প্রথম পর্ব: মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু আক্রমণ
পর্ব তিন: মুহম্মদ ঘুরীর দিল্লী দখল
পর্ব চার: কুতুব উদ্দিন আইবেকের শাসনামলের শুরু; হত্যা, দাসত্ব এবং মন্দির ধ্বংসের মাত্রা

শত শত বছর ধরে হিন্দুরা গণহত্যার শিকার হলেও আশ্চর্যের বিষয় হলো বেশীরভাগ হিন্দুই গণহত্যার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয় এবং কোন মানবাধিকার সংস্থাও এগিয়ে আসেনি হিন্দুদের গণহত্যার প্রতিবাদ করতে, দেয়নি পত্রিকায় দুই লাইনের বিবৃতি। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোন হিন্দুর সম্পত্তি দখল হয়ে যাচ্ছে, বাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, পরিবারের যুবক ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, সংসারের হাল ধরা ব্যক্তিটি খুন হয়ে যাচ্ছে, বাড়ির মেয়েকে তুলে নিয়ে জোর করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করছে, মা মেয়ে, ঘরের বউ ধর্ষিত হচ্ছে কিন্তু হিন্দুরা যাপন করে যাচ্ছে প্রতিদিনের সেই আটপৌরে স্বাভাবিক জীবন। প্রতিবেশীর মেয়ে ধর্ষিত হলেও তাদের কিছু যায় আসে না কারণ তার কাছে স্বস্তি তার নিজের পরিবারে তো আর এমনটা ঘটেনি! হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক কিশোরী শরণ লাল Theory and Practice of Muslim State in India বইতে দাবী করেন, ১০০০ সালে এখানের অধিবাসীর সংখ্যা ছিল ২০০ মিলিয়ন সেখানে ১৫০০ সালের জনসংখ্যা কমে গিয়ে ১৭০ মিলিয়নে পরিণত হয়। In Growth of Muslim Population in Medieval India বইতে ইতিহাসবিদ কিশোরী শরণ লাল লিখেছেন মুঘল আমলের যুদ্ধ, হত্যা, নির্বাসন, স্থানীয় অধিবাসীদের ব্যাপক দেশান্তর, দুর্ভিক্ষে তারা সংখ্যায় কমে গেছে। কিশোরী শরণ লালের বইকে অবশ্য সমালোচনা করেছেন প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইরফান হাবিব এবং তাকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক’র মুখপাত্র বলে অভিযোগ করেন। সমালোচনার জবাবে শরণ লাল বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের আক্রমণের কারণে ১০০০ থেকে ১৫২৫ সালের মধ্যে ৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু মাহমুদ গজনীর একার আক্রমণেই ২ মিলিয়ন হিন্দু নিহত হয়েছে। উইল ডুরান্ট ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের আক্রমণ এবং রাজ্যপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায় বলে চিহ্নিত করলেও তার সমসাময়িক ইতিহাসবিদগণ তার দাবীকে অগ্রাহ্য করেন।

হিন্দু গণহত্যার প্রেক্ষাপটকে আলোচনার সুবিধার্থে চারটা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে:
১। হিন্দু ধর্ম গ্রহণে অস্বীকার করার কারণে মুসলিম শাসকেরা হিন্দুদের হত্যা করে
২। হিন্দু রাজ্য দখলের সময় হিন্দু হত্যা
৩। দেশবিভাগের সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং গণহত্যা
৪। হিন্দুদের উপর চলমান সমসাময়িক আক্রমণ, অত্যাচার, নিপীড়ন।

