প্রথম পর্ব: মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু আক্রমণ
পর্ব দুই: সুলতান মাহমুদ গজনী’র ভারত আক্রমণ
পর্ব তিন:মুহম্মদ ঘুরীর দিল্লী দখল

মুহম্মদ ঘুরির সেনাপ্রধান কুতুব উদ্দিন আইবেক তার মালিক মুহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিল্লীতে মামলুক (দাস বংশের) শাসনামলের সূচনা করে। ছোটবেলায় দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া কুতুব উদ্দিন আইবেক ইরানের নিশাপুরের এক কাজির (বিচারক) কাছে বেড়ে ওঠে। কাজির কাছেই কুতুব উদ্দিন ঘোড়ায় চড়া, যুদ্ধবিদ্যা, তীর চালানো শিক্ষা লাভ করে। কাজির কাছ থেকে কুতুব উদ্দিনকে কিনে নেয় মুইজ উদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি। যুদ্ধের কৌশল আর বুদ্ধির জোরে কুতুব উদ্দিন, ঘুরির সেনাপ্রধান, সাহসী যোদ্ধা এবং ঘুরির বিশ্বস্ত সহচরে পরিণত হয়। তারাইনের প্রথম যুদ্ধে কুতুব উদ্দিনের সাহসিকতা আর উপস্থিত বুদ্ধির কারণেই ঘুরি প্রাণে বেঁচে যায়। মুহম্মদ ঘুরি ভারত দখল করে কুতুব উদ্দিন আইবেকের কাছে রাজ্য শাসনের ভার দিয়ে খোরাসানে ফিরে যায় সেখানকার বিদ্রোহ দমন করতে। শাসনভার পেয়েই আইবেক রাজস্থানের শাকম্ভারীর চৌহান রাজবংশকে উৎখাত করে, রাজপুতদের নাম নিশানা মুছে দিয়ে চৌহান রাজের রাজধানী অজয়মেরুর নাম বদলে আজমির শরীফ নামকরণ করে। সেখানে খাজা নিজামউদ্দিন চিশতীর জন্য নির্মাণ করে খানকা শরীফ,, দরগা এবং মাদ্রাসা। কুতুব উদ্দিন ধীরে ধীরে গাহাদাবলা, চালুক্য, চান্ডেলা এবং আশেপাশের ছোটবড় রাজাদের পরাজিত করে তাদের রাজ্যগুলো দখল করে নেয়। রাজস্থান থেকে ক্রমে ক্রমে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বারানসি, গঙ্গা অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, কনৌজ তার দখলে চলে আসে।

কোন রাজ্য দখলই রক্তপাত ছাড়া সম্ভব না, কুতুব উদ্দিন আইবেকের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। রাজ্য বিস্তারের পরতে পরতে রক্তের প্রবাহ, স্থানীয়দের মৃতদেহের স্তূপ, পরাজিত সৈন্যদের হত্যার সময়ের আর্তনাদ, রক্তের ফোয়ারা, ধর্ষিত হয়েছে স্বামীহারা নারী ও পিতাহারা কিশোরী কন্যা আর কিশোর ও শিশুরা হয়েছে ধর্মান্তরিত শ্রমদাস। ধর্ষণের পর নারীদের স্থান হয়েছে সুলতানের হারেমে। পৃথ্বীরাজকে হত্যার পর মুহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজের রাজ্য শাসনের ভার দেয় কাওমুল মূলকের উপর। পৃথ্বীরাজের ভাই হরিরাজা কাওমুল মূলকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং রাথোম্বোর দুর্গ দখলের চেষ্টা করে। কুতুব উদ্দিন কঠোর হাতে হরিরাজার আক্রমণকে প্রতিহত করে। হরিরাজার সাথে আক্রমণে যোগ দেয়া একজন সেনাও সেদিন জীবিত ফেরত যেতে পারেনি।

কুতুব উদ্দিনের মূল কৃতিত্ব আসলে রাজ্য বিস্তারের থেকেও ইসলামের প্রচার, প্রসার এবং ইসলামী স্থাপত্য নির্মাণের সূচনা করা। ইতিহাসবিদগণের হিসেবে কুতুব উদ্দিন আইবেক কমপক্ষে এক হাজার মন্দির ধ্বংস করে সেই ভিত্তির উপরেই নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করে। হিন্দুদের উপর ন্যক্কারজনক হত্যা, নিপীড়ন, তাদের মন্দির দখলের প্রক্রিয়া চলতেই থাকল শাসক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ মদদে এবং ছত্রছায়ায়। দিল্লীর জামে মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথে কোরআনের আয়াত লেখা সোনার পাতগুলো বানানো হয়েছে বিভিন্ন মন্দির থেকে লুট করা ২৭টি সোনার প্রতিমা গলিয়ে।

