আইএস সৃষ্টির শুরু থেকেই আমরা শুধু শত্রুর মুখ থেকেই আইএস সম্পর্কে শুনে এসেছি। আইএস’র নৃশংসতার কথা বলেছে তারাই যারা ইরাক এবং সিরিয়াতে নিজেরা সরাসরি যুদ্ধ করেছে, আইএস এর বর্বরতায় যাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে, যারা আইএস এর হিংস্রতা থেকে মুক্তি পেতে চায় এবং যারা আইএস’র মৌসুমি যোদ্ধা। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরতে শুরু করেছে। নিচের এই লেখাটি আইএস এর যোদ্ধা ‘আবু আহমেদ’ নামের এক সিরিয় যুবকের জবানবন্দী, যিনি আইএস’র বর্বরতার প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি মাসের পর মাস আইএস’র স্বদেশী, বিদেশী ভয়ংকর যোদ্ধাদের সাথে একসাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কয়েকটি পর্বে বিভক্ত অনন্য এই লেখাটিতে আবু আহমেদ নিখুঁতভাবে এবং আন্তরিক দৃষ্টি দিয়ে বর্ণনা করেছেন, আল-কায়েদার ভিত্তি ব্যবহার করে কিভাবে আবু বকর আল-বাগদাদি সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের বিস্তার ঘটালেন, এবং কিভাবে খেলাফতকে মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেন। আবু আহমেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কিছু নাম এবং তাদের বিবরণ ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপন করা হয়েছে। পর্ব এক-এখানে, পর্ব দুই-এখানে

২০১৩ সালে আইসিস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নিজেদেরকে পৃথিবীর সবথেকে ভয়ংকর জিহাদি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে প্রমাণ করার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে। দুর্ধর্ষ জঙ্গি হিসেবে প্রমাণের আগে অথবা দখলকৃত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার আগে আইসিসকে মোকাবেলা করতে হয়েছে এই অঞ্চলে অভিজ্ঞ জিহাদি সংগঠন আল-কায়েদার সাথে।

আল-কায়েদার ঊর্ধ্বতন নেতারা আবু আল-বাগদাদীর একক কর্তৃত্বের দাবি কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি ছিল না। বিশেষ করে যখন প্রকাশ হয়ে গেল আল-কায়েদার শীর্ষনেতা আইমান আল-জাওয়াহিরি আবু আল-বাগদাদীকে কোন নির্দেশই দেয়নি এবং বাগদাদী স্থানীয় আল-কায়েদা নেতাদের সাথে মিথ্যাচার করেছে তখন পরিস্থিতি রীতিমত সংঘাতে রূপ নিলো। কাফর হামরায় আইসিসের সদরদপ্তরে আইসিস প্রধান এবং আল-কায়েদার ঊর্ধ্বতন নেতাদের মধ্যকার আলোচিত মিটিংয়ের পর ছোট একটি জিহাদি গ্রুপের নেতৃত্বে স্বল্প পরিসরে কয়েকজন সিরিয়াতে গোপনে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে যায়। তাদের মনে আশঙ্কা ছিল বাগদাদীর অনুগত বাহিনী সিরিয়াতে তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে। এই গ্রুপের কাজ দ্রুত এবং নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসা। এই গ্রুপটির নাম হল ‘লাজনাত খোরাসান’। তাদেরকে খোরাসান দল বলেও চিহ্নিত করা যায়। গ্রুপের সদস্যরা আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের আল-কায়েদার তৃণমূল অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে আজকের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আত্মগোপনে থাকা আইমান আল-জাওয়াহিরির পক্ষে তারা সিরিয়াতে এসেছে।

খোরাসান দলে আছে একজন সিরিয়ান। আবু ওসামা আল-সাহাবি নামেই সবাই তাকে চেনে। সে সব সাথীদেরকে যাত্রাপথে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলল। সে অনুমান করেছিল বাগদাদী আল-কায়েদা সমর্থিত নুসরা ফ্রন্টের আমির আবু মারিয়া আল-কাহতানিকে অতর্কিতে হত্যা করার পরিকল্পনা হাতে নিতে পারে। আবু ওসামা আল-সাহাবি দলের অন্যান্য সদস্যদেরকেও সতর্ক করে দিলো। খোরাসান দলের কাজ হল সিরিয়াতে বাগদাদীর আইসিস কতটা শক্তিশালী এবং সিরিয়াতে তাদের কতটা বিস্তার সেটা তদন্ত করা। তাদের তদন্তের ফলাফল জাওয়াহিরিকে দিতে হবে এবং তার উপর ভিত্তি করেই জাওয়াহিরি ইরাক এবং সিরিয়াতে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সিদ্ধান্ত নেবে। সিরিয়াতে ইতিমধ্যেই আইসিস এবং আল-কায়েদা সমর্থিত নুসরা ফ্রন্টের মধ্যে বিরোধ চরমে পৌঁছে গেছে, এমনকি চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

