যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ ওয়েলসে প্রতিষ্ঠিত সন্ত্রাসবাদের বিস্তৃত চক্রকে এখন মনে করা হচ্ছে আমাদের ধারণার থেকেও অধিক সুপরিকল্পিত এবং আধুনিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিবিসি ওয়েলসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দক্ষিণ ওয়েলসের পন্টিপ্রিডে সন্ত্রাসবাদের রোপিত চারাগাছ আজকে এই বিশাল মহীরুহ ফুলে ফলে শাখায় পত্র পল্লবে পল্লবিত হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে আগত আপাতত দেখতে ‘নাজুক চেহারার’ একজন কম্পিউটার প্রকৌশলীর হাত ধরে।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে পেন্টাগনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা কর্নেল স্টিভ ওয়ারেন ইরাক এবং সিরিয়াতে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গি দলের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সন্ত্রাস দমন অভিযান “অপারেশন ইনহেরেন্ট রিজলভ” নিয়ে একটা ভিডিও বার্তা নির্মাণ করেন। পেন্টাগনের মুখপাত্র কর্নেল স্টিভ ওয়ারেন ভিডিও বার্তায় আইসিসের ১০ জন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গির খুঁটিনাটি তথ্য প্রকাশ করেন যাদেরকে কয়েকমাসের অভিযানে ড্রোন হামলায় খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, “আমরা আইসিসের বিষাক্ত কালসাপ খুঁজে বের করে তাদের মাথায় আঘাত করে পালের গোদাদের হত্যা করেছি। যারা নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে সাইফুল সুজন অন্যতম, সাইফুল সুজন একজন বাংলাদেশের নাগরিক যাকে লক্ষ্য করে ১০ ডিসেম্বরে সিরিয়ার রাকাতে ড্রোন হামলা করা হয়।”
কর্নেল স্টিভ ওয়ারেন বলেন, “যুক্তরাজ্যে কম্পিউটার সিস্টেম প্রকৌশলে উচ্চ শিক্ষিত সাইফুল সুজন ছিল আইসিসের বাইরে থেকে পরিচালনা এবং পরিকল্পনাকারী একজন গুরুত্বপূর্ণ এবং শীর্ষস্থানীয় আইসিস নেতা।”

Siful Sujan was targeted near Raqqa in Syria

যুক্তরাষ্ট্রের ঐ সেনা কর্মকর্তা সুজনকে আইসিসের ‘অন্যদের সুরক্ষিত কম্পিউটারে অনুপ্রবেশ (হ্যাকিং), নজরদারি এড়ানোর কৌশল, মারণাস্ত্রের উন্নয়ন’ পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেন। সাইফুল এখন নিহত হয়েছে, আইসিস হারাল তাদের জঙ্গি-চক্রের জাল বিস্তারের প্রধান সংযোগকারীকে, এই বলে কর্নেল ওয়ারেন তার কথার ইতি টানেন।
সাইফুল সুজন এবং তার ভাই আতাউল হকের তৃতীয় সাথে আরও একজন ব্যক্তি আছে যে সাইফুল সুজন ও আতাউল ভ্রাতৃদ্বয়ের ব্যবসাতে আইনত অংশীদার নয় কিন্তু আইব্যাকের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দক্ষিণ ওয়েলসে জন্ম নেয়া এবং যুক্তরাজ্যের শিক্ষা দীক্ষায় বেড়ে উঠা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ এই যুবক একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। নাম তার আবদুল সামাদ এবং সে দ্রুত সুজনের ব্যবসা পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরের মত গত দশকে কার্ডিফেও পরিবর্তন ঘটে গেছে সবার অলক্ষ্যে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে আগত সংখ্যালঘু যুবক, ইসলামে নব্য দীক্ষিত, মৌলবাদী তরুণ যুবকরা সংখ্যায় কম হলেও তারা প্রভাববিস্তারকারী, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে তারা বিভ্রান্ত হয়ে এবং আইসিসের হিংস্র ও উগ্র ধর্মীয় অলঙ্কারে ভূষিত বয়ানে মৌলবাদে প্রভাবিত হয়ে কার্ডিফে বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দিতে লাগল।
কার্ডিফের নাসের মুথানা এবং রিয়াদ খান ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যায় এবং আন্তর্জাতিক জিহাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। আইসিসের বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ভিডিওতে তাদের সরব উপস্থিতি দেখা যেতে লাগল এবং ইরাক ও সিরিয়াতে নতুন ঘোষিত ইসলামিক স্টেটের সাথে তাদের সখ্যতা প্রকাশ পেতে লাগল।

