আমি এখনো আজকের বাস্তবতার সাথে অতীতের চালচিত্র খুঁজে পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি কেননা আমিও সেই মানুষ যাকে এক সময়ে প্রাণের তাগিদে আইসিসকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে দেখতে হয়েছিল। আজকের যুদ্ধাবস্থা আর অতীতের শান্ত দিন যেন সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন জগৎ।

Syria’s eastern Deir Ezzor province, where the author was raised, a day after the Islamic State’s “caliphate” was declared defeated by the Syrian Democratic ForcesDelil souleiman / AFP / Getty

১৯৯০ দশকে আমি যখন কিশোর ছিলাম তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভেড়া চরাতাম। তখন আমার দৈনন্দিন জীবনযাপন ছিল প্রায় একইরকম। সকালে খোঁয়াড় থেকে ভেড়াগুলোকে ছেড়ে দিতাম, গ্রামের প্রধান রাস্তা ধরে তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতাম, দুপুরের খাবারের জন্য রাস্তার ধারের কোন দোকান থেকে হয়ত কিনে নিতাম ছোট্ট একটা তরমুজ এবং তখন রওনা দিতাম মরুভূমির দিকে। গ্রামের জনবহুল অংশটুকু পেরিয়ে গেলে ভেড়ারপালকে মরুভূমির দুই পাহাড়ের খাঁজে ছোট উপত্যকার খোলা প্রান্তরে ঘাস খেতে দিতাম।

সেই সময়ে আমার পরিবারের দুই ধরণের ব্যবসা ছিল, কৃষিকাজ এবং পশুপালন। ফলে আমাদের পরিবার ভালভাবেই চলে যাচ্ছিল। তখন আমাদের ১০০০ গবাদিপশু এবং আলেপ্পোর ব্যবসায়ীদের কাছে বাৎসরিক ইজারা দেয়া ৯০০ বেদানা গাছের ফলের বাগান ছিল। ব্যবসায়ীরা বেদানা পাকার সময়ে আমাদের গ্রামে এসে আশেপাশের বেদানার বাগান থেকে বেদানা সংগ্রহ করে তাদের শহরে নিয়ে যেত। আমাদের আট ভাইবোন মিলে আমি গ্রীষ্মের ছুটি ছাড়াও সারাবছর সাপ্তাহিক এবং অন্যান্য ছুটির দিনে কৃষিকাজে এবং পশুপালনে সাহায্য করতাম। ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত আমি আমাদের গ্রামের বাইরে কখনো পা রাখিনি। এরপরে আমার নবম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার পর আমাদের এলাকার নিকটস্থ আলবু কামাল শহরের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে চলে গেলাম। সিরিয়ার পূর্ব প্রান্তের দাইর ইজ্জোর প্রদেশের ইউফ্রেটিস নদীর পুবের দিকের তীরে আমার গ্রাম আশ শা’ফা অবস্থিত। কাছেই ইরাকের সীমান্ত। সেখানে মরুভূমির বাতাসে ক্ষয়ে যাওয়া ঢেউ খেলানো বালির খাঁড়ি আমাদের গ্রামের খুব কাছেই। আমাদের পরিবারসহ দাইর ইজ্জোরের বেশিরভাগ অধিবাসীই আরব সুন্নি ‘ইগাইদাত’ গোষ্ঠীর অন্তর্গত। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য যেকোনো গোষ্ঠীর মতই ইগাইদাত গোষ্ঠীর মানুষও ইরাক এবং পারস্যে উপসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে বসবাস করে।

সিরিয়ার ইউফ্রেটিস তীরের পূর্বাঞ্চল মূলত প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী প্রধান এলাকা। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা ছিল নিস্তরঙ্গ এবং ঘটনা-বিহীন। এখানে রাষ্ট্র-যন্ত্রের উপস্থিতি ছিল যৎসামান্য এবং গ্রামবাসীর জীবিকা ছিল কৃষিকাজ এবং নির্ভর করত পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে আত্মীয়স্বজনদের পাঠানো অর্থের উপর। এমনকি অতীতের কোন ঘটনাও প্রমাণ করে না আমার বাসভূমি অদূর ভবিষ্যতে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী ইরাকে আক্রমণের পরে সিরিয়া থেকে ইরাকে জিহাদি চলাচলের প্রধান পথে পরিণত হবে। কে জানত আমার বাসভূমি হয়ে যাবে ইসলামিক স্টেটের খেলাফত প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের ময়দান।

