গবেষণাপত্রটি ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে উপস্থাপন করা হয়েছে মহাকাশ বিজ্ঞানের অন্যতম সংগঠন আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নে।বিষয়টি বেশ পুরানো এবং জানা। কিন্ত পরীক্ষালব্ধ উপস্থাপনাটি নতুন এবং বিস্ময়কর।

আজ থেকে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে প্রায় ১৪ কিলোমিটার প্রস্থের একটি বিশাল আকৃতির গ্রহানু বা এস্টোরয়েড মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিনস্যুলায় ঘন্টায় প্রায় ৮৫,০০০ কিলোমিটার বেগে আঘাত করেছিল। এস্টোরয়েডের এই পতনের ফলে মেক্সিকো এবং সংলগ্ন এলাকায় ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন নিয়ে ভূতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণা করছেন অনেকদিন থেকেই।

এই বিশাল আকৃতির গ্রহানুর আঘাতের ফলেই যে ১০০ কিলোমিটার চওড়া ও ৩০ কিলোমিটার গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল সেটিও অকাট্য প্রমানেই আজ স্বীকৃত। এই বিশাল গ্রহানু বা এস্টোরয়েড আঘাতের ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে হিরোশিমা নগরীর ধ্বংসযজ্ঞের চেয়ে ১০০ বিলিয়ন গুন শক্তিশালী।

কিন্ত আমেরিকার মিসিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক প্রথমবার দেখিয়েছেন, ১৪ কিলোমিটার প্রস্থের এই বিশাল গ্রহানু বা এস্টোরয়েড আঘাতের ফলে যে বিশাল সুনামি বা সামুদ্রিক ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছিল তা শুধু অভাবনীয় নয়, অকল্পনীয়ও বটে।

বিজ্ঞানের সব তত্ত্ব বা থিউরি মেনে নিয়ে মডেলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সে সময়ে প্রায় ১ কিলোমিটার উচ্চতার সুনামি সৃষ্টি হয়েছিল। গ্রহানু বা এস্টোরয়েড আঘাতের ২৪ ঘন্টার মধ্যে গালফ অব মেক্সিকো হয়ে সমস্ত আটলান্টিক মহাসাগর এবং মধ্য-আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়েছিল এ বিশাল ঢেউ। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত জলরাশিতে আছড়ে পড়েছিল এই সুনামি।

যেখানে গ্রহানু বা এস্টোরয়েড আঘাত করে, সেখানে তেমন জল ছিল না সে সময়ে। ফলে শুকনো আবর্জনার ধূলোকণা ৬,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে, সে সময়ে জীবিত প্রাণী ও উদ্ভিদ অক্সিজেনের অভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর জলবায়ু বিশেষকরে তাপমাত্রাও কমে গিয়েছিল ১৪ থেকে ২৯ ডিগ্রী ফারেনহাইটের মতো। ডাইনোসর বিশেষজ্ঞগন পৃথিবী থেকে ডাইনোসরের বিলুপ্তির জন্য ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে মেক্সিকোতে ঘটে যাওয়া এই গ্রহানু বা এস্টোরয়েড পতনকেই দায়ি করে থাকেন।

মানব সভ্যতার সৌভাগ্য যে, এই ৬৬ মিলিয়ন বছরেও এতো বড় গ্রহানু বা এস্টোরয়েড পতনের অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়বার দেখতে হয়নি। যদিও সে সম্ভাবনা যে নেই, সেটিও জোর দিয়ে কেউ বলতে পারেননি এখন পর্যন্ত।

আমাদের সৌরজগতে ছোট বড় অসংখ্য গ্রহানু বা এস্টোরয়েড বা উল্কাপিন্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রায় প্রতিটি গ্রহের সাথে সাথে সূর্যকে আবর্তন করেই। সূর্যকে প্রদীক্ষণ করছে এ রকম অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির বস্ত সাধারণত তিন ধরনের হয়; কমেটস, এস্টোরয়েডস এবং মেটোরয়েডস।

সাধারণ এবং সহজ করে বললে, যেগুলোর আকৃতি ১ মিটারের কম সেগুলো মেটোরয়েডস। যেগুলো গ্যাস আর বরফকণায় তৈরী সেগুলোকে বলা হয় কমেটস। আর বড় আকৃতির গ্রহানুকে বলা হয় এস্টোরয়েড।

অপেক্ষাকৃত কম অক্ষ-উৎকেন্দ্রিক দূরত্বের জন্য সাধারণত গ্রহানু বা এস্টোরয়েডগুলো মংগল ও বৃহস্পতিকে ঘিরেই আবর্তণ করে থাকে। জানা গেছে, ১ কিলোমিটারের বড় আকৃতির গ্রহানু বা এস্টোরয়েড যারা শুধু মংগল ও বৃহস্পতি গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, তাদের সংখ্যাই ১.১ মিলিয়ন থেকে ১.৯ মিলিয়নের মতো।

