উৎপাদন ব্যবস্থা সব সময়ই প্রযুক্তিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠে। আগে কম ছিল, এখন বেশী প্রযুক্তি নির্ভরতা। এই যা ফারাক। এই উৎপাদন ব্যবস্থাই আমাদের জীবন যাপন প্রণালী, আচার, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, মিথ, ধর্ম ইত্যাদিকে তৈরি, নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে থাকে। প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী। মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্ভব করেছে। প্রযুক্তি ঢেলে সাজিয়েছে উৎপাদন ব্যবস্থাকে। আর এই পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন এনেছে আমাদের মনে, মননে, চিন্তা-চেতনে, বিশ্বাস, ধর্মে আর জীবনাচারে। এই প্রায় অনতিক্রম্য বৃত্তের বাইরে কোন অবস্থাতেই উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতি অবস্থান করতে পারে না। কোন দিন পারবেও না। পরিবর্তনের চাকায় ঘূর্ণায়মান তাই আমাদের জীবন, বিশ্বাস, সংস্কৃতির স্রোতধারা।

ব্যক্তির জীবনে সময়ের সীমিত মাত্রা অনিবার্যভাবে ধরা দেয়। কিন্তু বংশগতি, প্রজন্ম প্রবহমান। যতদিন এই সৌরজগৎ আছে, যতদিন এই পৃথিবী আছে, ততোদিন মানুষ আছে। হয়তো তার পরেও মানুষ টিকে থাকবে অন্য নাক্ষত্রিক গ্রহে নিজেকে অভিবাসিত করে। প্রয়োজনই তাকে নিয়ে যাবে এক পরিবর্তন থেকে আরেক পরিবর্তনে। এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে। এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে। সূর্য যদি তার হাইড্রোজেন ফিউশন আরও দেড়’শ কোটি বছর ঠিকঠাক মতন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তবে আমরা আমাদের কাম-ক্রোধ-লোভ নিয়ে এই ধরাধামে থেকে যেতে পারবো ঐ অতটা সময়।

দেড়’শ কোটি বছর খুব বেশী সময়। অতদূরে যেতে চাই না। হাতের কাছে যতটা জানা, অজানা, অল্পজানা তথ্য-প্রমাণ আছে তার আলোতে না হয় দেখে নেই, আগামী একশ বছরে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব! কেমন হবে আমাদের মন? কেমন হবে আমাদের আবেগ, ক্রোধ, বিশ্বাস আর ভালবাসার প্রকাশ? যদি বলি, বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীগুলো আমাদের আগামী জীবনের প্রতিচ্ছায়া, তাতে একটুও ভুল হবে না। কারণ এই গল্পসমূহ গড়ে উঠেছে প্রমাণিত ও অপ্রমাণিত তত্ত্ব ও হাইপথেসিস, যা এখনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে পর্যবেশিত হয়নি, তাদের উপরে ভিত্তি করে। কল্পনা সব সময় চলমান বর্তমানের আগে ধেয়ে যায়। আর যদি সেই কল্পনা বিজ্ঞানের ডানায় ভর করে তবে তো কোন কথা নেই। নিঃসন্দেহে নিকট অথবা দূর ভবিষ্যতে আমরা সেইসব কল্পনার বাস্তব রূপায়ন দেখবো তাতে কোন ব্যত্যয় নেই।