আইসিস আশ শা’ফা দখল করে নেয়ার মাস খানেক বা তার একটু বেশি সময় পরে আমার এক ভাই আমার কাছে বাবার ছবি পাঠায়। বাবার মুখে সাদাকালোর মিশেলে লম্বা দাড়ি দেখে চমকে উঠলাম বা যেন একটু শীতল হয়ে গেলাম। আমাদের বাবা সাধারণত নিয়মিত দাড়ি কামাতেন। কিন্তু আইসিস খেলাফতের অধীনে থাকার কারণে অন্যান্য সকল পুরুষের মত বাবাও দাড়ি রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ, দাড়ি হল পুরুষের জন্য ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রাথমিক চিহ্ন। পাঁচ বছর আগে আমি তখন আবুধাবিতে সাংবাদিক হিসেবে আইসিসের প্রতিটি কার্যক্রম করছিলাম, ছবিটা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম আইসিসের উগ্রবাদের নমুনা এবং মানুষকে অপমানের নিত্য নতুন ফন্দি ও ফিকির।
সিরিয়ার সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে আমাদের পরিবারের অবস্থা যে খুব সংকটাপন্ন ছিল, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। আমার পরিবারের কেউ সিরিয়ার বহুমুখী যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণও করে নাই কিন্তু তবুও তাদের যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা সমগ্র সিরিয়ার মর্মান্তিক ঘটনা প্রকাশের নয়া-দিগন্ত উন্মোচন করেছে এবং দেখিয়েছে একটা সমাজ মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই কতটা ভয়ানক উগ্রপন্থীতে পরিণত হতে পারে।

যখন গ্রামগুলোতে সিরিয়ার সংঘাত, যুদ্ধ, গোলাগুলি, বোমাবর্ষণ কেবল অল্পপরিসরে শুরু হয়, তখন শহর এলাকায় যুদ্ধের দামামা ইতিমধ্যেই বেজে গেছে। কিন্তু এরমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে আশেপাশের স্কুল এবং হাসপাতাল এবং আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগল অতি দ্রুত। ২০১৪ সালের জুন মাসের দিকে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে এবং ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলে যখন আইসিস ঝড় বয়ে গেল তখন সেখানে কিছু অবিন্যস্ত অপটু আধাসামরিক বাহিনী দাইর ইজ্জোরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল। ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় তারা যেন খড়কুটোর মত উড়ে গেল। সেখানে দখল নিলো আইসিসের জঙ্গি-দল, তারা যেন রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনীর মতই কাজ করতে লাগল।

আইসিস প্রথমেই দখল করে ফেলল সরকারী সম্পত্তি। আইসিসের কাছে যাদেরকে মনে হচ্ছিল ধর্মদ্রোহী তাদের সহায় সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করে নিলো। দখলকৃত সরকারী বেসরকারি ভবনগুলোতে তারা স্থাপন করল অস্থায়ী সেনানিবাস, বেইজ ক্যাম্প। এরপর থেকেই আইসিস নাটকীয়ভাবে প্রসারিত করতে লাগল তাদের অধিকৃত অঞ্চলের পরিধি। যুদ্ধের পূর্বে যেমন সরকারী-বাহিনীর তেমন কোন দৌরাত্ম্য ছিল না ঠিক তার উল্টো ঘটনা ঘটল আইসিস ক্ষমতা দখলের পরে। সর্বত্র দেখা যেতে লাগল আইসিস জঙ্গিদের আনাগোনা। আইসিস অধিকৃত অঞ্চলে তারা প্রতিটি বর্গ-ইঞ্চি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এমনকি পারিবারিক কোন্দল যা হয়ত কিছুদিন পূর্বেও আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব নিয়মে সমাধান হতো সেটাও এখন সমাধান দিচ্ছে আইসিস জঙ্গি।

