আমার বড় ভাই মেসবাহ রহমান, মানব গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর সাভার সিআরপিতে ভোর বেলা দেহ রেখেছিলেন, ঘুমের ভেতরেই হার্ট এটাক।

সেদিন মর্নিং ডিউটি ছিল, সকাল ৭টার টেলিভিশন নিউজ বুলেটিন অন এয়ার হয়েছে মাত্র। এমন সময় ভাইয়ার নার্সের হাউমাউ কান্না। আমি তাকে স্থির বুদ্ধিতে একজন ডাক্তার ডেকে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলি। অফিসে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ছুটি নিয়ে সাভারের পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছুটে যাই। পাগলের মত একেতাকে টেলিফোন করি, আমার একমাত্র ভাই!

আগের দিনই ডে অফের বিকালে দুঘন্টার বাস জার্নি করে সাভার সিআরপিতে গিয়ে ভাইয়ার সংগে অনেক সময় কাটিয়েছি। তার শরীর স্পঞ্জ করে দেই। জামাকাপড় বদলে নার্স মনোয়ারসহ ভাইয়ার হুইল চেয়ার ঠেলে কেবিনের বাইরে খোলা লনে বেড়াই। আমরা পুকুরের পাড়ে বিশাল কড়ই গাছের নীচে থামি, সন্ধ্যা বিলাস।

আমি ভাইয়াকে সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলরি টেইলরের গল্প বলি। সিআরপির আরো কিছু হুইলচেয়ার করে বেড়াতে বের হওয়া নারী-পুরুষ রোগি আমাদের আলাপচারিতায় যোগ দেন। ভাইয়া ভেলরি টেইলরের সাথে দেখা করার ইচ্ছে পোষণ করেন। সিআরপির খোলা পরিবেশে তাকে কিছুটা সুখি মনে হয়।

রাত ৮টায় কেন্টিনে নিয়ে গিয়ে ভাইয়াকে ডিনার করাই। তারপর গুনে গুনে গোটা দশেক হরেক রকমের অষুধ। এরপর বাস ধরে ঢাকার বাসায় ফেরা। আর সেই ভাই পরদিন সকালে চলে গেলেন! এতই সহজ!

মানব ভাই নকশাল আমলের বিপ্লবী ছিলেন। গত বছর প্রয়াত বৃদ্ধ বাবা আজিজ মেহেরের সাবেক দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (মতিন-আলাউদ্দীন) সক্রিয় ক্যাডার ছিলেন। হাইস্কুলে পড়ার সময় ভাষানীর সন্তোষের সম্মেলন করেছিলেন। এইসব করতে গিয়ে সে সময় শত্রু পক্ষের গুলি লেগেছিল তার পায়ে।

সাতের দশকে আমার ভাই সব ছেড়ে দিয়ে পপ সম্রাট আজম খানের গানের দলে যোগ দেন। তিনি ছিলেন তার অন্যতম গিটারিস্ট। সে সময় গুলিস্তানে চো চিংচো চাইনিজ রেস্তোরাঁয় আজম খানের সংগে অনেক কনসার্ট করেছিলেন।

এখনো চোখ বুজলে শৈশবের সেই ভাইকে যেন দেখি, লম্বা চুল দাড়ি, নোংরা বেল বটম প্যান্ট, রঙচঙ শার্ট, সরু কালো মোর সিগারেট ফুকতে ফুকতে গিটার বাজিয়ে গাইছেন, “রেল লাইনের ওই বস্তিতে!”

আজম খানের জনপ্রিয় সব গান রেকর্ড বন্দি হওয়ার আগেই সে সময় আমি মানব ভাইয়ের গলাতেই শুনেছি। বিডিনিউজে কাজ করার সময় আজম খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। পরে “আজম খানের মুক্তিযুদ্ধ“ নামে মুক্তমনাসহ বিভিন্ন সাইটে ব্লগ নোট লিখেছিলাম, সেখানে মানব ভাইয়ের কথা কিছু বলেছি, গুগোল করলে সে লেখাটি বোধহয় পাওয়া যাবে।

সেই ভাই বড় হতে হতে, দূরাগত হতে হতে, অনেক বছর আরব দেশে, প্রায় বেদুইন হয়ে গিয়েছিলেন!

