আগের পর্বের লিঙ্ক: নাইজেল ওয়ারবার্টনের “ফিলোসফিঃ দা বেসিকস্” -এর কিছু অংশের অনুবাদ (১ম ও ২য় পর্ব)

অনুবাদ করেছেন: এ্যান্ডি যোসেফ কস্তা

[নাইজেল ওয়ারবার্টনের “ফিলোসফিঃ দা বেসিকস্” -এর কিছু অংশের অনুবাদের প্রয়াস। এখানে বিজ্ঞান সম্পর্কীয় যে দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি পাঠকগণ বিজ্ঞান সম্পর্কে এই নিরপেক্ষ ও যুক্তিযুক্ত আলোচনায়, নতুন আঙ্গিকে বিজ্ঞান বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করবেন, তবে বিজ্ঞান চর্চার জন্য তা আবশ্যক নয়।]

নিরীক্ষণমূলক বিবৃতি (Observation statements)

সহজসরল ধারণা, বিজ্ঞান সম্পর্কীয় নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি উপেক্ষা করে থাকে তা হচ্ছে নিরীক্ষণ বিবৃতির- স্বরূপ (nature)।

স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীরা যে কোন নিরীক্ষণকে,কোন ভাষার মাধ্যমে ব্যক্ত করেন। তা স্বত্তেও বিজ্ঞানীরা যে ভাষার মাধ্যমে কোন নিরীক্ষণ বিবৃতি বর্ণনা করেন, তাতে তত্ত্বীয় ধারণা সমূহ পূর্বধারণা হিসেবে উপস্থিত (built into it) থাকে। বস্তুতপক্ষে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ কোন নিরীক্ষণ বিবৃতির অস্তিত্ত্ব নেইঃ

নিরীক্ষণ বিবৃতির ভিত্তি “তত্ত্বীয় ধারণার উপর নির্ভর করে গঠিত”

উদাহরন:

সে অনাবৃত তারটি ধরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হল।”

উপরোক্ত বিবৃতিতে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, বিদ্যুৎ নামক কোন কিছু রয়েছে এবং তা ক্ষতিকর। “বিদ্যুৎ” শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে , বক্তা বিদ্যুৎ সম্বন্ধীয় তত্ত্বটি আগেই পূর্বধারনা করে নিচ্ছেন এবং বিদ্যুৎ প্রবাহিত কোন অনাবৃত তার স্পর্শ করায় লোকটির ক্ষতি হওয়ার অভিজ্ঞতাটিও তার ধারনায় বিদ্যমান।

উদ্ধৃত বিবৃতিটি সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে হলে, বিদ্যুৎ ও শরীরবিদ্যা তত্ত্ব সম্পর্কীয় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

কাজেই এই ঘটনা বর্ণনার মাঝে তত্ত্বীয় পূর্বধারণা গুলো বিদ্যমান রয়েছে। অন্য কথায়, নিরীক্ষামূলক বিবৃতি আমাদের অভিজ্ঞতাকে কোন নির্দিষ্ট রূপে শ্রেণীবিন্যাস করে থাকে, তবে শুধুমাত্র এই উপায়েই আমাদের অভিজ্ঞতাকে শ্রেণীবিনস্ত করা যায়না, বিকল্প উপায়েও করা যেতে পারে।

নিরীক্ষণ মূলক বিবৃতির যে ধরনগুলো বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়, উদাহরণস্বরূপ:

বস্তুটির আণবিক কাঠামো তাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল

উপরোক্ত বিবৃতি আগেই একটি জটিল তত্ত্বকে পূর্বধারণা হিসেবে ধরে নেয়।

তত্ত্ব সবসময়ই আগে আসেঃ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সহজসরল ধারনা পুরোপুরিভাবে ভুল করে থাকে, যখন তারা ধরে নেয় যে, সকল তত্ত্বই নিরপেক্ষভাবে নিরীক্ষণ করে করা হয়।

তুমি যা দেখ, তা সর্বদাই তোমার জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল।

এবং কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করে, তুমি যে শব্দাবলী দ্বারা তা বর্ণণা কর, সবসময়ই তা তোমার ঐ ব্যাপার সম্পর্কীয় তত্ত্বীয় পূর্বধারণার ভিত্তিতে করা হয়।

এই দুটি হচ্ছে নিরীক্ষণের প্রকৃতি সম্বন্ধীয় অপ্রতিরোধ্য বাস্তব সত্য(facts) যা বস্তুগত, সংস্কারমুক্ত ও নিরপেক্ষ নিরীক্ষণের ধারণাকে দুর্বল করে দেয়।