ইংল্যান্ডে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কাছে সাইফুল সুজনকে কখনো রক্ষণশীল ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ মনে হয়নি, তার মুখ থেকে কেউ কোনদিন মৌলবাদী বয়ান শোনেনি এবং জিহাদকে সমর্থন দিয়ে সে কোনদিন ধর্মীয় বাণী লেখেনি। সুজনের সাথে সামান্য কিছু ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল কার্ডিফের এমন একজন রেস্তোরার মালিক এনাম উজ্জামান বলেন, “সাইফুল সুজনকে কখনো ধার্মিক মনে হয়নি। সে ছিল তার ব্যবসায়ের প্রতি একনিষ্ঠ মনযোগী এবং টাকা আয় করাই ছিল তার লক্ষ্য।”

Siful Sujan came to the UK from his native Bangladesh in the early 2000s

বাংলাদেশে ভ্রমণের সময় এনাম উজ্জামান সুজনের বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এনাম উজ্জামান বলেন, “সুজনের বিয়ে মোটেও কোন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের বিয়ের মত ছিল না, এমন নয় যে সেখানে ছেলেদের একপাশে, মেয়েদের অন্যপাশে বসার ব্যবস্থা বরং সেখানে ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা, কথা বলার সুযোগ ছিল। মনে হবে আপনি যেন ইংল্যান্ডের পশ্চিমা সংস্কৃতির কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।” আইব্যাকস এর অফিস যেখানে ভাড়া নেয়া হয়েছে যে বিজনেস পার্কে সেখানকার একজন অফিস সহকারী সুজন সম্পর্কে বলেন, “সুজন হঠাৎ করে পশ্চিমা স্টাইলের ক্লিন শেভ চেহারা ছেড়ে বাংলাদেশের আর আট দশটা মুসলিম ধার্মিকের মত দাঁড়ি রাখতে শুরু করে।”
কিন্তু যদিও তার এই দাঁড়ির মধ্যে মৌলবাদের কোন ছাপ ছিল না। কিন্তু যদি সে সত্যিই উগ্র ধর্মীয় শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে এবং আইসিসের প্রচারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে তবুও সে মাথা গরম মুথানা এবং রিয়াদ খানের মত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে নি। সুজন তার নিজের চিন্তা ভাবনা নিজের এবং নিজের সীমাবদ্ধগণ্ডির মাঝেই আবদ্ধ রেখেছিল।

Reyaad Khan, Nasser Muthana and Abdul Rakib Amin, from Aberdeen


Aseel Muthana travelled to Syria in 2014 to join his brother who was fighting for IS

সাইফুল সুজন এবং আতাউল হক দুভাই দুজন যমজ বোনকে বিয়ে করে এবং তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ওয়েলসে নিয়ে আসে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার ভাই আতাউল হকের স্ত্রী মারা যায়। কারো কারো মতে, সম্ভবত এই সময়টাই তার জীবনের ক্রান্তিকাল এবং ঘটেছিল পরিবর্তন, ঘুরে গেল জীবনের মোড়। সাইফুল সুজন হয়ে গেল পশ্চিমা ঘরানার উচ্চাভিলাষী ব্যবসায়ী থেকে ইসলামের মৌলবাদের সমর্থক, আর্থিক এবং সামরিক সরঞ্জামাদির যোগানদাতা। অত্যন্ত বিবেচ্য বিষয় এই যে, ঘটনা বহুদূরে বিস্তৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ পুলিশ এসবের কিছুই জানতে পারেনি। কখন এবং কীভাবে সুজনের পেশাগত জীবনের ক্রান্তিকালের সূচনা সেই সন্ধিক্ষণ খুঁজতে আমি এই বছরের শুরুর দিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তীব্র শীতের মধ্যে আমি বাল্টিমোরে গেলাম। যুক্তরাজ্যের মত যুক্তরাষ্ট্রও নিজ দেশের মাটি, আবহাওয়া, পরিবেশে, সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা ইসলামিক জঙ্গি মোকাবিলা করেছে যেসব জঙ্গিরা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছে জিহাদ করতে এবং আইসিসের কেন্দ্রে অবস্থান করতে। অন্যরা কেউ কেউ আইসিস’কে ডেকে এনেছে, নিজেরা আইসিসে পরিণত হয়েছে, সমমনাদেরকে জঙ্গিবাদের দীক্ষা দিয়েছে এবং জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে আমেরিকার মাটিতেই হামলা পরিচালনার করার চেষ্টা করেছে। যেমন আমেরিকার আর্মির মনস্তাত্ত্বিক মেজর নিদাল হাসান ইতিমধ্যে আইসিসের জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৯ সালে আফগানিস্তানের তালিবান জঙ্গিদের রক্ষা করতে টেক্সাসের ফোর্ট হুড আর্মি বেইস ক্যাম্পে নিরস্ত্র সৈন্যদের উপর নির্বিচারে গুলি শুরু করে এবং এই ঘটনায় ১৩ জন্য আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়। একইভাবে ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিলে কিরগিস্তানের চেচেন বংশোদ্ভূত এবং ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জোখার আনজরোভিচ জারনায়েভ এবং তার সহোদর ভাই তামারলান জারনায়েভ বোস্টনে এক ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় ফিনিশিং লাইনে দুইটা প্রেশার কুকারে বোমা পেতে রাখে, এই হামলায় বেশকিছু মানুষ হতাহত হয়।
উচ্চ তথ্য প্রযুক্তি সম্পন্ন অপরাধ তদারকি এবং দিনকে দিন উন্নতির দিকে যাওয়া কার্যকর নজরদারি ব্যবস্থাকে ধন্যবাদ, এফবিআই এবং বিভিন্ন সহযোগী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থ যোগান প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে, ফলে আমেরিকা এখন নিজের মাটিতে জঙ্গি হামলা ঠেকাতে এখন আগের থেকে বেশি সক্ষম। এরই ধারাবাহিকতায় এফবিআই ২০১৫ সালে খুঁজে পায় সুজনের পাঠানো অর্থ পাচ্ছে বাল্টিমোরের অধিবাসী মহম্মদ এলসিনাভি নামের একজন পত্রিকা সরবরাহকারী।

Mohamed Elshinawy

বাল্টিমোরের অধিবাসী মহম্মদ এলসিনাভি দীর্ঘ দিন ধরেই বিদেশ থেকে মানিগ্রাম এবং ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে অল্প পরিমাণে অর্থ পেয়ে আসছিল। বিভিন্ন দফায়, বিভিন্ন মানি ট্রান্সফার সেবার মাধ্যমে সে প্রায় ৮০০০ মার্কিন ডলার বা ৬০৪৫ পাউন্ড সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। ২০১৫ সালের অক্টোবরে এফবিআই তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, মহম্মদ এলসিনাভি’র বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে থাকে এবং সেখান থেকেই গোয়েন্দা সংস্থা পত্রিকা সরবরাহকারী মহম্মদ এলসিনাভি’র সাথে সাইফুল সুজন এবং তার কার্ডিফের আইব্যাকস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পায়। এমনকি এফবিআই অতি দ্রুতই বুঝতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার উদ্দেশ্যে এই অর্থ পাঠানো হয়েছিল। অর্থ পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাজ্যের আইব্যাকসের একাউন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জিহাদির কাছে এবং কীভাবে হামলা পরিচালনা করতে হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ দিকনির্দেশনা। ওয়াশিংটন ডিসি’তে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উগ্রপন্থা’ বিষয়ের সহকারী পরিচালক এবং সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ সিমাস হিউজ এলসিনাভি’র জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা সম্বন্ধে এক বছর ধরে পঠন পাঠনের পর বলেন, “সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার জন্য এলসিনাভি’র জঙ্গি নির্দেশদাতা দরকার যারা তাকে যাবতীয় দিক নির্দেশনা দিবে।”

Terrorism expert and academic Seamus Hughes spoke to Wyre Davies

মাকড়শার জালের মত সন্ত্রাসবাদের সচিত্র তথ্য উপাত্ত পিন দিয়ে আটকানো আছে সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ সিমাস হিউজের অফিসের দেয়ালে। গ্রাফিক্সে দেখা যাচ্ছে সন্দেহভাজনদের তালিকা ও ছবি যাদের কেউ জীবিত এবং কেউ কেউ অভিযানে নিহত হয়েছে। সিমাস হিউজ এখন সেইসব সন্ত্রাসী কুলাঙ্গার এবং তাদের জটিল কার্যকলাপ খুঁজে বের করছেন। সিমাস হিউজ বলেন, “এলসিনাভি’র সাথে প্রথম যোগাযোগ ছিল টেক্সাসে একজন মানুষকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু যখন এনসিনাভি সেটা করতে ব্যর্থ হয় তখন তার নির্দেশদাতারা তাকে বলে, কেন তুমি বাল্টিমোরে বেশি পরিমাণ মানুষের উপর হামলা করছ না?”

এলসিনাভি’র সাথে সুজনের যোগাযোগের সময় সুজন তাকে কমপক্ষে ১৬ টা ভিডিও ক্লিপ পাঠায় যেখানে কীভাবে বোমা বানাতে হবে তার নির্দেশনা দেয়া আছে। এফবিআই দেখাতে সক্ষম হয়েছে এলসিনাভি সম্ভাব্য কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে হত্যার লক্ষ্য হিসেবে খুঁজে ফিরেছে, এমনকি সে বাল্টিমোরের ফেডারেল কোর্টের প্রধান ভবনেও সম্ভাব্য মানুষকে হত্যার উদ্দেশ্যে খুঁজতে গেছে। মহম্মদ এলসিনাভি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ জেরার মুখে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, সে চলতি বছরের শুরুর দিকে সে কয়েকটা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ছিল। বিচারে তার ২০ বছরের জেল হয়।