এবার নাহয় একটা সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে আসতে পারি বিজ্ঞান গবেষণার খটমটে জগত থেকে মৃদুপায়ে চুপিচুপি। কি হচ্ছে সেখানে তার একটা ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে আসি বরং। প্রথমে বলা যায় ন্যনো-টেকনোলজির কথা। এই প্রযুক্তি এখন শৈশবে রয়েছে, তবে বেশীদিন এমন থাকবে না, যৌবন আসবেই। ন্যনো মানে অনেক অনেক ছোট অস্তিত্ব। একের পরে নয়টা শূন্য দিলে যে সংখ্যা হয়, তা দিয়ে এককে ভাগ করলে এক ন্যনো হয়। এমন আরকি। এই প্রসঙ্গে প্রথমে আসে ন্যনোবটের কথা। ন্যনোবট মানে ন্যনো রোবট। এই প্রযুক্তির সবচেয়ে সুন্দর ও জীবনদায়ী ব্যবহার হবে চিকিৎসা ব্যবস্থায়। ন্যনোবট হবে পারমানবিক বা প্রায় পারমানবিক স্তরের ক্ষুদ্রতম অস্তিত্ব, যাকে প্রোগ্রাম করা যাবে এবং প্রাণীর শরীরের ভিতরে নির্দিষ্ট কোন কাজ সমাধা করতে কমান্ড বা আদেশ দেয়া যাবে। ধরা যাক, লিভারের একটা কোনায় টিউমার হয়েছে, ওটাকে ধ্বংস করতে হবে। কোন এক জাতের এমিনো এসিড দিয়ে বানানো অনেকগুলো ন্যনোবট রক্তে ইনজেকশন করে দিলে তারা ঠিকমত কাজ সমাধা করে আসতে পারবে। এই ন্যনো টেকনোলজির ব্যবহার শুধু স্বাস্থ্যসেবায় নয়, আরও বহু ক্ষেত্রে সার্থকভাবে করা হবে, যেমন, প্রতিরক্ষায়, কৃষিব্যবস্থায়।

এরপর আসে রবোটিক্স এবং এ আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা। সব প্রযুক্তির মতন এরও উদ্দেশ্য মানুষকে লিবারেট করে দেয়া, মুক্ত করে দেয়া। সব প্রযুক্তি আবিষ্কারের পিছনে ঠিক এই মোটিভ বা নিয়ত কাজ করে। মানুষকে যেন কোন কিছুর জন্যে অন্য মানুষের উপরে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে না হয়। এ আই প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহারে মানব অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। কেন এই সাবধান বাণী? ডিজিটাইজেশন অব হিউম্যান কনশাসনেস নামের একটা গবেষণায় ইতিমধ্যে মানুষ তার বিনিয়োগ শুরু করে দিয়েছে। যদি কোনভাবে মানব চেতনাকে স্টোর করা যায় সিলিকন ডিস্কে এবং তা যদি কোন রোবটে আপলোড করা যায়, তবে সে ঠিক ঠিক মানুষের মতন হবে। মানুষের আবেগ অনুভূতি ধারণ করবে। ব্যবসার ব্যাপারটাও এইসব প্রযুক্তি গবেষণার সাথে জড়িয়ে আছে। হিউম্যনয়েড রোবটের আইডিয়াটা ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী কমিউনিটির মাথায় চলে এসেছে, এবং তা এসেছে মাইন্ড ডাউন লোড আইডিয়ার ভিতর দিয়ে। ডিস্কে স্টোর করা মানব চেতনাকে একটু ম্যনিপুলেট করে মানুষের উপযোগী সঙ্গী বা সঙ্গিনী তৈরি করা যেতে পারে, যা মানুষকে সত্যিকারভাবে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দিতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। যৌনসঙ্গী হিসাবে এইসব রবোটও মানুষের যৌন চাহিদা মেটাবে। এতে অন্ততঃ ঘরে ঘরে তালাকের শতকরা হার বেড়ে যাচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের বিনিদ্র রাত কাটানো লাগবে না। অর্ধ-রবোটিক দম্পতিরাও বেঁচে যাবে নিত্য দাম্পত্য যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে। রবোটিক্স ও এ আইয়ের সম্মিলন শুধু যে মানুষের নিঃসঙ্গতা দূরীকরণের কাজে লাগবে তা নয়, সভ্যতার প্রতি কোনায় কোনায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের সার্থক ব্যবহারকে নিশ্চিত করা হবে। উৎপাদন, বণ্টন, ব্যবস্থাপনা সব জায়গায় কাজ করবে এইসব এ আই সমৃদ্ধ বুদ্ধিমান রবোট। মানুষের হাতে আসবে অখণ্ড অবসর, যা তারা কাজে লাগাবে চিত্তের উৎকর্ষতা সাধনের কাজে- শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে। এমনই হবার কথা। মানুষ যত জীবনের বোঝা থেকে মুক্ত হতে থাকবে, ততো সে উন্নয়ন ঘটাবে তার মন ও মননের।