বাছাইকরণ (Selection)

নিরীক্ষণ সম্বন্ধীয় তৃতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে:

বিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র “নিরীক্ষণ”-ই করে থাকেন না, যেখানে তারা প্রত্যেকটি ঘটনার সকল পরিমাণের মান সংগ্রহ করেন। কেননা বাস্তব ক্ষেত্রে তা করা অসম্ভব হবে। তারা যে কোন অবস্থার কোন একটি বিশেষ দিকে মনোযোগী হয়ে তাকে বেছে নেন। এটি করার জন্যও তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হয় যা তত্ত্বীয় ধারনার উপর নির্ভরশীল।(theory-related)

আরোহ-প্রণালী সম্পর্কীয় সমস্যা / The problem of induction

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে সহজ সরল ধারণার অন্য ধরনের একটি আপত্তির কারণ হচ্ছে তা অবরোহী ভিত্তিক (deductive) না হয়ে, আরোহ প্রণালী(inductive) ভিত্তিক হয়ে থাকে। অবরোহী ও আরোহ প্রণালী এ দুটি ভিন্ন ধরনের তর্ক।

একটি আরোহ প্রণালী ভিত্তিক তর্ক সাধারণত, কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক নিরীক্ষণের ভিত্তিতে বিবেচ্য ব্যাপারটিকে সরলীকরণ করে প্রস্তুত করা হয়। যদি আমি লোমশ প্রাণীদের নিয়ে বহু সংখ্যক নিরীক্ষণ কার্য সম্পন্ন করি, আর এগুলোর ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আসি যে, লোম বিশিষ্ট প্রাণীরা প্রসব দানের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেয়। (viviparous: they give birth to live young rather than laying eggs), তাহলে আমি আরোহ প্রণালী জাতীয় তর্ক ব্যবহার করছি।

অপরপক্ষে, অবরোহ প্রণালীতে
কোন নির্দিষ্ট প্রস্তাব বা প্রস্তাবসমূহ হতে শুরু করে, তা হতে যুক্তিযুক্তভাবে একটি উপসংহারে পৌছানো হয়, যা উক্ত তর্কের প্রস্তাবগুলোকে অনুসরণ করে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, নিন্মোক্ত প্রস্তাবগুলো হতে একটি উপসংহারে আসা যেতে পারে:

‘সকল পাখিরা প্রাণী’ এবং ‘রাজহাঁস একটি পাখি’ সুতরাং

রাজহাঁস একটি প্রাণী।

এটি একটি অবরোহ ভিত্তিক তর্ক।

অবরোহ তর্কে সত্য অক্ষুন্ন থাকে। এর মানে হচ্ছে যদি প্রস্তাবগুলো সত্য হয়, তাহলে উপসংহারকেও আবশ্যিকভাবে সত্য হতে হবে। যদি এই ধরনের সত্য প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাওয়া উপসংহারকে না মানা হয়, তাহলে তা পরষ্পরবিরোধী বা অসঙ্গতিপূর্ণতার সামিল হবে (contradiction). কাজেই ‘সকল পাখিরা প্রাণী’ এবং ‘রাজহাস একটি পাখি’ এই দুটি যদি সত্য হয়, তাহলে “সকল রাজহাঁসও প্রাণী” এই উপসংহারকেও আবশ্যিকভাবে সত্য হতে হবে।

বিপরীতক্রমে, আরোহ প্রণালীর তর্কের প্রস্তাব সত্য হলেও, তার উপসংহার সত্য নাও হতে পারে। যদিও আমাদের নিখুঁতভাবে নিরীক্ষিত প্রত্যেকটি প্রাণী লোম-যুক্ত ও প্রসব-দানকারী হয়ে থাকে, আর যদিও আমার নিরীক্ষণের বস্তু হাজার সংখ্যক হয়ে থাকে, তা সত্ত্বেও আমার আরোহ প্রণালী ভিত্তিক তর্কের উপসংহার

“লোম বিশিষ্ট পশুরা ,প্রসব দানের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেয়”

মিথ্যা হতে পারে। আর বাস্তবিকই, অদ্ভুত লোম বিশিষ্ট ও ডিম পাড়া প্রাণী ডাক-বিল্ড প্লাটিপাসের অস্তিত্ব, প্রমাণ করে যে উপরোক্ত সরলীকরণ-টি ভুল। (simplification)

আমরা এই ধরনের আরোহ তর্ক প্রতিনিয়তই ব্যবহার করে থাকি। উদাহরন

আমি বহুবার কফি খেয়েছি, কিন্তু তা দ্বারা আমি কখনো বিদ্বিষ্ট (বিষে আক্রান্ত) হইনি, কাজেই এই আরোহ তর্কের উপর ভিত্তি করে আমি ধরে নিতে পারি, কফি পানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আমি কখনো বিদ্বিষ্ট হবনা।