কুতুব উদ্দিন আইবেকের মন্দির এবং প্রতিমা ভাঙার খ্যাতি অতীতের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তার সমসাময়িক বা পরেও মন্দির বা প্রতিমা ভাঙার ক্ষেত্রে তার ধারে কাছে কেউ নেই। ইরান, আফগানিস্তান থেকে দলে আসতে লাগল সুফি দরবেশ, ইসলামী পণ্ডিত। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় হিন্দুদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া চলতে লাগল সমানতালে। পরিস্থিতি কেমন ছিল, একটা উদাহরণ দিলে হয়ত একটু বোধগম্য হবে, কুতুব উদ্দিন আইবেক যখন কৈল/কালিঞ্জার (বর্তমান আলীগড়ে) পৌঁছায় তখন যেসব সৈন্য বুদ্ধিমান এবং ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিল তারা দলে দলে ইসলাম কবুল করতে শুরু করে। আর যারা নিজেদের আবহমান কালধরে পিতৃপুরুষের প্রচলিত ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের ছায়া তলে আসে না তারা চিরতরে তলোয়ারের ছায়াতলে চলে যায়। Kishori Saran Lal তার “Indian muslims: Who are they” বইতে কুতুব উদ্দিন আইবেকের প্রশংসা করে লেখা পারস্য থেকে আগত কবি ও লেখক হাসান নিজামির লেখা ইতিহাসের গ্রন্থ Taj-ul-Maasir’এর অনুবাদ থেকে উদ্ধৃতি করেন, “those of the garrison who were wise and acute were converted to Islam, but those who stood by their ancient faith were slain with the sword.” Taj-ul-Maasir গ্রন্থে কবি হাসান নিজামি ইতিহাস লিখতে গিয়ে কাব্যিকভাবে কুতুব উদ্দিনের বীরত্ব তুলে ধরেন।