এক্টোজেনেসিস ও কৃত্রিম জরায়ু। এক্টোজেনেসিস শব্দের মানে, মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তানের জন্মদান। ২০১৭ সালের এপ্রিলে চিলড্রেন হসপিটাল অফ ফিলাডেলফিয়ার গবেষণাগারে সিনথেটিক পদার্থে তৈরি কৃত্রিম জরায়ুতে একটা ভেড়ার ফিটাসকে পূর্ণাঙ্গ করা হয়। মাতৃগর্ভে সন্তান থাকা অবস্থায় যে অসংখ্য প্যারামিটার প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, ঠিক সেইসব মাল্টিপ্যারামিটার যান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব। ভেড়ার ফিটাস নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ঠিক এটাই প্রমাণিত হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে তারা মানুষের ফিটাস নিয়েও ঠিক একই ধরণের পরীক্ষা করতে পারবেন যদি সামাজিক ও নৈতিক আইনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যায়। সন্তান উৎপাদনের জন্যে যে যৌন সম্মিলনের দরকার নেই, সেই ব্যাপারটা চিনের গবেষকরা ইঁদুরের ক্ষেত্রে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন আতিসম্প্রতি। সুতারং সন্তান উৎপাদনে মাতৃ জরায়ু, ডিম বা শুক্রাণু, এসবকিছুর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে নিকট ভবিষ্যতে, সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়। এর ফলে প্রকৃতিগতভাবে মানুষের উপরে চাপিয়ে দেয়া যন্ত্রণা থেকে মানুষের মুক্তি মিলবে। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকেও মানুষের মুক্তি মিলবে।

মানুষে মানুষে নির্ভরশীলতা পুরাপুরি উঠে গেলে মানবিক সম্পর্কেরও ইতি ঘটবে বলে অনেক বিজ্ঞজন মনে করেন। সম্ভাবনাটাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে যদি এমন হয়, মানুষের প্রয়োজন মেটাবার উপায়ের ভিতরে যদি বিকল্প থাকে। যদি নিজের প্রয়োজনে মানুষের কাছে যাওয়া একটা ঐচ্ছিক বিষয় হয়ে যায়। তবে মানুষ স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে নিজের পছন্দমত যে কোন একটাকে বেঁছে নিতে পারবে। প্রযুক্তিই পারে মানুষকে এইধরণের পছন্দের স্বাধীনতা দিতে।

অমরত্বকে এখন আর খুব বেশী কল্প-কাহিনী বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছেন আগামী পনরো বছরের মধ্যে মানুষ অমরত্বের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। অষ্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেছে এমন এক ওষুধ, যা খেলে বয়স কমে যাবে ত্রিশ বছর। মানুষ যদি প্রযুক্তি ব্যবহারে তার নিজের সকল মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিবহন, বিনোদনসহ সবকিছু তৈরি করে নিতে পারে, তবে কেন সে নির্ভর করতে যাবে দৈবের উপরে। কেন সে বিশ্বাস করতে যাবে গড, ভগবান, ঈশ্বরে। কেন সে তোয়াজ করতে যাবে নেতা, বস, মহাজন, জমিদারকে। জীবন ধারণের সম্পদ যখন বাতাস ও পানির মতন সহজলভ্য হয়ে যাবে, তখন কোন অপরাধ থাকার কথা নয়। থাকার কথা নয় আদালত, পুলিশ, জেলখানাও। পারলে প্রযুক্তিই পারবে এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে। তাই যদি হয় তবে তখন জন্ম নেবে নতুন এক সংস্কৃতি, নতুন এক বিশ্বাস, নতুন এক মানবিক প্রতিবেশ। আজকের দিনের ধর্ম, বিশ্বাস, জাতিভেদ, হানাহানির কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বই থাকবে না। এটা যে হওয়া সম্ভব তার পূর্বলক্ষণ এখনই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

