[এই ক্ষুদ্র লেখাটি লিখতে গিয়ে ডঃ অভিজিৎ রায়ের কথা বড়ই মনে পড়ছে। অভিজিতের কাছে এই লেখাটির একটি বিশেষ মূল্য থাকতো, কারণ এরকম একটি লেখা মুক্তমনায় তিনি লিখেছিলেন ২০১০ সালের দিকে। ওর সেই লেখা ধরেই আমিও একটা লেখা লিখেছিলাম মুক্তমনায়। আমি এই লেখাটি বিনম্র চিত্তে অভিজিতকেই উৎসর্গ করতে চাই।]

আমার মা মৃত্যুর আগের প্রায় সাতদিন মরণ-বেষ্টনীর এপাশে-ওপাশে অবস্থান করতো। ভেতরে ঢুকলেই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতো। ক্ষণিক পরে বাইরে এসেই আবার স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতো। এটাকে সহজ করার জন্য অনেকে Simply Hallucination নামে হালকা করে দেখতে পারেন। কিন্তু এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অবশ্যই থাকবে। বয়সের ভারে জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হতে থাকে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা সেল গুলো অকেজো হতে থাকে। পার্শবর্তী অনেক সচল সেল অকেজো সেল গুলোর দায়িত্ব নিলে মস্তিষ্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। অথবা সেল গুলোতে সাময়িক রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হলে সেলগুলো থেকে ভুল তথ্য আসে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রে। তখনই কম্পিউটারের Arithmetic and Logic Unitএর মত মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র ভুল তথ্যের উপর ভুল Output দিয়ে থাকে। তাই মায়ের মুখ দিয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বেরিয়ে আসে। – এটা একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। মস্তিষ্ক বিজ্ঞানীরাই বলতে পারবে আসলে কী ঘটে মস্তিষ্কে। তবে মনে হয়ে সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়ার মত বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এখনও হয় নাই।

অনেকেই ব্যাপারটাকে মরন-প্রান্তিক অভিজ্ঞতার জটিল বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। ২০১০ সালের দিকে মুক্তমনায় ডঃ অভিজিৎ রায় এমনি একটা লেখা লিখেছিলেন। নাম ছিলো, “আত্মা নিয়ে ইতং বিতং”। আমার ভালোই মনে আছে। কারণ এই লেখাটা পড়ে আমি “আমার মরণ-প্রান্তিক অভিজ্ঞতা” নামে একটা লেখা লিখি মুক্তমনায়। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে একটা নির্ঘাত মৃত্যু থেকে বেঁচে যাই। মনে পড়লে এখনও আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠে। সাঁতরে নদী পার হতে গিয়ে ৩০ ফুট গভীর জল থেকে কীভাবে বেঁচে আসি তা কোনদিনই বলতে পারলাম না।

ডঃ অভিজিৎ রায়ের লেখাটা অনেক গবেষণা নিবন্ধ সমৃদ্ধ ছিলো। যেমন এক গবেষক আত্মা কী জিনিষ, কোথায় থাকে, মৃত্যুর সাথে এরে কী সম্পর্ক সে ব্যাপারে গবেষণা করেছেন। নিমিষেই মৃত্যু হবে এমন লোকদের ওজন মেপে বের করতে চেয়েছেন আত্মা-বিযুক্তিতে ওজনের হের ফের হয় কিনা। কোন হেরফের ধরা পড়েনি। তবে একটি কুকুরের মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন মৃত্যুর পরে কুকুরটির ওজন ২১ গ্রাম কমে গেছে। বলাবাহুল্য আত্মা নিয়ে এমত গবেষণা আমার কাছে হাস্যাস্পদ মনে হয়েছে।

