লিখেছেন: অতনু চক্রবর্ত্তী

সূচনাঃ

থমাস জেফারসন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট । ১৭৭৬ সালে কর্ণেল স্টুয়ার্ট তাঁকে এক বাক্স ফসিল হয়ে যাওয়া কোন এক অজানা প্রাণীর অস্থি পাঠান । ভার্জিনিয়ার গ্রিনবায়ার কাউন্টিতে একটা গুহার ভেতর এই অস্থি গুলো পাওয়া গিয়েছিল । অস্থিগুলির ভেতরে বেশ দীর্ঘ আর ধারাল নখ যুক্ত পায়ের হাড় থাকায় তিনি ধরে নিয়েছিলেন এগুলো কোন সিংহের ফসিল এর অংশ । তাই ১৭৯৭ সালের ১০ ই মার্চ ফিলাডেলফিয়াতে অনুষ্ঠিত হওয়া আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির যে কনফারেন্সে জেফারসন “Certain Bones” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেই প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেন এই অস্থিগুলো কোন বড় আকৃতির সিংহের ।

অস্থিগুলির মধ্যে ধারালো নখর বিশিষ্ট অস্থি থাকায় তিনি সিংহের নামকরণ করেন Megalonyx (Giant Claw)। কিন্তু মজার ব্যাপার হল জেফারসনের বাক্সের হাড়গুলি কিন্তু সিংহের ছিল না । ওগুলি এসেছিল বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দানবাকৃতির শ্লথ হতে ।

শ্লথের বিবর্তনঃ

ডাঙ্গায় চলে ফিরে বেড়ানো প্রাগৈতিহাসিক শ্লথগুলোর আবির্ভাব হয়েছিল তা প্রায় ৩৫ মিলিয়ন বছর আগে । উত্তর , দক্ষিণ আর মধ্য আমেরিকা মহাদেশের প্রায় পুরোটা জুড়ে বেশ কয়েক প্রজাতির শ্লথ দেখতে পাওয়া যেত । তখনকার Megalonychidae গোত্রের কিছু শ্লথ এখনো টিকে আছে যেগুলির আকার বড়োসড়ো বেড়ালের আকৃতির । কিন্তু শ্লথের অধিকাংশ প্রজাতি গুলোই ছিল দানবীয় আকারের । পরবর্তীতে গবেষকরা দেখতে পান জেফারসনের কাছে যে শ্লথের যে অস্থিগুলি গেছিল সেগুলি ছিল Megalonyx গণের অন্তর্ভুক্ত । এদের ওজন ছিল প্রায় টন খানেক । এর চেয়েও বড় ছিল Megatherium গণের শ্লথগুলো যেগুলি ওজনে প্রায় ছয় মেট্রিক টন আর আকার আকৃতিতেও সাইজের হাতির সমান । তাড়া নিজেদের বাহুর ওপর ভর দিয়ে বন কিংবা সাভানার ভেতর দিয়ে চলাফেরা করে বেড়াত । তীক্ষ্ম ও ধারালো নখগুলো তাদের খাবার খেতে ও গাছে উঠতে সাহায্য করত।

শ্লথেরা বিবর্তনের ধারায় বেশ কয়েক মিলিয়ন বছর টিকে ছিল । কিন্তু প্রায় দশ হাজার বছর আগ থেকে অন্যান্য বেশ কিছু দানবাকৃতির প্রাণীর সাথে সাথে বিলুপ্ত হতে শুরু করে । বিজ্ঞানীরা মনে করেন আসন্ন বরফ যুগ কিংবা ওই অঞ্চলে আস্তে আস্তে মানুষের অনুপ্রবেশের ফলেই স্থলচর দানবাকৃতির শ্লথেরা বিলুপ্ত হতে শুরু করে । শ্লথেরা উদ্ভিদভোজী হওয়ায় গাছের শীর্ষে তারা খাবার জন্যে প্রচুর পাতার সরবরাহ পায় আর গাছের শীর্ষদেশে থাকলে যেকোন শিকারি প্রাণী সহজে তাদের আক্রমণ করতে পারবে না – মূলত এই দুটি সুবিধা থেকেই কিছু ছোট আকৃতির শ্লথ গাছের শীর্ষদেশে উঠে সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে ।
এখন উত্তর দক্ষিণ আর মধ্য আমেরিকার রেইনফরেস্টে মাত্র ছয় প্রজাতির শ্লথ টিকে আছে ।

শ্লথগতির ইতিবৃত্তঃ

আমরা জানি প্রাণীরা গ্রহন করা খাদ্য শ্বসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি (এটিপি) উৎপাদন করে । এই শক্তি ই তাকে দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে । এই শক্তির মাধ্যমেই প্রাণী তার সকল জৈবনিক ক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করে পরিবেশে টিকে থাকে । তাই শ্বসন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ এবং প্রকৃতি প্রাণী কর্তৃক গৃহীত খাদ্যের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে ।

