Agricultural Engineering এ পিএইচডি ডিগ্রী শেষে চাকুরী জুটলো না। তখন Texas A&M University এর এক প্রফেসর বন্ধুর পরামর্শে Electrical Engineering দ্বিতীয় পিএইচডি শুরু করি। তিনি Robust Control এ পৃথিবীর একজন নামকরা প্রফেসর। কিন্তু ওস্তাদ আলী আকবর খানের একজন প্রিয় ছাত্র। তিনি খান সাহেবের কলেজের ফি দিতেন নিয়মিত। বিনিময়ে ক্লাশের অডিও ক্যাসেট পেতেন। সেটা শুনেই তিনি সরদ বাজানো শিখতেন। এই প্রফেসরের বাবা স্বদেশী আন্দোলন করতে যেয়ে ব্রিটিশ সরকারে রোষে পড়েন এবং রেঙ্গুনে পালিয়ে যান। ওখানে আইন ব্যবসায় প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। ভারতের যাবতীয় স্বদেশী কর্মীদের আশ্রয় দিতেন। নেতাজী সুবাস বসুও তাঁর বাড়িতে মিটিং করেছেন। প্রফেসরটির ওখানেই জন্ম। তিনি বাংলা বলতে পারতেন। কিন্তু পড়তে পারতেন না। ওস্তাদ আলাউদ্দিনের উপর লেখা একটা বাংলা বই এই প্রফেসরের হাতে আসে। তাঁর অনুরোধে বইটির ইংরেজী অনুবাদ করি। এটা ১৯৯৪ সালের কথা। এখন বাংলা বইটির নাম এবং লেখকের নামটিও মনে নেই। তবে শুনেছি – লেখক সরদ বাজানো শিখতেন। কিন্তু বাদক হিসেবে এগুতে পারেন নি।

আজ হঠাৎ আলী আকবর খান সাহেবের চিঠিটা চোখে পড়ল আর সেই সাথে মনে পড়ল পাঠশালার দু’জন নিবেদিত প্রাণ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কথা।

হঠাৎ নজরে এলো ওস্তাদ আলী আকবর খানের চিঠিটি

গজেন্দ্র চক্রবর্তীর হাতেই আমার হাতে খড়ি। ধনুকের মত বাঁকা দেহখানি চোখে ভাসে। আর ভাসে অনবরত মাথা এবং হাত কাঁপুনি। স্কুল ছুটি হয়েও ছুটি হতো না। বাড়ি ফেরার আগে সবাইকে গোল করে দাঁড় করিয়ে সমস্বরে এক চন্দ্র, দুই পক্ষ থেকে একশত পর্যন্ত করাতেন। প্রতিদিন সকালে ছাত্ররা পড়ছে কিনা তা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চেক করে যেতেন। মনোহর মন্ত্র শিখাতেন যাতে লেখাপড়া মনে থাকে।

এরকম আরও একজন শিক্ষকের কথা পড়েছি। ছাত্রটির নাম ছিলো আলম। বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ছাত্র স্কুলে আসে না। বাড়ি এসে মাকে জিজ্ঞেস করে – তোর ছেলে পাঠশালায় আসে না কেনো? মা বলে – যায় তো। প্রতিদিনই বই-স্লেট নিয়ে সময় মত যায়, সময়মত বাড়ি ফিরে।

আলম বাড়ি ফিরলে মা জেরা করতে শুরু করে। সত্য বেরিয়ে পড়ে। গত তিন মাসে একদিনও সে স্কুলে যায়নি। শিব মন্দিরে গান হয়। প্রতিদিন সেখানে গান শুনে।