খোরাসান দলের অস্তিত্বের কথা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত কেউ জানতো না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সিরিয়াতে খোরাসান দলের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালালে সব প্রকাশ পেয়ে যায়। খোরাসান দল তখন তাদের বহুযুদ্ধের পরীক্ষিত যোদ্ধারা বাগদাদীর বিশ্বব্যাপী অতর্কিত হামলা পরিকল্পনার সম্ভাব্যতা নিয়ে তদন্ত করছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক জেমস ক্ল্যাপার তখন এই বিমান হামলার বৈধতা দেয়ার জন্য বলেছিলেন, দেশের নিরাপত্তা বিবেচনায় খোরাসান দল এবং আইএস দুপক্ষই সমান হুমকি এবং ভয়ানক। কিন্তু এই সময়ে খোরাসান দলের যুক্তরাষ্ট্রে হামলার কোন পরিকল্পনা ছিল না। তাদের তখন প্রধান লক্ষ্য ছিল আইএসের দিকে। এরকম সময়ে খোরাসান দলের উপরে হামলা না চালালে ও চলত। প্রতিদিনই আল-কায়েদার অনুগত কোন না কোন জিহাদি দল আইসিসে যোগ দিচ্ছিল। যদি জাওয়াহিরি সিরিয়াতে জিহাদি গ্রুপের আনুগত্য অর্জনে ব্যর্থ হয় অথবা নিদেন পক্ষে অন্তঃকলহ না থামাতে পারেন তবে কিছু দিনের মধ্যেই আল কায়েদা প্রধান জাওয়াহিরি সৈনিক বিহীন জেনারেলে পরিণত হবে।

খোরাসান দলের ছয়জন যোদ্ধা কাফর হামরাতে আইসিসের সদরদপ্তর পরিদর্শন করেন। কিছুদিন আগেও এটা মজলিস শুরা আল-মুজাহিদিনের সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আবু আহমেদের সাথে চারজন খোরাসান সদস্যের কথা এবং আলাপ পরিচয় হয়। তারা ছিলেন আবু ওসামা আল-সাহাবি, কুয়েতি জিহাদি মুহসেন আল-ফাদলি। ফাদলির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কুয়েতে এবং সিরিয়ার সারমাদা শহরে ২০১৫ সালের ৮ জুলাই আমেরিকার বিমান হামলায় নিহত হয়। আছে সৌদির নাগরিক সানাফি আল-নাসর এবং আবু ইয়াসির আল জাযরাবি। দুজনেই সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের আল-দানা শহরে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হয়। একই হামলায় নিহত আরও একজন জিহাদি। তার নাম ছিল আবু আবদেল মালেক। আবদেল মালেক আল-কায়েদার নেতৃত্ব-স্থানীয়।

আবু আহমেদ বললেন, খোরাসান দলের জিহাদিরা ছিলেন অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে তাদের গভীর জ্ঞান ছিল। তারা সবাই দীর্ঘ বছর বিন লাদেন এবং জাওয়াহিরির একসাথে ইরান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সুসময়ে দুঃসময়ে অতিবাহিত করেছে।

ফাদলির সাথে খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগ আবু আহমেদের হয়নি। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের শহর সারমাদায় যখন তাদের দেখা হয় তখনও আবু আহমেদ জানতেন না ফাদলি আল-কায়েদার এত বড় ‘সিনিয়র ফিগার’। কিন্তু দুই বছর পর আবু আহমেদ বিমান হামলায় নিহত ব্যক্তির ছবি দেখে চিনতে পারলেন ঠিক এই লোকের সাথেই তার দেখা হয়েছিল। নিহত ফাদলির ছবি প্রকাশিত হয়েছিল রয়টার্সের একটা আর্টিকেলে। সেখানে ফাদলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আল-কায়েদার সীমিত যে কয়জন উচ্চ পর্যায়ের নেতা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে হামলার পরিকল্পনার কথা জানতো ফাদলি তাদের মধ্যে অন্যতম”। ২০১২ সালে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট ফাদলির অবস্থান সম্পর্কে তথ্যদাতাকে ৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার পুরষ্কার দেয়ার ঘোষণা দেয়।