আমার অভিজ্ঞতায়, দিনের পরে সবসময়ই রাত এসেছে, কাজেই আমি ধরে নিতে পারি যে, সর্বদা এভাবেই চলতে থাকবে।

আমি অসংখ্যবার নিরীক্ষণ করেছি যে, আমি যদি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে ভিজে যাব, কাজেই পূর্বের মত ভবিষ্যতেও এরকম হবে, কাজেই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে যাতে ভিজে না যাই, সেই কাজ করাই শ্রেয়।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের এই বাস্তবিক তথ্যের (fact) উপর নির্ভর করতে হয় যে:

আরোহ প্রণালী আমাদের মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ভাবে চারপাশের পরিবেশ সম্বন্ধে পূর্বাভাস প্রদানে সাহায্য করে থাকে,
এবং এটি আমাদের শুরু করা কোন কাজের সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে, তা-ও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।

আরোহ প্রণালী অনুসরন না করলে, পরিবেশের সাথে আমাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ব্যহত হত। অতীতের গতানুগতিক কার্য বা ঘটনাবলীর ফলাফলের সাথে, ভবিষ্যতের ঐ একই ধরনের কার্যাবলীর ফলাফলের মিল থাকবে কিনা তা সম্বন্ধে আমাদের ধারনা করার কোনরূপ ভিত্তিই থাকত না।

যে খাদ্য আমরা গ্রহণ করতে যাচ্ছি, তা আমাদের জন্য পুষ্টিকর না বিষাক্ত হবে, আমরা তা জানতে পারতাম না।

আবার আমাদের নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপে, আমাদের পায়ের নীচের মাটি, আমাদের ভর বহন করবে- না সেখানে একটি খাঁদ সৃষ্টি হবে এবং ইত্যাদি আরো অনেক।

চারপাশের পরিবেশে নিত্য নৈমিত্তিকভাবে যা ঘটে থাকে, তা ঘটার সম্ভাবনা আছে – কি নেই, তা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত আমাদের অনিশ্চয়তায় ভুগতে হত।

আমাদের জীবনে আরোহ প্রণালীর এই কেন্দ্রীয় ভুমিকা থাকা সত্ত্বেও, আরোহ তত্ত্ব যে সম্পূর্ণরূপে নির্ভরযোগ্য নয়, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে, আরোহ তত্ত্ব, সকল লোমশ প্রাণীই যে প্রসবদানকারী হবে, এই প্রশ্নের ভুল সমাধান দিয়েছে। আরোহ তত্ত্ব হতে পাওয়া উপসংহার, অবরোহ তত্ত্বের সত্য প্রস্তাব হতে প্রাপ্ত উপসংহারের মত ততটা নির্ভরযোগ্য নয়। এই ব্যাপারটি স্পষ্ট করার জন্য বারট্র্যান্ড রাসেল একটি মুরগীর উদাহরণ দিয়েছিলেন, যে একটি মুরগী প্রত্যেক দিন সকালে উঠে চিন্তা করে যে, আজকেও তাকে গতকালের মত খেতে দেয়া হবে। কিন্তু একদিন সকালে উঠে দেখে তার মনিব তার গলা কেটে দিয়েছে।

মুরগীটি এক্ষেত্রে আরোহ প্রণালী তর্ক ব্যবহার করছিল যার ভিত্তি ছিল, অসংখ্য পর্যবেক্ষন কৃত উপাত্ত। কাজেই আরোহ প্রণালী তর্কের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে আমরা কি মুরগীটির মত বোকামি করছি? আরোহ প্রণালীর উপর আমাদের বিশ্বাস রাখা কি সু যুক্তিপূর্ণ? এটিই আরোহ প্রণালীর সমস্যা হিসেবে পরিচিত যা ডেভিড হিউম সনাক্ত করেছিলেন তাঁর “Treatise Concerning Human Nature” বইয়ে। আমরা কিভাবে একটি আস্থাহীন তর্ক পদ্ধতির উপর আস্থা রাখতে পারি? এই ব্যাপারটি বিজ্ঞানের দর্শনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, কারণ বিজ্ঞানের যে সহজ-সরল তত্ত্ব পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, আরোহ প্রণালী উক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা দানকারী যুক্তিকে বাছাই (Inference to the Best Explanation)