Mohamed Elshinawy was recruited by IS

আমেরিকার স্বভূমিতে বেড়ে ওঠা একজন সম্ভাব্য জঙ্গি ধরা পড়েছে এবং সে এখন নিরাপদ হাজতে বন্দি অবস্থায় আছে। সিমাস হিউজ বলেন, “কিন্তু এফবিআই’র গত দুই বছরের তদন্তে দেখা যাচ্ছে আইসিসের কর্মকাণ্ডের জাল কত সুবিস্তৃত এবং কত আধুনিক উপায়ে এলসিনাভিকে জঙ্গি দলে ভিড়িয়েছে। আইসিস কত সফল এবং ত্রুটিমুক্তভাবে দক্ষিণ ওয়েলসের তথ্য প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান আইব্যাকসকে ব্যবহার করেছে যে তাকে নির্দোষ ভাবা ছাড়া উপায় নাই”। সিমাস হিউজ বলেন, “প্রক্রিয়াটা এত আধুনিক ছিল যে আমার কাছে মনে হয় আইসিসের কাছ থেকে এতটা আধুনিক অগ্রসরতার কথা কোন বিশেষজ্ঞ চিন্তাও করতে পারবে না। তারা শেল কোম্পানিকে ব্যবহার করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টাকা পাচারের জন্য যা খুবই অনন্য এবং কেউ ইতিপূর্বে ভাবতেও পারেনি। এটাই হল আমাদের জ্ঞানত আমেরিকার একমাত্র আইসিস অর্থায়নে হামলা প্রচেষ্টা।” সিমাস হিউজের আর কোন সন্দেহই রইল না যে এলসিনাভি’র আটকের ঘটনা সুজন এবং তার সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের বিশাল বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের গোপন জাল উন্মোচন করে দেবে।

আমরা কয়েক মাস এলসিনাভি’র বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের স্বপক্ষে প্রাপ্ত এফবিআই’র সকল তথ্য এবং আদালতের যাবতীয় নথিপত্র, প্রয়োজনীয় দলিল প্রমাণাদি খুঁটিনাটি পড়েছি যা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা দেখেছি আইসিসের জঙ্গি হামলা পরিচালনার জন্য সুজন অর্থ এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি যোগান দিতো। এফবিআই’র প্রতিটি নথিপত্রে বারংবার সুজনের সাথে আরও দুইটা নাম এসেছে তাদের একজন হল সুজনের ভাই আতাউল হক এবং অন্যজন আইব্যাকসে সুজনের সহকর্মী এবং কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ আবদুল সামাদ। এফবিআই বলছে তাদের তথ্য প্রমাণ বলছে আবদুল সামাদ সক্রিয়ভাবে আইসিসকে সমর্থন করে এবং সুজনের নির্দেশনায় সামাদ ব্যক্তিগতভাবে আমেরিকার এলসিনাভিকে অর্থের যোগান দিয়েছে। এফবিআই নথিপত্র আরও জানাচ্ছে যে, সামাদ আইসিস’কে সাংগঠনিকভাবে সাহায্য করেছে এবং তাদেরকে সামরিক বা কারিগরি বিভিন্ন সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে দিয়েছে।

আমরা জানতে পেরেছি সুজনের কার্যক্রমের ফলে আইসিস সামরিককাজে ব্যবহারের উপযোগী নজরদারি যন্ত্রপাতি, ড্রোনের যন্ত্রাংশ, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বা শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার্য সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহে পারদর্শী হয়ে উঠেছে, এবং আইসিসের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সুজন এগুলো তুরস্ক দিয়ে সিরিয়া এবং ইরাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। আইসিস এইসব যন্ত্রপাতি নিজেদের সামরিক কাজে ব্যবহার করে থাকে। যেমন এফবিআই খুঁজে পেয়েছে সাইফুল সুজনের অনুরোধে আবদুল সামাদ উত্তর আমেরিকার সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কীভাবে সরাসরি ১৮,০০০ মার্কিন ডলার (১৩,৬০১ পাউন্ড) মূল্যের সামরিক নজরদারি সরঞ্জামাদি কিনেছিল এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছিল। এফবিআই একাধিকবার নিশ্চিত করে বলেছে আইব্যাকসের যে ধরণের ব্যবসা তাতে কোনভাবেই এই ধরণের যন্ত্রপাতি লাগার কথা না। কারণ আইব্যাকস তো মূলত হোটেল ব্যবসাকে তথ্য প্রযুক্তির সেবা দিয়ে থাকে। এফবিআই আবদুল সামাদের সাথে আইসিস জঙ্গিদের যোগাযোগ এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ইতিহাস ঘেঁটে তথ্য প্রমাণ-সহকারে উন্মোচন করেছে জঙ্গিদেরকে অর্থ প্রেরণে এবং সামরিক সরঞ্জামাদি পাঠানোর ক্ষেত্রে সামাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। এফবিআই’র দাবীর মতো আমাদের অনুসন্ধানেও প্রমাণিত হয় সামাদ আইসিসের সক্রিয় সমর্থক এবং ইসলামিক উগ্রপন্থার সাথে তার যোগসাজশ ছিল।