১৯৯৮ সালে ক্রিকেটার শরণ লাম্বা ঢাকায় ক্রিকেট খেলতে আসেন। মাথায় বল লাগলে তিনি অদ্ভূত আচরণ শুরু করেন। ক্রিকেট ব্যাটখানা ঘাড়ে তুলে নেন এবং ধীর পদক্ষেপে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন। একটু বিশ্রাম নেন, কথা বলেন। তারপর অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা হাসপাতালে আইসিইউ তে ভর্তি করা হয়। দুদিন বাদে তার স্ত্রী আসেন লন্ডন থেকে। শরণ লাম্বার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। তিনি মারা যান।
মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু গবেষণার উল্লেখ আছে অভিজিতের লেখায়। অনেকেই নাকি টানেল আকৃতির ভিতর দিয়ে অদ্ভূত সব কিছু দেখতে পায়, যা সাধারণেরা দেখে না। কেউ কেউ আবার দূর থেকে নিজেকেই দেখে। যেমন মরণ-প্রান্তিক এক ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে থেকে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে ঘরের সিলিং এক কোণা থেকে। এরকম অদ্ভূত একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি অনেক আগে। আমি মারা গেলে আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। মিউনিসিপ্যালিটির এক ট্রাক এসে ফর্ক দিয়ে আমাকে যখন তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনই আমি ভয় পেয়ে যাই যে, ওরা আমাকে করব দিবে অথবা পুড়িয়ে ফেলবে। ভয়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো।

আমার মা বিচক্ষন মানুষ ছিলো। বৃদ্ধ বয়সেও স্মরণশক্তি, দৃষ্টি এবং শ্রবণ শক্তির কোন ঘাটতি হয়নি। বিচারবুদ্ধি সব সময়েই তার প্রখর ছিলো। অনেক জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়ে মায়ের সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে ভুল মনে হয়েছে। কিন্তু কিছু বছর পরে বুঝতে পেরেছি মায়ের সিদ্ধান্তটাই সঠিক ছিলো।
আমার মা গত ১২ বছর যাবৎ Touch Down লাইনে। কিন্তু Touch Down হচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত ২২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের বাংলাদেশ সময় অপরাহ্ন ১টা ১৫ মিনিটে আমার মায়ের দেহ সচল থেকে অচল হয়ে পরে। Touch Down হয়। সাধারণ পরিভাষায় এটাকে মৃত্যু বলা হয়ে থাকে। এই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মরণ-প্রান্তিক বেষ্টনীর ভিতরে এবং বাইরে তার অবস্থান প্রায় একসপ্তাহ কালব্যাপী। যখন তিনি বাইরে অবস্থান করছেন, তিনি স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতেন। যারা দেখতে আসতো তাদের এবং আশে-পাশের মানুষের খোজ-খবর করতেন। খেতে ইচ্ছে করছে না, ক্ষুধা লাগছে না, বা পরে খাব, ইত্যাদি। অথবা বলছেন – বাশমতি চাল নরম করে রান্না করে দাও। সাথে একটু সুখতো দিও, ইত্যাদি। বেষ্টনীর ভিতরে গেলেই অন্যরকম কথা বার্তা। ঘরে বসে কথা বলছেন, টেলিভিশন দেখছেন। যেহেতু আমি আমেরিকায় থাকি, তাই আমেরিকার সংবাদ একটু বেশী মগ্ন হয়েই দেখতেন। এর মধ্যে হঠাৎ বললেন – “ঘরের ভিতরে এত লাল পিঁপড়া কোথা থেকে এলো?” আমার সব চেয়ে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মিনুকে তখনই বললো – “মিনু, আগে এসব পরিষ্কার করো।“ কখনও তার চোখে পড়লো বন-জঙ্গল। “মিনু, আমি কোথায় এলাম? এখানে এত জঙ্গল কেনো!”
মৃত্যুর আগের দিন তার মনে হলো তিনি বাড়ীতে নেই। অন্য কোথাও। কাজেই বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হলেন। বাড়িতে প্রচুর লোক। এসেছে মায়ের মৃত্যু দেখার জন্য। পাশের গ্রাম থেকে আমার মাসতুত দাদা, রামেশ্বর এসেছিলো। মা স্বস্তি পেয়ে বললো – “ভালোই হলো, আমি তাহলে রামেশ্বরের সাথেই বাড়ি চলে যাই।”