যুদ্ধের আগে আমার গ্রামে একটা থানা পর্যন্ত ছিল না এবং সমস্ত দাপ্তরিক কাজকর্ম সমাধা হতো নিকটস্থ শহরে। কিন্তু আইসিস এই অঞ্চল দখল নেয়ার পরেই স্থাপন করল ‘হিসবাহ’ (ধর্মীয় পুলিশ) কেন্দ্র এবং প্রতিটি গ্রামে গোষ্ঠীদের মধ্যে আইসিস প্রচার কেন্দ্র। এলাকাময় পাহারা দিতে লাগল আইসিসের জঙ্গিরা ফলে গ্রাম থেকে কোন মানুষ, পথচারী আলবু কামাল শহরে যাওয়ার পথে ইউফ্রেটিস নদীর উপরে সংযোগ সেতুর দুইপাশে কয়েকবার তল্লাশির শিকার হতে লাগল। মানুষ তার আপন পরিবারের কাছেও আলাপচারিতায় সাবধানী হয়ে গেল। কিছুদিন আগেও কিন্তু এই অতি সতর্কতার কোন দরকার ছিল না, এমনকি আল-কায়েদার জঙ্গি সংগঠন জাবাত আল-নুসরা যখন দাইর ইজ্জোর নিয়ন্ত্রণ করত তখনো মানুষ এত সতর্ক ছিল না। গ্রামের মধ্যে ইসলামিক স্টেটের নিরাপত্তা যন্ত্র ব্যবস্থাপনার প্রধান সমন্বয়কারী ছিল একজন ২০ বছরের সিরিয়ান বংশোদ্ভূত বাহরাইন যুবক। সে এবং তার জঙ্গি-দল স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছে নিজেদেরকে মুক্তিদাতা হিসেবে উপস্থাপন করল এবং শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। পুরুষদেরকে শুধু দাড়ি রাখলেই হবে না মসজিদে নামাজ পড়াও বাধ্যতামূলক এবং মেয়েদেরকে পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে বোরখা পরতে হবে। ধূমপান এবং সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। কোন শরিয়া আইন ভঙ্গ করলে যেমন রমজানে দিনের বেলা পানাহার থেকে শুরু করে ব্যভিচারের শাস্তি প্রকাশ্য দিবালোকে বেত্রাঘাত অথবা ক্ষেত্র বিশেষে শিরশ্ছেদে মৃত্যুদণ্ড। জঙ্গিদের হাতে নিহতদের মৃতদেহ জনবহুল স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হতো যাতে সাধারণ মানুষ দেখতে পায়।

আমাদের গ্রাম দখল হয়ে যাওয়ার দুই মাস পর ২০১৪ সালের আগস্টে আমাদের পরিবার বুঝতে পারে আইসিসের ভয়াবহতা কতটা মারাত্মক এবং ব্যাপক। সেই সময়ে আইসিস এক মাসেই সাধারণ মানুষের উপর অমানসিক অত্যাচার, হত্যাকাণ্ড চালায়। ইরাকের ইয়াজিদি ধর্মের লোকদেরকে দাসে পরিণত করে এবং শায়তাত গোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শায়তাত গোষ্ঠী ইগাইদাত গোত্রের অংশ, আমাদের গ্রাম থেকে কয়েকটা গ্রাম দূরে তাদের বসবাস। আইসিস তাদেরকে ‘তাইফা মুমতানিয়া’ ঘোষণা করল। ফলে তারা হয়ে গেল ধর্মদ্রোহী মুসলিম যারা শরিয়া আইন মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায়। আইসিস একদিনে শায়তাত গোষ্ঠীর কমপক্ষে ৭০০ জনকে হত্যা করে। বেঁচে যাওয়া হতভাগ্যদের বেশিরভাগই হল বৃদ্ধ পুরুষ, নারী এবং শিশু। তারা পালিয়ে আশ শা’ফা গ্রামে চলে আসে এবং আমাদের পরিবার তাদের কাছ থেকে ঘটনার ভয়াবহতা শুনতে পায়। গোত্রের মধ্যস্থতাকারী পালিয়ে বেঁচে যাওয়া লোকদেরকে দয়া দেখানোর জন্য আইসিস নেতা আবু বকর-আল বাগদাদিকে রাজি করাতে সক্ষম হয় কিন্তু শেষপর্যন্ত আইসিস নির্দয়তার সর্বোচ্চ পরিচয় দেয়।

আমার ভাই হুসাইন আমাকে জানায় “আইসিসের অধীনে মানুষ চিরস্থায়ী ত্রাসের রাজত্বে বাস করে। তোমাকে নিশ্চিত করতে হবে তুমি কোন ভুল করছ না এবং তাদের ধারে কাছে ঘেঁষছ না। একমাত্র সেটাই তোমার বাঁচার পথ।” যারা ইতিপূর্বে সরকারবিরোধী এবং ফ্রি সিরিয়ান আর্মির মত অজিহাদি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল তাদের বিপদ সীমাহীন। তারা ছিল আইসিসের সম্ভাব্য হুমকি। আইসিস তাদেরকে প্রথমদিকে ডেকে অনুতাপ করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলে এবং মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়।