কিলওবামা৭৭

আবদুল সামাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইসিসের কিছু প্রচারণা ভিডিও শেয়ার দেয় যেখানে ভিডিওর ধারাবর্ণনাকারী ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠার আবেদন জানানো হয়। একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সব মুসলিমদেরকে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়। আবদুল সামাদ আল-কায়েদার একজন শীর্ষস্থানীয় ভয়ংকর জঙ্গিকে ‘২১ শতকের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করে।
সাইফুল সুজনের আইব্যাকস প্রতিষ্ঠানের একজন হিসাব রক্ষকের কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড ছিল কিলওবামা৭৭। যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ পুলিশ ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর আবদুল সামাদকে গ্রেফতার করে এবং একই দিনে সিরিয়াতে আমেরিকার ড্রোন হামলায় সাইফুল সুজন নিহত হয়।

Evidence was seized from Abdul Samad’s Newport home

সাইফুল সুজন নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত আবদুল সামাদ ছিল আইব্যাকস কার্ডিফ অফিসের একচ্ছত্র অধিপতি এবং গ্রেফতারের সময় সামাদের নিউপোর্টের বাসভবন এবং কার্ডিফের আইব্যাকস অফিসের সমুদয় যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার প্রমাণ হিসেবে জব্দ করা হয়। পুলিশ সামাদকে জানায়, জব্দ-কৃত যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার তাকে কোন অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়।
আমরা আবদুল সামাদকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটা অভিযোগের জবাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দিয়ে চিঠি লিখি। যেমন সেগুলো হল, আবদুল সামাদ যুক্তরাষ্ট্রের একজন স্বীকৃত আইসিসের সমর্থককে অর্থ পাঠানোর দায়ে অভিযুক্ত, সে আইসিসের ব্যবহারের করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সামরিক সরঞ্জামাদি যোগাড়ের ক্ষেত্রে সরাসরি যুক্ত ছিল, তার কম্পিউটারে প্রচুর পরিমাণ জিহাদি ভিডিও এবং উগ্রপন্থার সহায়ক লেখা পাওয়া যায় যা দ্বারা প্রমাণ হয় এফবিআই’র দাবী মোতাবেক আবদুল সামাদ ইসলামিক উগ্রপন্থার একজন একনিষ্ঠ সমর্থক।

২০১৫ সালে প্রথমবারের মত গ্রেফতারের পর কোন প্রকারের শাস্তি ছাড়াই সামাদ বেকসুর খালাস পায় এবং এমনকি তার বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা হয়না। অভিযোগের জবাবে সামাদ জানায় সাইফুল সুজনের নির্দেশে সে করেছে। তার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ সে অস্বীকার করে, সে জানায় সে কোন জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলায় অর্থের যোগান প্রসঙ্গে বলে সে এ বিষয়ে কিছুই জানে না এবং কোম্পানির জন্য শুধু আইনত বৈধ যন্ত্রপাতিই সে কিনেছে।

২০১৭ সালে সামাদের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে সামাদ, সাইফুল সুজনের ভাই আতাউল হকের নামে দক্ষিণ ওয়েলসে নতুন একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করে, কিন্তু সেই সময়ে আতাউল হক স্পেনে কাজ এবং বসবাস করছিল। আতাউল হক বয়সে সুজনের থেকে বছর খানেকের বড়। তারা দুভাই খুব ঘনিষ্ঠ এবং দক্ষিণ ওয়েলসে দুজনে আইব্যাকস কোম্পানির অংশীদার। বাল্টিমোরে আইসিস সমর্থক মহম্মদ এলসিনাভি’র এফবিআই তদন্তে আবদুল সামাদের সাথে আতাউল হকের নামও উঠে আসে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল সামাদের মত আতাউল হক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে থাকার পরেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আইসিসের ঊর্ধ্বতন নেতার ভাই, এমনকি তার কম্পিউটারে আইসিস সম্পর্কিত গাদা গাদা তথ্য প্রমাণ, প্রচারণা ভিডিও থাকার পরেও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। আতাউলের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে কার্ডিফে সে একজন স্প্যানিশ নারীর সংস্পর্শে আসে এবং যথাযথ নিয়ম মোতাবেক তাদের বিয়ে হয়, ফলে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সুবাদে সে সহজেই স্পেনে পাড়ি জমায়। তুরস্ক থেকে অজানা কারণে বহিষ্কারের পর ২০১৫ সাল থেকে আতাউল স্পেনেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

