লিখেছেন: ঘুণপোকা

কোন রাষ্ট্রকে কি ভাবে শরীয়ারাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে দেখুন শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দুটি উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে সমঝোতার মাধ্যমে ‘বিধর্মী’ শাসকের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করা। তাতে সম্মত না হলে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা। এটিই দারুল হারব থেকে দারুল ইসলামে রূপান্তরের উপায়। এক্ষেত্রে তালেবান এবং আইএস এর শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি লক্ষ্যনীয়। আফগানিস্তানের প্রাক্তন শাসক নজিবুল্লাহ এবং তার ভাইকে হত্যা করে প্রকাশ্যে তাদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে ১৯৯৬ সালে সশস্ত্র আক্রমণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল তালেবান। নজিবুল্লাহর মৃতদেহ থেকে পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছিল, আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেতলে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তিতে বহু নৃশংস কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানকে শরীয়ারাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয় তালেবান।

নৃশংসতা এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালে রাকা শহরকে কেন্দ্র করে আইএস-কেও আমরা একই পদ্ধতিতে শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে দেখি। শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সে অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কোন ধর্মের অনুসারী সেটা বিবেচ্য নয়। যে কোন ধর্ম অধ্যুষিত অঞ্চলেই শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে, তবে শাসকশ্রেণীকে অবশ্যই মুমিন মুসলমান হতে হবে। এ প্রসঙ্গে রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী তার এক ফতোয়ায় বলছেন, ‘কোন শহর বা রাষ্ট্র দারুল হরব বা দারুল ইসলাম হবার ভিত্তি হল ক্ষমতা ও শক্তির উপর। ক্ষমতা ও শক্তি কাফেরদের হাতে না মুসলমানদের হাতে। বাস এতটুকুই। তাই যে সকল স্থান মুসলমানদের বিধি বিধানের অধীন তা দারুল ইসলাম আর যা কাফেরদের বিধি বিধানের অধীন তা দারুর হরব’। শান্তিপুর্নভাবে শরীয়া প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি হচ্ছে কোন খলিফার অধীনস্ত সৈন্যদল ‘দারুল হরব’ বা শত্রুরাষ্ট্রে গিয়ে সেখানকার শাসক এবং ‘কাফের’ অধিবাসীদের ইসলামের দাওয়াত দিবে। যদি সেখানকার মানুষ ইসলাম গ্রহনে সম্মত না হয় তবে জিজিয়া কর দিয়ে সেই শরীয়ারাষ্ট্রে বসবাস করতে পারবে। আর জিজিয়া কর দিতে সম্মত না হলে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে সে সকল ‘কাফেরদের’ তাড়িয়ে/হত্যা করে এবং নারী-শিশুদের দাস বানিয়ে শরীয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটাই কোরানের নির্দেশ।

তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে। (তওবা ২৯) পুরো কোরানজুড়েই জিহাদ সংক্রান্ত আয়াতের ছড়াছড়ি। প্রায় সব আয়াতের সারকথা একই-কাফের-অমুসলিমদের হটিয়ে আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

●আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের
উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। (আনফাল ৬০)

●হে নবী, আপনি মুসলমানগণকে উৎসাহিত করুন জেহাদের জন্য। তোমাদের মধ্যে যদি বিশ জন দৃঢ়পদ ব্যক্তি থাকে, তবে জয়ী হবে দু’শর মোকাবেলায়। আর যদি তোমাদের মধ্যে থাকে একশ লোক, তবে জয়ী হবে হাজার কাফেরের উপর থেকে তার কারণ ওরা
জ্ঞানহীন। (আনফাল ৬৫)

●আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে।আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন। (তওবা ৩৬)

●হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কি হল, যখন আল্লাহর পথে বের হবার জন্যে তোমাদের​ বলা হয়, তখন মাটি জড়িয়ে ধর,তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে
পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প। (তওবা ৩৮)

●তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের (এখানে সরঞ্জাম বলতে অস্ত্রের কথা বলা হয়েছে) সাথে এবং জেহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে, এটি
তোমাদের জন্যে অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পার। (তওবা ৪১)

●হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর,তাঁর নৈকট্য অন্বেষন কর এবং তাঁর পথে জেহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও। (মায়েদাহ ৩৫)