ভারতীয় উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল তখনকার সময়ে বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব শিক্ষার তীর্থস্থান। মন্দির এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, পণ্ডিতদের খুন হয়ে যাওয়া আর ছাত্রদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার কারণে তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, বিরাট একটা প্রজন্ম থেকে যায় শিক্ষার আড়ালে। অর্থ এবং রাজার আনুকূল্যের অভাব, মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির প্রতিকূল পরিবেশে মুখ থুবড়ে পড়ল বিজ্ঞান চর্চা। সংস্কৃত ভাষা, বৈদিক দর্শন, গণিত ও বিজ্ঞান চর্চা প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে যায়। মুসলিম শাসনামলের শিক্ষার চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পণ্ডিতদের টোলভিত্তিক শিক্ষা চলছিল নিভুনিভু। এই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে মোঘল সম্রাট আকবর এগিয়ে আসেন। সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণদের তত্ত্বাবধানে উচ্চবর্ণের পড়াশোনা পূজাপার্বণ, ব্যাকরণ, ধর্মশাস্ত্র পর্যন্ত উন্নিত হলেও নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং বৌদ্ধরা রয়ে গেল অশিক্ষার অন্ধকারে। আকবরের অসাম্প্রদায়িক রাজ্যপরিচালনার মধ্যেও কিন্তু থেমে থাকেনি মন্দির ভাঙা, মন্দির দখল, দেবালয়ের মূর্তির শরীর থেকে লুটে নেয়া অলংকার। মন্দির এবং মূর্তি ভাঙার উৎসবের সময়ে উত্তর ভারতের গঙ্গা অববাহিকার হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান, দিল্লীর কোন অঞ্চলের মন্দির ভাঙা বাদ ছিল না। লুটতরাজও চলেছিল সমানতালে। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য কোন মন্দিরও গড়ে ওঠেনি। যে কয়জন মুসলিম আক্রমণকারী ভারতে আক্রমণ করেছিল তাদের মধ্যে গজনীর সুলতান মাহমুদ অন্যতম ভয়ংকর যোদ্ধা এবং লুটেরা খুনি। যদিও পাকিস্তানের পাঠ্যক্রমে, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আলোচনায় মাহমুদকে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য উল্লেখযোগ্য বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সুলতান মাহমুদ গজনী:

সুলতান মাহমুদ গজনী ১১শতকের শুরুর দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম আক্রমণ শুরু করে তখন পরাক্রমশালী রাজপুতদের ক্ষমতা পড়তে শুরু করেছে এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও চরমে। মাহমুদ প্রথমে কাবুল (বর্তমানে আফগানিস্তান), পাকিস্তান দখলে করে ভারতে প্রবেশ করে ১০০১ সালে। মুলতানে রাজা জয়পাল এবং তার ছেলে আনন্দ পাল মাহমুদের সাথে যুদ্ধ করলেও মাহমুদের দুর্বার গতির সৈন্যদলের কাছে তাদের সৈন্যদল খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। রাজপুতদের হস্তি-বাহিনীর সৈন্যদল মূলত মাহমুদের ঘোড়ায় চড়া সৈন্যদের গতির কাছেই হেরে যায়, কারণ মাহমুদের সৈন্যদলের অপ্রতিরোধ্য গতি। ১০০৯ থেকে ১০২৭ সালের মধ্যে মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে মাহমুদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আক্রমণ মাহমুদের প্রথম আক্রমণ ছিল খায়বার শহরে। সেখানে কয়েকটি দুর্গ দখল করে পছন্দের শাসকের হাতে অর্পণ করে আবার গজনীতে ফিরে যায়।