হাসান নিজামি লিখেছেন, ১১৯৩ সালে সদ্য জয় করা রাজ্য কালিঞ্জার (বর্তমান আলিগড়ে) হিন্দুদের বিদ্রোহ দমনের পর কুতুব উদ্দিন আইবেক কালিঞ্জারের হিন্দু প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মাথা কেটে তিনটে দুর্গ সমান স্তূপ করে, তাদের মাথা বিচ্ছিন্ন শরীর ফেলে রাখে বনে বাদাড়ে কুকুর শিয়ালের খাবারের ব্যবস্থা করতে। পুরো কালিঞ্জারে কোন মন্দির ভাঙা পড়তে বাকি ছিল না, পুরো এলাকা মূর্তি শূন্য করে করা হয়। ১১৯৪ সালে আইবেক দিল্লীতে ২৭টি মন্দির ধ্বংস করে। মন্দিরের ভাঙা ইট, সুরকি দিয়েই নির্মাণ করে ‘ক্বুয়াত-উল-ইসলাম’ (ইসলামের শক্তি) মসজিদ এবং ১১৯৫ সালে আইবেক এই মসজিদের উদ্বোধন করে। পারস্যের নিশাপুর থেকে আগত হাসান নিজামের লেখা ইতিহাসের জবানী থেকেই জানা যায়, কুতুব উদ্দিন আইবেক ক্বুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ নির্মাণ করে মন্দিরের লুট করা অর্থ রত্ন পাথর দিয়ে, মসজিদ নির্মাণের শ্রমিকরাও সদ্য বন্দী হওয়া হিন্দু দাস। ১১৯৫ সালে গুজরাটের সৌরাষ্ট্র এবং আজমির এলাকার ‘মার (Mehr) আদিবাসী গোত্র’ বিদ্রোহ করলে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে গুজরাটের চালুক্য রাজ্যের সেনাবাহিনী। মার বিদ্রোহ দমন করার জন্য কুতুব উদ্দিন আইবেক গজনী থেকে দ্রুত নতুন সেনাবাহিনী নিয়ে আসে। ১১৯৬ সালে আইবেক গুজরাটের রাজধানী অনিলবার পাটানের দিকে ধাবিত হয় বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে নতুন উদ্যমে। রাজা কর্ণ যুদ্ধে পরাজিত হলে নিজামি লিখেছেন, “মার গোত্রের রাজা কর্ণ পরাজিত হয় এবং পালিয়ে যায়। মার গোত্রের ৫০ হাজার বিধর্মীকে একদিনেই তরোয়ালের আঘাতে দোযখে পাঠিয়ে দেয় কুতুব উদ্দিনের মামলুক বাহিনী। মার জনগোষ্ঠীর ২০ হাজারের অধিক মানুষকে বন্দী করে দাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য, অগণিত গবাদিপশু, ধনসম্পত্তি, লুটেরমাল চলে আসে বিজয়ীদের হাতে”। গজনী থেকে যুদ্ধ করতে আসা সেনাদের কেউ খালি হাতে ফেরেনি সেদিন। ধর্ষিত হয়েছিল অসংখ্য নারী, কিশোরী। বনে জঙ্গলে যারা পালিয়ে যেতে পেরেছিল তারা সৌভাগ্যবান। পুরো অনিলবারা শহরে লুটতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ চলে কয়েকদিন ধরে, প্রতিটি মন্দির ভাঙা হয়, প্রাসাদে লুট হয়। অনিলবারা শহর ধ্বংস করে আজমীর ফেরার পথে বিশালদেবা এলাকার সংস্কৃত টোল, মঠ, আশ্রম সব ধুলোয় মিশিয়ে দেয় মামলুক সেনাবাহিনী। কুতুবের সেনাদল প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বিশালদেবা সংস্কৃত পাঠশালা নিশ্চিহ্ন করে সেখানে একটা মসজিদ নির্মাণ করে কুতুব উদ্দিন এবং নাম দেয় Arhai din ka Jhonpra. ১২০২ সালে কালিঞ্জার বিজয় ছিল কুতুব উদ্দিনের ভারত বিজয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন। নিজামি তার লেখার সমাপ্তি টেনেছেন এই বলে যে, “কালিঞ্জার বিজয় করে কুতুব উদ্দিন সেখানের মন্দিরগুলোকে মসজিদে পরিণত করে, সেখান থেকে ৫০ হাজার দাসদাসী পাওয়া যায় এবং এই যুদ্ধজয়ে এত হিন্দু নিহত হয় যে কালিঞ্জারের সমতল মাটিও রক্তে ভিজে থকথকে কাদা হয়ে গিয়েছিল।”
কুতুব উদ্দিন আইবেক ১২০০ থেকে ১২১০ সালের মধ্যে গোয়ালিয়র, বুন্দেলখণ্ড, আজমির, রানথাম্ভর, অনিলবারা, মধ্যপ্রদেশ এবং মালবা দখল করে নেয়। গুজরাটের কাছেই নাহারবালা শহরে এক যুদ্ধে কুতুব উদ্দিন আইবেক একদিনেই ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। সেনাদের মাঝে লুটের অর্থ দান করে কুতুব বিশাল খ্যাতি অর্জন করে। জনশ্রুতি হয়ে গিয়েছিল যে, কুতুব উদ্দিন ‘লাখবাকস’ লাখ টাকা দানকারী উপাধি পায়, তেমনি একদিনে এত মানুষ হত্যা করে ‘লাখোহত্যাকারী’ খ্যাতিও অর্জন করে। ইরানের ইতিহাসবিদ ও লেখক Fakhr-i-Mudabbir লিখেছেন, যুদ্ধজয়ের পুরষ্কার হিসেবে কুতুব উদ্দিন আইবেক সেনাদের মাঝে বন্দী নারী শিশু বণ্টন করে দেয় ফলে একজন একেবারে মামুলি মুসলিম সেনাও রাতারাতি কয়েকজন দাসদাসীর মালিক হয়ে যায়।

