চলে গেলেন একুশে পদক প্রাপ্ত দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আজয় রায়।

অনাড়ম্বর জীবনাচারে বিশ্বাসী মানুষটি ছিলেন বর্নাঢ্য গুনের অধিকারী।ছিলেন একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, পদার্থ বিজ্ঞানের নামকরা অধ্যাপক, মানবাধিকার কর্মী, লেখক, সম্পাদক (বিজ্ঞান, মুক্তচিন্তার ত্রৈমাসিক পত্রিকা মুক্তান্বেষার তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক)। ছাত্র অবস্থায় বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন।গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ এবং আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী অজয় রায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

বন্ধু অভিজিৎ রায়ের বাবা হিসেবে তাঁকে সর্বপ্রথম চিনি ২০০১ সালে।পরে তাঁর সম্পর্কে আর ও অনেক কিছু জানি।

মুক্তমনা ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেতিনি ছিলেন সম্পাদক ও উপদেষ্টা পরিষদের তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। মুক্তমনা সীমিত সামর্থ্য এবং জনবল নিয়ে বাংলাদেশে মাঠ নির্ভর যে কয়টি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল সেগুলি তিনি এবং তাঁর তরুণ কর্মী বাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে সম্ভব হয়েছিল।

মনে পড়ছে ২০০৪ সালের প্রবল বন্যার তোপে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়। মুক্তমনার সদস্যরা কিছু টাকা (প্রায় সাত হাজার ডলারের মত) চাঁদা তুললাম।ঠিক কি ভাবে এটা কাজে লাগালে মানুষের উপকার হয় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম। অধ্যাপক অজয় রায় প্রস্তাব রাখলেন উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত রৌমারী এলাকায় একটি প্রাইমারী স্কুল বন্যায় পুরা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে।মুক্তমনা এবং শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ এটি পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিক।চমৎকার প্রস্তাব, সবাই রাজী। এই না হলে তিনি শিক্ষাবিদ! আমরা বলাবলি করলাম।

সত্তর ছুঁই ছুঁই করছে বয়স। কিন্তু প্রাণ শক্তির অভাব নেই।রাজধানী ঢাকা থেকে কয়েক শ’ মাইল গাড়ি, নৌকা আর ট্রলারে করে পাড়ি দিয়ে দুর্গম রৌমারীতে পৌঁছাতেন তিনি আর তাঁর টিম।। কাজের প্রগ্রেস আর স্কুলের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের খোঁজখবর নিতেন। ছবি সহ ডীটেইলস পাঠাতেন আমাদের। আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই রিপোর্ট পড়তাম। পাঠকের জন্য রিপোর্টটির লিঙ্ক দিচ্ছি এখানে


Pic: Dr. Ajoy Roy among the school children

একাত্তরের নির্ভীক যোদ্ধা ছিলেন তিনি। দেশের প্রতি দায় কোন সিজনাল ব্যাপার নয়।সে জন্য সদা সোচ্চার, সরব ছিলেন কূপমন্ডুকতা আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। তীব্র প্রতিবাদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন যখন দেশে সংখালঘু সম্প্রদায় (হিন্দু, আহমদিয়া, বৌদ্ধ, খৃস্টান ) এর উপর স্বার্থান্বেষী সখ্যাগুরুদের অত্যাচারের খড়গ নেমে এসেছে।

প্রতিবাদ করেছেন বিজ্ঞান মনষ্ক আর মুক্তচিন্তার মানুষদের উপর ধর্মান্ধদের নৃশংস আক্রমণের বিরুদ্ধে। তসলিমা নাসরিন এর মত প্রকাশের স্বাধীনতার সমর্থনে কলম ধরেছেন, আবার অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের উপর ধর্মান্ধরা হামলা চালালে লিখেছিলেন, কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে। (তাঁর সে সময়কার অনেক লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।)

সমালোচনা করেছেন আওয়ামীলীগের হেফাজত প্রীতির। (হেফাজতে ইসলামের চাওয়া অনুযায়ী সরকার পাঠ্যবইয়ে ‘সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন’ আনলে আজয় রায় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে, এ ভাবে চলতে থাকলে একদিন আপনাকে ও বোরকা পরতে হবে। )

বিজ্ঞান মনষ্কতা, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ আর সব লিঙ্গের সমাধিকার দাবিতে সোচ্চার তরুণ ব্লগার, লেখক, মুক্তমনার মূল প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বাবা ছিলেন তিনি।

২০১৫ সালে বই মেলায় মাত্র বিয়াল্লিশ বয়সে অভিজিৎ ঘাতকের চাপাতির আঘাতে নিহত হয়। কিছু দিনের মধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল, যারা তাঁকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, তারা আসলে তাঁকে চির অমর বানিয়ে দিয়েছে।

ছেলের অকাল প্রয়াণে শোকাগ্রস্ত হয়েছেন অধ্যাপক অজয় রায়। তবু কাউকে বুঝতে দিতেন না। মৌলবাদীরা তাঁকে ও হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু নির্ভীক আর দৃঢ় কণ্ঠে দাবী জানিয়েছেন সরকারের কাছে অভিজিৎ সহ মৌলবাদীদের হাতে নিহত অন্যান্য ব্লগার-এক্টিভিস্টদের হত্যার বিচারের দাবিতে।

পরিণত বয়সে মারা গিয়েছেন অধ্যাপক অজয় রায়। সে জন্য দুঃখ নেই।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই, পুত্র হত্যার বিচার চাইতে বিরাশী বছর বয়সে অসুস্থ শরীরে হুইল চেয়ারে করে কোর্টে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয়েছে তাঁকে চার বছর ধরে। তবু ও জেনে যাননি নিশ্চিত করে এ দেশে অভিজিৎ এর খুনিদের বিচার আদৌ হবে কি- না।

চৌদ্দ বছর পর ২০১৪ সালে দেশে গিয়েছিলাম। অভিজিতের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অফিসে দেখা করতে যাই।

ছোটবেলায় গুরুজনদের কদমবুচি করতাম। বড় হয়ে বুঝলাম পা ছুঁয়ে সালাম বা কদমবুচি এক এধরনের কুসংস্কার। অধ্যাপক অজয় রায়কে কদমবুচি করব ঠিক করলাম।চরণ ছুঁতে গিয়ে মনে হল নির্মল আত্নতৃপ্তির জন্য দু’ একটা কু সংস্কার জীবনে রাখা বোধ হয় জরুরী। সে সময় অজয় রায় কে নিয়ে আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম।

অভিজিৎ মারা যাবার পরে অধ্যাপক রায়কে একবার কল দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম চিন্তে পারবেন কি না, কিন্তু ঠিক পেরেছিলেন। তাঁর মত দৃঢ়, চিত্তের মানুষকে আমি আর কি শান্তনার বানী শোনাব! বললাম অভিজিৎ এখন সারা পৃথিবীতে ফ্রি থিঙ্কারদের কাছে পরিচিত একটি নাম। তিনি চুপ করে শুনলেন। টুক টাক কিছু কথা হল।

“গণতান্ত্রিক, স্বাধীন দেশ আমাদের। কেবল স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য কেউ কাউকে প্রাণে মেরে ফেলবে!” কাঁপা কাঁপা, ভারী স্বরে করে আস্তে আস্তে কথা কয়েকটি বললেন।

আজ অবধি সে কথার যুতসই কোন উত্তর খুঁজে পাইনি।