আবু আহমেদ খোরাসান দলের দুইজন সৌদি নাগরিককে ভালোভাবে চিনতে পেরেছিলেন। সে একবার মালেক এবং জাযরাবির সাথে একই গাড়িতে করে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের আল-বাব শহরে গিয়েছিলেন। জাযরাবি তখন সিরিয়ার আল-বাবের পাশের শহর লাটাকিয়াতে নুসরা ফ্রন্টের রাজনৈতিক মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলো।

যখন আবু আহমেদ জানতে পারলেন, দুইজনই বিমান হামলায় নিহত হয়েছে তখন তার খুব খারাপ লাগছিল। মানুষ দুইজনকে আবু আহমেদের কাছে আর পাঁচটা মানুষের মত নিতান্ত সাধারণ মনে হয়েছিল। তারা দুইজনই আল-কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিল তবুও তাদের ব্যবহারে, আচরণে কখনো উদ্ধতভাব প্রকাশ পায়নি, কোন অহংকার ছিল না। খোরাসান দলের সকল সদস্যদের মধ্যে সাহাবির সাথে আবু আহমেদের সখ্যতা অনেক বেশি। আল-কায়েদা প্রধান জাওয়াহিরির সাথে সাহাবির সরাসরি যোগাযোগ ছিল। আফগানিস্তান থেকে সিরিয়াতে গোপন পথে আসতে খোরসান দলের সময় লেগেছিল প্রায় দেড় মাস। সাহাবির সাথে ছিল তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ফলে এই দীর্ঘ যাত্রাপথ তার জন্য আরও বিপদ সংকুল আর প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ। সাহাবি, আবু আহমেদকে বলেছিলেন, “বিশ বছর ধরে আমি জিহাদের পথে, সুতরাং বিপদ আমার জন্য নতুন কিছু নয়”।

খোরাসান দলে তাদের কাজ ছিল মূলত রাজনৈতিক। তাদের দায়িত্ব ছিল কাফর আল-হামরাতে পাঁচদিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যেসব জিহাদি কমান্ডার, নেতা ইতিমধ্যে বাগদাদীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন তাদেরকে বোঝানো যে বাগদাদী আসলে তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। খোরাসান দল সব জিহাদি নেতাদের বললেন, বাগদাদীর খেলাফতের দাবী ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট। সে জিহাদিদের সাথে জালিয়াতি করেছে। জাওয়াহিরি কখনোই বাগদাদীকে ইরাক থেকে সিরিয়াতে পাঠায়নি। জাওয়াহিরি কখনোই বলেননি, জিহাদি কমান্ডারদেরকে বাগদাদীর প্রতিষ্ঠিত আইসিসের সাথে যোগ দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে হবে। খোরাসান দলের সামনে খুব কঠিন সময়। কারণ, ক্ষতি যা হবার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। অনেকেই আইসিসে যোগদান করে ফেলেছে। যাইহোক, সাহাবি সম্প্রতি আইসিসে যোগ দেয়া একজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডারকে সিরিয়া এবং তুরস্কের সীমানার কাছাকাছি একটা শহরে দেখা করার জন্য রাজি করে ফেলল।

সাহাবি সেই গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডারকে বুঝিয়ে বলল, কেন বাগদাদী আইসিস সৃষ্টি করেছে। বাগদাদী আইসিস সৃষ্টি করেছে কারণ, সে বুঝতে পেরেছে অত্র অঞ্চলে নুসরা ফ্রন্ট শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সে জানত নুসরা ফ্রন্টের দলনেতা জুলানি এখানের নেতা হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে। সব শুনে কমান্ডার খুব অবাক এবং বিরাট ঝাঁকুনি খেয়ে গেলেন। সাহাবি কমান্ডারকে দ্রুত আইসিস ত্যাগ করার পরামর্শ দিলো। উত্তরে কমান্ডার অবশ্য তেমন কিছু বলে নি। ভয়ানক নীরবতা তার চোখে মুখে। শুধু বলল, “আমি তো ভেবেছিলাম বাগদাদী জাওয়াহিরির প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছে তাই বাগদাদীর কাছে কথা দিয়ে ফেলেছি, আমাকে চিন্তা করার সময় দাও। অন্যদের সাথেও কথা বলতে হবে। কিন্তু এখনই আমি হঠাৎ করে আমার অবস্থান থেকে সরে আসতে পারব না”। তবে সে কথা দিলো নুসরার পক্ষে কাজ করবে। সাহাবি বলল, “আমরা জাওয়াহিরির কাছে আমাদের অনুসন্ধান এবং ফলাফল পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছি”।

