আমি ফুলকানা । মাত্র হাতেগোনা ক’টি ফুলের নাম বলে দিতে পারি বড় জোর । ছোটবেলায় আমার ঈশ্বরভক্ত বড়মাকে দেখেছি জবা ফুল দিয়ে পূজো করতে । বাড়ির তুলসীতলার পাশে লাল জবা। ভালই লাগত ঘন্টির মতো ঝুলে থাকা প্রজাতি বিশেষের ফুলগুলোকে । ওই চোখের দেখা পর্যন্তই; তুলে আনার সাহস ছিল না; রাতে তো নয়ই ।

সকালের স্নান সেরে ফুল তুলে এনে ঠাকুরদেবতায় নিবেদন-বড়মার নিত্যকর্মের এক কর্ম । তাই তুলসী পাতা আর জবা ফুল আমার অতিচেনা । তাছাড়া পান্না লালের কন্ঠে “ আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে উঠনা ফোটে মন” তো বারোয়ারী কালীপূজায় জাতীয় সংগীতের মতোই বাজতো। ফলে জবা ফুল ভোলার কারণ নেই এ জীবনে ।

আর ক’টি ফুল যেমন পলাশ, ইস্কুলের স্বরসতী পূজোর সময় লাগতো । গাঁদা ফুল লাগতো আমাদের বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের নিত্যলেগে থাকা পারিবারিক পূজোয় । বর্ষাকালের শাপলা কিংবা ইস্কুল থেকে ফেরার পথে জমিদার বাড়ির বিরাট দিঘিতে ফুটে থাকা পদ্ম । ফসলের মাঠ, ক্ষেতের আইল,কাঁচা সড়কের দু’পাশ,পায়ে হাঁটার মেঠোপথ এসবের পাশেও ফুটে থাকতো নানান রংয়ের ফুল । কিন্তু আদিগন্ত হলুদ সর্ষে ফুল ছাড়া আর কারো নামই জানতাম না ।

একবার ঢাকা কলেজের বোটানির মজিদ স্যার নিয়ে গেলেন উদ্যানে । এখনকার সংসদ ভবনের পাশে রেসিডেন্টসিয়াল কলেজের উল্টোদিকে ছিল নানান প্রজাতির উদ্ভিদ উদ্যান । এখনও কি উদ্যানটি আছে? বছর চার-পাঁচ আগে ঢাকা গেলেও চোখ পড়েনি ওদিকে ।

যা হোক, হাতে-কলমে উদ্ভিদ ও ফুল দেখার সে মাঠশিক্ষণের সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রটি ছিলাম বোধহয় আমি । কারণ, যখনই গাছের কাছে যাই সবুজ- ভালোবাসায় আক্রান্ত হই আমি । এত সবুজের সমারোহে বিমোহিত আমি,শুধুই পাতার দিকে তাকিয়ে থাকি । ফলে পাতার সমাহারে ফুল দেখা আর হয়নি সে সফরে আমার। হয়ে ওঠেনি ফুলেল জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া । জ্ঞান বাড়েনি এক ফোঁটাও। যদিও বাড়তি বিষয় হিসেবে নম্বর বেড়েছিল অনেক ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেই কঠিন ভালোবাসায় প্রাণ ত্রাহি । ইস্কুলে বান্ধবীদের বইয়ের পাতায় গুজে রাখা স্বরসতী পূজোর পলাশ ফুলে শুকিয়ে কালচে হয়ে গেলেও একটি তাজা লাল গোলাপ লুকিয়ে রাখার সাহস হতো না । অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠাতে লাগলাম গোলাপ । গোলাপের অতি ব্যবহারে হাঁপিয়ে ওঠার আগেই প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য জাতীয় উপকারটি করে গেলেন আমাদের প্রেমিক-স্বৈরাচার এরশাদ ।

হঠাৎ শাহবাগের মোড়ে মোড়ে গোলাপ আর রজনীগন্ধার দোকানে ভরে গেল । গোলাপের সাথে আরেকটি নতুন ফুল প্রেমের নৈবেদ্যে লাগল, রজনীগন্ধা । সে সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, “এক গোছা রজনী গন্ধা হাতে নিয়ে বললাম, চললাম” । কত প্যারোডি আর ভড়ং-ই না চলতো তখন এ গানটি নিয়ে? রজনীগন্ধা বোধহয় তখনও চাষ হতো না ব্যাপকহারে । তাই অতিমূল্যের কারণে রজনীগন্ধা আর তেমন জোটেনি ভালোবাসার মানুষটির কপালে ।

হঠাৎ এক বর্ষার দিনে আবিষ্কৃত হলো আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটের আর্কিটেক্টচার ভবনের বিপরীত দিকে সিভিল আর ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাঝখানের গেইটের পাশে আছে কয়েকটি কদম গাছ । সে সাথে রবিঠাকুরের গান “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান” । বর্ষার বর্ণনায় রবিঠাকুর অতুলনীয় । জয়দেবের “গীতগোবিন্দ”-এর পরে এতো নিবিড় বর্ষার বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে দিতে পেরেছেন বাংলাসাহিত্যে?

বাংলাসাহিত্য বললাম এ কারণে যে,ওদিন দক্ষিণ আমেরিকার আরেক কবি পাবলো নেরুদার আত্মস্মৃতি “ মেমোওরস” নিয়ে একটি লেখা পড়ছিলাম । মুগ্ধ হচ্ছিলাম নেরুদার বৃষ্টির বর্ণনা পড়ে । নেরুদার দক্ষিণ আমেরিকার বৃষ্টি দারুণ ধীরস্থির। নামছে তো নামছেই । চলে যাবার কোন তাড়া নেই । নেরুদার বাড়ির সামনে সে ধৈর্যশীল বৃষ্টিতে আটকে পড়ে কী হেনস্তাই না হচ্ছে গরুর গাড়িগুলো ?

পড়ছিলাম আর শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের সে বিখ্যাত “ অবনী বাড়ি আছো”- কবিতার বৃষ্টির অতুলনীয় ও অভূতপূর্ব বর্ণনা মনে করছিলাম, “ বৃষ্টি পড়ে এখানে বার মাস/ এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে” । এ যেন দক্ষিন-আমেরিকার আরেক কবি পাবলো নেরুদার কবিতারই সুর । যেন শক্তি চট্রোপাধ্যায় আর পাবলো নেরুদা ভিজে একাকার এক দীর্ঘ বৃষ্টিতে। বৃষ্টি কি শুধু বাইরে, বৃষ্টি কবির অন্তরেও। শক্তি চট্রোপাধ্যায় তাই বলেন,

“ বৃষ্টি নামলো যখন আমি দৌড়ে গিয়ে একা
উঠান পানে ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা
হয়ত মেঘে বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছ আকাশ ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নাই বাহিরে অন্তরে মেঘ করে
ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঘরে।“

আমিও লিখেছিলাম কবিতা একদিন বৃষ্টিকে নিয়েই অনেকটা কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়কে মনে রেখেই

“বৃষ্টি হলে কষ্ট বাড়ে কিন্তু সেতো প্রলেপটাও
পারতো দিতে জলের ছিটায়। জল গড়ালে কিংবা
রোদে স্পর্শ খুঁজি, মধ্যদিনে দুপুর গড়ায়
বাতাস যখন স্তব্ধ বধির অরণ্যে গায় শূন্যতাও”।

পৃথিবীর তাবৎ কবি বৃষ্টির বর্ণনা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতা ও গানে বর্ষাকে অতুলনীয় করে তুলেছেন। প্রকৃতি পর্যায়ের গানের মধ্যে বর্ষার গানই ১১৪টি। রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টি ও বৃষ্টির আনুসংগিকতা অনেক রোমান্টিক – প্রেমে,প্রেম নিবেদনে এবং প্রেম-বিচ্ছেদে । আমাদের মতো স্বল্প সংগতিসম্পন্ন প্রেমিকদের কাছে তো বটেই । অন্তত চালচুলাহীন ছাত্রজীবনে, যখন বুকের গভীরের অসীম ইচ্ছেটা ছিল বুকপকেটের সংগতিটার কাছে বাধা ।
তাই বর্ষার প্রায় বিকেলেই কদম গাছের ডাল ভেঙে গোটা পাঁচেক কদম ফুল নিয়ে প্যারোডি করে বললতাম,“ এক গোছা কদম ফুল হাতে নিয়ে বললাম,চললাম”।

পথ চলতে চলতে প্যারোডিটা কখন বদলে যেত । আবার ভর করতো চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ । কখনো ঘনঘোর বরষায়, কখনো বৃষ্টিস্নাত ঝকঝকে সন্ধ্যায় । এক আকাশ শুভ্রনীলকে সাক্ষী করে সব প্রেমিকের মতো শাশ্বত কন্ঠে বেজে উঠতো, “ বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছো দান”।

অনেক দূরে ফেলি এসেছি কদম ফুল । আষাঢ়ও সেভাবে আর নেই এ মুল্লুকে । কিন্তু বৃষ্টির ধারাপাত আছে । নানান রকমের মেঘকালো আকাশ আছে তেমনি ছায়াময় এখানেও । আর ছায়ার মতো ছুঁয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ বিশেষত রবীন্দ্রনাথের গান এবং প্রকৃতি পর্যায়ের বর্ষার গানগুলো।

গীতবিতান পড়তে পড়তে আজকেই একটি না-শোনা গানের কথায় চোখ আটকে গেল । হাতের কাছের ইউটিউব খুঁজে দেখলাম গানটি দেবব্রত বিশ্বাস গেয়েছেন, গেয়েছেন সুমিত্রা সেন – এমনকি রেজোওয়ানা চৌধুরী বন্যার কন্ঠে আছে গানটি। “কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ়মেঘের ছায়া খেলে”। শিল্পী সুমিত্রা সেনের কন্ঠে গাওয়া গানটি অসাধারণ লেগেছে ।

আভোগ বা দ্বিতীয় অন্তরার কথাগুলো যখন পড়ছিলাম , তখন সামনের উঠোনে দূরের বন থেকে সূর্যের শেষ আলোটুকু এসে পড়ছিল । আকাশের অন্যপ্রান্তে কালোমেঘ জমেছে। যেকোন সময়ে বৃষ্টি পড়বে । রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

“ঝিল্লিমুখর বাদল-সাঁঝে কে দেখা দেয় হৃদয়-মাঝে,
স্বপনরূপে চুপে চুপে ব্যথায় আমার চরণ ফেলে॥“
লাইন দু’টো পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম ফেলে আসা আষাঢ়, আষাঢ়ের বৃষ্টি আর রবীন্দ্রনাথের গানের সেই কদম ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সময়টিকে।

প্রতিবারের মত আবার আষাঢ় এসেছে । এবারেও নির্জনতায় ভরে যাবে মন । ভালোবাসায় উথলে উঠবে সব প্রেমিক মন; কখনো কুঁড়িয়ে পাওয়া নতুনে, কখনো ফেলে আসা পুরাতনে । রবিঠাকুরের আষাঢ়ে এবারেও হয়তো নামবে শক্তি চট্রোপাধ্যায় কিংবা পাবলো নেরুদার বৃষ্টি । হয়তো এবারেও কদম ফুল ফুটবে । গাওয়া হবে গান । উত্তর আমেরিকার এক শহরে বসে আমিও বলে উঠবো, “ I first opened my eyes to life, love, the land, poetry and the rain”।

( ভজন সরকারঃ রবীন্দ্রনাথের গান )