২২ শে অক্টোবরের ব্যাপারটা অন্য রকম। তিনি বুঝে গেছেন – হাতে সময় বেশী নাই। তারহুড়া বেশীই করলেন। মৃত্যুর সময় জলপিপাসা পায়। গলা শুকিয়ে আসে। মুখে জল দেওয়াটা একটা রিচ্যুয়্যালের সৃষ্টি হয়েছে – মৃত্যুর আগে গঙ্গাজল দিতে হয়। মৃত্যু পথ যাত্রী জল না চাইলেও নিকটজনেরা মুখে একক ফোটা – দুফোটা করে জল দিবেই দিবে। আমরা দেশের বাইরে থাকি। সেটা তার খেয়াল আছে। মুখে জল দিতে না পারলে পরে আমরা কষ্ট পাবো ভেবে মা মিনু ডেকে বললো – “এক গ্লাস জল আর একটা চামচ আনো। আমার মুখে নিপ্যার (আমার ডাক নাম) নামে এক চামচ জল দাও।“ খেয়ে বললো – “মিনুর (আমার স্ত্রীর নামও মিনু) নামে দাও।“ তারপর বললেন – “এখন ইয়েন (আমার মেয়ে)এবং শৈবালের নামে দাও।”
এদের নামে জল খাওয়ার পরে বললেনন – “ইয়েনের স্বামী আর শৈবালের স্ত্রীর নামে তো দিলে না! ওদের নামেও দাও।“ মা ইয়েনের স্বামী এবং শৈবালের স্ত্রীকে দেখে নাই। কিন্তু এই ক্রান্তিকালে তাদের কথাও মনে আছে। তারপর বললেন – “নিপ্যার নাতি-নাতনীর নামেও দাও।”
সবার নামে জল খাওয়ার পরেই বাড়ি যাওয়ার জন্য ত্বারা দেওয়া শুরু হলো। মৃত্যুর মূহুর্ত ঘনিয়ে এসেছে এরকম একটি উপলদ্ধি বা চেতনার (বায়োকেমিক্যাল রিয়্যাকশন) সৃষ্টি হয়ে গেছে মায়ের অবচেতন মনে। মিনুকে ডেকে বললো – “মিনু, আমাকে স্নান করিয়ে দাও। রামেশ্বরের হাতে সময় নাই।”

মিনু তখন অন্য একটা কাজে ব্যস্ত। মা বললো – “হাতের কাজটা পরেও করতে পারবে। এখনই চলে যাবে। আমি তার সাথেই যাই।“ মিনু আর আমার ভাইঝির কাঁধে ভর করে মা হেটে ঘর থেকে দুয়ারে এসে একটা মোড়ায় বসলো। চারিধারে লোক। মায়ের মৃত্যু দেখতে জড়ো হয়েছে। নলকূপ থেকে বালতিতে জল এনে মিনু মায়ের মাথায় ঢাললো। মা নিজের হাত দিয়ে মাথা থেকে জল সরিয়ে দিলো বার বার।
ঘরে মেঝেতে বিছানা পাতা ছিলো। মা দুজনের কাঁধে হাত রেখে হেটে ঘরে ঢুকলো। বিছানার মাঝখানে বসলো। মাকে দেখতে বড়ই স্নিগ্ধ এবং মনোরম দেখালো। সামনে তাকালো। ডানে-বামে তাকালো। ঘরের ভিতরে এবং বাইরে মানুষের ভীড়। প্রত্যেকের দৃষ্টি মায়ের উপর। একসময় মায়ের মাথাটা ডানদিকে একটু কাত হলো। মিনু ‘মা’, ‘মা’ করে কয়েকবার ডাকলো। মা কোন উত্তর দিলো না। সবাই শংকিত হলো। একসাথে সবাই চেচিয়ে উঠলো – “ওনি চলে যাচ্ছেন। ধরো ধরো, বিছানায় শুইয়ে দাও।“ সবাই মাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমার ছোট দুই ভাই এবং ওদের স্ত্রীরা ‘মা, মা’ করে ডাকলো। দুই নাতিন ডাকলো – ঠাকমা, ঠাকমা। মা সারা দিলো না।

বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জীবজগৎ বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া (Biochemical process) দিয়েই জীবনের সূত্রপাত। প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগতের জৈব প্রক্রিয়ার বিবর্তন হচ্ছে। একটি জীবনের শুরু জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া দিয়ে। যতদিন এই প্রক্রিয়া চলে, জীবন চলমান থাকে ততদিন। এই প্রক্রিয়ার একটি উপাদান বাতাসের অক্সিজেন। শ্বাস নালী দিয়ে অক্সিজেন রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে। রক্ত অক্সিজেনকে শরীরের প্রতিটি অংশে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যায়ে জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া চলছে শরীরের প্রতিটি অংশে, সারাক্ষণ। শরীরে শক্তি সংযোগ হচ্ছে। শরীর থাকছে চলমান। হৃদযন্ত্র একটা রেসিপ্রোকেটিং পাম্প। আমার মায়ের হৃদ-যন্ত্রটি প্রায় ৮৮ বছরের পুরাতন। চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেলো। অক্সিজেন ঢোকা বন্ধ হয়ে গেলো। বন্ধ হলো জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া। বন্ধ হলো শক্তি সরবরাহ। মা শক্তিশুণ্য হয়ে পড়লো। ঘাড় কাত হলো। পুত্রবধুদের ডাকে সাড়া দিলো না। ছেলেদের, নাতনীদের ডাক মায়ের শরীরের অসার কোন বায়োকেমিক্যাল সিস্টেম গ্রহন করলো না। ব্যাপারটা বুঝতে চাইলে সহজেই বুঝা যায়। কিন্তু পুরণো ধ্যান-ধারণা মাথায় চেপে থাকলে এটা বুঝা যাবে না। বুঝানোও যাবে না।

আমার মায়ের মরণ-বেষ্টনীর বিষয়টা নিয়ে একমাত্র অভিজিতের সাথেই আলাপ করতে পারতাম। অভিজিৎ মনোযাগ দিয়ে শুনতো। শুধু তাই না অনেক প্রশ্ন করতো। হয়তো আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মিনুর সাথেও কথা বলতে চাইতো। তারপর আরও কিছু গবেষণা পত্র ঘেটে দেখতো। একটা গবেষণামূলক লেখা লিখতো। এমনও হতে পারতো – বিষয়টা নিয়ে পড়তে পড়তে একটা বিজ্ঞান-ভিত্তিক বই লিখে ফেলতো। অভিজিতের কাছে এটা নতুন কিছু নয়।

আমার নিকট জনেরা জানে আমি মায়ের জন্য শ্রাদ্ধ করবো না। তবু আউট অব কিউরিওসিটি তা্রা প্রশ্ন করেছে। আমার উত্তর কী হবে তা জেনেই তারা সহজভাবেই নিয়েছে। কিন্তু আমার ভাইজি, চিনু রায়, কষ্ট পেয়েছে। বলেছে – “আমার কাকাডা-না, ভালো! আমার মাত্র একটা কথা রাখো! তুমি একবার মন্দিরে যাইও। পুরোহিত যা কয়, এট্টু হুইনো।

আমি বলেছি – তোরা আমার মাকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছিস। মায়ের আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। ছাই বাতাসে মিলে গেছে। আর আত্মা!। আত্মা বলে কোনদিন কিছু ছিলো না। জীবের কোন আত্মা থাকে না। কাজেই আত্মা-ফাত্মা কোন কিছুই ভগবানের কাছে পৌছুবে না। আত্মার মত ভগবানেরও কোন অস্তিত্ব নাই। মাকে পুড়িয়ে দিয়েছিস, শেষ করে দিয়েছিস, মা মহাবিশ্বের অসীমে হারিয়ে গেছে। বাস্‌, সব শেষ। এখন শুধুই স্মৃতি। আমারদের স্মৃতিতে মা কিছুদিন থাকবে। তারপর সেটাও আমাদের মগজ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