বিবর্তনের ধারার একটা সময়ে গাছের শীর্ষ দেশে বসবাস শুরু করতে থাকা শ্লথ আস্তে আস্তে ওই পরিবেশে ই অভিযোজিত হয়ে থাকে । আর তারা ওই খাদ্যাভ্যাসেই অভ্যস্ত হয়ে যায় ( বিশেষত Bradypus গণের শ্লথ গুলি খাদ্যের জন্যে শুধু মাত্র গাছের পাতার উপর নির্ভর করে থাকে ) । গাছের পাতা থেকে শ্বসনে প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ অন্যান্য ফল মূল কিংবা আমিষ খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তির তুলনায় অনেক কম । তাই শুধু মাত্র গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকা শ্লথগুলি অন্যান্য প্রাণীগুলির তুলনায় বেশ কম শক্তি উৎপন্ন করে ।

তিন পায়ের পাতা বিশিষ্ট শ্লথগুলি ( Bradypus) প্রাণিজগতের সবচে ধীর বিপাক হার সম্পন্ন প্রাণী ।

তাই শ্লথদের এই কম পরিমাণ শক্তি দ্বারা সকল জৈবনিক কার্যাবলী সম্পন্ন করার জন্যে তাদের নিজেদের শারীরবৃত্তীয় আচরণকে সেই অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়েছে।

প্রথমত , শ্লথেরা খাদ্য থেকে নির্যাস হিসেবে সর্বোচ্চ শক্তিটুকু গ্রহণ করে। শ্লথের পুরো শরীরের অর্ধেকের ও বেশি অংশ জুড়ে কয়েকটি প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পাকস্থলি রয়েছে । প্রজাতি ভেদে একবার খাদ্য গ্রহণ করবার পর তা সম্পূর্ণ রূপে পরিপাক করতে শ্লথের পাঁচ থেকে সাতদিন সময় লাগে। এভাবে তারা খুব চমৎকার ভাবে শক্তি সঞ্চয় করে রাখে ।

দ্বিতীয়ত , দৈনন্দিন জীবনে তারা যত অল্প সম্ভব ঠিক ততটুকুই শক্তি ব্যয় করে। যেমন , তারা না পারতে একদম নড়া চড়া করে না । তারা অধিকাংশ সময়েই খাদ্য গ্রহণ করে বিশ্রাম ও ঘুমিয়ে কাটায় । সপ্তাহে একবার তারা একবার রেচন ক্রিয়ার জন্যে বিরতি গ্রহণ করে। তো সেই রেচন ক্রিয়ার উদ্দেশ্যে গাছ থেকে নামার সময়েও তারা খুব ধীরে সুস্থে নড়াচড়া করে । শ্লথ এক মিনিটে মোটামুটি পনের গজ মত পাড়ি দেয়

তৃতীয়ত, যেহেতু শ্লথের খুব দ্রুত চলাচল করতে হয় না । তাই শ্লথের খুব বেশি পেশির ও দরকার পড়ে না । প্রকৃতপক্ষে তাদের সমান আকৃতির যেকোন প্রাণীর চেয়ে তাদের পেশির পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কম ।

এদের নিজেদের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতেও খুব বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয় না । কারণ অন্যান্য যেকোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর চাইতে তাদের শরীরের তাপমাত্রা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে প্রায় পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করতে পারে।

এই শারীরবৃত্তীয় ও আচরণগত অভিযোজন ও অর্জিত বৈশিষ্ট্য শ্লথের শক্তির ব্যয় কমিয়ে তা পরিমিত পরিমাণে খরচ করতে সাহায্য করে ।

শ্লথের এই ধীর গতি তাই তাদেরকে এভাবে শুধু মাত্র পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে তাই ই নয় বরং অন্যান্য বিভিন্ন শ্যাওলা , ছত্রাক ইত্যাদির পোষক হিসেবে ও কাজ করে । শ্যাওলার আবরণ আবার বনের ভেতর শিকারির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ছদ্মবেশ হিসেবে কাজ করে শ্লথকে কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা ও দান করে ।

বিবর্তনের ধারায় শ্লথ হয়ত তার সেই অতিকায় দানবীয় চেহারা হারিয়েছে । কিন্তু তারপরেও শারীরিক আর আচরণগত বৈচিত্র্য থেকে শ্লথ কিন্তু একেবারেই কম আকর্ষণীয় নয়।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জিঃ

● Goaman, Karen, and Amery, Heather. Mysteries and Marvels of the Animal World. London: Usborne, 1983: 30.
● Stewart, Melissa (November 2004). “Slow and Steady Sloths”. Smithsonian Zoogoer. Smithsonian Institution. Retrieved 2009-09-14.
● Gilmore, D. P.; Da Costa, C. P.; Duarte, D. P. F. (2001-01-01). “Sloth biology: an update on their physiological ecology, behavior and role as vectors of arthropods and arboviruses”. Brazilian Journal of Medical and Biological Research. 34 (1): 9–25. doi:10.1590/S0100-879X2001000100002. ISSN 0100-879X.