ইন্ধনশক্তি বা জ্বালানী মানব সভ্যতার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। এই ব্যপারে আমরা এখনও শৈশবেই রয়ে গেছি। এখনও আমরা জীবাস্ব জ্বালানীর উপরে নির্ভরশীল। জীবাস্ব জ্বালানী নির্ভর একটা ভূরাজনীতিও আমাদের এই নির্ভরতাকে দীর্ঘায়ীত করছে। সে এক জটিল চক্র। এর মাঝেও কিছু আসার আলো নিয়ে আসছে নিত্য নতুন প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের টেকসই প্রযুক্তি। নবায়নযোগ্য জ্বালানী প্রায় অফুরন্ত। যেমন সৌরশক্তি। চলমান গবেষণা সোলার প্যানেলের ক্ষমতা শতকরা সত্তুরভাগে উন্নীত করার চেষ্টায় আছে। দুই স্তর বা তিনস্তর বিশিষ্ট সোলার প্যনেলের উদ্ভাবন এখন সময়ের ব্যপার মাত্র। সোলার এনার্জিকে সঞ্চয় করা হয় ব্যটারীতে। ব্যাটারীর গুণমান বাড়াতে সেখানেও চলছে নিরলস গবেষণা। আরও রয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউশনের একটা বাস্তব সম্মত ব্যবহার নিশ্চিত করা। সে বিষয়েও গবেষণা চলছে বিপুল। নিউক্লিয়ার ফিউশন পদ্ধতিতে সূর্য্য শক্তি উৎপাদন করে, যা আমরা এই পৃথিবীতে বসে পাই বিনা পয়সায়। চারটা হাইড্রজেন পরমানু বিপুল চাপ ও তাপে একসাথে ফিউজ হয়ে একটা হিলিয়াম অনু তৈরি করে। সাথে সাথে অনেক শক্তি সে এই বিক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্ত করে দেয়। সূর্যের এই বৈশ্বিক বিক্রিয়াকে যদি নকল করে পৃথিবীতে ফিউশন নিউক্লিয়ার রিয়্যাকটর বসানো যায়, তবে মানুষ পাবে তার প্রয়োজনের থেকে বহু বহু গুণ বেশী জ্বালানী শক্তি। এইসব গবেষণার পিছনে রয়েছে বিপুল পরিমান বানিজ্যিক স্বার্থ। তা থাকে থাক। তারপরেও জীবাস্ব জ্বালানীর ভাগাড় থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রচেষ্টা তাকে মোটের উপর সাধুবাদই জানাতে হয়।

রিসাইক্লং সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার একটা টেকসই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির উপরে আমাদের অস্তিত্বের একটা বড় অংশ নির্ভরশীলও বটে। পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে রিসাইক্লিংয়ের কোন বিকল্প নেই। একসময়ের লৌহ সম্পদে সমৃদ্ধ জাতিসমূহ এখন আর লৌহ নির্ভরতাকে পুঁজি করে ধনী হতে পারে না। কারণ সবচেয়ে বেশী রিসাইক্লিং হয়ে থাকে লোহা ও লোহাজাত পণ্য। প্লাস্টিক পরিবেশের বিপর্যয় ঘটায়, একথা এখন শিশুরাও জানে ও বুঝে। রিসাইক্লিং সংস্কৃতি সেখান থেকেও আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে। এই রিসাইক্লিং প্রযুক্তির সাথে বানিজ্যিক স্বার্থ ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার বিষয়টা খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বর্তমান সভ্যতাকে টেকসই করার জন্যে। রিসাইক্লিং যে শুধু ধাতু আর প্লাস্টিক হয়, তা নয়। ব্যবহার যোগ্য সবকিছুই রিসাইক্লিং করা সম্ভব। এমন কি মনুষ্য মলও।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা আমরা এখন হর হামেশাই শুনছি। বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আধিক্য যে এই উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ, তা এখন সবাই জেনে গেছে। পৃথিবী জুড়ে বনায়ন প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করা এর একমাত্র সমাধান নয়। এর জন্যে প্রযুক্তি সমাধানও থাকতে হবে। এই মুহূর্তে সেই প্রযুক্তিও মানুষের হাতে এসে গেছে। ক্লাইমওয়ার্ক্স সুইজারল্যন্ড ভিত্তিক একটা প্রতিষ্ঠান, যারা সার্থকভাবে মেশিনের মাধ্যমে বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আলাদা করে সিলিন্ডারজাত করতে সক্ষম হয়েছে। এই জায়ান্ট মেশিন খোলা প্রান্তরে বসাতে হয়, যা সৌর শক্তির মাধ্যমে চলে। এই যন্ত্র তার ফোর্স ইন্ডিউজড ফ্যনের মাধ্যমে কার্বনযুক্ত বাতাসকে একটা তরল রাসয়নিক পদার্থের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আটকে ফেলে। পরে সেই তরল থেকে দুষিত গ্যাসটাকে আলাদা করে সিলিন্ডারে সংগ্রহ করে। বিজ্ঞানীরা এই সংগৃহিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বানিজ্যিক ব্যবহারের উপরে গুরুত্ব দিচ্ছেন এই কারণে, যাতে বিনিয়োগকারীরা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে এই গ্রীনহাউস গ্যাস উৎপাদনে উৎসাহী হয়। কারন এই মেসিভ প্রগ্রাম একা সরকারের পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। এর জন্যে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য। সংগৃহিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার করা যায়- যেমন, ইউরিয়া সার তৈরিতে, মিথেন জ্বালানী তৈরিতে। এই গ্যাসের বানিজ্যিক ব্যবহার আরও ব্যপকভাবে উৎসাহিত করা গেলে খুব শিঘ্রি গ্রীনহাউস এই গ্যাসটাকে পরিমিত মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।