মা ঢেকির সাথে বেঁধে বেদম মার দেয়। আলমের কান্নার খবর পাশের গ্রামে মধুদিদির কানে যায়। মধুদিদি এসে আলমের বাঁধন খুলে দেয়। আলমকে নিয়মিত স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু আলমের মন মজেছে গানে। গান ছাড়তে পারবে না। আলম টাকা-পয়সা খুজতে থাকে। মা একটি মাটির হাড়িতে পয়সা জমাতো। সেখানে পেয়ে যায় আট টাকা। মাত্র আট বছরের আলম পড়নের প্যান্ট আর গায়ের জামার পকেটে আটটি টাকা নিয়ে ঐ রাতেই বেরিয়ে পড়ে। বাড়িতে গানের কদর ছিলো। তাই কলকাতার নাম শুনেছে। সেখানে শুধু গান-বাজনা হয়। কলকাতা যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে যেতে হবে আলম জানতো না। কিন্তু সত্যি সত্যি আলম একদিন কলকাতা পৌছে যায়। দিনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। সকালে এবং বিকেলে যেখান থেকেই গানের সুর ভেসে আসে, আলম সেখানে পৌছে যায়। মানুষের বাসায় চেয়ে কোন দিন খায় কোন দিন উপোস। শেষে এক লঙ্গর খানার খোজ মিলে। একবেলা খাবার নিশ্চিত হয়। সকাল-বিকেল বাবুদের বাড়িরে বাইরে থেকে গান শুনা চলতে থাকে। এক প্যান্ট এক শার্ট। প্যান্ট ভিজিয়ে গঙ্গায় স্নান। প্যান্ট গায়েই শুকিয়ে নিত আলম। জামাটা পুটলি বানিয়ে বালিশ মত করে রাতে গুমোতো রাস্তায় বা বাবুদের বারান্দায়। এভাবে জামার পকেট থেকে টাকাটাও খোয়া যায়।

একদিন ওস্তাদ আহমদ আলী খান সাহেবের ফাই ফরমাশ খাটার সুযোগ হয়। এই আহমদ আলী খান মুক্তাগাছার জমিদারের সঙ্গীত শিল্পীর চাকুরী নিয়ে মুক্তাগাছা আসেন। আলমও সাথে আসে। খান সাহেব জমিদারের সাথে শিকারে গেলে চুরি করে সরদ বাজানো শিখতে থাকে। একদিন ধরা পড়লে প্রচুর বকুনী শুনতে হয়। জমিদারের চাকুরী ছেড়ে খান সাহেব নিজ বাড়িতে চলে আসেন। বাড়ি বানান। আলম ইটের জোগানদার। কঠিন আমাশয় হয়। কিন্তু ইট না টানলে থাকা-খাওয়া মিলবে না। ওস্তাদের সরদ শোনা হবে। এত সব ভেবে আলম খান সাহেবের সাথে থেকে যায়।

একসময় আলম হারমুনিয়াম, তবলা, বেহালা, সেতার, সরদ, বাশি সহ প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখে যান। উদয়শংকর তাঁর নাচের দলের সাথে ইউরোপ ট্যুরে নিয়ে যান। উদয়শংকরের নাচের দলে রবিশংকরও নাচতেন। সেখানেই রবিশংকর সরদের প্রেমে পড়ে যান এবং আলমের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন।

আলমের লেখা পড়া হয়নি। ভাঙ্গা অক্ষরে দস্তখত শিখেছিলেন মাত্র। শেষপর্যন্ত আলম সঙ্গীত জগতের শীর্ষস্থান দখল করেন। তখন তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান নামে পরিচিতি লাভ করেন। রবিঠাকুর শান্তিনিকেতনে তাঁকে ভিজিটিং অধ্যাপক নিয়োগ করেছিলেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের তিন বিখ্যাত ছাত্রের নাম পন্ডিত রবিশংকর, ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং অন্নপূর্ণা দেবী।

ওস্তাদ আলী আকবর খানের জীবনাবসান ঘটে ক্যালিফোর্নিয়ার San Anselmo শহরে ১৮ই জুন ২০০৯ তারিখে। জন্মেছিলেন ১৯২২ সালের ১৪ই এপ্রিল বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায়।

পণ্ডিত রবিশংকরের দেহাবসান ঘটে ২০১২ সালের ১১ই ডিসেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার La Jolla শহরে। জন্মেছিলেন ৭ই এপ্রিল ১৯২০ সালে ভারতের বারানসী শহরে।

অন্নপূর্ণাদেবীর দেহাবসান ঘটে ১৩ই অক্টোবর ২০১৮ সালে Breach Candy Hospital Trust, Mumbai, Indiaতে। জন্মেছিলেন ২৩শে এপ্রিল ১৯২৭ সালে ভারতের মাইহার শহরে।

শ্রদ্ধা জানাই তিন দিকপালকে। বৃদ্ধ গজেন্দ্র চক্রবর্তীর জীবদ্দশায় তাঁর অবদান অনুভব করতে পারিনি। এখন অনুশোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই।