয়নসম্মুখে তুমি নাই/ নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’।