আমি ক্রমশ দেখেছি মিলন এবং হুমায়ূন দুজনই বিনোদনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কারণ ওটি আর্থিক দিক দিয়ে অত্যন্ত চমৎকার। তারা টেলিভিশনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। টেলিভিশন এমন একটি ছোট পর্দা, যে পর্দায় জীবনধারণ করা সম্ভব নয়। শিল্পকলা ধারণ করা সম্ভব নয়। সপ্তাহের পর সপ্তাহে টেলিভিশনে যে নাটকগুলো প্রচার হয় এগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে গৃহপরিচারিকারা। তাদের মেধার উপযুক্ত হতে হবে, নইলে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। আমি বিনোদনধারার উপন্যাসের নাম দিয়েছিলাম ‘অপন্যাস’।- আমাদের বইমেলা, হুমায়ুন আজাদ।
হুমায়ুন আজাদের এই কথাগুলি নিয়ে আমার কিছু কথা–
মানুষ বাতাস খেয়ে বাঁচতে পারে না, আকাশে বিনা খরচে ঘুমোতে পারে না। মানুষকে জীবিকা অর্জন করতে হয় নিজের ও পরিবারের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করার জন্য। আজাদ যে বললেন, হুমায়ূন আহমেদ ও মিলন বিনোদনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে অত্যন্ত চমৎকার অর্থ উপার্জনের জন্য, সেই আজাদ নিজেও কি শিক্ষকতা করে ও লিখে অর্থ উপার্জন করেন নি? তিনি কি ফ্রীতে পড়িয়েছেন? ফ্রীতে বই লিখেছেন? হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপারে আমি বলতে পারি, তিনি শুধুই চমৎকার অর্থ উপার্জনের জন্য টেলিভিশনে আসেন নি। এ-কাজকে ভালবেসেই তিনি এসেছিলেন। এবং আমাদেরকে অনেক ভাল মানের কিছু নাটকও তিনি উপহার দিয়েছেন। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তাই।
টেলিভিশনে ব্যাপক জীবনের সবকিছুই ধারণ করা সম্ভব নয়। একথা তো সবক্ষেত্রেই সত্য, শুধু টেলিভিশনের বেলায় নয়। এমন কোনো ক্ষেত্রই তো নেই যেখানে জীবনের সবকিছু ধারণ করা সম্ভব! সবকিছু ধারণ করা সম্ভব না হলেও টেলিভিশনে অনেককিছু ধারণ করা সম্ভব। বাচ্চাদের জন্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, নিরপেক্ষ সত্য সংবাদ, ভাল মানের নাটক, ভাল মানের গানের অনুষ্ঠান, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুষ্ঠান, শিক্ষামূলক প্রামাণ্য চিত্র ইত্যাদি কতকিছুই তো সম্ভব টেলিভিশনে। উন্নত দেশের টিভিগুলিতে তো তাই হচ্ছে। কার্ল সেগানের কসমস এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের টিভিতেও হচ্ছে। তবে মান নিয়ে কথা আরকি। ছোটবেলায় আমাদের টিভির নাটকগুলো অনেক ভাল মানের ছিল। আর এখন হয়ে গেছে যা তা। এসবের মান কীভাবে উন্নত করা যায় সে বিষয়ে কথা না বলে আজাদ বলে দিলেন, টেলিভিশনে শিল্পকলা ধারণ করা সম্ভব নয়! এটা খুবই বালখিল্য ও যা তা ধরণের কথা নয় কি?