দাপ্তরিক কাজে এবং সামাজিক অবকাঠামোতে নিরাপত্তার কুখ্যাত যন্ত্রপাতি এবং নজরদারি ব্যবস্থা আরও কড়া হয়ে যাওয়ার কারণে ২০১৫ সালে আইসিস খেলাফত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে জনসাধারণ পালিয়ে যাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয় প্রবল জনস্রোত। একই বছর হুসাইন তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরসহ আমাদের পরিবারকে গ্রামের বাইরে বের করতে সক্ষম হয়। ২০১৬ সালে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এই নরক থেকে বেরিয়ে আসে। আইসিস অধিকৃত ‘ইসলামি দেশ’ থেকে ‘কাফের দেশে’ পলায়ন ঠেকাতে আইসিসের কাছে থেকে লিখিত অনুমতি ছাড়া সাধারণ জনগণের চলাচলের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হল। এমনকি কারো যদি চিকিৎসার প্রয়োজনেও বাইরে যেতে হয় তাহলে তার পক্ষ থেকে ইসলামিক খেলাফতে বসবাসকারী কেউকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে উক্ত ব্যক্তি অবশ্যই ফিরে আসবে। গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে আইসিস তাদের নিরাপত্তা চৌকি বাড়িয়ে দিলো, যদি কোন গাড়ি চালক কেউকে লুকিয়ে সীমান্ত পার করার চেষ্টা করে তাকে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের পালানোর পথগুলোতে ভূমি-মাইন পেতে রাখা হল। তবুও আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মানুষের পালিয়ে যাওয়ার গতি বেড়েই চলল। শুধু আইসিসের বর্বরতা বৃদ্ধির কারণেই নয়, বরং রাশিয়ার বোমাবর্ষণ আর অবকাঠামোর উপর যুক্তরাষ্ট্র জোটের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞও অন্যতম কারণ।

আইসিস ২০১৭ সালে মসুল, রাকা এবং আনবারে পরাজিত হওয়ার পরে সর্বশেষ শক্ত-ঘাঁটি ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকায় ঝাঁকে ঝাঁকে জড়ো হতে লাগল জঙ্গির দল। আইসিস জঙ্গিরা অতিদ্রুত পালিয়ে যাওয়া মানুষের ফাঁকা বাড়িতে ‘ইঁদুরের মত’ দখল করে নিলো। একদিন যুদ্ধের বিভীষিকা থেমে যাবে এবং তখন পালিয়ে পরিবার বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ত আবার ফিরে আসবে এই আশায় শত বিপদের মধ্যেও স্থানীয় কিছু মানুষ সহায় সম্পত্তি রক্ষা করতে রয়ে গেল। কেউ কেউ তো সাথে প্রাণ ছাড়া আর কিছুই নিতে পারে নি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও আমার বাবা, বোন, চাচা, এবং চাচাতো ভাইবোন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যদিও ২০১৭ সালে চিকিৎসার প্রয়োজনে বাবা ইউফ্রেটিস উপত্যকা ত্যাগ করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার পরিবার আইসিসের মুখোমুখি হওয়া পরিহার করে আসছিল, কিন্ত আমার চাচাত ভাই উসামার ভাগ্য এতটা প্রশস্ত ছিল না। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একদিন সে তার বাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় আইসিস জঙ্গিদের সামনে বালির ঢিবিতে আঘাত করে ফেলে এবং কিছু বালি উড়ে যায় ও নুড়ি পাথর তাদের গায়ে লাগে। আইসিস জঙ্গিরা তাকে থামায় এবং অভিযোগ করে সে তাদেরকে আঘাত করতে চেয়েছে। জঙ্গিরা তার বাড়িতে তল্লাশি চালায় এবং একটা ক্যামেরা আর বন্দুকের সন্ধান পায়। এইসব উপাদান আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিষিদ্ধ ফলে জঙ্গিরা তাকে তাদের জিম্মায় নিয়ে যায়।