মাহমুদের দ্বিতীয় আক্রমণ ছিল ১০০১ সালে বর্তমানের পাকিস্তানের অন্তর্গত পেশোয়ারের তৎকালীন রাজা জয়পালের রাজ্যে। ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রাজা জয়পাল হেরে যায় এবং মাহমুদ জয়পালের কাছ থেকে ২,৫০,০০০ দিনার এবং ৫০টি হাতি আদায় করে। ভারতীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ স্ট্যানলি লেন পুল বলেন, “যুদ্ধে হেরে যাওয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরে জয়পাল নিজেই চিতায় আত্মাহুতি দেন।” জয়পালের স্থলাভিষিক্ত হন তার ছেলে আনন্দ পাল।
মাহমুদের তৃতীয়বার ভারত আক্রমণের সময়টা ছিল ১০০৫ সালে বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ভেরা অঞ্চলে। ভেরা তখন ছিল কাবুলের সাথে বাণিজ্যের প্রধান পথ। ভেরার রাজা বিজয় রায় বীরত্বের সাথে মাহমুদকে বাঁধা দিলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। বিজয় রায়ের সব প্রতিরোধ চূর্ণ করে মাহমুদ যখন রাজ্য দখল করে নিলো তখন অসম্মানের আত্মগ্লানিতে বিজয় রায় আত্মহত্যা করে। মাহমুদ পুরো ভেরা নগরটাকেই তছনছ করে দেয়, লুটে নেয় সব সম্পদ এবং নগরের সব প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদেরকে নির্দয়-ভাবে হত্যা করে এবং শিশু ও নারীদেরকে দাস হিসেবে গজনী এবং খোরাসানে চালান করে দেয়।

১০০৫ এবং ১০০৬ সালের মধ্যে চতুর্থ আক্রমণে সুলতান মাহমুদ মুলতান দখল করে নেয়। তখন মুলতানের শাসক ছিল একজন আরব বংশোদ্ভূত ফতেহ দাউদ এবং জয়পালের দৌহিত্র জানুজা নামের দুজন সামন্ত রাজা। যুদ্ধে হেরে গিয়ে জানুজা প্রাণ বাঁচাতে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়।

ইসলাম গ্রহণ করলে সুলতান মাহমুদের আনুগত্যে জানুজা মুলতানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পায়। মুসলিম নাম ধারণ করে আফগানিস্তানের লাংমান থেকে কাশ্মীর, শিরহিন্দ, ফতেনগর, মুলতান এবং পেশোয়ার অঞ্চলে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রাজ্য শাসন শুরু করে। একই সাথে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা দিয়ে সে ইসলাম ত্যাগ করে। জানুজার ইসলাম ত্যাগের খবর শুনে সুলতান মাহমুদ আবার তার রাজ্য আক্রমণ করে, পরাজিত করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। হত্যাকাণ্ডের তীব্রতায় প্রাণের দায়ে নব্য-মুসলিম কেউ আর ইসলাম ত্যাগের সাহস করেনি।

১০০৮ থেকে ১০০৯ সালে পরিচালিত ষষ্ঠ আক্রমণে সুলতান মাহমুদ আনন্দ পাল এবং তার মিত্রবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পর্যদুস্ত করে। আনন্দ পাল উজ্জয়নী, গোয়ালিয়র, কালিনজার, আজমিরের রাজাদের নিয়ে মিত্রবাহিনী গড়ে তোলে। ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক স্ট্যানলি পুল বলেন, আনন্দ পালের মিত্রবাহিনীর সেনাদের সংগঠিত করে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নারীরা পর্যন্ত তাদের গহনা বেচে দিয়ে আনন্দ পালকে সাহায্য করেছিল। আনন্দ পালের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে আক্রমণকারী সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, মাহমুদ প্রায় ধরাশায়ী হয়ে এসেছিল এমন মুহূর্তে হঠাৎ করে আনন্দ পালের হাতি পাগলা হয়ে যায় এবং দিক্বিদিক দৌড়াতে শুরু করে, ফলে সেনাবাহিনী ভেবে বসে তাদের রাজা বুঝি ভয়ে যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করছে। অহেতুক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ভয় দানা বাঁধতে শুরু করে আনন্দ পালের মিত্রবাহিনীর মধ্যে। বিশৃঙ্খলার মধ্যে মিত্রবাহিনীর এক সেনানায়ক পদপিষ্ট হয়ে নিহত হয়। মাহমুদ বুঝতে পারে মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাতে শুরু করেছে। এই তো সময়, মাহমুদ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করে না। সে নব উদ্যোগে মিত্রবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুইদিন ধরে মাহমুদের বাহিনী আনন্দ পালের মিত্রবাহিনীকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে এবং বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয় এবং অত্র এলাকার ধন সম্পত্তি, রত্ন সম্ভার লুটে নেয়। ১০০৯ সালে সপ্তম আক্রমণে সুলতান মাহমুদ হিমাচল প্রদেশের কাঙরা থেকে শুরু করে নেপালের নাগরকোট পর্যন্ত দখল করে নেয়। ইতিহাসবিদগণের মতে, নাগরকোট এবং কাঙরা লুট করে এত পরিমাণ মণিমাণিক্য, ধন, সম্পত্তি দখল করে নেয় যে তখনকার সময়ে মাহমুদ পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী সম্রাটে পরিণত হয়।