স্প্যানিশ পুলিশ কিন্তু আতাউল হকের স্পেনে পদার্পণের পর থেকেই তাকে কড়া নজরদারিতে রাখে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের চক্রের বিস্তৃতি খুঁজতে আমার পরবর্তী যাত্রায় স্পেনের পুলিশের সাথে আমার আলাপ হয়। তারা আমাকে জানায় বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার মাঝে যোগসূত্র খুঁজে বুঝতে পেরেছে ২০১৫ সালে সুজনের মৃত্যুর পরেও কীভাবে এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের জাল এখনো কার্যকরভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

Spanish police arrest Ataul Haque


পুলিশের স্পর্শকাতর কাজের ধরণের কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্পেনের জাতীয় তদন্ত পুলিশ ফোর্সের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে বলেন, আতাউল তাদের আগের কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ‘ইসিংকটেল’ নামে স্পেনেও দক্ষিণ ওয়েলসে তার ভাই সুজনের মত একই ধরণের ব্যবসা শুরু করেছিল। পুলিশ কর্মকর্তাটি বলেন, “আমরা জানি আতাউলের ভাই আইসিসের ঊর্ধ্বতন নেতা। আইনের দৃষ্টিতে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখানে বৈধ। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি সে আইসিসকে প্রযুক্তি এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছে।”
স্প্যানিশ পুলিশ মনে করছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আতাউল তার ভাইয়ের থেকে অনেক বেশি আগ্রাসী। সে বাণিজ্যিকভাবে সহজলভ্য ড্রোনকেই আইসিসের সামরিক এবং প্রচারণার কাজে ব্যবহারের উপযোগী করে ফেলে। গত বছরে ইরাকে মশুলে যুদ্ধের মধ্যে রিপোর্ট করার সময়ে আমি নিজে দেখেছি গোলা বা গ্রেনেড বর্ষণে এবং আত্মঘাতী হামলাকারীদেরকে পরিচালনার জন্য আইসিস কত নির্ভুলভাবে ড্রোন ব্যবহার করেছে।

২০১৫ সালের শেষের দিকে আমেরিকান সৈন্যদের সুজনকে লক্ষ্য করে হামলা করার অন্যতম কারণ ছিল আইসিসে তার উচ্চ পর্যায়ের অবস্থান এবং মনে করা হচ্ছে সে আইসিসের “প্রযুক্তি যুদ্ধ” পরিচালনা করত। স্প্যানিশ পুলিশের তদন্ত দলের মতে, সুজনের ভাই আতাউল হকেরও আইসিসের জন্য ড্রোন সংগ্রহ এবং আইসিস জঙ্গিদের ব্যবহার উপযোগী করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা আছে।

স্প্যানিশ পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়, আতাউল আইসিসের প্রয়োজন মোতাবেক স্পেনে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই ড্রোনকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য বিশদ গবেষণা করেছে। আতাউল সতর্ক ছিল, কারণ তার ভাইয়ের কোম্পানি আইব্যাকস ইতিমধ্যে বেশ বড়সড় সামরিক এবং কূটনৈতিক মানের নজরদারি, নিরাপত্তা সরঞ্জামাদির চালান মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিস্তৃত কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি ওয়াশিংটনে আমেরিকান সামরিক রণকৌশল বিশেষজ্ঞ পিটার সিঙ্গারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। পিটার সিঙ্গারের কাছ থেকেই জানতে পারি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের প্রযুক্তি নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ ওয়েলসে সাইফুল সুজনের আইব্যাকস কোম্পানির হাত ধরে এবং সন্ত্রাসবাদের কালো থাবা পৃথিবীব্যাপী শিকড়ে শাখায় পত্রে পল্লবে বিকশিত হয়েছে তার কোম্পানির অর্থ পাচারের দক্ষতা এবং সহজলভ্য কারিগরি যন্ত্রপাতি দিয়ে। পিটার সিঙ্গার বলেন, “সন্ত্রাসীদের দ্বারা ড্রোনের প্রচুর ব্যবহার ভবিষ্যতে আমরা আরও দেখতে পাবো, তার কারণ কিন্তু এই নয় যে আইসিস ইরাকে বা সিরিয়াতে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, বরং ড্রোনের ব্যবহার বাড়ার কারণ হল প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়।”

Peter Singer of New America think-tank

নিউ আমেরিকা থিংক ট্যাংক নামের একটা অরাজনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক বলেন, “আইসিসের কর্মীরা নজরদারি এবং হামলা করতে খুব দ্রুত ড্রোন পরিচালনা শিখে ফেলছে, হামলার দৃশ্যগুলো প্রচারণার ভিডিওর সাথে যুক্ত করে দিচ্ছে। ড্রোনের ডিজাইন পরিবর্তন করে তার সাথে যুক্ত করছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ফলে ড্রোন আগের তুলনায় ভাল কাজ করছে।”