স্মৃতি থাকে মগজে। মগজ হলো কমপিউটারের মেমোরির মত। অথবা বলা যায়, কম্পিউটার আমাদের মগজের অনুকরণেই ডিজাইন করা হয়েছে। আসলে তাই কিন্তু। আমরা অনেক কিছুই মনে রাখি, অনেককেই মনে রাখি। রিফ্রেস না করলে ভুলে যাই। এসব স্মৃতি থাকে মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশে। সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে নিয়ন্ত্রন বিষয়ক কেন্দ্র। গাছ-গাছালিতেও তাই হয়। কম্পিউটারের বেলায় এটাকে বলা হয় Arithmetic and Logic Unit (ALU). আমাদের পঞ্চ বা তার অধিক সক্রিয় ইন্দ্রিয় বায়োকেমিক্যাল প্রসেস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, রাগ-অভিমান, দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না শরীরে অবিরত ঘটমান বায়োকেমিক্যাল প্রক্রিয়ারই ফসল বা রেজাল্ট। বায়োকেমিক্যাল প্রক্রিয়া বন্ধ হলেই সব কিছু বন্ধ চিরদিনের জন্য। আমার মায়ের জন্য সাত দিন চলে বন্ধ হতে যাওয়া প্রসেস। হৃদ যন্ত্র ফ্যাইনালী যখন বন্ধ হলো, মা মাথাটা আর ধরে রাখতে পারলো না। কারও ডাকাডাকিতে সাড়া দিতে পারলো না।

মিনু মরণ-বেষ্টনীর কাছে থাকা মায়ের কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলো। স্নান করলো, মরণের জন্য তৈরী হয়েই মারা গেলো, মরণ-সময়ে কোন কষ্টই করলো না। মিনু বলছিলো – “মা অনেক ভাগ্যবতী ছিলো।” আমি বললাম – হ্যা, মা অবশ্যই ভাগ্যবতী ছিলো। ভাগ্যবতী ছিলো বলেই তোমার মত এত ভালো পুত্রবধু পেয়েছিলো। তুমি যে সেবা-শুশ্রষা করেছো, তা এযুগে কেউ করেনা। আমার মাকে দেখেছি তার শাশুড়ীকে (আমার ঠাকুরমা) এরকম সেবা-যত্ন করতে। আত্মীয়-অনাত্মীয় সবার জন্যই আমার মায়ের হাতটা বরাবরই বাড়ানো ছিলো। অনেক ঘটনাই মনে পড়ে।
মিনু যে সেবা-যত্ন করেছে তা একটা উদাহরণ। দূর থেকে আমার পরিচিত এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুখে অনেক বছর যাবৎ এই কথাটাই শুনে আসছি। এবং এই গর্ববোধটা নিয়েই ছিলাম – শেষ জীবনে এসে মায়ের কোন কষ্টই থাকবে না। এটা সত্যে পরিনত হলো। It was a very pleasant death. She remembered all even those who live away from home. Minutes before her Touch Down she took her last bath, entered her room, sat on her bed, let her heart stop pumping blood anymore, leaned gracefully to one side. Inside and outside of her room everybody watched her die peacefully and gracefully. She died a brilliant and gorgeous death. এসব শুনে মায়ের মৃত্যুতে আমার আনন্দের সীমা থাকে না। গর্বে আমার বুক স্ফীত হয়ে উঠে। মা যে এত মহান ছিলো আগে বুঝিনি। আমার অ,আ, সময়কার বন্ধু খালেক বলছিলো – ‘আমার নিজের মায়ের কথা মনে নেই। খুড়িকে আমি মায়ের মতই পেয়েছিলাম।’ মা খুবই সদালাপী ছিলো। আমার সহপাঠী নিতাই আর দুলাল তাদের বাড়ি যাওয়া-আসার পথে নিয়ত মায়ের সাথে দেখা করে যেতো। আমার মেয়ের বর অবাঙ্গালী। স্কাইপে একবার কথা হয়েছে। গতকাল ওরা এসেছিলো। আমি জামাইকে জিজ্ঞেস করলাম – তুমি কি মায়ের কোন কথা বুঝেছিলে? নাত-জামাইএর চেহারা এবং হাসি দেখে মার কী আনন্দ! আমি বলেছিলাম – “তুমি নাত-জামাইএর কোন কথা বুঝতে পেরেছিলে!” মায়ের উত্তর ছিলো – “আমি সব বুঝেছি।“ অসীম আনন্দ, উত্তেজনা, আবেগ এবং বুদ্ধিমত্তা থাকলেই একজন কিছু না বুঝেও বলতে পারে আমি সব বুঝেছি। মা ছেলেটির অন্তরে ঢুকে গিয়েছিলো।

শ্বেত-সুভ্র কাপড় পড়ে আমার মা একাকী হেটে হেটে মহাবিশ্বের অসীমে মিলিয়ে গেলো।