মাহমুদের মথুরা আক্রমণ: প্রায় সহস্রাধিক মন্দিরের সৌন্দর্যমণ্ডিত মথুরা শহরের নয়নাভিরাম দৃশ্য ভুবন বিখ্যাত। শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা হিন্দুদের কাছে পবিত্র তীর্থভূমি। মাহমুদ নিজেই মথুরার বর্ণনা লিখেছিল, “বিশ্বের সবথেকে মেধাবী একদল স্থপতি যদি ২০০ বছর ধরে হাজার হাজার রাজমিস্ত্রি নিয়ে কোটি কোটি দিনারও ব্যয় করে তবুও মথুরার মন্দিরের মত এত সুন্দর স্থাপত্য কীর্তি সৃষ্টি করতে পারবে না।” মথুরা জয় করে মাহমুদ বরাবরের মত মথুরার সব মন্দির লুট করে, মন্দিরের যাবতীয় প্রতিমা ভাংচুর করে এবং সবশেষে সবগুলো মন্দির ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। রুটিন মাফিক আক্রমণে মাহমুদ পরের বছর দ্বারকা, বারানসি, থানেশ্বর, জ্বালামুখী, মহেশ্বর দখল করে সবগুলো মন্দির লুট করে। হত্যা করে প্রতিরোধকারী সেনাবাহিনীকে।

মাহমুদের সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণ: মূলত সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণ এবং ধ্বংস করার কারণেই ইসলামের ইতিহাসে মাহমুদ মহান বীর হিসেবে চিহ্নিত। স্ট্যানলি লেন পুলের মতে, “সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের মধ্য দিয়ে মুসলিম ধর্মবিশ্বাসীদের চোখে মাহমুদ বিশাল যুদ্ধ বিজয়ী ইসলামি নায়কে পরিণত হয়”।

সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের কারণে এখনো মুসলিমদের কাছে মাহমুদ একজন ইসলাম প্রচারক বীর যোদ্ধা। পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রমে মাহমুদের ভারত আক্রমণকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়। মাহমুদ বুঝতে পেরেছিল, হাজার হাজার হিন্দু সোমনাথে পুজো দেবার সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ দক্ষিণা হিসেবে মন্দিরে দিতো। ফলে সোমনাথ মন্দির ছিল তৎকালীন সময়ে ধন-সম্পদ, সোনা, রত্নের বিশাল ভাণ্ডার। মাহমুদের ১৭তম আক্রমণ ছিল সোমনাথ মন্দিরে লুট করার উদ্দেশ্যে। রাজপুত সৈন্যবাহিনী সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও সোমনাথ মন্দিরের শেষ রক্ষা করতে পারে না। তিনদিন যুদ্ধের পর মাহমুদের বাহিনী মন্দিরে ঢুকে পড়ে, মন্দিরের সব মূর্তি এবং শিবলিঙ্গ ভেঙে ফেলে, সোনার মূর্তি, মূল্যবান পাথর, নগদ অর্থ, অলংকার যা ছিল সব নির্বিচারে লুট করে নিয়ে যায়, মূর্তি যেহেতু বিদআত তাই মাহমুদ সোনার মূর্তি গলিয়ে মাহমুদ তৎকালীন বাজার মূল্য ২ কোটি দিনার মুদ্রায় পরিণত করে। মাহমুদ সোমনাথ মন্দির লুটের সময় ৫০০০ রাজপুত সৈন্যকে মন্দিরের মধ্যেই হত্যা করে। দিল্লীর গার্গী কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক মীনাক্ষী জৈনের মতে, “মাহমুদের সোমনাথ মন্দির এতটাই ধ্বংস করে দিয়েছিল যে ১০২৫ থেকে ১০৩৮ সাল পর্যন্ত এখানে কোন তীর্থ যাত্রী আসতে পারেনি। তুর্কি-পার্সিয়ান সাহিত্যে মাহমুদের সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপিত হয়েছে।” মাহমুদের আক্রমণে সোমনাথ মন্দিরের নগরী সৌরাষ্ট্রে ৫০,০০০ মানুষের মৃতদেহের যে স্তূপ জমে উঠে তা সৎকার করার মত অবশিষ্ট লোক পর্যন্ত ছিল না।

