কিছুদিন আগে ২১ শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলার রায় হয়েছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাও বলা যাবে না কারণ গদি বদলানোর সাথে সাথে আসামী সাফা মওকুফের ইতিহাস বাংলাদেশে নতুন নয়। যদিও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মতন আর দল এতো খুনির সাজা মওকুফ করেনি। এতো দয়ালু সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখা যেতেই পারে; তারা কী ২১ শে অগাস্টের আসামীদের সাজা মওকুফ করবে কিনা কিংবা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের? নাকি ক্ষমা পাওয়ার জন্যে একমাত্র পথ তাদেরও আওয়ামী লীগ হয়ে যেতে হবে। কারণ কুখ্যাত খুনিদের জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে বর্তমান সরকার আর এতে সহযোগিতা করেছে আমাদের রাষ্ট্রপতিরা। কৌতুক বলে বিখ্যাত হওয়া আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তাদের একজন যারা সরকার প্রধানের নির্দেশে কুখ্যাত খুনিদের ফাঁসি থেকে মুক্তি দিয়েছেন, অনেক খুনির সাজা কমিয়েছেন। অনেকে আবার বলে থাকেন, আমরা নাকি সৌভাগ্যবান কারণ আমরা এমন ভাল (!) রাষ্ট্রপতি পেয়েছি।

তাই যাদের ফাঁসির আদেশ কিংবা যাবজ্জীবন হয়েছে তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নাই! আইনজীবী নুরুল ইসলামকে নিজ বাসায় টুকরা টুকরা করা তাহের পুত্র বিপ্লব যদি মৃত্যুদণ্ড থেকে পার পেয়ে ৭ বছরেই রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে তাহলে বিএনপি ও অন্যদলের খুনিরা হতাশ হবে কেন। শুধু তাদের প্রয়োজন; গণভবনের গদি ও জিল্লুর রহমান, রসিক রাষ্ট্রপতির মতন দয়ালু রাষ্ট্রপতি যারা প্রধানমন্ত্রীর আদেশে ক্ষমাশীল হয়ে উঠবেন।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার পরিসংখ্যান (পত্রিক থেকে)

– ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মাত্র একজন আসামী মুক্তি পান।

জিয়ার আমল

১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের আলোচিত সাত খুনের মামলার প্রধান আসামী শফিউল আলম প্রধানকে বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে ১৯৭৮ সালে তিনি মুক্তি পান। ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা গঠন করেন। সাত খুন নিয়ে বিস্তারিত পড়তে চাইলে- মুহসিন হলের সেভেন মার্ডার । জিয়া তাকে মাপ করে দেন, আর এই কৃতজ্ঞতায় ছাত্রলীগের নেতা শফিউল আলম সারা জীবন বিএনপির সঙ্গে ছিলেন।

এরশাদের আমল

-১৯৮৭ সালে প্রথম এক আসামীকে ক্ষমা করা হয় যিনি আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দিন আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত হয়।

বিএনপি-জামাত সরকারের আমলে

– ২০০৫ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামী সাধারণ ক্ষমা লাভ করে। বিএনপির সুইডেন শাখার সভাপতি মহিউদ্দিন জিন্টুকে ক্ষমা করেন। দুই দশক আগে একটি জোড়া খুনের মামলায় তার ফাঁসির রায় হয়েছিল।

তত্ত্বাবধায়কের আমল

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের আমলে সাধারণ ক্ষমা পান এক আসামী।

আওয়ামী লীগের আমল ২০০৯-২০১৩

২০০৯ সালে ১ জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, ২০১১ সালে ২ জন।

জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবরকে ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ক্ষমা করার অধ্যায়। তার মধ্যে আলোচিত লক্ষীপুরের গডফাদার তাহেরের পুত্র সন্ত্রাসী বিপ্লবের মামলা। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুল রহমান সাত মাসের ব্যবধানে দুটি হত্যা মামলায় দুবার তার সাজা হ্রাস করে দেন। দুই ক্ষেত্রেই তার মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড করা হয়।

এবছর আমাদের রাষ্ট্রপতি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তোফায়েল আহমেদ জোসেফ কে ক্ষমায় মুক্তি প্রদান করেন।

২০১৪

সংসদে প্রশ্নোত্তর- ২৬ জনের ফাঁসির দণ্ড মওকুফ রাষ্ট্রপতির

বিগত মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে ২৬ জন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামির সাজা মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। গতকাল বুধবার সংসদের নির্ধারিত প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ তথ্য জানান।
জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমানের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় ফৌজদারি মামলায় সাজা পাওয়া ৩৩ ব্যক্তির সাজা মওকুফ বা কমানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ৩০ জন ব্যক্তি আছেন। রাষ্ট্রপতি বিশেষ ক্ষমা পাওয়া এসব ব্যক্তির মধ্যে মহিউদ্দিন জিন্টু ও বর্তমানে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র আবু তাহেরের ছেলে এ এইচ এম বিপ্লবের নাম রয়েছে। বাকি তিনজনের কারাদণ্ডের সাজা মওকুফ অথবা কমানো হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, ৩৩ ব্যক্তির মধ্যে ২৬ ব্যক্তির ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে বিগত মহাজোট সরকারের সময়ে। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে দুজন এবং এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আরও দুই ব্যক্তির ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করা হয়।

২০১৫

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকিরের ফাঁসির সাজা মওকুফ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। ২০১৭ সালে তিনি মুক্তি পান৷ গতবছর আবারও এক হত্যা মামলার প্রধান আসামি হন তিনি৷

২০১৮

রাষ্ট্রপতির ‘প্রাণভিক্ষায়’ সেই মেয়রপুত্র কারামুক্ত। হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া লক্ষ্মীপুর পৌর মেয়র আবু তাহেরের বড় ছেলে আফতাব উদ্দিন বিপ্লব এখন কারামুক্ত। এছাড়াও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তোফায়েল আহমেদ জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পায়।জোসেফ বর্তমান সেনা প্রধানের আপন ভাই!

রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা

সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে−কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে−কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’

রাষ্ট্রপতির দায়মুক্তি

৫১। (১) এই সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদের হানি না ঘটাইয়া বিধান করা হইতেছে যে, রাষ্ট্রপতি তাঁহার দায়িত্ব পালন করিতে গিয়া কিংবা অনুরূপ বিবেচনায় কোন কার্য করিয়া থাকিলে বা না করিয়া থাকিলে সেইজন্য তাঁহাকে কোন আদালতে জবাবদিহি করিতে হইবে না, তবে এই দফা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যধারা গ্রহণে কোন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন করিবে না।

(২) রাষ্ট্রপতির কার্যভারকালে তাঁহার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন প্রকার ফৌজদারী কার্যধারা দায়ের করা বা চালু রাখা যাইবে না এবং তাঁহার গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোন আদালত হইতে পরোয়ানা জারী করা যাইবে না।

তাই অবিলম্বে সংবিধানের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতা বাতিল করে দেওয়ার জন্যে সংবিধানের এই কালো অনুচ্ছেদ বাতিল করতে হবে। যদিও জনগণের চাপ ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল এই অনুচ্ছেদ বাতিল করতে চাইবে না কারণ তারা নিজ দলের খুনিদের মুক্ত হওয়ার জন্যে এই অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্পষ্ট করে বলেছেন (৩০ অক্টোবর ২০১৪)- “রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিধান বাতিল করা যায় না, রাষ্ট্রপতির কাছে এমন কিছু ক্ষমতা থাকা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।