ইসলাম মূলত দুইভাবে ছড়িয়েছে। প্রথমদল, যারা তুলনামূলক উদারপন্থী, তারা ইসলামের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে মানুষকে প্রভাবিত করে ধর্মান্তর করেছে। তারা এই আয়াতগুলকে পাশ কাটিয়ে যে সকল উদারবাদী আয়াত মক্কায় নাজিল হয়েছে সেগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে সূফীদের ইসলাম প্রচারের পদ্ধতি এই ধরণের ইসলাম প্রচারের একটা বড় উদাহরণ। দেশ দখল কিংবা শরীয়ারাষ্ট্র কায়েম করা এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এরা ইসলাম প্রচার করতে করতে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে পরবর্তীতে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। কখনো কখনো ক্ষমতাও দখল করেছেন, তবে সেটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এই দলটি বহু ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে সশস্ত্র জিহাদীদের দেশ দখলের ক্ষেত্র প্রস্তুতেও সহায়তা করেছে। অন্য দলটি ইসলাম প্রচারের মত শান্তিপূর্ণ পথে না গিয়ে আগে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পক্ষে। জিহাদ নিয়ে উদারপন্থী মুসলিমদের যে ব্যাখ্যা সেটাকে খারিজ করতে ‘কট্টরপন্থীগণ’ উপরোক্ত আয়াতগুলো উপস্থাপন করেন, যেখানে স্পষ্টতই বলা হচ্ছে সশস্ত্র জিহাদের কথা। এদের মত হচ্ছে ইসলামের বিজয়কে টেকসই করতে হলে যে কোন উপায়ে আগে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে, পরে বিভিন্ন শরীয়া আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলামকে মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে হবে। এই দলটি যেহেতু টেক্সটের সরাসরি অর্থকেই গ্রহণ করে তাই এরা কোরান-হাদিসের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে সশস্ত্র জিহাদকেই শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় মনে করে। সশস্ত্র জিহাদের পক্ষে এদের মত হচ্ছে ইসলাম যেহেতু ‘একমাত্র জীবনব্যবস্থা’ এবং আল্লাহ্‌ এবং তার রাসুল যেহেতু জিহাদ করার জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন সুতরাং সেখানে স্বভাবতই অন্যসব মতবাদ খারিজ হয়ে যায়। এরা মনে করে শুধুমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই নয় বরং সেটার সম্প্রসারণের জন্যও জিহাদ করতে হবে।

নিম্মোক্ত হাদিসগুলো থেকেও সশস্ত্র জিহাদ সম্পর্কে নির্দেশনা পাওয়া যায়।

●আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি যে, সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মুমিনদের এমন একটি দল না থাকত, যারা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে পছন্দ করে না এবং যাদের সকলকে সাওয়ারী দিতে পারব না বলে আশংকা করতাম, তা হলে যারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ
করছে, আমি সেই ক্ষুদ্র দলটির সঙ্গী হওয়া থেকে বিরত থাকতাম না। (বুখারী ২৬০৪)

●আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমার পথে জিহাদকারীর জন্য আমি নিজেই যামিন। আমি তার জীবনটা নিয়ে নিলে তবে তাকে জান্নাতের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেই। আমি তাকে (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) ফিরিয়ে আনলে তবে তাকে সাওয়াব বা গানীমাত সহ ফিরিয়ে আনি”।
(তিরমিজি ১৬২০)

●আবু নাজীহ আস সুলামী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ-কে বলতে শুনেছিঃ “আল্লাহ তা’আলার রাস্তায় যে লোক তীর ছুড়লো তার জন্য রয়েছে একটি গোলাম মুক্ত করার অনুরূপ সাওয়াব”। (তিরমিজি ১৬৩৮)

●আনাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলার পথে মৃত্যুবরণ করা সকল পাপের কাফফারা হয়ে যায়”। (তিরমিজি ১৬৪০)

লক্ষ্যনীয় যে, কোরানে জিহাদ সংক্রান্ত যে আয়াতগুলো আছে তার সবই ‘নাজিল’ হয়েছে মদীনায়, কুরাইশদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে। নিরাপত্তার প্রশ্নে মক্কার জীবনে মোহম্মদ কোন আয়াত বা বক্তব্যেই ‘কাফেরদের’ বিরুদ্ধে জিহাদ করতে বলেন নি। সমস্ত আয়াত নাজিল করিয়েছেন মদীনায় নিজেই একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর। এই আয়াতগুলোতে মদীনা রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ কিংবা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জিহাদের আহবান করা হয়েছে। সেসময় যেসব সাহাবী জিহাদের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছেন তাদেরকে উদ্ভুদ্ধ করা বা ভয় দেখানোর জন্য উপরোক্ত আয়াতগুলো নাজিল হয়েছে।