ইনসাইট মহাকাশযানের পাঠানো সাম্প্রতিক ছবি

বিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচার-প্রপাগান্ডার প্রায় অলক্ষ্যেই। সোমবার নভেম্বর ২৬,২০১৮ তারিখ মঙ্গল গ্রহে ন্যাশনাল এ্যারোনটিকস এ্যান্ড স্পেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) পাঠানো মহাকাশযান অবতরণ করেছে। মানুষের মঙ্গল গ্রহে বাসস্থানের অভিযান আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল এদিন। পৃথিবী থেকে ৪৮৬ মিলিয়ন কিলোমিটার (নর্থ আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের দূরত্বের প্রায় ২২,০০০ গুন সমান) পাড়ি দিতে নাসার এ মহাকাশযানের সময় লেগেছে প্রায় ৭ মাস। নাসার তৈরী ৩৬০ কিলোগ্রাম ওজনের ইনসাইট নামের এ মহাকাশযানের গতিবেগ ছিল উত্তরণের সময় প্রতি ঘন্টায় ১৯,৮০০ কিলোমিটার। মঙ্গল গ্রহের আবহাওয়ামন্ডলে এর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১১৪ কিলোমিটার আর অবতরণের সময় এর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৫ কিলোমিটার।

২০১২ সালের পর মঙ্গল গ্রহে এটাই নাসার সফল অভিযান। ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানীদের মঙ্গল গ্রহে মহাকাশযান প্রেরণ শুরু আর সে হিসেবে ইনসাইট মহাকাশযান মঙ্গল গ্রহে পাঠানো মহাকাশযানের মধ্যে অষ্টম সফল অভিযান। কিন্তু প্রচেষ্টা ছিল প্রায় দুই ডজনেরও অধিক। প্রচন্ড ধুলিময় এ লোহিত গ্রহে মহাকাশযানের অবতরণ সাফল্য মাত্র ৪০ শতাংশ।

নাসার পাঠানো ইনসাইট মহাকাশযান প্রকল্পের খরচ ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইনসাইট আগামী ২ বছর পৃথিবীতে পাঠাবে নিয়মিত তথ্য ও উপাত্ত। মঙ্গল গ্রহের ১ বছর আমাদের পৃথিবীর ১ বছরের চেয়েও ৩২০ দিন ১৮ ঘন্টা বেশী। সে হিসেবে ইনসাইট মঙ্গল গ্রহের ভূপৃষ্ঠে থাকবে সেখানকার এক বছরের কিছু অধিক সময়। এ দীর্ঘ সময় ইনসাইট মহাকাশযানের অবস্থানের উদ্দেশ্য মঙ্গল গ্রহের ঋতু পরিবর্তনকে আরও বিশদভাবে জানা।

আমাদের পৃথিবীর বাইরে আর যে সকল গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা সন্ধান করছেন মঙ্গল গ্রহ তাদের অন্যতম। পৃথিবীর সাদৃশ্য এ গ্রহটি আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম। যা পৃথিবীর আয়তনের মাত্র শূন্য দশমিক দুই চার আট ( ০.২৪৮) ভাগ মাত্র। জলবায়ুও প্রতিকূল কিন্তু জীবন ধারণের উপযোগী; ঋতু বৈচিত্রও প্রায় পৃথিবীর মতোই। তাপমাত্র সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস কিন্তু সর্বনিম্ন মাইনাস ১৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহ প্রায় একই সময়ে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল। এক সময়ে আমাদের পৃথিবীর মতোই নদী-লেক-জলাশয় ছিল; সেখানে পানি প্রবাহেরও চিহ্ন পাওয়া যায়।কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তিত হোতে হোতে এখন মঙ্গল প্রচন্ড কঠিন ও শীতল এক গ্রহ।

একই সময়ে সৃষ্টি হয়েও মঙ্গল এখন এক মৃত ভূখন্ড কিন্তু পৃথিবী আজও কিভাবে এতো সবুজ, সেটা জানারই প্রচন্ড আগ্রহ বিজ্ঞানীদের। আর সে ঔৎসুক্য থেকেই মঙ্গল গ্রহের প্রতি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এতো আগ্রহ এবং এতো অভিযান।

এবারের মঙ্গল গ্রহে ইনসাইট মহাকাশযানের সফল অবতরণ অন্যান্য অভিযানের চেয়ে একটু ভিন্ন। কারণ, এবারই মঙ্গল গ্রহের ভূপৃষ্ঠে ১৬ ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করা হবে, জানা যাবে মঙ্গল গ্রহের ভূপৃষ্ঠের নিচের তাপমাত্রা – যা আগে কখনোই করা হয়নি। এবারই বছরব্যাপি মঙ্গল গ্রহের জলবায়ুর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে। আধুনিক প্রযুক্তির ক্যামেরা দিয়ে প্যানারোমিক চিত্রগ্রহনের মাধ্যমে ইনসাইট মহাকাশযানের অবতরণস্থানের চারিদিকের চিত্র ধারণ করে পৃথিবীতে পাঠানো হবে নাসার পাঠানো আরও দু’টো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে, যে স্যাটেলাইট দু’টো ইনসাইট মহাকাশযানের সাথেই উৎক্ষেপন করা হয়েছে এবং মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডল সারাক্ষণ প্রদীক্ষণ করছে।

ইনসাইট মহাকাশযানের পাঠানো এ সব তথ্য-উপাত্ত নাসায় কর্মরত কয়েক ডজন বিজ্ঞানী বিশ্লেষণ করবেন। আর সে বিশ্লেষণলব্ধ গবেষণা থেকেই নাসা ২০২০ এ প্রেরণ করবে আরও শক্তিশালী এক মহাকাশযান, যা মঙ্গল গ্রহে প্রাণের বর্তমান, অতীত এবং সুদূর অতীতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সম্যক প্রমান দিতে সক্ষম হবে।

এ সব কিছু বিবেচনা করেই নাসার ইনসাইট মহাকাশযানের অবতরণে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা প্রচন্ড রকমের উৎফুল্ল। আর সে উৎফুল্লতার রেশ আম-জনতার মধ্যেও। তাই তো ইনসাইট মহাকাশযানের মঙ্গল গ্রহে অবতরণের দৃশ্য টিভি ক্যামেরায় প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রচন্ড জলবৃষ্টি উপেক্ষা করেও আমেরিকার নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে সমবেত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ।

নাসার বিজ্ঞানীদের সাফল্য উদযাপনের দৃশ্যও ছিল দেখা মতো। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নাসা তার টুইটারে লিখেছে “সত্যি অপূর্ব সুন্দর এ মঙ্গল গ্রহের চিত্র! নতুন বাসগৃহ আবিষ্কারের অপেক্ষায় নাসা”।

ইতিমধ্যে স্পেসএক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলোন মাস্ক ২০২৪ সালে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর এক ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন। পৃথিবীর কিছু বিত্তশালী মানুষ মঙ্গল গ্রহে যাবার বিলিয়ন ডলার মূল্যের ওয়ানওয়ে টিকেটও কনফার্ম করে ফেলেছেন।

সেদিন হয়ত বেশী দূরে নয় যেদিন পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহের মতো অন্যান্য গ্রহেও থাকবে নিয়মিত ফ্লাইটস। অনাগত সময়ের সেই সৌভাগ্যবান মানুষদের জন্য নাসার বিজ্ঞানীদের আজকের এই সাফল্য হয়ে থাকবে মাইলফলক।