মাহমুদের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফলাফল:
১. পাঞ্জাব গজনী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
২. রাজপুতদের দুর্বলতা, রাজ্য রক্ষার অক্ষমতা প্রকাশ পায়।
৩. মাহমুদের ভারতে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের শাসনের পথ সুগম হয়।
৪. ভারতের বিপুল পরিমাণ ধন সম্পত্তি গজনিতে পাচার হয়ে যায়।
৫. ভারতের শিল্পকলা, স্থাপত্য, বিজ্ঞানচর্চা, দার্শনিক আলোচনা, গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার পঠন পাঠন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ধ্বংস হয়ে যায় অসংখ্য মন্দির, মন্দির-ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মঠ এবং গুরু-শিষ্যের পরম্পরা শিক্ষা ব্যবস্থা।
৬. ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসারে মাহমুদের ভারতে আক্রমণের বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
৭. বারংবার আক্রমণের মুখে ভেঙে পড়েছিল ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অর্থনীতি।
৮. প্রতিটি আক্রমণে ভারত হারিয়েছিল হাজার হাজার সৈন্য। ফলে ভারত অরক্ষিত সম্পদের ভাণ্ডার। যেকেউ অতি সহজেই আক্রমণ করে লুটে নিয়ে যেতে পারত অর্থ, সম্পদ এবং বন্দী করে নিয়ে পারত নারী এবং শিশু, পরে তাদেরকে দাস হিসেবে বেচে দিতো। তৎকালীন হারেমগুলো ছিল যুদ্ধবন্দী ভারতীয় নারীদের হাহাকারের সমষ্টি।

মাহমুদের ভারত আক্রমণের কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদগণ বলেছেন মোটামুটি চারটি কারণে মাহমুদ ভারতে বারংবার আক্রমণ করেছিল।

সম্পদের লোভ: ধনসম্পত্তির প্রতি লোভ মাহমুদকে করে দুর্বিনীত, দুঃসাহসী। মাহমুদ শুনেছিল সমৃদ্ধ ভারতের কথা। সম্পদের প্রতি মাহমুদের অপরিসীম মোহ, সুতরাং সম্পদ লুট করতে সে ভারতে আক্রমণ করে। বিখ্যাত কবি ফেরদৌসির প্রতি দুর্ব্যবহারই প্রমাণ করে মাহমুদ কতটা লোভী। মাহমুদ কবি ফেরদৌসিকে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘শাহনামা’ লেখার শুরুতে প্রতিটি পঙক্তির জন্য একটা সোনার মোহর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ফেরদৌসি শাহনামা কাব্যগ্রন্থে ৬০০০ পঙক্তি লিখে প্রতিশ্রুত ৬০০০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দাবী করলে মাহমুদ স্বর্ণমুদ্রা দিতে অস্বীকার করে। স্বর্ণমুদ্রার বদলে মাহমুদ কবি ফেরদৌসিকে ৬০০০ রূপার মুদ্রা দিতে চায়, কবি এই মুদ্রা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফেরদৌসির সাথে এহেন দুর্ব্যবহারের প্রসঙ্গে শিল্প ইতিহাস আলোচক আর্নেস্ট বিনফিল্ড হাভেল যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন, “মুসলিমদের পবিত্র নগরী বাগদাদের কোন মসজিদেও যদি সোমনাথ মন্দিরের মত এত বিপুল ধনসম্পত্তি থাকত তবে হয়ত লোভের বশে মাহমুদ সেটাও আক্রমণ করত”।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারস্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল জিওগ্রাফির প্রফেসর আদম মাহমুদ হাবিব বলেন, “ভারতের মন্দিরের ধন সম্পত্তি লুণ্ঠন করাই ছিল সুলতান মাহমুদের প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, ইউরোপের কোন চার্চে তেমন আক্রমণ হয়নি, কারণ সেখানে এত ধনসম্পত্তির ছড়াছড়ি ছিল না।”

