বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়িতে কবি লিখেছিলেন, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। …

কিন্তু এখন পণ্য প্রচারের নামে নামে টিভিতে আদিবাসী পাহাড়ি নারীকে হেয় করে তথা পুরো আদিবাসী সমাজকেই ব্যাঙ্গ করে যে কুৎসিৎ বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে, তাতে বিজ্ঞাপনের কালিমায় কদার্য হচ্ছে আমাদের সকলেরই মুখ।

পাঠক, আসুন, এই আলোচ্য বিজ্ঞাপনের তত্ত্ব-তালাশ করি।

রবি মোবাইল অপারেটর কম্পানির বিজ্ঞাপনের শিরোনাম “নিখোঁজ সংবাদ”। এর তিনটি চরিত্রের মধ্যে কেন্দ্রীয় দুই নায়ক-নায়িকা তারকা মডেল, জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী – তিশা ও চঞ্চল চৌধুরী। অপর চরিত্রটি এক পাহাড়ি বালক।

বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যায়, ব্যাকপ্যাক কাঁধে চঞ্চল (তার পেছনে দিগন্ত জোড়া আকাশ ও পাহাড়ের পর পাহাড়)। তিনি এক পাহাড়ি নারীকে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে দিয়ে বলছেন: ম্যাগ আর পাহাড় দুইডাই কিন্তু ধরবেন সিস্টার, ওকে?

আড়াআড়ি করে মোবাইল ফোন হাতে তিশাকে দেখা যাবে, চোখ সরু করে তাকিয়ে আদিবাসী সাজার আপ্রাণ চেষ্টা, পরনে আদিবাসী পাহাড়ি পোশাক, পেছনে একটি পাহাড়ি খড়ো ঘর, দা্ওয়ায় এক পাহাড়ি বালক মোবাইল ফোন হাতে (অস্পষ্ট), তিশা, মানে কথিত পাহাড়ি নারী মাথা কাত করে বলেন: হুউউম।

ছবি তোলা শেষ হলে লাফিয়ে এসে মোবাইলের মনিটর দেখেন চঞ্চল: ওয়াও! এখন ছবি আপলোড করলেই লাইক প’ড়তেই থাকবে।

কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিনে বাফারিং দেখা যায়, অর্থাৎ ইন্টারনেট প্রবলেম।

পরে নেটওয়ার্কের সন্ধানে মোবাইল সেট এদিক-ওদিক করেন চঞ্চল: একি! ফেসুবকই দেখি ওপেন হয় না!

পাহাড়ি বালকটি এবার মুচকি হাসে। বাড়ির আঙিনায় ঝোলানো আনারস পরিচর্যা করতে করতে তিশা আধো বাংলায় বলেন: নেত ওয়াক পবেলেম?

চঞ্চল: হুম।

বালক (ফোন সেট উঁচিয়ে): আমাল ফোনে ইন্টারনেট আছে!

চঞ্চল (থতমত মুখ করে): ক্যামনে?

তিশা (মুখ টিপে হাসে বালকের ফোন সেট হাতে নিয়ে): রবিতে আছে, রবিতে আসেন, রবিতে নো পবলেম।

চঞ্চল (বোকা বোকা হাসি): তাই নাকি!

এরপর ভয়েস ওভার: দেশের যে কোনো প্রান্তে ফোর পয়েন্ট ফাইভ জি ইন্টারনেট স্পিড পেতে নম্বর না বদলে রবিতে চলে আসুন. . .ইত্যাদি। চঞ্চল চৌধুরীকে দেখা যাবে রবির একটি আউট লেটে আঙুলের ছাপ দিয়ে নতুন রবির সিম তুলে মোবাইলে লোড করতে।

