প্রথম আলোতে একটি খবরের শিরোনামে চোখ আটকে গেল; ৪৬ হাজার কোটি রুপির সামরিক কেনাকাটা ভারতের, হেলিকপ্টার কিনতেই ব্যয় ২১ হাজার কোটি রুপি! ভারত পৃথিবীর শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক ও সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট দেশের অবস্থান পাশাপাশি। খেয়াল করে দেখবেন; পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বস্তি অবস্থিত। ভারত স্বাধীন হয় ৪৭ সালে অন্যদিকে ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে এবং চীনের মূল ভূখণ্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। আমি বলছি না যে দেশে গণতন্ত্র আছে সেই দেশেই বস্তি বিদ্যমান। তবে এটা স্পষ্টত যে ভারতের গণতন্ত্র ও শাসনতন্ত্রে সমস্যা আছে বিধায় দেশটিকে সবচেয়ে বড় বস্তি বিদ্যমান। পৃথিবীর এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পলিসিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। হ্যাঁ, গণতন্ত্র কীভাবে পরিচালিত হবে কিংবা কীভাবে কাজ করবে তা নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে, থাকবে। কিন্তু এশিয়া কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোতে গণতন্ত্রের নামে আসলে প্রতারণা করা হয়। যেন; গণতন্ত্রের মাছওয়ালা বোকা ক্রেতাকে ইলিশের বাচ্চা বলে চাপিলা মাছ ধরিয়ে দিচ্ছে।

যে দেশে জনগোষ্ঠীর বিশাল বড় অংশ দরিদ্র সীমার নিতে বাস করে, যদি সেই দেশের প্রতিরক্ষার বাজেট যখন এতো বড় হয় তাহলে প্রশ্ন আসে এই প্রতিরক্ষা বাজেট আসলে কার জন্যে কিংবা কাদের রক্ষার জন্যে এতো কিছু কেনা হচ্ছে? আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এই সব অস্ত্র আপনার টং দোকান কিংবা লাখ টাকার সামান্য জমি রক্ষার জন্যে নয়। কথাটা শুধু ভারত নয় প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যে কৃষক অন্যের জমিতে কাজ করে এই অস্ত্র কী তাকে সুরক্ষার জন্যে কেনা হচ্ছে কিংবা যে গরীব লোক রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে তার সুরক্ষার জন্যে কেনা হচ্ছে? অস্ত্র কেন ও কার জন্যে কেনা হচ্ছে, এই প্রশ্ন করা মাত্র কিছু গৎবাঁধা দেশ প্রেমের বাক্য শুনিয়ে দেওয়া হবে! যেন দেশকে রক্ষার জন্যে কিংবা দেশের মানুষকে রক্ষার জন্যে হেনতেন। বোকা জনগণও এমন বাণীতে বিভোর হয়ে অন্যের জমিতে কামলা দিতে চলে যাবে। আমাদের দুর্ভাগ্যের একমাত্র কারণ আমরা জাতি হিসেবে নির্বোধ! নাগরিক অধিকার সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। ইউরোপের লোকজন যতো কম পড়াশুনাই করুক না কেন নিজের নাগরিক অধিকারটুকু সম্পর্কে সে সচেতন। বাংলাদেশের কোন নাগরিক কখনো প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তুলনে আগ্রহী নয়। অন্যদিকে শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্র কেন বেসরকারিকরণ হচ্ছে এই বিষয়েও প্রশ্ন করতে অনাগ্রহী। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিচার ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করে জনগণকে ১০ হাজার টাকা মাইনে দিয়ে সৎ থাকতে বলা, এক অর্থে জনগণের সাথে প্রবঞ্চনা করা। কারণ জনগণ গ্রিসের দার্শনিক নয় যারা ছেড়া জামায় গৌরব বোধ করবে। ওদের পরিবার আছে, পিতার অবর্তমানে সংসারে কী হবে সেই ভাবনাও আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির মূল বিষয় হওয়া উচিত ছিল জনগণের ৫টি মৌলিক অধিকারের বিষয়। অথচ আমাদের আলাপ অহেতুক অন্য জায়গায়। পৃথিবীর যে রাষ্ট্রগুলোতে দুর্নীতির হার সবচেয়ে কম সেই রাষ্ট্রগুলোর শাসন ব্যবস্থা কেমন তার দিকে নজর দিতে হবে। সেই সাথে নজর দিতে সে রাষ্ট্রগুলোর সুযোগ সুবিধা। আইসল্যান্ডের মতন ধনী শান্তি প্রিয় দেশে কোন সেনাবাহিনী নেই। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সেনা বাহিনীর ব্যয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ভার্সিটিগুলোতে সেই তুলনায় বরাদ্দ বাড়ছে না। বাংলাদেশের দুই প্রেসিডেন্ট হত্যাকারী, ২৩টির বেশি সেনা অভ্যুত্থান ও পাহাড়ের সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত আমাদের সেনাবাহিনী যেহেতু পবিত্র সংগঠন সেহেতু এই সেনা বাহিনীর আয়-ব্যয় নিয়ে কথা বলাও এক প্রকার ব্লাসফেমির পর্যায়ে পড়ে। অথচ তাদের বাজেটও হয় সাধারণ জনগণের পয়সায়। আমি বলছি না; সেনাবাহিনী খারাপ কিংবা সেনাবাহিনীতে যারা কাজ করে তারা খারাপ। আমাদের মূল প্রশ্ন আসলে; সেনাবাহিনী কাদের রক্ষার জন্যে নিয়ন্ত্রিত হয় কিংবা দিন শেষে তারা আসলে কাদের সেবাদাসীতে পরিণত হচ্ছে। সেনাবাহিনী কাদের জন্যে এবং তারা মূলত কাদের রক্ষা করে এই বিষয়ে “ছোটদের রাজনীতি” বইতে ড. নীহার কুমার সরকার খুব ভাল ভাবে ব্যাখ্যা করেছে।

