রোহিঙ্গা সমস্যা, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কারাবাস, খুলনা সিটি নির্বাচন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ইত্যাদি একের পর এক ঘটনা প্রবাহ ছাড়িয়ে এখন লোকমুখে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘ক্রসফায়ার’।

গত দিন দশেক হলো সারাদেশে চলমান র্যা ব-পুলিশের যৌথ বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানে মারা পড়েছেন প্রায় ১০০ ব্যক্তি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি কথিত ‘ক্রসফায়ার’ এ নিহত এসব ব্যক্তি সকলেই মাদক ব্যবসায়ী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মাদকের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছে। আর ‘ক্রসফায়ার’ প্রশ্নে তিনি বলেছেন, যে পদ্ধতি ভাল হয়, তারা সেটিই করে যাবেন (দেখুন, মাদকের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রথমালো)।

চোখের বদলে চোখ, ধর্ষনের বদলে পুরুষাঙ্গ, সমস্যা?
মিডিয়া ফলাও করে চলমান ‘ক্রসফায়ার’ সংবাদ প্রচার করছে ঠিকই, কিন্তু লক্ষ্যনীয় অধিকাংশ মিডিয়া এসব সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে উদ্ধৃতি চিহ্নবন্দি বা কথিত অভিধায় বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। সংবাদপত্রের মতামত বিভাগে বা টিভির টক-শোতে বিচার বহির্ভূত এসব হত্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছেই।

স্মরণ করা ভাল. বাংলাদেশে তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ এর ইতিহাস খুব নতুন নয়। বলা যায়, স্বাধীনতার পর পরই এটি এ দেশে চালু হয়। ওপারে নকশাল নিধনের নামে এটি চালু করেছিল ইন্দিরা গান্ধি সরকার। এ নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর বিখ্যাত উপন্যাস আছে, ’হাজার চুরাশির মা’, পরে এ নিয়ে বিখ্যাত সিনেমাও হয়েছে।…

দেখা গেছে, ওপারে এসব ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ করে নকশালদের দমন করা যায়নি, যারা এখন মাওবাদী নামে পরিচিত, তেমনি এপারেও এসব ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ করে কোনো অপরাধই একেবারে দমন করা যায়নি, যাবেও না।

আর সম্ভবত এ দেশে প্রথম ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার হন– পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদার। আলোচিত এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ অর্থাৎ ‘ক্রসফায়ার’টিকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন (দেখুন, সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা. মুক্তমনা ব্লগ, লেখক

এরই জের টেনে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া সরকার বিচারবহির্ভূত রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। খালেদা জিয়ার আমলে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ চলেছে; এখন শেখ হাসিনার সরকার জঙ্গি দমনের পর মাদক দমনের নামে চালু করেছে ‘ক্রসফায়ার’।

…গত ২৬ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু বিষয়ক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, এমপি বদির বেয়াই ‘ক্রসফায়ার’ এ মারা গেছেন, যদি এমপি বদির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার প্রমান পাওয়া যায়, তিনিও ছাড় পাবেন না—ইত্যাদি (দেখুন, ভাই-বেয়াইকে নিয়ে ইয়াবা ব্যবসায় এমপি বদি, বিডিনিউজ)।

কিন্তু আমরা যারা মানবাধিকারের কথা বলি, তারা মনেপ্রাণে চাই, এমপি বদিও ‘ক্রসফায়ার’থেকে ছাড় পান, তাকে যেন বিচারের মুখোমুখি করা হয়। কারণ ‘ক্রসফায়ার’কোনো সভ্য সমাজের আইন বা দণ্ড হতে পারে না, এটি হচ্ছে বিচার বহির্ভূত বর্রবর হত্যাকাণ্ড, মাদকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড তো নয়ই । এছাড়া নিয়মতান্ত্রিক বিচারে অপরাধী ছাড়া পা্ওয়ার সুযোগ থাকলেও একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিও যেন শাস্তি না পান, সেটি নিশ্চিত করার প্রশ্ন আসে।

’চুরির শাস্তি কব্জি কর্তন’ হচ্ছে মধ্যযুগীয় বর্ববর শাস্তি, যা থেকে সভ্য সমাজ অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে। আর কে না জানেন, খ্রিষ্টপূর্ব ‘চোখের বদলে চোখ’ পন্থা আবার চালু করা হলে এক সময় হয়তো বদলা নিতে নিতে পুরো সমাজের সকলেই অন্ধ হয়ে যাবেন!

তাছাড়া বরাবরই অভিযোগ, ’ক্রসফায়ারে’ দেওয়ার নামে পুলিশে ভাল ধরণের অবৈধ বাণিজ্য হয়। আর ‘ক্রসফায়ার’ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক স্বার্থে যে ব্যবহৃত হবে না, তারই বা গ্যারান্টি কী?