দুবছর আগে আগস্টের কোনো এক বিকালে হঠাৎ টেলিফোন – দুবাই হসপিটালে আমার ভাই কোমায় আছেন! তার ব্রেইন স্ট্রোক করেছে, হার্ট ফেইল করেছে, এখনতখন অবস্থা! বিদেশ বিভূঁইয়ে একা, নিষ্প্রাণ, সাবেক বিপ্লবী, সাবেক আজম খানের গিটারিস্ট, প্রকৌশলী মানব ভাই পক্ষাঘাতে অতি বিপন্ন।

একমাস পর মেডিকেল সায়েন্সকে চমকে দিয়ে তিনি চোখ মেলে তাকালেন, ততোদিনে তার বামপাশ অসাড় হয়ে গিয়েছে, অবশ্য কথাবার্তা পরিস্কার, মস্তিস্ক কিছু এলোমেলো। …

দুবাই থেকে ঢাকা, ডাক্তার, নার্স, তার সহকর্মীদের সংগে টেলিফোনের পর টেলিফোন! আমার ভাইপো অনিন্দ্য (পেশায় ব্যাংকার, সেও দারুণ গিটারিস্ট, ভাইয়ার কাছেই গিটারে তার হাতেখড়ি) ভাইয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তার মা আর আমার বোনেরাসহ অনেক কাঠখড় পোড়ায়। দুমাসের অবিরাম চেষ্টার পর সেই ভাইকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর ল্যাব এইড হাসপাতালে তার অনেক চিকিৎসা, ডাক্তার, থেরাপিস্ট, নার্স, অষুধের বাক্স।

ঢাকার মগবাজারের বিশাল ফ্লাট বাড়ির পুরোটাই অস্থায়ী হাসপাতালে পরিনত হয়। তার জন্য রাখা হয় সার্বক্ষণিক নার্স।

হুইল চেয়ার বন্দি ভাইয়ের সেভিং ও স্নানের দায়িত্ব নেই আমি। মাঝে মাঝে ভাইকে বিভিন্ন ব্লগপোস্ট, পত্রিকা থেকে পড়ে শোনাই, একসাথে ডিসকভারি দেখি, নানান বিষয়ে গল্প করি। গতবছর ১০ আগস্ট বাবা চলে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে মুক্তমনাসহ বিভিন্ন সাইটে লেখা “আমার বাবা আজিজ মেহের“ নোটটি ভাইয়াকে পড়ে শোনাই। সেই লেখাটি শুনতে শুনতে ভাইয়া চোখ মোছেন। নকশাল বাড়ি আন্দোলনের আগুন ঝড়া দিনগুলোর কথা বলেন। বলেন, তার সহযোদ্ধা খোদ কৃষকের ছেলে নিদানের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর কথা। সাতের দশকে নিদানকে শত্রুপক্ষ বিভৎসভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুন করে। এইসব বিপ্লবীর আত্মত্যাগ কী বৃথাই গেল? আমরা তো ভুলি নাই শহীদ…।

সেই মানব ভাই বছর খানেক অনেক ভুগে কেমন আলগোছে চলে গেলেন! যেন হাতের ভেতর থেকে আচমকা ফস্কে গেল হাত। ভাই আমার হারান অতল অন্ধকারে।

তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ভাইয়ার স্ত্রী ছেলেমেয়ে, আমার বোনেরা সবাই সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়ি মুগবেলাই জড়ো হয়েছিলাম। সেখানেই আমার ভাই জন্মেছিলেন, স্কুলে পড়েছেন, কৃষক রাজনীতিতে জড়িয়ে রাষ্ট্রবিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

বব ডিলানকে মনে পড়ছে, ” পিপল ডোন্ট লিভ অর ডাই, পিপল যাস্ট ফ্লোট”… মানুষের আসলে মরণ নাই, কর্মের ভেতরে, প্রিয়জনের পরানের গহিনে তার বাস, অবিরাম স্মৃতিতে তার বয়ে চলা।…