সবধরনের আরোহ প্রণালীর গঠনই কিন্তু উপরে বর্ণিত আরোহ প্রণালীর গঠনের মত নয়। অবরোহী পদ্ধতির ব্যতিক্রম আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তর্ক পদ্ধতি যা Inference to the Best Explanation or, less commonly abduction (শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা দানকারী যৌক্তিক ভিত্তি ) নামে পরিচিত। এই ধরনের তর্কে অতীত পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে আমরা ভবিষ্যতের ব্যাপারে কেবলমাত্র কোন সাধারন পূর্বাভাসই করিনা। বরং তার পরিবর্তে অনুমানটি (hypothesis) যে ধরনের ব্যাখ্যা দান করে, তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা বিচার করে থাকি। সর্বশেষ্ঠ অনুমান (hypothesis) হচ্ছে যা সর্বাপেক্ষা বেশি ব্যাখ্যা দান করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বাড়ির কর্তা যদি বাড়িতে পৌছে, উদর-পিন্ড থেতলে যাওয়া কোন ইঁদুর এবং তার পোষা বেড়ালকে, ওটার পাশে খুব সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে গভীর ঘুমে মগ্ন দেখতে পায়, যে সময়ে সাধারণত তার বাড়িতে পৌছার পরই সে সাধারণত খাবারের জন্য আবদার করে থাকে। কাজেই, এই পরিস্থিতিতে, কর্তার অনুপস্থিতিতে যা ঘটেছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখা হচ্ছে, তার বেড়ালটা ইঁদুরটাকে ধরেছে ও তা আহার করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে শুরু করেছে। আমি আমার সামনে প্রমাণ যে দেখছি, তা দ্বারা কিন্তু আমি যুক্তি খণ্ডনের (অবরোহ প্রণালীর মত) মাধ্যমে উপসংহারে পৌঁছাই নাঃ কারণ যা ঘটেছে তার আরো বিকল্প ব্যাখ্যাও থাকতে পারে। (যেহেতু তা আমি প্রত্যক্ষ করিনি।)

উদাহরণস্বরূপ, অন্য একটি বেড়াল হয়তবা বেড়াল-দরজা (cat door) দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে, রান্নাঘরের মেঝেতে থেতলে যাওয়া ইঁদুরটি ফেলে রেখে যেতে পারে। অথবা অন্য কেউ বিড়ালকে দোষারোপ করার জন্য কাজটি করে, বেড়ালের পাশে তা রেখে দিয়েছিল। তবে, আমার উপসংহার: বেড়াল ইঁদুরটাকে ধরে খেয়ে ফেলেছে, তা পরিস্থিতি সাপেক্ষে সর্বাপেক্ষা বেশি যুক্তিসঙ্গত। এর কারণ হচ্ছেঃ অন্যান্য যে প্রতিযোগী অনুমানগুলো এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা দিতে পারে, তা বেড়ালটির তৃপ্তিপূর্ণ ঘুমের ব্যাখ্যা করতে পারছেনা।

এই ধরনের যুক্তি প্রয়োগের কৌশল, বিজ্ঞানে ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, উপরের উদাহরন হতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটা পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। এখানে একই ঘটনার কারণ হিসেবে অনেকগুলো ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কাজেই শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা দানকারী যৌক্তিক ভিত্তি -তে, তর্কের উপসংহারটি, অনিবার্যভাবেই তার প্রস্তাবগুলোকে অনুসরন করেনা, যেরূপ একটি অবরোহ প্রণালীতে হয়ে থাকে। এটি এই প্রশ্নের জন্ম দেয় যে, কোন্ ব্যাখ্যাটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য করা হবে এবং কেন।

দার্শনিকগণের মাঝে, শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা দানকারী যৌক্তিক ভিত্তিমূলক তর্ককে, আরোহ তর্ক হিসেবে চিহ্নিত করায় – মতপার্থক্য রয়েছে। তবে তারা এটি স্বীকার করেন যে, এই ধরনের তর্কের প্রস্তাবের সত্যতা তার উপসংহারের সত্যতাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চয়তা দান করেনা। আর এই দিক দিয়ে, অবরোহ প্রণালীতে আস্থাশীল যে বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে, শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা দানকারী যৌক্তিক ভিত্তিমূলক তর্কে তা অনুপস্থিত থাকে । তবে শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা দানকারী যৌক্তিক ভিত্তির – বৈশিষ্ট্যের এই মূল্যায়ন, তাকে সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে নয়। আমরা বাস্তবে প্রায়ই এই ধরনের যুক্তি ব্যবহার করি যখন কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অবরোহ প্রণালী প্রয়োগ করা অসম্ভব হয়ে থাকে, উদাহরণস্বরূপ, যেখানে আমরা কোন কিছুর কারণ বুঝতে বা কোন কিছু্কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি, যেখানে একাধিকভাবে তা ঘটার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