কুতুব উদ্দিন আইবেক যুদ্ধজয়ের পর একটু থিতু হয়ে সুন্দর সুন্দর ইমারত, মসজিদ, মিনার নির্মাণে মনোযোগ দেয়। প্রথম সুলতান হিসেবে দিল্লীর সিংহাসনে বসে ভারতে মুসলিমদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দ্রুত স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি নতুন রাজ্যের স্থানীয় অধিবাসীদের মনে প্রভাব বিস্তার করাও তার নতুন দায়িত্বের মধ্যে চলে আসে। দৃশ্যত স্থাপত্যকলা হয়ে ওঠে মুসলিমদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনীর উৎকৃষ্ট মাধ্যম। কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকি নামের একজন ইসলাম প্রচারক সুফির নামে নির্মিত কুতুব মিনার বা ‘বিজয় স্তম্ভ’ মুসলিমদের ভারত বিজয়ের নিশানা। কুতুব মিনারের পরিকল্পনা, নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১১৯৬ সালে, যদিও এটির নির্মাণ কাজ শেষ করে আইবেকের জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ। ইলতুতমিশ নিজেও তার শ্বশুরের মতই মিনার নির্মাণের খরচ নির্বাহ করে লুটের অর্থ দিয়ে আর শ্রমের জন্য তো যুদ্ধবন্দী দাস শ্রমিক ছিলই। দিল্লী, গুজরাটের আশেপাশের ২৭টি হিন্দু এবং জৈন মন্দির এবং রাজপ্রাসাদ থেকে লুট করা রত্নপাথর বিকৃতি ঘটিয়ে বা গলিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা হয় কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজে। ক্ষেত্র বিশেষে লুটের চিহ্ন গোপন করতে মূল্যবান পাথর, মার্বেল শ্লেটকে উলটে বা গাঁথুনির ভিতরে ব্যবহার করা হয়। প্রায় ১৫০ বছর পরে মরক্কোর মুসলিম পর্যটক তার ভ্রমণকাহিনীতে কুতুব মিনার এবং ক্বুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “কুতুব মিনারের পেঁচানো সিঁড়ি এতটাই প্রশস্ত যে একটা হাতি পর্যন্ত অনায়াসে উপরে উঠে যেতে পারবে। ইবনে বতুতার ক্বুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদের পর্যবেক্ষণ বেশ আকর্ষণীয়, তিনি লিখেছেন, “মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথে রয়েছে পাথরের সাথে আটকানো দুটি বিশাল পিতলের মূর্তি, মসজিদে যারা আসে যায় তাদেরকে প্রতিবার পিতলের মূর্তি অতিক্রম করে যেতে হয় এবং সবার নজরে পড়ে। মসজিদের অন্যপাশেই রয়েছে একটা মূর্তির ঘর, বোঝা যাচ্ছে কিছুদিন আগেও এটা মন্দির ছিল। দিল্লী জয়ের পর কুতুব উদ্দিন আইবেক মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তর করলেও মূর্তি বেরিয়ে পড়েছে।” ২৭টি মন্দির লুট করে পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়, সেটা দিয়েই মসজিদের নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয় এবং খোদাই করে ভারত বিজয়ের তারিখ আর বিজয়ীর নাম লেখা হয় মসজিদের পূর্বদিকের দরজায়। মন্দিরের মার্বেল শ্লেট, উল্টো করে গাঁথুনির প্রসঙ্গে ইতিহাসের অধ্যাপক Abu Mohammd Habibullah বলেন, এটা সুপরিকল্পিত না হলেও পুরো স্থাপত্যের মধ্যে মামলুকদের বিজয় ও শাসনের প্রতীক ফুটে উঠেছে।

মুইজ উদ্দিন মুহম্মদ ঘুরির সেনাপ্রধান কুতুব উদ্দিন আইবেক ১১৯১ সালে দিল্লী দখল করার পরে পৃথ্বীরাজ চৌহানের দুর্গ ‘রাই পিথোরা’কে মসজিদে রূপান্তর করে। দুর্গের ভিতরের মন্দির থেকে সব মূর্তি অপসারণ করা হয়। মন্দিরের ভিতরে, দেয়ালে, দরজায়, পিলারে যেসব দেবদেবীর টেরাকোটা, মূর্তি খোদাই করা ছিল সেগুলো শাবল দিয়ে খুঁচে তুলে ফেলা হয়। কিছুটা বিকৃত হয়ে গেলেও মন্দিরের মূল কাঠামো এখনো কোনভাবে টিকে আছে।

১১৯৫ সালে গুজরাটের একটা ছোট রাজ্য সোলাংকির রাজা ভীমকে আক্রমণ করে তার রাজ্য দখলে নেয় কুতুব উদ্দিন। সোলাংকি থেকে ২০ হাজার যুদ্ধবন্দী লাভ করে আইবেকের সেনাবাহিনী। সোলাংকির মন্দির গুড়িয়ে দিয়ে, মূর্তি ভেঙে দিয়ে সেখানেও মসজিদ স্থাপন করা হয়। হাসান নিজামি লিখেছেন, “সেনাবাহিনী আটককৃত বন্দীদের উদ্দেশ্যে বলে, মূর্তিপূজা বন্ধ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। কালিঞ্জারের ৫০ হাজার বন্দীদেরকে দাস বানিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়, ফলে গুজরাট, কালিঞ্জার এলাকায় দ্রুত বেড়ে যায় মুসলিম জনসংখ্যা।”
আলি ইবনে আল-আসির (Ali ibn al-Athir) তার Al-Kāmil fī al-tārīkh ইংরেজিতে অনুদিত (The Complete History) ইতিহাস বইতে লিখেছেন, “কুতুব উদ্দিন আইবেক হিন্দ (ভারতের) রাজ্যগুলোর উপর সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সে হত্যা করেছে প্রচুর, সে রাজ্যগুলোকে দখল করে প্রতিবার ফিরে এসেছে অসংখ্য যুদ্ধবন্দী আর বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তি নিয়ে বিজয়ীর বেশে। সে বেনারসে অগণিত হিন্দুকে জবাই করেছে, নারী ও শিশু ছাড়া ১৬ বছরের উপর কেউ রেহাই পায় নাই। যথারীতি নারী ও শিশুরা হয়ে গেছে দাসী-বান্দি, কারো কারো স্থান হয়েছে হারেমে।”