এগুলো পুনরায় আমাদেরকে এফবিআই’র অনুসন্ধানে উন্মোচিত সন্ত্রাসীদল এবং তাদের কার্যক্রমের বিস্তারিত প্রমাণের দিকে ধাবিত করে যে জঙ্গিগোষ্ঠী কত নিখুঁতভাবে বাণিজ্যিকভাবে সহজলভ্য কিন্তু উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক উপকরণ কিনতে পেরেছে যেমন সেন্টার লোডেড ম্যাগ মাউন্ট স্ক্যানার, গোয়েন্দা কাজের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী ৩জি/৪জি মোবাইল ফোন, গোয়েন্দা কাজে ব্যবহার্য তার বিহীন গোপন ক্যামেরা, গোপন ক্যামেরা খুঁজে বের করার যন্ত্র, অন্ধকারে কাজ করতে সক্ষম ক্যামেরা ইত্যাদি। স্প্যানিশ পুলিশের দাবি, সুজনের মত আতাউলের হকেরও স্থির লক্ষ্য ছিল কীভাবে আইসিসের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণ করা যায়। মাদ্রিদে এক বৈঠকে স্প্যানিশ পুলিশের সাথে কথা বলার সময়ে আমি জানতে পারি “আতাউল হক উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক যন্ত্রপাতি মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে তুরস্কে পাঠায় এবং জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য হাজার হাজার ডলার বাংলাদেশের জঙ্গিদের কাছে পাঠায়।”

আমাদের বাংলাদেশের সহকর্মীদের মতে, “আমরা ধারণা করছি ২০১৫ সালে আতাউল হক সন্ত্রাসী হামলা এবং সংগঠন পরিচালনার জন্য সবমিলিয়ে ৫০,০০০ মার্কিন ডলারের (৩৭,৭৮১ পাউন্ড) সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু কোন এক রহস্যময় কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেদেশে আইসিস জঙ্গির অস্তিত্ব আছে সেটা কখনোই স্বীকার করা হয় না। যদিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলা বেড়েই চলেছে এবং সরকারের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যহীনভাবে বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশি জিহাদি আইসিসে যোগ দিয়ে ইরাক এবং সিরিয়াতে যুদ্ধ করতে গেছে। তাসনীম খলিল নামের একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক মনে করেন সুজন এবং নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে আইসিসের ব্যাপ্তি বাড়াতে গভীর এবং প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছে।

Exiled Bangladeshi journalist Tasneem Khalil

তাসনিম খলিল কয়েক বছর ধরেই সাইফুল সুজন এবং আতাউল হক ভাইদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। পেশাগত কারণে বাংলাদেশ সরকার তাকে বিভিন্ন সময়ে অত্যাচার করেছে এবং বর্তমানে সে সুইডেনে নির্বাসনে আছে। তার সাথে আমি দেখা করতে আমি সুইডেনে গিয়েছিলাম। সুইডেনের মালমোতে বসবাসরত এবং পেশায় সাংবাদিক তাসনিম খলিল সুধীজন সমাবেশে আমাকে জানান, “বিশ্বব্যাপী আইসিসের অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাইফুল সুজন মূল কারিগর হিসেবে কাজ করে। সাইফুল সুজন বাংলাদেশে আইসিসের প্রাথমিক অবকাঠামো গড়ে তোলে এবং আইসিসের সাংগঠনিক কাজ করে, সিরিয়ার যুদ্ধের ময়দানের জন্য তরুণ যুবা জিহাদি সংগ্রহ করে।
তাসনিম খলিল মনে করেন, প্রাথমিকভাবে সুজনের কার্ডিফের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশে সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে কমপক্ষে ৫০ জনের মত জিহাদি যোগাড় করে। তাদের মধ্যে অর্ধেক পরিমাণ ইরাক এবং সিরিয়াতে পাড়ি দেয় আইসিসের হয়ে যুদ্ধ করতে বাকি অর্ধেক বাংলাদেশের মাটিতে হামলা করার জন্য রয়ে যায়। নির্বাসিত এই সাংবাদিক বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করার জন্য সুজন অর্থায়ন করেছিল।”

জঙ্গি হামলা

ধারণা করা হচ্ছে সুজনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠানো টাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢাকার ‘হলি আর্টিজান’ বেকারি রেস্টুরেন্টে সংঘটিত নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার অর্থায়ন হয়েছিল। ২০১৬ সালের জঘন্য সেই জঙ্গি হামলায় ২৪ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের পুলিশ যথারীতি জঙ্গি হামলার বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। সুজন নিহত হওয়ার প্রায় দুই বছর পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে স্পেন এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় সুজনের সন্ত্রাসীচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিরাপত্তাবাহিনী মনে করছিলো সুজনের মৃত্যুর পরেও তার বিছানো সন্ত্রাসের জাল এখনো সমানভাবে কার্যকর এবং অধিক কর্মক্ষম। স্পেনের দক্ষিণে মেরিদা শহর থেকে আতাউল হককে গ্রেফতার করা হয় এবং একই সাথে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে সন্ত্রাসীচক্রের সাথে যুক্ত থাকার সন্দেহে বাংলাদেশ থেকে ১১ জন জঙ্গিকে আটক করা হয়।