তিনি একজন স্বঘোষিত নারীবাদী। তিনি যে বললেন, ‘টেলিভিশনে যে নাটকগুলো প্রচার হয় এগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে গৃহপরিচারিকারা’– তাঁর এই কথাগুলি তাঁর স্বঘোষিত নারীবাদের ক্ষেত্রে কতটুকু বিপরীত, একবার ভাবুন আপনারা! শুধু নারী-বিরোধীই নয়, এই কথাগুলি মানবতাবিরোধীও জঘন্যভাবে। শিক্ষকতা ও লেখা যেমন তাঁর পেশা, তেমনি মানুষের বাসায় গৃহকর্মের কাজ করাও গৃহকর্মীদের পেশা। তাঁর নিজের পেশাদ্বয় তাঁর কাছে সম্মানের, আর গৃহকর্মীদের পেশা কেন অসম্মানের? গৃহপরিচারিকারা তাঁর কাছে এত নিচু মেধার কেন? কেন এত অসম্মান ও অশ্রদ্ধার? তাঁদের রুচি কেন তাঁর কাছে এত নিচু মানের? তাঁর নিজের রুচি ও মেধাকে কেন তিনি গৃহপরিচারিকাদের রুচি ও মেধার চেয়ে উন্নত মনে করেন? এই কি একজন ভাষাবিজ্ঞানীর ভাষাজ্ঞান? একজন নারীবাদীর লালিত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ? তাঁর নিজের বাসার পরিচারিকাদেরও কি তিনি একই দৃষ্টিতে দেখতেন? অথবা তাঁদের রুচি ও মেধার মান উন্নয়নের জন্য কি তিনি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? তাঁদের উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার কোনো তাগিদ কি বোধ করেছিলেন? কোনো উদ্যোগ কি তিনি নিয়েছিলেন? অন্তত তাঁর নিজের গৃহ থেকে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে চেয়েছিলেন কিনা সেই প্রশ্নে না হয় এখন না-ই-বা গেলাম! নাকি চেয়েছিলেন, ওঁরা ওঁদের নিচু রুচি ও মেধা নিয়ে সমাজের সবার পদতলে পড়ে থাকুন আজীবন? এবং তিনি তাঁর উন্নত মানের উপন্যাস ও লেখায় তাঁদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা ছড়িয়ে তাঁর হাত ও মনের বিনোদন লাভ করবেন?
আর ‘অপন্যাসের’ কথা তিনি যা বললেন– তাঁর বিবেচনায় সবাই অপন্যাস লিখেছে। উপন্যাস কি কেবল লিখেছেন তিনি? আনিসুল হক তাঁর ‘গদ্য কার্টুনে’ বেশ বলেছিলেন, উপন্যাস খালি লেখেন হুমায়ুন আজাদ, বাকিরা ‘অপন্যাস’ লেখে। কথাটি অবশ্য হুমায়ুন আজাদেরই। আজাদের বিবেচনায় অপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ অনেক ভাল উপন্যাসও রচনা করেছেন কিন্তু। মধ্যাহ্ন, বাদশাহ নামদার এসব কি ভাল উপন্যাস নয়? এ-উপন্যাসগুলি কি আজাদ পড়েছিলেন? নাকি পড়লেও দাম্ভিকতার কারণে উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন নি?
কোনো নোবেল প্রাপ্ত লেখকেরও সব লেখা কালজয়ী নয়। রবীন্দ্রনাথ জীবনে যা যা লিখেছেন তার সবই কি কালজয়ী? আর আজাদ যা যা লিখেছেন তার সবই কি অসাধারণ? প্রবন্ধ তিনি ভাল লিখেন, তাঁর ভাষা অসামান্য। কিন্তু যাদের তিনি পছন্দ করেন না তাদের খুব তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। খুব যা তা ভাষায় কথা বলে দেন তাদের সম্পর্কে। এটা একজন বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ সাহিত্য-সমালোচক ও ভাষাবিদের কাজ নয়। একজন প্রাজ্ঞ ভাষাবিজ্ঞানীর সাহিত্য সমালোচনার ভাষা ও ধরণ এমন নয়। যিনি একজন ভাষাবিজ্ঞানী তিনিই কীভাবে স্থূলভাষী হন? আর তাঁর উপন্যাস আমার কাছে যা তা লাগে, তাঁর ভাষায় ‘অপন্যাস’!
এই যে এ-কথাগুলি তিনি বললেন গৃহকর্মীদের ব্যাপারে; এসব খুব বাজে কথা নয় কি? খুব বাজে রকমের অমানবিক কথা নয় কি? আমার তো পড়ে ঘেন্না লাগছে। আজাদ আজ বেঁচে থাকলে তাঁর এ-বাজে কথাগুলির জন্য ক্ষমা চাইতেন কি? নিজের অন্যায় বোঝার জন্য সমর্থ্য হতেন কি নিজের অপরিসীম দম্ভকে অতিক্রম করে?