জঙ্গিরা উসামার পরিবারকে আশ্বস্ত করে যে উসামাকে নিয়মিত জিজ্ঞাসাদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে তাকে বিচারকের সম্মুখীন করা হবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই জঙ্গিরা জানায় তারা উসামার কোন খোঁজখবর বা কোথায় আছে কিছুই জানে না, তবে আইসিসের সাধারণ নিরাপত্তা গোয়েন্দারা তাকে নিয়ে গেছে। সাধারণত যদি কোন সাধারণ নাগরিকের কাছে ক্যামেরা পাওয়া যায় তবে আইসিস সন্দেহ করে যে সে হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করে। একই ধরণের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রামে ইতিপূর্বে আইসিস অভিযুক্তকে হত্যা করেছে, ফলে উসামার পরিবার ভয়ে সিটিয়ে রইল।

প্রায় মাস খানেক পরে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আমার বাবা-মায়ের বস্ত ভিটায় গোলা আঘাত হানে এবং আমার বাবা গুরুতর আহত হন। শেষ পর্যন্ত বাবা আমার বোনদের নিয়ে দেশ ছাড়তে রাজি হয়। সব সময় দেশ ত্যাগে বাধাদানকারী চাচা অনিচ্ছা সত্বেও তার সন্তানদের নিয়ে দেশ ছেড়ে যেতে চান যদিও তখনো উসামার কোন হদিস পাওয়া যায় নি। আমার পরিবারের বেশীরভাগ সদস্য সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পৌঁছাতে সক্ষম হয় এবং সেখান থেকে আইসিস নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের আশ্রয় শিবিরে পৌঁছান। এই দীর্ঘ পরিক্রমা আমার বাবার শরীরের উপর বড় ধকল দিয়ে গেল কিন্তু তিনি একজন আত্মীয়কে সাথে নিয়ে আবার গ্রামে ফিরে গেলেন।

বাড়িতে ফিরে আমার বাবা দেখতে পেলেন দুইজন ইরাকি আইসিস জঙ্গি বাড়িতে ফেলে যাওয়া গাড়ির যন্ত্রাংশ খুলে নিচ্ছে। তিনি জঙ্গিদের গাড়ির যন্ত্রাংশ খুলতে বাধা দিলে জঙ্গিরা উল্টো বাবাকেই খেলাফত থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে। বাবা বুঝতে পারলেন যদি তিনি গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরিতে বাধা দেন তাহলে হয়ত জঙ্গি দুইটা তার বিরুদ্ধে নালিশ করে দিবে অথবা এখানেই খুন করে ফেলতে পারে। বাবা ঘরে বসে রইলেন এবং দ্বিতীয় দফার চেষ্টায় পরিবারের সব সদস্যদেরকে নিয়ে আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের বাইরে শায়তাত গোত্রের মুক্ত ভূমিতে পৌঁছাতে সক্ষম হন।

বাবাকে হাসপাতালে নেয়া হয় চিকিৎসার জন্য। একই সময়ে আমার বোন, চাচা এবং চাচাতো ভাইয়েরা আশ্রয় শিবিরে অপেক্ষা করছিল। এর অল্প কিছুদিন পরেই জানুয়ারি মাসে আমাদের গ্রাম জঙ্গি মুক্ত হয় এবং খবর পাওয়া যায় গেল আইসিসের হাতে বন্দীদেরকে সিরিয়ান ডেমোক্রেডিট ফোর্সের কাছে হস্তান্তর করবে। আমার চাচতো ভাই বন্দীদের একজন জীবিত বা মৃত যাই হোক না কেন তার সন্ধান চাই। আইসিস সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে তাদের শাসন অবকাঠামো জারি রেখেছে এবং শরিয়া আইন প্রবর্তন করতে চায়। যদিও এটা নিশ্চিত যে তারা বেশিদিন টিকতে পারবে না। ইরাকের মসুলে আবু বকর আল-বাগদাদির ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার চার বছর আট মাস পরে ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ খেলাফত সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ে। আর আমার পরিবারের জন্য এক অধ্যায় সমাপ্ত হলেও অন্য অধ্যায়ের সবে শুরু।

