লিখেছেন: ঘুণপোকা

আজ প্রায় সারাদিনই নেট ঘেঁটে দেখছিলাম দুনিয়াজুড়ে কিভাবে, কোন প্রেক্ষিতে স্বৈরাচারের লক্ষণগুলো প্রকট হতে শুরু করে। প্রায় সব গবেষণাই স্বৈরাচারের কমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণের কথা বলছে। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যেখানেই স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে, সেখানেই সে হয় উগ্র জাতীয়তাবাদ নয়তো ধর্মের ঘাড়ে চড়ে ক্ষমতাকে পোক্ত করেছে বা করতে চেয়েছে। হিটলার, মুসোলিনি, ইয়াহিয়া কিংবা আমাদের দেশে জিয়া এরশাদ। এরা সকলেই ধর্ম কিংবা জাতীয়তাবাদের মুলো ঝুলিয়ে ক্ষমতায় টিকে ছিল বছরের পর বছর। বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেছে, বইপুস্তকে পড়া গতানুগতিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা যে নতুন ফর্মে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে সে বিষয়টি আমরা সচেতনভাবে গুরুত্ব দিয়েছি বলে মনে হয় না।

জিয়া ক্ষমতা দখল করে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে পুনর্বাসন করেছেন, রিকন্সিলিয়েশনের নামে পাকিস্তানের সাথে ইসলামিক ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করেছেন। এরশাদ আরেককাঠি বেড়ে রাষ্ট্রের গলায় ধর্মের মালা জড়িয়েছেন, রাষ্ট্রের মূলনীতি ভঙ্গ করেছেন বারবার। খালেদাও ধর্মকে পুঁজি করেছেন; জামাতকে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ দিয়েছেন, এই দেশে মৌলবাদ বিস্তারে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। তবে বাংলাদেশে হাসিনালীগ এবং তাঁর প্রশাসনের (আমি সরকার বলতে রাজি নই) বর্তমান কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে যদি বলি গত দশ বছরে মৌলবাদ আর আমলাতন্ত্রের ঘাড়ে ভর করে একটু একটু করে বাংলাদেশকে অধুনা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার দিকে অনেকদুর এগিয়ে নিয়েছে তাতে ভুল বলা হবে কি? বরং যদি বলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সেটাকে ছাড়িয়েও গেছে তাহলে আমার আওয়ামী কিংবা প্রবল জাতীয়তাবাদী বন্ধুগণ হয়তো মেনে নিতে চাইবেন না। আমরা যদি গতানুগতিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার কথাও বলি, সেক্ষেত্রে হাসিনা প্রশাসন কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই। অন্তত মৌলবাদ তোষণ-পোষণের মাধ্যমে ধর্মকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার এবং ধার্মিক হিসেবে একধরণের ব্যক্তি ইমেজ তৈরি করে মানুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে হাসিনালীগ এবং ব্যক্তি শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।

এই দিক থেকে জিয়া-এরশাদ-খালেদা অন্তত সৎ; তারা বিশ্বাস করতেন ধর্মের রাজনিতিকীকরণে এবং কার্যক্ষেত্রে সেটাই করে দেখাতেন। এরা কোন ভনিতার আশ্রয় নেননি। কিন্তু শেখ হাসিনার মুখে ধর্মনিরপেক্ষতা, কাজে মৌলবাদ তোষণ এবং ব্যক্তি চরিত্রে সতি-সাধ্বী ইসলামিস্ট; এই যে দ্বিমুখী চরিত্র এটা এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য। একদিকে ধর্মের বাতাস দিয়ে, সুবিধা দিয়ে মৌলবাদ-উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেয়া অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জিকির তুলে বিশাল জনগোষ্ঠীকে তথাকথিত চেতনার আফিমে আচ্ছন্ন করে সীমাহীন দুর্নীতি আর একচেটিয়া ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার যে ব্যবস্থা হাসিনা করেছেন সেটাও এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য। শেখ হাসিনার মনস্তত্ত্ব মনোবিজ্ঞানীদের জন্য একটি ভালো গবেষণার ক্ষেত্র হতে পারে নিঃসন্দেহে।

হাসিনা প্রশাসন মৌলবাদ তোষণে আগের সকলের কীর্তিকে ছাড়িয়ে গেছে বললে কি বাড়িয়ে বলা হবে? ২০১৪ সালে দেশের তরুনদের রাজাকার-জামাত-হেফাজত বিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা পোক্ত তো করলেন, করে কি করলেন? হেফাজতের আমিরকে পাশে নিয়েই উপাধি নিলেন ‘কওমি জননী’র। ৫৭ ধারার নামে যত্রতত্র ‘ধর্মবিরোধী’ হুজুগের প্রশ্রয়, মৌলবাদীদের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকের ইসলামীকরণ, প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারাদেশে মসজিদ নির্মাণ, কোনরকম গবেষণা ছাড়াই কওমি শিক্ষার সনদায়ন, হজের নামে ফি-বছর বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয়। উদাহরন দিয়ে শেষ করা যাবে না। অন্তত কাগজে-কলমে হলেও যে দেশের সংবিধানে এখনও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে জাতীয় চার মূলনীতির মধ্যে, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী কিভাবে এমন নির্লজ্জভাবে মৌলবাদী শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন সেটার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। আজকে আমাদেরও আত্মপোলব্ধির সময় এসেছে ২০১৩ সালে আমরা হাসিনালীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আন্দোলন করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি কিনা। বিপুল তারুণ্যের শক্তিকে অপব্যবহারের যে নমুনা সেসময় শেখ হাসিনা দাঁড় করিয়েছেন সেটাও একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

শুরুতেই বলছিলাম স্বৈরাচারের লক্ষণগুলোর কথা। সকল স্বৈরাচারই হয় ধর্মকে নয় জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে জনগণের ভেতরের পুঞ্জিভূত হতাশা-ক্ষোভ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা প্রশাসনও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সব স্বৈরাচারের যে পরিণতি হয় সেটা থেকে হাসিনা যে বেঁচে যাবে সেটা ভাবার কোন কারণ দেখি না। মাঝখানে থেকে একটা জাতির মনস্তত্ত্বের মধ্যে উগ্র ধর্মীয় চিন্তাভাবনা ঢুকিয়ে দেয়ার যে কাজ করা হয়েছে তা থেকে মুক্তি কবে মিলবে বলা কঠিন।

একদিকে আমলাতন্ত্রের অস্বাভাবিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বিপুল দুর্নীতি আর অপশাসনের উদ্ভব, অন্যদিকে উগ্র মৌলবাদের চাষাবাদে নিয়মিত পুষ্টি যোগানের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন শেখ হাসিনা এবং তাঁর আশেপাশের লোকজন সেটার জন্য তাঁকেও একদিন জবাবদিহি করতে হবে। তবে আশঙ্কা করি সেদিন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগও হয়তো পাবেন না।