শ্রেণি ও রাষ্ট্র:
“এইরূপ সম্পত্তিতে অধিকার এসে গেল, তখন থেকেই সমাজে প্রথম শ্রেণী দেখা দিলো। উৎপাদন-যন্ত্রে কারণ কতোখানি অধিকার বা কার কতখানি উৎপাদন যন্ত্র বা সম্পত্তি তাই দিকে কে কোন শ্রেণিতে থাকবে-তা ঠিক হয়। একদল লোক হল-যার কোন সম্পত্তি থাকলো না, বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো তাদের শারীরিক পরিশ্রম। তারা গতর খাটিয়ে কিছু আয় করে বেঁচে থাকলো। আর একদল লোক হলো ঠিক এর উল্টো, তারা এতো সম্পত্তির মালিক হলো যে, তাদের আর পরিশ্রম করার দরকারই হলো না, সম্পত্তি থেকেই তারা প্রচুর আয় করতে লাগলো এবং অপরের পরিশ্রমের উপরেই এরা বেঁচে রইলো। পরগাছার মতো। এর মাঝামাঝি আবার অনেকগুলো শ্রেণি হলো যাদের আয় কিছু সম্পত্তি থেকে হতো আর কিছুটা পরিশ্রম করে। এমনিভাবে নানা শ্রেণি গজিয়ে সমাজ ভাগ হয়ে গেল। যারা প্রচুর সম্পত্তির মালিক হলো, তারা তাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্যে রাষ্ট্র (State) নামে একটা সংগঠন সৃষ্টি করল। রাষ্ট্রের কাজ হলো দু’ রকম। এক, সমাজে যাদের উৎপাদন-যন্ত্রে কোন অধিকার নেই, সেই সম সম্পত্তিহীন লোকদের আক্রমণ থেকে উৎপাদন যন্ত্র রক্ষা করা এবং এই উৎপাদন যন্ত্র যাতে মালিকদের জন্যে চালু থেকে লাভ সৃষ্টি করে তার ব্যবস্থা করা। দুই, বিদেশের আক্রমণ থেকে সম্পত্তিওয়ালাদের সম্পত্তি বাঁচানো। এই কাজ করার জন্যে রাষ্ট্র দু’রকম ব্যবস্থা করে। এক, উৎপাদন যন্ত্র যাতে সম্পত্তিওয়ালাদের হাত-ছাড়া না হয়ে যায় এবং ঠিকমতো তাদের লাভের জন্যে চালু থাকে তার উদ্দেশ্যে “আইন” তৈরি করে। আর এই আইন যাতে ঠিকমতো কাজে লাগে এবং সবাই মেনে চলে, সৈন্য, পুলিশ, গুপ্তচর, বিচার, জেল প্রভৃতি রেখে তারও ব্যবস্থা করা। উৎপাদন যন্ত্র ঠিকমত চালু রাখতে হলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ভালো থাকা চাই। তার দিকে লক্ষ্য রাখার জন্যে রাষ্ট্র স্বাস্থ্য বিভাগ খোলে। শ্রমিকদের খানিকটা শিক্ষাও দেওয়া দরকার, তার জন্য শিক্ষা বিভাগ আর তারা নিজেদের ভেতর মারামারি কাটাকাটি করলে কাজের ক্ষতি হয়, তাই শান্তিরক্ষা বিভাগ ইত্যাদি চালু করা হয়। যে শ্রেণী অন্যান্য শ্রেণিগুলোকে বশে রাখে। এমনি ভাবে আদিম কমিউনিজম ভেঙ্গে যাওয়ার পর সম্পত্তির মালিক শ্রেণি তাদের শাসন ও শোষণ বজায় রাখবার জন্যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করলো এবং রাষ্ট্রের সাহায্য তাদের শাসন বজায় রাখতে লাগলো কিন্তু অন্যান্য শ্রেণিগুলো তাদের ওপরে এই কর্তৃত্ব মুখ বুঝে সব সময় সহ্য করলো না। শাসক-শোষক শ্রেণী ও শাসিত-শোষিত শ্রেণীগুলোর মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকলো। কখনও কখনও সে ঝগড়া প্রকাশ্যে ভীষণ আকার ধারণ করে ফুটে উঠতো। খনও বা তা টের পাওয়া যেত না। কিন্তু ঝগড়া লেগেই ছিলো। এই শাসক-শোষক শ্রেণীর সঙ্গে শাসিত-শোষক সঙ্গে শাসিত-শোষিত শ্রেণি যে ঝগড়া, তাকেই বলে “শ্রেণিসংগ্রাম (Class Struggle)। এই শ্রেণিসংগ্রামের ফলে অনেক বার সমাজে শাসক-শাসিত শ্রেণীর অদল বদল হয়েছে। যারা নীচে পড়ে ছিলো, তারা ওপরে উঠে গিয়ে শাসকশ্রেণীকে ধ্বংস করে নিজেরাই শাসকশ্রেণী হয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের কথা তোমরা বোধ হয় শুনে থাকবে। এই ফরাসী বিপ্লব এমনি একটা শাসকশ্রেণী বদলের ঘটনা।“