আমাদের পৃথিবীকে আবর্তণ করছে এমন গ্রহানু বা এস্টোরয়েডের সংখ্যাও কম নয়। ২০১৬ সালের জুন মাসের এক মহাকাশ ম্যাগাজিন থেকে জানা যায়, ১৪,৪৬৪ গ্রহানু বা এস্টোরয়েডস পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। এদের মধ্যে আবার ৯০০ থেকে ১০০০ গ্রহানু বা এস্টোরয়েডস আছে যাদের আকৃতি ১ কিলোমিটারের বেশী চওড়া।

এ উদ্বেগজনক তথ্য থেকে পৃথিবীর অস্তিত্ব ও অনিশ্চয়তা নিয়ে সকলের মতো মহাকাশবিজ্ঞানীরাও উদ্বিগ্ন। তাই তো গ্রহানু বা এস্টোরয়েডস নিয়ে গবেষণা হচ্ছে প্রতিদিন। মহাকাশাযানগুলোও আবিষ্কার করছে নিত্য নতুন গ্রহানু বা এস্টোরয়েড।

২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারিখে নাসার পাঠানো অসিরিস-আরএক্স মহাকাশাযান পৃথিবী থেকে ১১ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে একটি গ্রহানু বা এস্টোরয়েড এর ছবি তুলেছে। অসিরিস-আরএক্স যখন এই গ্রহানু বা এস্টোরয়েডের ছবি তোলে তখন তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র ৪৬ কিলোমিটার। তুলনায় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এই গ্রহানু বা এস্টোরয়েডটিও কিন্ত অর্ধকিলোমিটার চওড়া।


(সংযুক্ত ছবিতে বাম দিকে দেখা যাচ্ছে ছোট দু’টি বিন্দু, পৃথিবী ও চাঁদ এবং ডান দিকে এস্টোরয়েড)।

অসিরিস-আরএক্স মহাকাশাযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য বেনু নামের এক গ্রহানু বা এস্টোরয়েডকে জানা। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর এই বেনু নামের গ্রহানু বা এস্টোরয়েডের পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনা আছে। অপেক্ষাকৃত কম সম্ভাবনাও (২,৭০০ ভাগের ১ ভাগ)যদি সত্যি হয় তবে ২১৭৫ সাল থেকে ২১৯৯ সালের কোন এক সময়ে বেনুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ ঘটে যেতে পারে। মানব সভ্যতা ধ্বংসের এই নিম্নতম সম্ভাবনা নিয়েও তাই এতো আয়োজন।

আর নাসার এ অভিযানের সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২০ সালের দিকে অসিরিস-আরএক্স মহাকাশাযানটি এস্টোরয়েড বেনুকে স্পর্শ করে সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত পাঠাবে। আর সে তথ্য-উপাত্ত পৃথিবীতে এসে পৌঁছুবে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সালের দিকে।

এতক্ষণ যা লিখলাম সবই ভয় বা ভাবনার। কিন্ত এসব দুর্ভাবনা পাশে সরিয়ে রেখে একটি সুসংবাদ দিই।

এ মাসেই অপেক্ষা করছে একটি বিশেষ রাত্রি; পূর্ণ চন্দ্রগ্রহনের রাত। জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখ রাতে দেখা যাবে ২০১৯ ও ২০২০ সালের একমাত্র পূর্ণ চন্দ্রগ্রহন। আমেরিকা, ইউরোপসহ এশিয়ার অনেক জায়গা থেকে ৩ বিলিয়ন মানুষ দেখতে পাবে ১ ঘন্টা ২ মিনিট স্থায়ী এ পূর্ণ চন্দ্রগ্রহন। এই ২১-২২ জানুয়ারির এই চন্দ্রগ্রহন আরো ক’টি বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, এই সময়ে চাঁদের বিশেষ অক্ষ-অবস্থানের কারণে পৃথিবী থেকে চাঁদের আকৃতি দেখাবে অপেক্ষাকৃত ৭ ভাগ বড়। দ্বিতীয়ত, এ সময়েই দীর্ঘ তরংগের রঙগুলো পৃথিবীর আবহাওয়া ভেদ করে চাঁদের গায়ে এসে লাগবে, ফলে চাঁদকে দেখা যাবে বর্ণিল এবং প্রায় ৩০ ভাগ বেশী উজ্জ্বল। তৃতীয়ত, চাঁদের পূর্ণগ্রহন ২৬ মে,২০২১ এর আগে পৃথিবী থেকে আর দেখা যাবে না। তাই আশা করি সবাই আগামী ২১ তারিখ রোববার রাতে ঘাড় উঁচু করে চাঁদের এই পূর্ণ গ্রহন দেখবেন আর রবীন্দ্রনাথের মতোই বলবেন,

“রাত কাটে, ভোর হয়, পাখি জাগে বনে — চাঁদের তরণী ঠেকে ধরণীর কোণে”।