২০১৩ সালের মে মাসে খোরাসান দল সিরিয়াতে আসার পরে বাগদাদীর মিথ্যাচার প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আইসিস এবং নুসরা ফ্রন্টের মাঝে কমবেশি সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বিদ্রোহী গ্রুপের যোদ্ধা অন্য বিদ্রোহী গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে চলাচল করতে পারত, এমনকি বিরোধী পক্ষের সদরদপ্তরেও যাওয়া যেত। সেই সময়ে বিরোধী বা বিদ্রোহী দলগুলো নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করার পদক্ষেপ নিচ্ছিল। আবু আহমেদ নুসরা ফ্রন্টের এমন অনেক যোদ্ধাকে চেনেন যারা বছর খানেক সময় ধরে আইসিসের ব্যানারে যুদ্ধ করেছে। যার ফলে আবু আহমেদের জন্য খোরাসান দলের লোকদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল।

কিন্তু যখন ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বাগবিতণ্ডা দেখা দিলো তখন আইসিস এবং নুসরা ফ্রন্টের মধ্যে সুসম্পর্কের বদলে দেখা দিলো শত্রুতা এবং অবিশ্বাস। নুসরা ফ্রন্টের নেতারা দেখতে পেলো, আইসিস নুসরা ফ্রন্টের জিহাদিদের একতা নষ্ট করে এবং দুর্বল বানিয়ে সিরিয়াতে সুযোগমত নিজেরা ক্ষমতা দখল করবে। আইসিস সদস্যরা নুসরা ফ্রন্টের সদস্যদের বলতে লাগল তারা জিহাদের ময়দানে শিথিল হয়ে গেছে এবং মূলধারার সাথে মিশে গেছে। আইসিস নুসরা ফ্রন্টের প্রাক্তন সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে বলতে লাগল তারা সহি মুসলিম থেকে খারিজ হয়ে গেছে।

সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধের দামামা ক্রমেই রণহুংকারে পরিণত হচ্ছে। খোরাসান দল এরমধ্যেই বুঝে গেছে বাগদাদীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এদিকে জাওয়াহিরি পেয়ে গেছে খোরাসান দলের তদন্তের সারমর্ম। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো সিরিয়াতে শুধু নুসরা ফ্রন্ট থাকবে, আইসিসের কোন জায়গা হবে না এখানে। জাওয়াহিরি নুসরা ফ্রন্টের নেতাদের ডেকে তাদের হাতে সিরিয়াতে জিহাদ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিলো এবং বাগদাদীর উদ্দেশ্যে বললেন, বাগদাদীকে ইরাকে ফিরে যেতে হবে। ২০১৩ সালের মে মাসে আল-কায়েদার প্রচার মাধ্যমে সব জিহাদিদের জন্য প্রকাশিত হয় জাওয়াহিরির খোলা চিঠি। সেখানে জাওয়াহিরি বলেন, বাগদাদী আল কায়েদার সাথে কোন আলোচনা বা অনুমতি না নিয়েই নিজের মত করে আইসিস গঠন করেছে। খেলাফত দাবি করেছে।

এক চিঠিতেই সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় বাগদাদী আল কায়েদার কেউ না। আইসিস তার একক সিদ্ধান্তে গঠিত হয়েছে। বাগদাদী এবং জাওয়াহিরির পাল্টাপাল্টি বক্তৃতায় কিছু জিহাদির মনে হল তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। আবু আহমেদের ধারণা, ৩০ শতাংশ জিহাদি নুসরা যোদ্ধা যারা আইসিসে যোগ দিয়েছিলে তারা জাওয়াহিরির নেতৃত্বে আবার আল কায়েদায় ফিরে আসে। বাগদাদী আর জাওয়াহিরির মধ্যকার চলমান সংঘর্ষে কিছু জিহাদি নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। আহরার আল-শাম এবং জুনদ আল-আকসা এরকম আরও জিহাদি গ্রুপগুলো ক্ষমতার কামড়াকামড়ি থেকে নিজেদেরকে বাইরে রাখে। তারা বাসার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করার জন্য লড়াই জারী রাখে। জিহাদিরা কে কোন পক্ষে গেল তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নাই। আবু আহমেদের সহযোদ্ধা মজলিস সুরা আল- মুজাহিদিনের ৯০ জন ডাচ এবং বেলজিয়ান যোদ্ধাদের মধ্যে যারা আইসিসে যোগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে ৩৫ জন নুসরা ফ্রন্টে ফিরে আসে। বাকিরা থেকে গেল আইসিসের থাকে। আবু আহমেদ জানতে পেরেছিলেন, খোরাসান দলের সদস্য সাহাবি আইসিসের ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের সাথে মাসখানেক আগে তুরস্কের সীমান্তে সাহাবির সাথে দেখা হয়েছিল, যিনি আইসিস ছেড়ে নুসরা ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন।