কিশোরী লাল শরণ Muslim slave system in medieval India বইতে কলিকাতা এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক Abu Mohammd Habibullah’র The Foundation of Muslim Rule in India বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “মুহম্মদ ঘুরির নেতৃত্বে তার সেনাপ্রধান কুতুব উদ্দিন আইবেক ঝিলাম নদীর তীরবর্তী পাথুরের লবনাক্ত এলাকার খোখারস জনপদের উপর হামলা চালায়। অতর্কিত হামলা করে সেখানে তারা পুরুষদের হত্যা করে, জনপদ লুট করে অনেক সাধারণ মানুষকে বন্দী করে নিয়ে আসে।” মামলুক সাম্রাজ্যে এত দাসী হয়ে যায় যে প্রতিটি তুর্কির বাড়িতে রাতের খাবার পরিবেশন করার জন্য পাঁচজন দাসী চলে আসত। যুদ্ধবন্দী হিসেবে প্রচুর স্থানীয় মানুষকে খোরাসানে বেচে দেয় তারা, ফলে যুদ্ধ হয়ে ওঠে নতুন ব্যবসা”।

কুতুব উদ্দিন আইবেকের জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ ১২৩৩ সালে মালভা এবং উজ্জয়নি দখল করে মহাকাল মন্দিরটি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। সেখান থেকে রাজা বিক্রমজিতের ভাস্কর্য টানতে টানতে দিল্লীর মসজিদের সামনে নিয়ে আসে ভাঙচুর ও পদদলিত করার জন্য, ইতিহাস বইতে লেখা আছে মসজিদ-ই-আদিনা এবং দিল্লীর জামে মসজিদের নাম।

বেঁচে থাকা হিন্দুদের পড়ালেখা শেখার জন্য অবশিষ্ট ছিল না কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তারা দীর্ঘ দিন থেকে গেছে শিক্ষার আলোকের বাইরে। যেহেতু মন্দিরগুলোর আশেপাশেই ছিল সংস্কৃত পাঠশালা, টোল, আশ্রম সেহেতু পণ্ডিতদের কপাল পুড়েছে সবার আগে।

রেফারেন্স:
1. Dr. Murray Titus quoted from B.R. Ambedkar, Pakistan or The Partition of India (1946)

2. Lal, K. S. (1994). Muslim slave system in medieval India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 8 and 10 (quoting A.B.M. Habibullah, The Foundation of Muslim Rule in India)

3. Lal, K. S. (1992). The legacy of Muslim rule in India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 7 (quoting Kamil-ut-Tawarikh, E and D, II, p. 250-1; Tarikh-i-Fakhruddin Mubarak Shah, p. 20.)

4. About antiquities of Delhi. Syed Ahmed Khan, Translated from the Urdu of Asaru’s-Sanadid, edited by Khaleeq Anjum, New Delhi, 1990. Vol. I, p. 305-16

5. Ibn Asir, Kamil-ut-Tawarikh, E.D., II, 250. quoted from Lal, K. S. (1994). Muslim slave system in medieval India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 5

6. Hasan Nizami, Taj-u-Maasir, E.D., II, 231. Farishtah, I, 62. quoted from Lal, K. S. (1994). Muslim slave system in medieval India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 5

7. Quoted from Lal, K. S. (1999). Theory and practice of Muslim state in India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 5 (quoting Gordon Sanderson, ‘Archaeology at the Qutb’, Archaeological Survey of India Report, 1912-13; Ibn Battutah)

8. Hasan Nizami, quoted from Goel, Sita Ram (2001). The story of Islamic imperialism in India. ISBN 9788185990231 Ch. 6

9. Shajara-yi ansāb by Fakhr-i Mudabbir,

10. The History of Civilization by Will Durant

11. The Foundation of Muslim Rule in India by Abu Mohammd Habibullah.