আমি সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন একটা শহরের যে গ্রামে বেড়ে উঠেছি সেখান থেকে আমার বাবা এবং ভাইবোন অনেক দূরে থাকে। পরিবারের কেউ জানে না তারা আবার বাড়িতে ফিরতে পারবে কী না বা গ্রামে পৌঁছে আদৌ তাদের বাড়ি চিনতে পারবে কী না। আমাদের গবাদিপশুগুলো আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে আর ফল বাগানের ভাগ্যে কী আছে অজানা এবং মরুভূমির যেখানটাতে আমি এক সময়ে ভেড়া চরাতাম সেখানে এখন প্রবেশ করা যায় না কারণ সেখানে আইসিস জঙ্গিরা মাইন পুতে রেখেছে। এরকম দুর্ভোগের ভুক্তভোগী গ্রামের সবাই। পশুপালন ও ফলের বাগানে কাজ করার জন্য বাবা একসময়ে কমপক্ষে তিনজন শ্রমিক নিয়োগ দিতেন এবং তাদের পরিবারের সবার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতেন বিশেষ করে রমজান এবং শীতের মৌসুমে। সেই মানুষকে আজ সামান্য হাত খরচার জন্য বিদেশে থাকা সন্তানদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে এবং তিনি এখন কেউকে কোন সাহায্য করতে পারেন না। পরিস্থিতি যত-বেশি উন্মোচিত হচ্ছে চিত্রটা ততই গুরুতর হয়ে উঠছে। আইসিস নিপাত গেলেও রেখে গেছে সামাজিক কোন্দল। তারা সমাজকে বিভাজনের কৌশল অবলম্বন করে শাসন করত। তার প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখা যাচ্ছে এখন; স্থানীয় যারা আইসিসকে সাহায্য করেছিল তাদের প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে শায়তাত গোষ্ঠী। কিন্তু এটা বলা অসম্ভব ঠিক কত সংখ্যক মানুষ ইসলামিক স্টেটের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

কিন্তু আমাদের সম্প্রদায়কে জবর দখল আইসিসের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ছিল না, কোনভাবে আবশ্যক তো নয়ই। গ্রাম এলাকা এমনিতেও রক্ষণশীল ছিল এবং গোত্রের নিয়মকানুন দ্বারা পরিচালিত হতো কিন্তু ধর্মীয়ভাবে ততটা গোঁড়া ছিল না। কঠোরভাবে ধর্মীয় বিধিনিষেধ, আচার অনুষ্ঠান মেনে চলা ব্যক্তি গ্রাম এলাকায় দরবেশ বলে পরিচিত ছিল, তাকে মানুষ সাধারণত সাদাসিধে আলাভোলা মনে করত। আইসিসের দখল নেয়ার আগ পর্যন্ত ঐতিহাসিকভাবে ফাল্লুজা থেকে আলেপ্পোর গ্রাম পর্যন্ত সুফিবাদের ব্যাপক চর্চা হতো। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের পর এই অঞ্চলে শান্ত সুফিবাদের বদলে উগ্রবাদী জঙ্গি আইসিস ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো। ২০১৪ সালে আইসিসের নাটকীয় উত্থানের প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়াতে আইসিস তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল কিন্তু দাইর ইজ্জোরে তাদের কোন তৃণমূল সমর্থক ছিল না। আইসিসকে অন্য বিদ্রোহী জঙ্গি দলের কাছ থেকে দাইর ইজ্জোরকে ছিনিয়ে নিতে হয়েছিল এবং দাইর ইজ্জোরের নাগরিকদের একাংশ পূর্বের বিদ্রোহী দলের সাথেই কিছুটা মানিয়ে নিয়েছিল।

যদিও বিগত পাঁচ বছরে এই এলাকা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সৃষ্টি করেছে নতুন বাস্তবতা। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে, ক্ষমতার শূন্যতা দেখা দিয়েছে সেই সাথে ধর্মীয় উগ্রবাদ। পরিস্থিতি কেউ বুঝিয়ে বলতে পারবে না। যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত আমাদের গ্রামবাসীদের নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন, তারা হয়ত উগ্রপন্থী আইসিসে যোগ দিবে, যদিও কিছু দিন আগেও তারা হয়ত দৃঢ়ভাবে উগ্রপন্থাকে নাকচ করতে পারত। দুইটা সম্ভাবনা এবং বাস্তবতার মধ্যে আলোকপাত করলে দেখা যায় ছোট বয়সে আমি যে সাধারণ একটা পরিবেশে বাস করতাম আর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আমার বাবা কী জটিল ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। পরিস্থিতির বৈপরীত্য হয়ত সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি গুরুতর হবে।

মূল প্রবন্ধ: What ISIS Did to My Village