এবার আসা যাক পরিবহন বা ট্রান্সপোর্টেশনের ক্ষেত্রে খুব শিঘ্র কি কি ঘটতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে। সুপারসনিক গতিবেগ মানুষ যেমন আনতে পেরেছে, হাইপারসনিকও পেরেছে সে। সুপারসনিক সহ্য করতে পারলেও হাইপারসনিক মানুষের দেহ সহ্য করতে পারে না। হাইপারসনিক গতি সহ্য করার প্রযুক্তি এখনও সেভাবে মানুষের পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য্য নয়। তবে বিমান যাত্রার বিকল্প হিসাবে স্থলপথে হাইপারলুপ পরিবহন ব্যবস্থা আসছে খুব শিঘ্রই। এই পরিবহন ব্যবস্থা চলবে সৌরশক্তির মাধ্যমে এবং তার বাহন গতি পাবে সর্বোচ্চ ঘন্টায় ১০০০ মাইল, যা হতে পারে বিরক্তিকর বিমানযাত্রার একটা বিকল্প। সম্পূর্ণ ম্যগনেটিক লেভিটেশনের মাধ্যমে চলবে এই যান। এই হাইপারলুপ যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিবহন জগতে একটা বিপ্লব আনবে তাতে সন্দেহ নেই। তবে দূর ভবিষ্যতের পরিবহন ব্যবস্থা হবে টেলিপোর্টেশন, যা এখনও স্টারট্রেক নামক সাইফাইয়ের বড় উপজীব্য। বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী যে একসময় সত্য হয়, তার প্রমান রয়েছে আমাদের হাতে ভুরিভুরি।
প্রযুক্তি মানুষের ভবিষ্যত তৈরি করবে। তার এই প্রচেষ্টা সহজ, মসৃণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে পারে যদি দেশ, জাতি ও পৃথিবীর রাজনীতি সঠিক পথের উপরে থাকে। যেখানে আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের মতন দেশের নেতৃত্বের কাছ থেকে শুনতে হয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও পরিবেশ বিপর্যয়ের গুরুত্বহীনতা ও অসারতার কথা, সেখানে ভবিষতে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও সভ্যতার অস্তিত্ব নিয়ে মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ্য হয় বৈকি? তারপরেও মানুষ আশাবাদী। মানুষ এই কারণে আশাবাদী, যে ভাল হোক মন্দ হোক কোন নেতৃত্বই চিরস্থায়ী নয়। একদিন না একদিন নেতৃত্বের মাঝখানে শুভবুদ্ধির উদয় হবেই। তা না হলে প্রযুক্তি পথ হারাবে। প্রযুক্তির ফসল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া যাবে না। মানুষ তাই আশা বুকে নিয়ে অপেক্ষা করবে প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্বের সকল স্তরের নেতৃত্বের ভিতরে শুভচেতনার জন্মের জন্যে। সেই সাথে সাথে সাধারণ গণমানুষকেও নিজেদের তৈরি করতে হবে আগামী প্রযুক্তি-পৃথিবীর উপযুক্ত নাগরিক হিসাবে।