পর্ন কী সেটা এযুগে কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। আগে লোকে ডিভিডি কিনে ঘরের দরজা-জানালা লাগিয়ে পর্ন দেখত, আর এখন এই ইন্টারনেটের যুগে, বদলেছে শুধু দেখার মাধ্যমটাই। অনলাইনে ইনকগনিটো মুড অন করে কিংবা না করেই কয়েক ক্লিকেই ঢুকে যাওয়া যায় পর্নের দুনিয়ায়। হাতেহাতে মুঠোফোন পৌঁছে যাওয়ার সাথেসাথে পর্নও চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। আগে বরং লুকিয়ে দোকান থেকে পর্নের ডিভিডি কিনে তা কাগজ মুড়ে কিংবা প্যান্টের নিচে গুঁজে, বাড়িতে এনে গোপনে দেখতে হত। আর এখন যেখানে যখন ইচ্ছা বসে পর্ন দেখা যায়, শুধু দরকার ইন্টারনেট সংযোগ। ভারতের একজন সাংসদ তো সংসদে বসেই একবার এই অকাজটা করে ফেলেছিলেন।

পর্ন ভাল নাকি মন্দ, তা’নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে ঢের, সেদিকে যাবো না। আলোচনা করতে চাই ‘ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ’ ও মোস্তফা জব্বারের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ড নিয়ে।

বাংলাদেশের ডাক টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, শিশুদের জন্য ইন্টারনেটকে উপযোগী করতে বদ্ধপরিকর। তাই তিনি ধরে ধরে পর্ন সাইটগুলোর কান মুলে দিচ্ছেন, ইতোমধ্যেই বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন কয়েকটি জনপ্রিয় পর্নসাইট। তার এই স্পৃহা ও কর্মোদ্যোমকে অভিবাদন জানাই। যদিও আমি মোস্তফা জব্বারের মত,  শিশুদের ইন্টারনেটের দুনিয়ায় পদার্পনকে সমর্থন করি না। যে সময়ে শিশুদের ব্যস্ত থাকার কথা মাঠে(মাঠ কোথায়?) কিংবা ঠাকুরমার ঝুলিতে, সে সময়ে তারা মুঠোফোনে মাথা ডুবিয়ে বসে থাকবে- চিত্রটাকে ঠিক স্বাভাবিকভাবে কোনদিনই নিতে পারিনি; যদিও প্রায়ই তা চোখে পড়ছে। বাচ্চারা এখন ঠাকুরমার ঝুলি না পড়ে কিংবা মায়েদের মুখে না শুনে, দেখছে ঠাকুরমার ঝুলি নিয়ে বানানো কার্টুন। এর ফলাফল সম্পর্কে আমি সন্দিহান। তারা নিজেদের শিল্পসংস্কৃতি সম্পর্কে যেমন জানছে না, তেমনই আমাদের গ্রামীণ খেলাগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে মাঠের সাথেসাথে। এসবের পরও যখন মন্ত্রীসাহেব শিশুদের ইন্টারনেটের জগতে আনতে চান, তখন তা সত্যিই ভাবায়।

পর্ন সাইট বন্ধ করা হয়েছে, এ’নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু তারা পর্নসাইটের সাথেসাথে বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্লগসাইট সামহোয়্যারইন ব্লগকেও বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগটা এখানেই। ২০০৫ সালে ব্লগসাইটটি চালু হওয়ার পর থেকেই হয়ে উঠেছে কয়েক লাখ মানুষের কণ্ঠস্বর। ‘কয়েক লাখ’ কথাটা সচেতনভাবেই বলেছি- এপর্যন্ত দুই লাখের অধিক রেজিস্টার্ড ব্লগার লিখেছেন এই বিশাল প্লাটফর্মে! ২০০৫ সালের পর থেকে এদেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা নিয়েই তারা লিখেছেন, বিতর্ক করেছেন, দিয়েছেন নিজেদের মতামত। অনেকেই লিখতেন ও লিখছেন গল্প, কবিতা, ছড়া। কয়েকটি উপন্যাসও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে ব্লগে। প্রতিবছর সামহোয়্যারইন ব্লগের ব্লগারদের অর্ধশত বই অন্তত প্রকাশিত হয়। আমার জানা মতে, এবছর একুশে বইমেলায় ব্লগারদের ৬৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। মূলধারার মিডিয়ায় যারা জায়গা পায়নি, কিংবা জায়গা করে নিতে যারা অক্ষম, তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে ব্লগটি। গবেষণা ও ফিচারধর্মী লেখা আসে ব্লগে প্রতিনিয়তই। ভ্রমণব্লগ, বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়া, মুভিরিভিউ, ছবি-ব্লগ- সব মিলিয়ে ব্লগটি সর্বদা সরগরম; জ্ঞান ও স্বাধীনতার অসাধারণ মিশেল। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে, শাহবাগের গণজাগরণে অংশ নিয়েছিলেন প্রতক্ষ্যভাবে এই ব্লগের অনেক ব্লগার।