ধর্মীয় কারণ: মাহমুদের সমসাময়িক ইতিহাসবিদ আবুল হুসাইন উতবি মন্তব্য করেন, “মাহমুদের ভারত আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম প্রচার করা”। মাহমুদ ভারতের হিন্দু মন্দির এবং দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি এবং ইসলামের প্রচার প্রসার করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। উতবি মাহমুদের ভারত আক্রমণকে জিহাদ হিসেবে উপস্থাপন করেন। মাহমুদ রাজ্য শাসনের ভার গ্রহণ করেই ঘোষণা দেয়, সে প্রতি বছর একবার করে ভারত আক্রমণ করে ইসলামের রাজ্য সীমানা বৃদ্ধি করবে। যুদ্ধে হেরে যাওয়া বিধর্মীদেরকে মাহমুদ জোরপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করত, ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করলে মৃত্যু অনিবার্য। লুটের টাকা দিয়ে মাহমুদ বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে এবং রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে ইসলাম প্রসারের জন্য মাহমুদ ভারতে আক্রমণ চালায়। মনে রাখতে হবে, নতুন ধর্মান্তরিত তুর্কি যুবকদের ইসলামের প্রতি আগ্রহ তখন তুঙ্গে, ইসলাম প্রচারের জন্য তারা জান বাজি রেখে লড়ছে, কারণ বেঁচে থাকলে সুন্দরী নারী ও নগদ অর্থ আর মরে গেলে সোজা বেহেস্ত, সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ৭২ জন হুর।

রাজনৈতিক কারণ ও খ্যাতির মোহ: মাহমুদ চেয়েছিল সে হবে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা যাতে তার কথা মানুষ চিরদিন মনে রাখে। কিছু কিছু ইতিহাসবিদগণ যুক্তি দেখিয়েছেন, মাহমুদের উদ্দেশ্য ছিল ভারত বিজয় করে সেখানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু মাহমুদের ভারত আক্রমণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৭ বার সফলভাবে ভারত আক্রমণ করে বিজয় অর্জন করলেও এই অঞ্চলে স্থায়ী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি। যদিও মাহমুদ শুধু পাঞ্জাবকে গজনবী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। স্ট্যানলি লেন পুলের মতে, সেই সময় তুর্কিরা হয়ত ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসের কথা চিন্তা করেনি। বলা হয়ে থাকে, উচ্চাভিলাষী মাহমুদের মনে সুপ্ত ইচ্ছা ছিল ভারত জয় করে বীরের খ্যাতি অর্জন করবে, ইসলামের ইতিহাসে তার চিরদিন লেখা হবে শ্রদ্ধার সাথে।

খ্যাতির মোহ: মাহমুদ প্রতিবছর গ্রীষ্মকালের শুরুতে ভারত আক্রমণ শুরু করে। সুদৃশ্য ইমারতের প্রতি মাহমুদের খুব আগ্রহ ছিল বলে সে প্রতিবার আক্রমণ করে ইমারত নির্মাণের সুদক্ষ কারিগরদের খুঁজে খুঁজে বন্দী করে নিয়ে যেত। ইসলাম প্রচারের ঈমানি দায়িত্ব, সম্পদের লোভ, খ্যাতির মোহ ছাড়াও ইমারত নির্মাণের কারিগর ও দাস সংগ্রহও হতে পারে ভারত আক্রমণের অন্যতম কারণ।