তারকা খ্যাতি ও নির্মাণ কৌশলে বিজ্ঞাপনটি রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেলে খুব অবাক হওয়া কিছু থাকবে না। সেই সঙ্গে দর্শক মনে হয়তো অবচেতনে ঢুকে যাবে বিজ্ঞাপনটির হীন অন্তর্দশন, আপত্তিটি এইখানে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল সম্পর্কে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ সূত্রে বলা যায়, বিজ্ঞাপনে রবির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক প্রচারের পাশাপাশি আরো যা প্রচার করা হচ্ছে, তা অনেকটা এরকম: পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়, অরণ্য, মেঘের প্রাকৃতিক লীলাভূমি, সেখানের পাহাড়িরা শুদ্ধ বাংলা বলতে অক্ষম, পাহাড়ি মেয়ে সুন্দরী, মিশুকে ও অচেনা লোকের সাথে সহজেই কথা বলেন, খড়ো ঘরের বাসিন্দা জুমচাষী (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ) পাহাড়িদের কাছেও সহজলভ্য স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট- অর্থাৎ তারা বেশ সুখেই আছেন – ইত্যাদি। যদিও উন্নয়নের মূলধারা থেকে প্রায় বিচ্ছন্ন পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষেত্রে এর কোনটিই সঠিক নয়। তবে আপাতত এর ফোকাস পয়েন্ট নিয়েই কথা বলা যাক।

দুর পাহাড়ের আদিবাসী অনেকেই শুদ্ধ প্রমিত বাংলা উচ্চারণ জানেন না, এটিই স্বাভাবিক, কারণ বাংলা তাদের মাতৃভাষা নয়, তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমৃদ্ধশালী ও ঐতিহ্যময় পাহাড়ি ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত, তারা যেটুকু বাংলা না বললেই নয়, সেটুকু বলেন হাট-বাজারে, স্কুল-কলেজ বা অফিস-আদালতে, শুধুই ব্যবহারিক কারণে।আবার সে বাংলা ভাষাটিও প্রমিত বাংলা নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলা বা চাটগাঁইয়া বাংলা।

অপরদিকে, একজন বাঙালি চাকমা ভাষা শিখলেও রাতারাতি শুদ্ধ চাকমা বলতে পারেন না, বা চট্টগ্রামের বাসিন্দা বাঙালিজনও রাতারাতি শুদ্ধ প্রমিত বাংলা বলতে পারেন না। উচ্চারণের অশুদ্ধতা থেকেই যায়।

ভেবে দেখুন তো, একই বিজ্ঞাপন যদি চট্টগ্রামের কোনো গ্রামের বাঙালি নারীকে দিয়ে (যিনি চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত) আধো বাংলা বা অশুদ্ধ প্রমিত বাংলায় করানো হতো (যেমন, ও বাই. আফনের নেটওয়ার্ক সমইস্যা যে? আমি আপ’নাকে বলতেছি যে, তাইলে রবিতে আইস্যেন। রবিতে নো প্র’বলেম)! তাহলে কি ভয়ানক তুলকালামই না ঘটে যেত এতদিনে!!

সেক্ষেত্রে বাঙালি তারকা শিল্পীকে পাহাড়ি পোষাক পরিয়ে চোখ ছোট করে মুখোচ্ছবিতে মঙ্গোলয়েড ভাবধারা আনার চেষ্টা ও আধো বাংলা বুলি গুঁজে দেওয়া নেহাত আহাম্মুকি শুধু নয়, আদিবাসীদের হেয় করে দেখার অতি চটুল বাঙালি রীতি, যা আসলে উগ্র জাত্যাভিমান!

বাঙালির উগ্র জাত্যাভিমান রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে সিনেমা, নাটক পেরিয়ে এখন বিজ্ঞাপনেও ছড়িয়ে পড়েছে।এই উগ্র জাত্যাভিমানের বিষফোঁড়ার বিষাক্ত রক্ত ও পুঁজ শুধু আদিবাসী সমাজকেই দুষিত করছে না, তা দুষণ ঘটাচ্ছে মূল বাঙালি চেতনাতেও। তাই জরুরি ভিত্তিতে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠির উগ্র জাত্যাভিমানের এই বিষফোঁড়া অস্ত্রপচার আবশ্যক।

পাশাপাশি আদিবাসী পাহাড়ি জাতিসত্ত্বকে হেয় করে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করা চাই। ডিজিটাল সরকার বাহাদুরের তথ্য মন্ত্রণালয় তড়িৎ গতিতে এই হীন বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, সে দাবি জানাই।

জয় হোক, আদিবাসীর অধিকার!