এই যে বিভিন্ন দেশের নতুন নতুন অস্ত্র ক্রয় কিংবা অস্ত্র উৎপাদনের প্রতিযোগিতা এতে কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে যে সামরিক শক্তির সমতা আসেনি! যেমন পাকিস্তান একটা যুদ্ধ বিমান কিনলে তার বিপরীতে ভারত দুইটি যুদ্ধ বিমান কেনে। ফলে বিশ বছর আগে ভারত-পাকিস্তানের যে সামরিক শক্তির ব্যবধান তা আগের মতনই রয়ে গেছে। মাঝখান দিয়ে দুটি দেশ শুধু শুধু কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা করল। অথচ এই অস্ত্রর অর্থ দিয়ে দুটি দেশ তাদের নাগরিকের জীবনমান উন্নত করতে ব্যয় করতে পারতো। এই অস্ত্র বেচাকেনায় যে কারো লাভ নয় না তা নয়। তবে সেটি দেশের ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের এতে কিছু যায় আসে না।

১০ বছরে সামরিক খাতে কোন দেশ কত ব্যয় বাড়িয়েছে বা কমিয়েছে। ছবি-বিবিসি

বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী (৩ মে ২০১৮) বাংলাদেশে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সামরিক খাতে ১২৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। পুঁজিবাদী আমেরিকাসহ সমাজতান্ত্রিক চীন কেউই সামরিক বাজেট বৃদ্ধিতে পিছিয়ে নেই। সুইডেন-ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা সিপ্রি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামরিক ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেছে। গবেষণা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সামরিক খাতে ব্যয় ছিল প্রায় ছয় হাজার ছয়শ’ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালে আমাদের মতন স্বল্প উন্নত দেশের সামরিক খাতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় আটাশ হাজার আটশত কোটি টাকা। যদিও সর্বশেষ বাংলাদেশের বাজেটে সামরিক খাতে বরাদ্দ ছিল প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। গবেষণা সংস্থাটির হিসেবে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশে সামরিক খাতে ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। যদিও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ও সামরিক সরঞ্জাম বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। এমন তথ্য দিয়েছিল গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স ২০১৭।

অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাজেট ধরা হয়েছে মাত্র ৭৪১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। দেশের সর্বোচ্চা বিদ্যাপীঠের অর্ধ-লক্ষ শিক্ষার্থীদের বাজের এই অবস্থা। অথচ এই নিয়ে আমাদের কোন বিকার নেই। অন্যান্য বিষয়গুলো তো বাদই, মানুষ হিসেবে শিক্ষা ও চিকিৎসা যে আমার অধিকার এই সামান্য বিষয় আমরা বুঝতে চাই না। সিস্টেম নিয়ে কথা না বলে কেউ একজন আসবে আমাদের উদ্ধার করতে এমন এক ধারণা নিয়ে বসে আছি। আমাদের সমস্যা ব্যক্তিপূজার সংকট। আমরা ইহুদি জাতির মতো নবি (নেতা) খুঁজিতেছি। আমাদের আশা, আমরা ভেড়ার পাল নবির কুকুরের তাড়া খেয়ে একদিন খোয়ারে ফিরবো।