মজলিস সুরা আল-মুজাহিদিনের আমির আবু আল-আথীর তার বিদ্রোহী গ্রুপ নিয়ে আইসিসের সাথে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রইল। তার কাছে আবু বকর আল-বাগদাদী একজন বীরযোদ্ধা। কিন্তু তার মনে সুপ্ত ভয়, বাকি ডাচ এবং বেলজিয়ান যোদ্ধারা নুসরা ফ্রন্টে ফিরে যাবে না তো? আবু আল আথীর নির্দেশ দিয়ে দিলো কোন আইসিস যোদ্ধা নুসরা ফ্রন্টের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। এমনকি ইন্টারনেটেও নয়। নুসরা ফ্রন্টে যোগ দেয়া কোন ডাচ বা বেলজিয়ানের সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। আবু আল আথীর আলেপ্পো প্রদেশের উরুম আল সুঘরায় অবস্থিত নুসরা ফ্রন্টের আবু সুলেমান আল অস্ট্রালির অধীনস্থ সব ডাচ এবং বেলজিয়ান যোদ্ধাদের সতর্ক করে দিলো তারা যেন আইসিসের যোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করার সাহস না করে। আথীর সব বিদেশী যোদ্ধাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়ার হুমকি দিলো যাতে তারা সিরিয়া থেকে পালাতে না পারে। কিন্তু এমন হুমকিতে বিদেশী যোদ্ধাদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো, তাহলে কি আমির তাদেরকে বিশ্বাস করে না? যথারীতি আথীর শান্ত হয়ে গেল, তার গ্রুপের বিদেশী যোদ্ধারা তাদের পাসপোর্ট সাথেই রাখতে পারবে।

নুসরার পুরনো বন্ধু আজ আইসিসের শত্রু। প্রত্যেক ইউরোপিয়ান যোদ্ধা ভিন্ন দলের ইউরোপিয়ান যোদ্ধাদের দল ভাঙনের মন্ত্রণা দিতে লাগল। আবু আহমেদ দেখতে পেলেন, হঠাৎ করে আইসিসের গোপন পুলিশের তৎপরতা বেড়ে গেছে। আইসিস শিবিরে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে কেউ যদি দল ভাঙনের চেষ্টা করে অথবা পালাতে চায় তাহলে তাদের দেখা মাত্র গুলি করে হত্যা করা হবে। আইসিসের পক্ষে যুদ্ধরত আবু আহমেদের এক বন্ধু বিভিন্ন জিহাদি গ্রুপের মধ্যে শত্রুতায় খুব হতাশ। সে আথীর এবং বাগদাদীর অনমনীয় মনোভাবের সমালোচনা করে আইসিসের শ্লোগান “নাশিদ” ব্যঙ্গ করে মুখে মুখে আবৃত্তি করে বেড়াত। যেহেতু সে কোন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করত না সেহেতু আইসিস তার বিরুদ্ধে ইসলামের নিয়ম ভঙ্গের কোন অভিযোগ আনা যেত না। তার ব্যঙ্গ কবিতা ছিল “আমাদের আমির সন্দেহের বাইরে থাকে, তার গায়ে যেন যুদ্ধের আঁচ না লাগে”। এক রাতে আবু আহমেদের সেই বন্ধু ব্যঙ্গাত্মক ছড়া আবৃত্তি করছে, এমন সময় সেখানে আইসিসের গোপন পুলিশ সেখানে এসে উপস্থিত। পুলিশ তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নেয় এবং জেলে পুরে দেয়। কয়েকদিন তাকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়। তবে পুলিশ তার উপর কোন শারীরিক নির্যাতন করে নি। তার বদলে তাকে আইসিসের শাস্তির রকমফের নিয়ে একটা বই পড়তে দেয় এবং অন্য বন্দীদের উপর সেই শাস্তি হাতে কলমে প্রয়োগ করতে বলা হয়। ২০১৩ সালে বাগদাদীর অভ্যুত্থান সফল হলে নুসরা ফ্রন্ট ধ্বংসের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। কিন্তু জিহাদি গ্রুপের মাঝে অন্তঃকলহ কারণে নুসরা ফ্রন্ট ফিরে পেতে থাকে তাদের হারানো শক্তি। তারা জিএদের শক্তি বুঝতে শুরু করে এবং সালাফি মতাদর্শের জিহাদি গ্রুপ আহরার আল শাম এবং ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ)’র সাথে একতা গড়ে তোলে।