আরোহ সমস্যার অন্য একটি দিক

এপর্যন্ত আমরা আরোহ সমস্যাকে শুধুমাত্র,

অতীত ফলাফলের ভিত্তিতে, ভবিষ্যতে কি ঘটতে হতে পারে তা সাধারণ-কৃতকরনের(generalization) যুক্তিযুক্ততাকে বিবেচনা করে আসছি।

আরোহ সমস্যার আরেকটি দিক হচ্ছে –

যে কোন একটি ব্যাপার সম্পর্কে অতীতের ভিত্তিতে আমরা সংখ্যাধিক ভিন্ন ভিন্ন সাধারণ-কৃতকরনের করতে পারি, এবং তাদের সবগুলোর সাথেই পর্যবেক্ষণকৃত উপাত্তের সংগতি থাকবে। আর তা সত্ত্বেও এই সাধারণ-কৃতকরনের প্রত্যেকটি, ভবিষ্যতের ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা ভবিষ্যদ্বাণী দেবে। এটা দার্শনিক নেলসন গুডম্যানের (১৯০৬-৯৮) ‘গ্রূ’ (‘grue’) এর উদাহরন দ্বারা খুব ভালভাবে দেখিয়েছেন।

গুডম্যান আরোহ সমস্যার দ্বিতীয় দিকটি উন্মোচন করার জন্যে ‘গ্রূ’ শব্দটি সৃষ্টি করেছিলেন। ‘গ্রূ’ শব্দটি হচ্ছে লেখকের একটি কল্পিত রং। যদি কোন কিছুর রং গ্রূ হয়, তাহলে তা যদি ২০০০ সালের আগে পরীক্ষা করা হয়, তবে তার রং সবুজ হবে, কিন্তু যদি তাদের পরীক্ষা করা না হয়, তাহলে সেগুলো নীল হবে। গুডম্যান ২০০০ সালের আগে লিখেছিলেন। তবে এই উদাহরনকে কার্যকরী করার জন্য এখানে ২০০০ এর বদলে ২১০০ সাল ধরা হবে। “সকল পান্না সবুজ রঙের” এই সাধারণ-কৃতকরনের পেছনে আমাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে আমাদের প্রমাণের সাথে “সকল পান্না গ্রূ রঙের” এই বিবৃতিও সমভাবে যুক্তিযুক্ত হবে (যদি ধরে নেয়া হয় যে, আমাদের সকল নিরীক্ষণ ২১০০ সালের আগে করা হয়েছে)। তথাপিও সকল পান্না সবুজ রঙের বা তারা গ্রূ রঙের এ’দুয়ের মাঝে কোনটি বলা হবে, তা ভবিষ্যতে, ২১০০ সালের পরে, আমরা যে পান্না বিষয়ক পর্যবেক্ষণ করব, তার উপর প্রভাব ফেলবে। আমরা যদি বলি, সকল পান্না গ্রূ রঙের, তাহলে আমরা এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে, ২১০০ সালের পরে পর্যবেক্ষণ কৃত কিছু পান্না নীল রঙের হতে পারে। যেগুলো ২১০০ সালের আগে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে তাদের সবুজ দেখাবে আর যাদের ২১০০ সালের পরে পর্যবেক্ষণ করা হবে তাদের কিছু কিছু নীল দেখাবে। কিন্তু, যা আমরা খুব সম্ভবত করে থাকব, তা হচ্ছে সকল পান্নাকে সবুজ রঙের বলা,এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করব যে, পান্নাকে যে কোন সময়ই পর্যবেক্ষণ করা হোক না কেন তারা সবুজ রঙের হবে।

এই উদাহরণ দেখাচ্ছে যে, আরোহ পদ্ধতি ব্যাবহার করে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা যে পূর্বাভাস করি, সেই এই প্রমাণের ভিত্তিতে একাধিক বিকল্প পূর্বাভাসও করা সম্ভব। কাজেই আমরা এই উপসংহারে উপনীত হই, যেখানে আরোহ পদ্ধতির ভিত্তিতে করা পূর্বাভাস কেবল আংশিকভাবে নির্ভরযোগ্য তা নয়, সেখানে প্রাপ্ত প্রমাণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একাধিক বিকল্প পূর্বাভাসও করা সম্ভব

আগামী পর্বে আরোহ পদ্ধতির বিভিন্ন সমাধানের ব্যাপারগুলো আলোচনা করা হবে।

চলবে…