লিখেছেন: জীবন

মুক্তবাজার অর্থনীতির সকল প্রকার রূপ-রস উগরে নিয়ে আমরা প্রতিদিন উন্নতি করছি। উন্নয়নের সূচক দিনদিন স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছে। আমরা সকাল বিকাল তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি এই ভেবে যে, এইতো আর কিছুদিন পরই আমরা পৌঁছে যাবো সেস্তরে যেখানে কেবল শান্তি আর শান্তি। মাঝে মধ্যে যে বদহজম হচ্ছেনা তা কিন্তু নয়। মুক্তবাজারের দাওয়াই দিয়েই তার উপশম হচ্ছে। বাণিজ্যই যখন দেশ কথা ; তখন আর যা কিছু আছে তা অতি নগন্য-তুচ্ছ। আমরা যে হাপ্পিতেশ করিনা তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যেই আমরা আয়োজন করে হাপ্পিতেশ করি। অতঃপর খেই হারিয়ে আবার বাণিজ্যের রঙিন দুনিয়াই নীল হয়ে যাই। এই যে দিশাহীন যাপিত জীবন সেখানে দেশপ্রেম-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সহনশীলতা কেবল বাহারি শব্দ। কাজেই জিপিএ ৫-ই চূড়ান্ত কথা।

আচ্ছা একটি স্বাধীনদেশে দেশপ্রেমের ধরণ কিরূপ হবে? মহান রাজনীতিক থেকে শুরু করে আমাদের কোন বুদ্ধিজীবি কি কখনো এ বিষয়ে স্বল্প বা বৃহৎ পরিসরে আলোচনার সুযোগ নিয়েছে ? কিংবা তা সংযোজিত হয়েছে কোন পর্যায়ের পাঠ্যসূচীতে? তাইতো একদল দিশাহীন মেধাবী মনে করেন কাউকে
পেটানো হচ্ছে দেশপ্রেম। যে স্টাটাস দিয়ে আবরার তাঁর দেশপ্রেমকে শানিত করার সুযোগ নিয়েছিল সেই আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করার মধ্য দিয়ে আরেকদল তাঁদের দেশপ্রেমের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছে বলেই তারা মনে করেন। যেহেতু আবরার এবং এই দলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক কোন বৈরীতা ছিলনা সেহেতু এখানে কি কারনে আবরারকে জীবন দিতে হলো তা নিয়ে কিন্তু কোন আলোচনা-পর্যালোচনা করতে দেখা গেলনা। কাজেই একটি স্বাধীন দেশে দেশপ্রেম কেবল মেরুদন্ড সোজা করে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গেয়ে যাওয়া যে নয় তা নির্ধারণে আমরা
কিন্তু দারুনভাবে ব্যর্থ হয়েছি। ফলশ্রুতিতে তৈরী হচ্ছে থতমত দিশাহীন বিকৃত দেশপ্রেমিক প্রজন্মের। সহনশীলতা-পরমতসহিঞ্চুতা-আইন মান্য করা-প্রেম-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মান যে দেশপ্রেমের অন্যতম অনুসর্গ তা কে শেখাবে ? কাজেই আবরার যে শেষ শিকার তা কিন্তু দ্বিধাহীন ভাবে বলে দেয়া যাচ্ছে না।
যে ভুলের মধ্য দিয়ে আমরা গত ৫০ বছর চলেছি এবং আগামীতে চলার প্রস্তুতি নিচ্ছি তা কিন্তু আমাদের আলোর পথে নয় বরংঞ্চ তীব্র-ঘন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে। যে দলের পূর্বপুরুষগণ প্রতিটি সংগ্রামে মুক্তিরযুদ্ধে বিনাদ্বিধায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। সে দলের উত্তর পুরুষগণের মধ্যে আজ দেশপ্রেম হচ্ছে নিজ চিন্তা-চেতনার বাইরে যা কিছু আছে তা অগ্রহণযোগ্য-অমান্য এবং নিশ্চিতভাবে প্রতিরোধযোগ্য। এই যে মানসিক বৈক্যলতা তার দায় পূর্বপুরষ-মধ্যপুরুষ-উত্তরপুরুষ কেউ এড়াতে পারেনা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় মৃত্যু এখন “উদযাপন” এর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ভাই-বন্ধু-স্বজনের চোখ খুবলে নিয়েও তারা থেমে যাচ্ছে না। কেননা এতে উদযাপনটা যুতসই হয় না। এ মানসিক অবস্থা থেকেই বিশ্বজিৎ-আবরার-এর মৃত্যু। মূল বিষয় হচ্ছে ক্ষমতার শিখরে যারা আছেন যেনতেনভাবে হলেও তাঁদের নেক নজরে আসতে হবে। যেহেতু মূল সংগঠনের বাইরে সহযোগী দালাল সংগঠনগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার দেয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেহেতু তাঁদের বুকের পাটা সাধারণের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি স্ফীত হবেই। তাইতো প্রতিটি পাড়া-মহল্লা-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ হাজারো অনিক-রাসেল-সম্রাট ঘুরে বেড়ায়। কাজেই মূল সংগঠনের দালাল সংগঠন হিসেবে কোন সহযোগী সংগঠনই এখন আর ছাত্র-জনতার বন্ধু নয়। কেননা বাণিজ্যই শেষ কথা।

আরে বাবা স্বাধীনতা পূর্ব সময়ের ছাত্র রাজনীতি এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতি কখনো এক ধারায় চলতে পারেনা। ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দরকষাকষির জন্য রাজনীতির প্রয়োজন আছে। সে রাজনীতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মূল সংগঠনের দালাল সংগঠন হিসেবে পরিচালিত ছাত্র রাজনীতি একটি মেধাবী ছেলেকে মাস্তান বানিয়ে কেবল বিশ্বজ্যিৎ-আবরার এর জীবনই হরণ করতে পারে। এর বেশী নয়। আশা করাও বোকামি। কাজেই বর্তমানে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির ধরণ-প্রকৃতি বিদ্যমান রেখে যতই দাওয়াই দেয়া হোকনা কেন তা কখনোই স্থায়ী সমাধান হতে পারেনা। কিন্তু ছাগলের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে-আবরার কি মৃত্যুকালে তাঁর সকল মনোযোগ তাঁর মায়ের সহজ-সরল-আটপৌড়ে হাসিমাখা মুখে স্থির করতে পেরেছিলো ? তোমরা কি ওকে শেষবারের মতো “ও মা” বলে ডাকার সুযোগ দিয়েছিলে ?