স্প্যানিশ তদন্ত দলের আর কোন সন্দেহই রইল না যে আতাউল হক এবং সাইফুল সুজন দুই সহোদর আসলে খুবই ভয়ংকর ব্যক্তি। স্প্যানিশ তদন্ত দল বলেন, “সত্যিই তারা ভয়ংকর। যারা প্রকাশ্যে জঙ্গি হামলার হুমকি দেয় তাদেরকে সহজেই খুঁজে বের করা যায় কিন্তু এই সহোদর আরও বিপদজনক, কারণ এই দুজনের কার্যক্রম এবং সন্ত্রাসীচক্রের ব্যাপ্তি খুঁজে বের করে নিষ্ক্রিয় করতে চারটে দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর ছয় বছরের সমন্বিত প্রচেষ্টা লেগেছে। জঙ্গিবাদে অর্থদাতা এবং সরঞ্জামাদির আন্তর্জাতিক যোগানদাতাদের খুঁজে বের করে প্রতিহত করা এখন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে সেই সাথে ধর্মীয় আদর্শ, জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ প্রভাববিস্তারকারী যেসব মৌলবাদী তরুণ যুবক উগ্রপন্থী মতবাদের সাথে একাত্মতা বোধ করে নিজের দেশে বা দেশের বাইরে জঙ্গি হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে তাদেরকে প্রতিরোধ করা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে জঙ্গি হামলার পরে এফবিআই’তে ‘সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন শাখা’ নামে নতুন একটা তদন্ত কমিশন গঠন করেন ডেনিস লরমেল। তিনি বলেন, “যদি কেউ ডলারকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারে এবং সেই ডলার যদি জঙ্গিদের হাতে যায় এবং ব্যবহার করতে পারে তবে তো বোমা বানানো, জঙ্গি হামলা চালানো সহজ এবং এটা অবিশ্বাস্যরকম ভয়ংকর।”

Dennis Lormel

সুবিশাল সন্ত্রাসীচক্রের শিকড় কতটা গভীরে বিস্তৃত সেটা খুঁজে বের করার শুরুতে আমি যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে অর্থ পাচার এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ ডেনিস লরমেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেন, “জঙ্গির মতই জঙ্গিবাদে অর্থায়নকারীও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নকে আমরা যত বেশি বাধাগ্রস্ত করতে পারব ততই কমে যাবে তাদের সফল জঙ্গি হামলার পরিমাণ।” সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বলেন, ঠিক এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ২০১৫ সালে সুজনকে হত্যা করে।

সুজন মৃত

সুজনের ভাই আতাউল হক এখন স্পেনের জেলেখানায় বন্দী। স্পেনের পুলিশ বলছে বছরের শেষের দিকে তার বিরুদ্ধে জঙ্গি হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে যদিও আতাউল হক ইতিপূর্বে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আবদুল সামাদও তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ অস্বীকার করেছে যদিও আমাদের তদন্ত এবং এফবিআইয়ের তদন্তে এই দুজনের কুকীর্তি, জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করার সব নথিপত্র, প্রমাণ আমাদের হাতের মুঠোয়। যদিও ব্রিটেনের পুলিশ তখন সামাদকে জানায় তাদের কাছে এমন কোন পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ নেই যা দিয়ে সামাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা যায়। স্পেনে আতাউলের গ্রেফতারের আগেরদিন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগও দাখিল করা সম্ভব হয়নি। সামাদ কিন্তু থেমে থাকেনি। সে আগের মতই আতাউল হকের নামে ওয়েলসে ‘ইসিঙ্কটেল’ নামের আর একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। স্পেনের পুলিশ জানায় একই নামে স্পেনের কোম্পানির বিরুদ্ধে আইসিসকে অর্থ এবং সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহের অভিযোগ আছে।

সুজনের প্রতিষ্ঠিত সন্ত্রাসীচক্রের অর্থ পাচার ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত নস্যাৎ করা সম্ভব হয়েছে, যদিও দুই বছরের বেশি সময় পরে আমেরিকান কর্নেল পদমর্যাদার একজন সামরিক অফিসার সাইফুল সুজনকে মৃত বলে ঘোষণা দেয়। এখন মনে করা হচ্ছে, সুচারুভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সন্ত্রাসবাদ পরিচালনার এমন আধুনিক সন্ত্রাসীচক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই তার যুদ্ধ সমাপ্তির সংবাদ প্রচার করা হয়ে গিয়েছিল।

মূল প্রবন্ধ: The global terror network that started in Pontypridd By Wyre Davies