হঠাৎ ‘ক্রসফায়ার’?
একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে এখন মাদকের বিস্তার খুব ভয়াবহ। সর্বত্রই ইয়াবা নামক নেশার ট্যাবলেটের ছড়াছড়ি। অলিগলি, মুদি দোকানেও এখন ইয়াবা পাওয়া যায়। এমনকি টেলিফোন করলে বাসায় ইয়াবা পৌঁছে যাবে, এমনই অবস্থা। কয়েক বছর আগেও ফেন্সিডিল ছিল জনপ্রিয় মাদকের মধ্যে শীর্ষে, এরপর আসে হেরোইন, আর এখন সব মাদককে ছাড়িয়ে গেছে ইয়াবা। যুব সমাজের বিশাল একটি অংশ এখন ইয়াবা আসক্ত, শুধু ছেলেরা নন, মেয়েরাও ইয়াবাতে আসক্ত হচ্ছেন। নেশার ছোবলে একটি প্রজন্মই এখন কর্মহীন হতে বসেছে।

শিক্ষিত ও নিরক্ষর বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, সামাজিক অনাচার ও নারী নির্যাতনও বাড়ছে, এসব থেকে হতাশা তৈরি হচ্ছে। আর হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তরুণরা মাদেকের আশ্রয় নিচ্ছেন। বিনোদনের অভাবে অনেকে মাদককেই বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করছেন।

আরেকটি বিষয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সয়াহতা ও রাজনৈতিক আশ্রয় ছাড়া মাদক ব্যবসা হতে পারে না, এটি শহরের সাধারণ রিকশাওয়ালা বা গ্রামের নিম্নবিত্ত ক্ষেতমজুরও জানেন, যারা দেশের নীতি-নির্ধারক, তারাও তা জানেন। আমারা কেউই বোকার স্বর্গে বাস করছি না বা জেগে ঘুমাচ্ছি না (দেখুন, স্যার, আপনার কথামতো সবাই চইলা গেছে, বিডিনিউজ)।

কিন্তু তারমানে এই নয় যে, বিদ্যুত-পানি-গ্যাস, চাল-ডাল-তেল-মাছ-মাংস, নিত্যপণ্য, যানবাহন, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিত্তদিনের বড় বড় সব সমস্যাকে ছাপিয়ে গেছে মাদকের সুনামি। তাহলে হঠাৎ করে এই ‘ক্রসফায়ার’ আমদানীর প্রয়োজনীয়তা কেন?

বলা ভাল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটার বিহীন সহিংস নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইমেজ সংকট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে দরকার হয়ে পড়েছিল প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার।

আর আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটের বাজারে সুনাম কুড়াতে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, আর এরই ধারাবাহিতায় আওয়ামী লীগ সরকার কিছু সস্তা হাততালি পাওয়ার জন্য ‘ক্রসফায়ার’ চালু করেছে। এছাড়া হয়তো জনজীবনের বড় বড় সমস্যা থেকে জনগণকে ভোলাতে হঠাৎ করেই আবার এ সরকারকে ‘ক্রসফায়ার’ চালু করতে হয়েছে।

তবু সচেতন মানবাধিকার কর্মী ও প্রগতিশীলরা ‘ক্রসফায়ারের’ বিরোধীতা করছেন। কারণ, বন্দুক দিয়ে মাদক নির্মূল করা যায় না। একজন মাদক ব্যবসায়ীকে সরিয়ে দেওয়া হলে আরেক মাদক ব্যবসায়ী জন্মায়।

কাঠের চশমায় প্রতিবাদ
প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহল, সুশীল সমাজ, লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী পেশাজীবী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্টী, সরকারি কোটা সংস্কারের দাবিতে এই সেদিন সারাদেশে ফুঁসে ওঠা ছাত্র সমাজ বা প্রজন্ম শাহবাগ কেউই সত্যিকার অর্থে নির্বিচারে সিরিজ হত্যাকাণ্ড বা ‘ক্রসফায়ারের’ জোর প্রতিবাদ গড়ে তুলছেন না, গড়ে তুলছেন না রাজপথের তুমুল আন্দোলন।

লাল মওলানা ভাষানীর মতো নেতাও তো আর নাই। যিনি সাতের দশকে মুজিব সরকারের ‘নকশাল দেখামাত্র গুলির নির্দেশের’ প্রতিবাদ করে একাই বুক চিতিয়ে বলবেন, ‘খামোশ! নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না!’

শোষণ যতোটা না আতঙ্কের, তারচেয়ে বড় আতঙ্কের শোষণ গা-সয়ে যাওয়া! অতএব, সাধু সাবধান!
……….
সংযুক্ত: ই-সাউথ এশিয়ায় সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসানের সাথে আলাপচারিতা: