উন্নয়নের প্রচণ্ড ডামাডোল বাজছে চতুর্দিকে। দেশের শাসকগোষ্ঠী তারস্বরে ঘোষণা করছেন আমাদের দেশ সহসা নাকি শুধু এশিয়ার নয়, বিশ্বের
রোল মডেল হতে যাচ্ছে। আমরা নাকি সহসা কানাডা, ফ্রান্সকেও ছাড়িয়ে যাব।

আমাদের দেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে। ব্যাংক বীমা অফিস আদালতে আমরা দেদারসে ইন্টারনেট, কম্পিউটার,ব্যবহার করছি। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে আমরা মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিক্ষেপ করেছি। আমাদের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শণৈঃ শণৈঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমাদের দু’লাইনের মহাসড়ক চার লাইন হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ দ্রুত্ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ছোট বড় অনেক নদ-নদীর উপর কত সেতু নির্মিত হচ্ছে-মেঘনা গোমতি ইত্যাদি। শহর-নগর ছেয়ে যাচ্ছে উড়াল সেতুতে। রক্তদিয়ে কেনা স্বদেশের এহেন সাফল্যের ফিরিস্তি দেখে, একাত্তুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গর্বে বুক ফুলে ওঠারইতো কথা।

সত্যইতো, এসব উন্নয়নতো হচ্ছেই একথা ভাবার পরক্ষণেই কিন্তু মনটা প্রচণ্ড বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, যখন শুনতে পাই-আমাদের দেশের শ’য়ে শ’য়ে কর্মপ্রত্যাশী বেকার তরুণেরা, ভূমধ্যসাগরের নীলাভ জলে আত্মাহুতি দিচ্ছে-নৌকা ডুবিতে সলিল সমাধি লাভ করে-জীবিকার অন্বেষণে । কর্মহীন তরুণের স্ংখ্যা ফি বছর স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছে। ধনীদের সম্পদ বাড়ছে বিপুল হারে, গরীব আরো গরীব হচ্ছে। প্রখ্যাত ব্যাংকার ইব্রাহিম খালেদের মতে-প্রবৃদ্ধি যাই হোক ৯৫ ভাগ জাতীয় আয় চলে যাচ্ছে ৫ ভাগ মানুষের হাতে।

কৃষকেরা ধানের মূল্য না পেয়ে নিজের পাকা ধানক্ষেতে অগ্নি সংযোগ করছে। এ দৃশ্য অতীতে কখনো দেখিনি। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন দিচ্ছে ডজনে ডজনে মানুষ। সান গ্লাস পড়ে আমাদের সড়ক মন্ত্রী নিরাপদ সড়ক যাত্রার প্রশস্তির ঢেকুর তুলছেন। নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, খুন, গুম ইত্যাদি যেন আমাদের গা-সওয়া সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে । নাগরিক নিরাপত্তা জোট নামক একটি সংগঠনের দেওয়া তথ্য মতে-জানুয়ারী ’১৯ হতে এপ্রিল ’১৯ পর্যন্ত ৪ মাসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনির হাতে তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে ১১৮ জন, নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৫৪ টি, শিশু ধর্ষণের ঘটনা ২৩৪, শিশু খুন ১৪৪ জন এবং গুম হয়েছে ৬ জন। এটা কি কোন ভাবেই একটি স্বাধীন ও সভ্য সমাজের চিত্র হতে পারে?

দুর্নীতি আজ ভয়াবহরূপ পরিগ্রহ করে গ্রাস করেছে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে । বিগত ১০ বৎসরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা যারা ব্যাংক থেকে লুটপাট করেছে, বিদেশে পাচার করেছে, তারা আজ সমাজে সমাদৃত-রাজনৈতিক ক্ষমতায় ক্ষমতাবান বলে। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি আজ তাদের হাতেই কুক্ষিগত। বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে তারা আজ আইনের উর্ধ্বে। রাষ্ট্রকেও তারা বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাচ্ছে। সকল সাংবিধানিক অধিকার হারিয়ে আমজনতা আজ দেশের মালিকের পরিবর্তে প্রজায় পরিণত হয়েছে। দিকে দিকে কেবলই তোষামোদি-মোসাহেবীর মহোৎসব চলছে-পাশাপাশি হালুয়া-রুটি নিয়ে কামড়াকামড়ি, ফলশ্রুতিতে খুনাখুনি । দেশটি যেন হীরক রাজার দেশে পরিণত হয়েছে-এথানে রাজা বলেন যা, করতে হবে তা।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা-যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সুশাসন, শোষণহীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার্। কিন্তু আজ আমাদের সমাজে সুশাসন বলতে যা বুঝায়, তার পরিবর্তে চলছে জোর যার মুল্লুক তার-বড়দের ছোটদের গিলে খাওয়ার সে প্রবৃদ্ধি মাৎস্যন্যায়ম্ নীতি। গণতন্ত্রের ন্যূনতম যে প্রতিভাস, নাগরিকদের ভোটাধিকার, তাও আজ লুণ্ঠিত। মেয়র নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন-কোন নির্বাচনেই জনগণকে আজ আর কষ্ট করে তাদের ভোট দিতে হয় না-ভোটের আগের দিন রাতে কিংবা ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দল ও তার অনুগত প্রশাসনের লোকেরা্ই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এ সংস্কৃতি সহজে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছি না।

তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত সংবিধানে ঘোষিত নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা-ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে এক ভয়ঙ্কর আইনের বজ্র আটুনীতে বাক্সবন্ধী। যে কথাই বলেন শাসক শ্রেণীর পছন্দ না হলে জেল ৭ বৎসর থেকে ১৪ বৎসর। এখানে দেখা যাবে না, শুনা যাবে না, বলা যাবে না কথা-রক্ত দিয়ে কিনেছি শালার এমন স্বাধীনতা!

প্রতিদিন দেশের কোন না কোন প্রান্ত থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, নিপীড়ন ও তাদের সম্পত্তি বেদখলের খবর আসছে। হামলা ও ভাঙ্গচুর হচ্ছে তাদের মন্দিরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দল কিংবা তাদের আশ্রিতদের দ্বারা এসব হচ্ছে। অতি সম্প্রতি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-গেল বছরে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় দেড় হাজার । ২০১৫ সালের তুলনায় তা সাড়ে পাঁচগুণ বেশী। ভাবতে বুক ভেঙ্গে যায়; একাত্তুরে দেশের সকল নাগরিক মিলে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য। সে স্বাধীন দেশে আবার ধর্মীয় বিভাজনে নিপীড়নে!

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ চুড়ান্তভাবে পরিত্যক্ত, অবদমিত, বিকৃত ব্যবসায়িক পণ্য । ক্রমান্বয়ে স্বদেশ যেন পশ্চাদগমন করছে। ক্ষমতাসীন দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে মুখে ফেনা তুললেও বস্তুত: তারা ক্রমে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ ও কর্মসূচীকে নিজেরাই আত্মস্থ করে নিচ্ছে। ফলত: সরকারেরই জনৈক মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন-দেশ নাকি অচিরে ইসলামী শরীয়া আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।

ভোটের রাজনৈতিক বিবেচনায় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিভিন্ন দাবী ও আবদার মেনে নিয়ে, তাদের কাছ থেকে নানা খেতাব গ্রহণ করে গৌরবান্বিত হচ্ছেন রাজদণ্ডের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব-দেশের সর্বময় ক্ষমতার মালিক। মর্মান্তিক অধ:পতন ঘটছে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধে আমরা যেন সেই পাকিস্তান আমলের চেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এমন অধোগতি ঘটেছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ছাড়া আমরা যেন কোন পরীক্ষার কথাই ভাবতে পারি না। ছাত্র অভিভাবক সকলে প্রকৃত শিক্ষার বদলে সনদের পেছনে ছুটছে হন্যে হয়ে। আজ কেবল মাদ্রাসা নয়, আধুনিক ইংরেজী শিক্ষার স্কুল গুলো থেকেও জন্ম নিচ্ছে জঙ্গী সদস্য। শিক্ষার সাথে দর্শনের সংযোগহীনতা আজকের ছাত্রদের বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পরিবর্তে নিয়তিবাদী করে তুলছে। হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তিবাদ । উর্বর হয়ে ওঠছে ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের জন্ম ও বিকাশের ক্ষেত্র।

উন্নয়নের রথযাত্রায় সমাসীন স্বদেশ সত্যিই আজ বিপন্ন। বড় বিপন্ন দেশের আমজনতা।