অথচ পর্নসাইট হিসেবে আখ্যায়িত করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ব্লগসাইটটি! কীভাবে তারা কিছু না জেনেই এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিল, সেটাই মাথায় আসছে না।

সামহোয়্যারইন ব্লগ বন্ধের জন্য ডাক টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রী যে কারণগুলো দেখিয়েছেন, সেগুলো পুরোপুরি অযৌক্তিক। তিনি ব্লগের পোস্টগুলোকে সরকারবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মানে ব্লগকে সচল রাখার জন্য, সর্বদা সরকারের পক্ষেই লেখালেখি করতে হবে? আর সরকারের অনিয়ম ও দূর্নীতি নিয়ে কথা বললেই কি কেউ সরকার বিরোধী হয়ে যায়? সরকারের কি সমালোচনা শোনার দরকার নেই? নাকি সবাইকে সরকারের পক্ষ নিয়ে, সরকারের সব কাজের সাফাই গেয়ে লিখতে হবে? এ ধরণের কথা বলে মন্ত্রী নিজেই কী তার দলকে বিতর্কে জড়ালেন না? বলা কি যায় না, সরকারের বিপক্ষে কথা বলার সব উপায় তারা বন্ধ করে দিচ্ছে, এভাবে মিথ্যা পর্নাসাইটের অপবাদ দিয়ে?

মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের আরেকটি অভিযোগ, ‘নাস্তিকতার জন্য দায়ী’ এই ব্লগ!

বাংলাদেশে গত কয়েকবছর ধরে একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। কাউকে কুপোকাত করতে চাইলে, তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে, তাকে বানিয়ে দেয়া হচ্ছে নাস্তিক। যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবীতে গণজাগরণমঞ্চ যখন উত্তাল, তখন এর মুখপাত্রদের ‘নাস্তিক ব্লগার’ হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছিল একটা পক্ষ। ঠিক একই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন মোস্তফা জব্বারও। ব্লগটাকে বন্ধ করার একটা কারণ হিসেবে তিনি টেনে নিয়ে এলেন সেই নাস্তিকতাকেই।

আর মোস্তফা জব্বার যেভাবে কথাটা বলেছেন, তাতে মনে হতেই পারে, নাস্তিকতা একটা অপরাধ। দুষিত পানি যেমন ডায়রিয়া, কলেরার জন্য দায়ী; তেমনই অভিযুক্ত ব্লগটি দায়ী নাস্তিকতার জন্য! ঠিক এমন করেই হয়ত ভেবেছিল অভিজিত রায়ের খুনীরা। তারা নাস্তিকতাকে অপরাধ হিসেবেই দেখতো- তাদের এই মানসিকতার জন্যই প্রাণ দিতে হয়েছে অভিজিতের মত আরো অনেক ব্লগার, লেখক ও প্রকাশককে। তারা যেমন হত্যা করে, চাপাতি চালিয়ে বন্ধ করতে চেয়েছিল মুক্তমত ও বিজ্ঞানচিন্তা, তেমনই মোস্তফা জব্বারও ব্লগ সাইটটি বন্ধ করে রুদ্ধ করে দিচ্ছেন চিন্তা ও স্বাধীনতার সুপ্রশস্ত পথটি।

বাকস্বাধীনতা প্রত্যেকের নাগরিক অধিকার। সরকার নানা পাঁয়তারা করে- কখনো আইন প্রণয়ন করে, কখনো ব্লগ বন্ধ করে, জনগণের সে অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করছে। এর আগেও সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে কয়েকটি ব্লগকে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ইস্টিশন ব্লগ ও মুক্তমনা। এবারে বন্ধ করে দেয়া হলো সামহোয়্যার ইন ব্লগ। এভাবে আর কতদিন? সাধারণ মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করে কতদিন আর আমাদের মননের উপর চলবে এমন নিপীড়ন?

ইন্টারনেটে হয়ত কয়েক লাখ পর্ন সাইট আছে। সরকার সেসব সাইট বন্ধ করে দিচ্ছে, এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে। কিন্তু পর্ন সাইট বন্ধ করার নামে যেন কোন ব্লগ কিংবা যেসব সাইট কোন অবৈধকাজে জড়িত নয়, তাদের যেন বন্ধ না করে সেদিকেও সচেতন থাকতে হবে। সামহয়্যার ইন ব্লগকে পুনরায় সচল করার জোড় দাবী জানাচ্ছি।

আরণ্যক রাখাল
[email protected]