নুসরা ফন্ট, আহরার আল-শাম, এফএসএ’র মিলিত শক্তি এবং আইসিসের মধ্যে সংঘর্ষ চরমে পৌঁছে গেল। আইসিসকে হটিয়ে দিলো সিরিয়ার ইদলিব এবং আলেপ্পোর কিছু অঞ্চল থেকে। নুসরা ফন্ট আইসিসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো দারেত ইজ্জা। মনে আছে, পুরনো বন্ধুত্বের সময়ে একসাথে সিরিয়ান আর্মির বেইসক্যাম্প ১১১ দখলে নিয়েছিলো? দারেত ইজ্জা শহর এখন নুসরার নিয়ন্ত্রণে। আইসিস দারেত ইজ্জা থেকে পিছু-হটে তুরস্কের সীমান্তের কাছে আল-দানা শহর থেকে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। সেই যুদ্ধে আইসিসের হাত থেকে আল-দানা শহরও হাত ছাড়া হয়ে যায়। এরপরে আইসিস আশ্রয় নেয় আল-আতারিব শহরে। এখানেও একই দৃশ্যের পুনরায় মঞ্চায়ন। যথারীতি নুসরার হাতে আইসিসের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

আইসিস পুরো সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২০১৪ সালের ৪ মার্চ আইসিস আজাজ শহরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সীমানা বরাবর অবস্থান নিয়ে শক্তি সচয় করে আবার নুসরাকে আক্রমণ শুরু করে। আইসিস সমস্ত শক্তিকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে মজলিস শুরা আল-মুজাহিদিনের সদরদপ্তরের অনতিদূরে কাফর জুম এলাকায় চক্রব্যূহ রচনা করে। এই সেই সদরদপ্তর যেখানে বিভিন্ন জিহাদি গোষ্ঠী, কমান্ডারদের সাথে বাগদাদীর পাঁচ দিনব্যাপী মিটিং হয়েছিল।

সিরিয়ার পুরো উত্তরাঞ্চল এখন দুইটি জিহাদি গ্রুপের খণ্ডিত যুদ্ধ-ভূমি। আইসিস এবং নুসরা ফ্রন্ট যাপন করছে নিজেদের জীবন একইসাথে চালিয়ে যাচ্ছে পৃথক যুদ্ধ। আইসিস সিরিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ দখল করে প্রতিষ্ঠা করেছে খেলাফত। হত্যা করেছে এই অঞ্চলের যোদ্ধাদের অথবা তাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে নুসরা সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছে। ইদলিব প্রদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে নুসরা এখন শক্তিশালী খেলোয়াড়। দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের সীমানার সীমানার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। যে যেমন পারে সে তেমন দখল করে। কে কতদিন দখল রাখতে পারে এটাই বিষয়। উত্তরের প্রদেশের সীমানায় তাদের মুখোমুখি অবস্থান। কয়েকদিন আগের মিত্র আজ মুখোমুখি। দুই শত্রু। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি সিরিয়ার দুই জায়ান্ট জিহাদি গ্রুপের আনুষ্ঠানিক ভাঙনের দিন। কাফর জুম থেকে তল্পিতল্পা গুটাতে হয় আইসিসকে। বিশাল লটবহর। ২০০ গাড়ির বিশাল কনভয়। গাড়ি, ট্রাকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, আইসিস যোদ্ধা ও তাদের পরিবার। আর সাথে আছে কিছু বিদেশী জিম্মি। আবু আহমেদ দেখতে পেলেন, রেজিমেন্ট ১১১ থেকে নুসরা ফ্রন্ট কিভাবে কেমিক্যাল ভর্তি ১৫টা কনটেইনার দখল করে নিলো। পরাজিত আইসিসকে বহন করে বিশালাকৃতির ট্রেন স্টিলের ঘড়ঘড় শব্দ করে ইরাকের রাকা শহরের দিকে যাত্রা শুরু করল।

(মূল লিংক-The Greatest Divorce in the Jihadi World)